গতকালই ফিরেছি গৌহাটি থেকে। গন্তব্য ছিল, গৌহাটি থেকেই শিলং (shillong) ছুঁয়ে মেঘালয়। পাঁচদিন ধরে লম্বা সফরে অদ্ভুত সব জায়গা দেখা আর এক রাত করে থাকা। গারো অঞ্চল টানা হলেও, খাসি এলাকাগুলো বেশ দেখা হয়ে গেল। এমনকি নামার পথে বুড়ি ছুঁয়ে জয়ন্তিয়াও। ভূগোলে পড়া নামগুলো হাত পা নেড়ে কথা বলে, আদর করে চোখ জুড়িয়ে দিল আমাদের। বাড়ির ড্রাইভারের মতোই সফরসঙ্গী ওয়ান। বছর চল্লিশের তাগড়াই যুবা। খাসি উপজাতির মানুষ। খ্রিশ্চান। সব সময় হাসিমুখ আর গপ্পের ঝুড়ি। চারটি ছেলেমেয়ের বাবা। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায় দিদিমার কাছে মানুষ। এসব গপ্পো অবশ্য পরে শোনা অভিরুচির কাছে। আমাদের এই বেড়ানোর কলম্বাস, অভিরুচিই। এমন অনায়াসে সে Mawphanlur-Nongkhnum, Shnongpdeng-Mawlyngbna-Ialong এসব জায়গার উল্লেখ ক’রে চলেছে, যেন এ পাড়া থেকে টুক করে ওই অন্য পাড়ায় গিয়ে, ওয়ানের সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলতে নেমেছে অভিরুচি। সে বসেছেও সামনের সিটে, ওয়ানের পাশেই। আমি আর সহেলি পিছনের সিটে। দু’জনেই চুপ করে শুনে যাচ্ছি, ওদের মশগুল আলাপ। ওয়ানের কথা থেকেই জানলাম যে, এখানে প্রায় সব অঞ্চলের নামের আগে এই যে ‘mong’ শব্দটা জুড়ে আছে, কারণ mong মানে মেঘ। বুঝলাম, আসামের অন্তর্গত খাসি, গারো আর জয়ন্তিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে যখন কেন্দ্রশাসিত একটিই সংগঠিত অঞ্চল তৈরি করা হল, তখনই তার নাম হল মেঘালয়। মেঘালয় শব্দটি এখানকার ভূমিজ শব্দ নয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে ‘mong’ তাই অনেক আপন। এজন্যই বোধহয় ওয়ানরা কেউই নতুন নাম ‘মেঘালয়’ এর অর্থ বুঝতে পারে না। কারণ হিন্দি বা সংস্কৃত সম্পর্কে ওরা একেবারেই অনভিজ্ঞ এবং উৎসাহহীন। খানিক পথ এগিয়ে ওয়ান জিজ্ঞাসা করল, রাস্তার ধারের স্টল থেকে খাসি খাবার খাব কিনা! কারণ ট্রিপ অ্যাডভাইসারের দেওয়া দু’টো দোকানই তখনও বন্ধ। ফলে ওয়ানের পছন্দেই রাস্তার ধারে বসে ধোঁয়া ওঠা স্টিকি রাইস, পর্ক কিমা, পর্ক বল এবং পছন্দ অনুযায়ী বিফ বা চিকেন স্যুপ। আর খাওয়া শেষে কয়েক চুমুক রেড টি। আমার জন্য আবার কাঁচা সুপারি সমেত এক প্যাকেট খাসি ঘরানার পানও যোগাড় করে দিল ওয়ান। তবে ওয়ানের উদ্যোগে ঝাল ঝাল রোস্টেড পর্ক দেওয়া খাসি খাবারের ব্যাপারে আমারই উৎসাহ ছিল প্রবল। অন্য দু’জন বাধ্যত নিরামিষ বা বড়জোর পাখি, মানে ফেদার টাচ। গরু, শুয়োর বা ভেড়া–এসব লেদার জাতীয় খাবারে তাদের ঘোর অনীহা। এবার ভর পেটে আবার এগিয়ে যাওয়া। অপূর্ব পাহাড়ি পথ। কত যে বাঁক! আর তাতে থরে থরে তেমনই বাহার। আকাশের ওড়নায়, পাতার মেখলা আর কুয়াশা-নূপুর।

ওয়ানের পরিচ্ছন্নতা, ভদ্র আচরণ, দায়িত্ববোধ এবং অতর্কিতে ছেয়ে আসা কুয়াশা সামলে, দক্ষ হাতে গাড়ি চালানো– সব বিষয়েই একঘর। শেষ রাত কাটল ‘Joai’ এর ‘Ialong’ বলে এক মনোরম বনবিতানে। ইকো পার্কের হোম স্টে। আমাদের সঙ্গে না থেকে ওয়ান চলে গেল কাছেই ওর কোনও এক আত্মীয়ের বাড়ি, শুখা মাছ খেয়ে রাত কাটাতে। যাবার আগে, আশেপাশেই কী একটা নদীও দেখাতে চাইছিল। অভিরুচি গেলেও আমরা আর নড়তে চাইলাম না। শেষ বিকেলে একটু পরেই চাঁদ উঠবে। কলকাতায় ফিরে গিয়েই কোজাগরী পূর্ণিমা। পোশাক বদল করে শাল মুড়ি দিয়ে বাইরে বসেছি। মাথার ওপর খোলা ছাদ। সরুসরু হিলহিলে পাহাড়ি গাছের কালো মাথা দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে রূপোলী আকাশে। আটটা বাজে। নীচের ধাপে গাড়ি থেকে অভিরুচি নামল। ওয়ান বেরিয়ে গেল স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে। বাগানের আলো পড়ল ওর মুখে। তবু কেন আমি অন্ধকার দেখলাম! মুহূর্তে কেঁপে উঠে কেন মনে হল যেন অশরীরী কেউ! ওয়ান ছিল কি! খোলা চত্বর থেকে ঘরে আসতেই, আবার ভেসে উঠল অন্ধকার মাখা ওয়ানের কোটরগত চোখ দু’টো। কেন এরকম হচ্ছে! খানছয়েক সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে, খাবার জায়গা। গরম স্যুপ, চিকেন ওমলেট আর অ্যাপেল কাস্টার্ডে ডিনার রেডি। পাশের কটেজে কয়েকজোড়া ছেলে মেয়ে ক্যাম্প ফায়ার করে, গিটার সঙ্গতে ওয়েস্টার্ন গাইছে। ঘরে ঢুকে আমরা যে যার খাটে শুয়ে আছি আয়েশ করে। ওদের গানের মোলায়েম রেশ বেশ জড়িয়ে ধরছে এ ঘরটার আনাচকানাচও। ভরা শীতের আমেজ। শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ছি সকলে। ভোর রাতে ঘুম ভাঙল, অচেনা পাখির ডাকে। এর আগে যে দু’জায়গায় থেকেছি পাখির ডাক শুনেছি কি! ভাবতে বসলাম, কী শুনেছি তবে! মনে হল যেন শুধুই দেখেছি, সবুজ পাহাড়ের ছায়া সবুজ লেকের জলে। আর দেখেছি– নীলাকাশ, সাদা মেঘ, ঝিরঝিরে কুয়াশা। বন্ধ কাচের জানলা থেকে ঘরের পর্দা সরিয়ে, বাইরে তাকাতেই দেখি, তখনও আলো ফোটেনি। ঘন অন্ধকার। আর আশ্চর্য! গাছের ফাঁকে জেগে থাকা স্টিয়ারিং সিটে বসা ওয়ানের সেই মৃত মুখ! ভয় না পেয়ে তাকিয়ে থাকতেই, নিজে থেকেই যেন তা মিলিয়েও গেল। ঘন বনের কালচে পাতায়, কমলা রং ধরিয়ে সূর্য উঠছে। একেই কী আলোর বিকিরণ বলে! গাড়ি নিয়ে ওয়ান এল, আটটা নাগাদ। আরও একটা গাড়ি এসেছে। সহেলি আর আমাকে গৌহাটি ড্রপ করতে। ওয়ানকে নিয়ে দু’টো দিন বেশি থেকে তারপর কলকাতায় একলাই ফিরবে অভিরুচি। সেই ফিরে যাওয়ার মুহূর্ত জমাট বাঁধতে লাগল ওয়ানের সরব উপস্থিতি; সকলে মিলে ফোটো তোলার উচ্ছ্বাস, তার সঙ্গে একটু মন খারাপও। ওর সঙ্গে কি আর কোনওদিন দেখা হবে? কী মনে করে আমাকে ও নিজে থেকেই ওর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা দিল ওয়ান। অন্য গাড়িটায় ওঠার আগে ওয়ানকে স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে ওর একটা ফোটো তুলতে চাইলাম। ডার্ক গ্লাস চোখে লাগিয়ে, দুরন্ত ভঙ্গি করে ওয়ান স্টিয়ারিংয়ে বসতেই, আবার দেখি সেই মৃত চোখ। অথচ জলজ্যান্ত ওয়ান তো আমার সামনেই বসে! অযথা ভয় না পেয়ে, ঝামেলা বাঁচিয়ে ভাবলাম– ওয়ান নয়, বুড়ি হতে হতে আমি নিজেই বোধহয় একটা ভুত বনে গেছি। আমাদের গাড়িটা রওনা করিয়ে দিয়ে ওয়ানকে স্টিয়ারিং ধরিয়েই গভীর বনাঞ্চলে উধাও হয়ে গেল অভিরুচি। আর আমরা দু’জন উল্টো পথে, ক্রমে সমতলে নামতে নামতে, গৌহাটি থেকে ফিরতি বিমানে কলকাতা।
নাতিবাবুকে নিয়ে মেয়েও আজ বেড়িয়ে ফিরল। ওরা মা-ছেলে মিলে, মেয়ের ছোট দেওর ও জায়ের বাড়ি সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গিয়েছিল। আজকাল কোনো জায়গা থেকে ফিরে সকলে মিলে দল বেঁধে যে গল্প, সে আর হয় কোথায়! পরদিন থেকেই ধেই ধেই করে শুরু হয়ে যায় সব্বার ইস্কুল, কলেজ বা অফিস। তারই মধ্যে হুড়োহুড়ি করে এসে পড়ল ‘All Souls Day’ বা ‘Halloween Day’। ইংলিশ মিডিয়াম নাতির সূত্রে আমাদের বাড়িতেও এখন এসবের নিয়মিত চল। নাতির স্কুলে Activity Class-এ ওই অনুষ্ঠান পালন হয়ে গেলে তার মায়ের ইচ্ছেতেই বাড়ি এসে সবাইকে আবার ভূত সাজতে হবে। সে যত রাতই হোক না কেন! মনে হয় ছেলেকে দেখে, মায়েরও একটু সাজতে ইচ্ছে হয়েছে। গতকাল মিসেস গোমসের ছেলেও ফোন করে ভবানীপুর সিমেট্রিতে আজ উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নভেম্বরের এই শেষ দিনে, ওঁরাও আজ পালন করবেন All Souls Day। আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে এক হয়ে বাবা-মায়ের কবরে ফুল ও উপহার সাজিয়ে। ফলে, ভবানীপুর সিমেট্রি ফেরত একটু সন্ধে নাগাদই মেয়ের কাছে যাব নাতির সঙ্গে ভূতযাপন করতে। জোর কদমে তৈরি হচ্ছি আর মনে পড়ছে মিসেস গোমসের হুট করে চলে যাওয়া। তখন তো আমি মেঘালয়ের মকফানলুরে, ট্রান্সিস নামে আরও একটি খ্রিশ্চান-খাসি মানুষের অনবদ্য হোম স্টেতে শুয়ে বসে বিলাসি সময় কাটাচ্ছি। মরকত-সবুজ লেকের জলে ভেসে থাকা নীল পাহাড়ের ছায়া দেখছি। সেখানেই আমাদের প্রথম রাত্রিবাস। দূর পাহাড়ের টিলায় একটা চার্চ, যেখানে সেদিন সকালে কারও মেমোরিয়াল সার্ভিস চলছিল। কালো পোশাকে দলে দলে মেয়ে-পুরুষ ও বাচ্চারা। সেদিকে তাকিয়েই মনে পড়েছিল ভবানীপুর সিমেট্রির কথা। ঠিক দু’বছর আগে চলে গেছেন মিস্টার গোমস। তাঁর পাশেই এবার ঘুমিয়ে থাকবেন মিসেস গোমসও। একইরকম সার্ভিস শেষে। ওঁর ছেলে ফোটোও পাঠিয়েছেন সেই সার্ভিসের। খারাপই লাগছিল উপস্থিত থাকতে পারলাম না বলে! খ্রিশ্চানদের মৃত্যুও যেন উৎসব। ফুল, পোশাক এবং যাজকের বলা কথা—সবটাই বড় সুন্দর। তাই ভাবলাম, এই হ্যালোইউনও নিশ্চিত সেরকমই কিছু। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে ফেসবুক উপচেও তো ছবি, উচ্ছ্বাস; ভূত সাজার মোহময় হিড়িক!
বাইরের দু’একটা কাজ সেরে, দুপুর গড়িয়ে পৌঁছলাম ভবানীপুর সিমেট্রিতে। কত পরিবার যে এসেছে! আগে শুধু সাহেবদের কবর ছিল। পরে ফোর্ট উইলিয়ামের সৈনিকদের। কিছু হিন্দু সৈনিকের কবরও নাকি এখানে আছে। আরও পরে, অনুমতি মেলে ধনী ভারতীয় খ্রিশ্চানদের কবরের। এই সমাধিক্ষেত্রটি এখনও বেশ উচ্চশ্রেণির অভিজাত এবং ধনী মানুষদের জন্যেই। কেউ কেউ আবার পাদ্রি এনেও প্রার্থনা করাচ্ছেন। সে যে কি রুচশীল স্মরণ– সহজে ভোলার নয়। ফুল আর স্তব্ধতায় কিছুক্ষণের জন্যে সকলের সঙ্গে এক হয়ে দাঁড়াতে, বেশ অন্যরকম লাগল। ভবানীপুর সিমেট্রি থেকে যাদবপুরমুখো বাড়ি ফিরছি। ফেরার পথে, টালিগঞ্জ ক্লাবের উল্টো দিকে, ভাঙড় হাসপাতালের পাঁচিল ঘেঁষে ডান হাতেই আর একটা কবরখানা। আগেও দেখেছি। কিন্তু আজ যেন তা বিশেষভাবেই চোখে পড়ল। কারণ মেলা বসে গেছে গেটের বাইরে। গেটটাও বড় করে খোলা। মনে পড়ল, পাঁচিল ঘেরা এই বিস্তীর্ণ সবুজের উল্টোদিকের পাঁচিলের গায়েই মালাদিদের নতুন ফ্ল্যাট। প্রায়ই সে বলে, তার আর এখন ভূতের ভয় করে না। কবর খোঁড়া শুরু হলেই ওর যেন মনে হয় যে, নতুন কোনও প্রতিবেশী এলেন। ও তাই সানন্দে স্বাগত জানায় তাঁকে। ভবানীপুরের তুলনায় এই কবরখানাটা একেবারেই সাধারণ মানুষের জন্য। তাজা ফুলের বদলে, সস্তায় প্লাস্টিকের ফুলই বেশি বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গে রং-বেরঙের বেলুন। মানুষের পেঁজা পেঁজা ভিড় নিয়ে, হইহই করে এখানেও পালিত হচ্ছে– All Souls Day। গেটের থেকে একটু দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, রাস্তার স্টলে এক ভাঁড় চা খেতে খেতে ভেতরটা দেখছিলাম। জীবিত ও মৃতদের যৌথ উৎসব। এখান থেকেই সোজা মেয়ের বাড়ি।
এখন তার বেডরুমটা যেন বদলে যাওয়া সাজঘর। দুনিয়ার পরচুল, স্কার্ফ, ঢোলা জামা কাপড়ের আয়োজনে আমরা একেকজন তো তখন, তাক লাগানো দারুণ দারুণ সব ভূত। মোমবাতির আলো, জলে-ভাসানো চন্দ্রমল্লিকা আর মেয়ের বানানো ব্রাউনি ও কফিতে, সে এক জমজমাট ভূত উৎসব। যাই হোক, নাতিবাবুর হ্যালোউইন মাতামাতি শেষ হলে, মেয়ের বাড়ি থেকে নিজের আস্তানায় এসেই এলিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন না জাগরণে জানি না, এখনও যেন মোলায়েম জড়িয়ে, মেঘালয়ের নিভৃত গ্রামে থাকা সেই ট্রানসিস, গ্রাটিফাই, স্মল, ফার্দিন আর ওয়ান। আর পাহাড়– দিগন্তে সেই ধূসর চার্চটা। ফেরার আগের দিনই ওয়ান বলেছিল, আগামী সপ্তাহেই ঘরে ঘরে পালিত হবে–All Souls Day। বলেছিল, ওইদিন চেনা বা অচেনা Souls সকলেই জীবিতদের কাছাকাছি আসে আশীর্বাদ করতে। মনে হয়েছিল, অনেকটা যেন সেই ছোটবেলা থেকে দেখা, কার্ত্তিক মাসে ভোরবেলা খোলা ছাদে আমাদের আকাশ প্রদীপ দেওয়ার প্রথা।

কিছুক্ষণ পরে কী মনে হতে, একটা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে, ঘরের নিয়নগুলো নিভিয়ে দিলাম। খাবার খেয়ে, রাত-পোশাক গলিয়ে, ক্রিম মেখে আবার এলিয়ে পড়লাম কিং সাইজ খাটটায়। আজ আর এসি না চালিয়ে জানলাটা খুলে তাকিয়ে রইলাম নগর- নিয়নের আলোক রেখা আর ছায়ামাখা রাতের কলকাতার দিকে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অথচ ঘুম আসছে না কিছুতেই। মনের আনাচ কানাচে স্তব্ধতামাখা কিছু ফুল; আর বিষণ্ণ বিকেলের সেই স্বজনস্রোত। খানিক পরে ডোরবেল বাজতেই, তড়াক করে উঠে দরজাটা খুলেও দিলাম। ঘড়ি দেখার কথাটা মনেই আসেনি। কিন্তু দরজা খুলতেই একই সঙ্গে বিস্ময় এবং ভয়!
–ওয়ান তুমি?
একগাল হেসে ওয়ান ঢুকে এল জুতো পরেই। জানি যে জুতো খোলার রেওয়াজ ওদের নেই। মোড়াটা টেনে বাইরে ঘরে বসে ওয়ান বলল, গুড হোম!
মোমবাতির আলোয় ওর উজ্বল মুখের ওপর ঘুরে বেড়াতে লাগল ঘুম ছুটে যাওয়া আমারই দিশেহারা চোখ দু’টো। কী আশ্চর্য! কেন শুধু ওর মুখটুকুই দেখতে পাচ্ছি! বাকি শরীরের আভাস মিশে আছে নিচু মোড়াটায়। ঘর থেক বেরিয়ে দরজা খোলার সময়, রাত-পোশাকের ওপর ওড়নাটা অভ্যাসবশেই টেনে নিয়েছি দেখে, নিজেও যেন একটু আস্বস্ত বোধ করলাম। ওয়ান বলল, কলকাতায় এসেছিলাম একজনের সঙ্গে দেখা করতে। তোমার বাড়ির ঠিকানাটা তো বুকিং রেজিস্টারে ছিলই। দেখলাম আমার ওই আত্মীয়ের বাড়ির খুব কাছেই তুমি থাক। খুঁজে নিয়ে তাই চলেই এলাম একবারে। ধাঁধা লেগে রইল, আমার ঠিকানা রেজিস্টারে পেয়েছে শুনে! কারণ যাবতীয় যা বুকিং, সেসব তো অভিরুচিই করেছিল। উত্তর দিচ্ছি না বুঝেই হঠাৎই কেমন ছটফট করে উঠে পড়ল ওয়ান। এক গাল হেসে বলল, ফোটোটা পাঠালে না তো! সেই যে স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে ফিরে আসার দিনে তুললে! আসলে ওটা নিতেই তো এসেছিলাম!
পিছনে ফিরে চার্জে বসানো মোবাইলটা হাতে নিতেই খেয়াল হল, ওমা! সদর দরজা তো বন্ধ! রোজকার মতোই ভেতর থেকে তালা মারা! কোথায় ওয়ান! দুম করে কাকে ঢোকালাম দরজা খুলে! কে এসে বসেছিল! এই মাঝ রাতে আমিই বা কখন উঠে এসেছি এই বসবার ঘরে! নীচে একটা গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ হতেই বারান্দায় এসে দেখি, স্টিয়ারিংয়ে বসা ওয়ান। তার সেই কোটরাগত কালো চোখ সমেত মুখটা তুলে, বারান্দায় দাঁড়ানো আমাকেই দেখছে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভোরের আলোয় গাড়ি নিয়ে মিলিয়ে গেল ওয়ান ।
ভোর রাতে ঘুমিয়ে একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠে নিশ্চিত হলাম, ওয়ানের স্বাভাবিক মুখটাই কাল স্বপ্নে দেখেছি। যাক বাবা! আপদের শান্তি বিপদের শান্তি। কিন্তু, কয়েকদিন পরেই সহেলির ফোনে জানলাম, অভিরুচির রেফারেন্সে শিলং গিয়ে ওর পরিচিত একজন ওয়ানের গাড়ির খোঁজ নিতে গিয়ে জেনেছেন, ওয়ান বেঁচে নেই। তিন পুরুষ ধরে, মেঘালয়ের বাসিন্দা হলেও, নতুন সরকারি আইনের কাগজপত্র অনুযায়ী, ও নাকি আদপে একজন চাইনিজ অনুপ্রবেশকারী। কারণ ওর মা খাসি হলেও বাবা চাইনিজ; এবং কনভার্টেড খ্রিশ্চান। তাই ধরা পড়বার ভয়ে, পালাতে গিয়ে সীমান্তরক্ষী জোয়ানদের গুলিতেই নাকি প্রাণ যায় ওয়ানের। অনুপ্রবেশকারী হওয়ায়, ওর খাসি পরিবার শুধু খবরটুকুই যা পায়। কিন্তু মৃতদেহের সৎকার কীভাবে হয়েছে, কেউই তা জানে না। ওয়ানের দেহ ওর পরিবারে ফিরেও আসেনি।
মনে মনে ভাবলাম, খবরটা যেন মিথ্যে হয়। কারণ ভূতে আবার আমি কবে বিশ্বাস করি!
*ছবি সৌজন্য: Hindustan Times , India Today
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
One Response
ধন্যবাদ
Atiqur Rahman। পাঠকের প্রতিক্রিয়াই লেখকের উৎসাহ।