এক অডিওবুকপ্রেমীকে বলতে শুনেছিলাম, ‘অডিও-কেতাবের সবচেয়ে বড় মজা কী জানো তো? এর মতো সহজে বই পড়ার (আসলে শোনার) উপায় দুনিয়াতে আর দুটি নেই। বই পড়তে পড়তে অনেক কিছু করে নেওয়া যায়। দাড়ি কাটা যায়, রান্না করা যায়, গাড়ি চালানো যায়, জামাকাপড়ও ইস্তিরি করে নেওয়া যায়। টয়লেটেও বই আমার সঙ্গী।’ আসল কথা হল, বই পড়ার জন্য আলাদা করে সময় বরাদ্দ করার কোনও প্রয়োজন নেই। অনুমান করা যায়, বইপ্রেমীরা এমনটা শুনে আঁতকে উঠে বলবেন, ‘সে কী! অন্য কাজ করতে করতেই যদি বই পড়তে হয়, তাহলে এমন পড়ার মানে কি? মনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু কি আমাদের থেকে নিজস্ব সময় দাবি করতে পারে না? এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, নাকি পুরোটাই লোকদেখানো?’
আন্তর্জালে একটা কথা বেশ চালু হয়ে গিয়েছে দেখলাম। লোকেরা বলছেন, বই পড়া নয়, আসল কথা হল বই ‘কনজিউম’ করা। অনেকেরই মত হল, কাগজের বইকে খুব শিগ্গিরি টেক্কা দেবে অডিওবুক। ক্রমাগত বেড়ে চলা বিক্রির হিসেব এই সম্ভাবনার কথাই জানান দিচ্ছে।
অডিওবুক ব্যাপারটা কী? একটু খোলসা করে বলা যাক। সোজা কথায় বলতে গেলে, এ হল শ্রাব্য বা শ্রুতিযোগ্য বই। দুটো হাতকে ব্যস্ত করে দিয়ে, চোখের মণি ক্রমাগত বাঁদিক থেকে ডানদিকে নাচিয়ে, পাতা উল্টিয়ে, নিমগ্ন হয়ে বই পড়ার আসলে কোনও দরকার নেই। যখনই চাইব, বই বেজে উঠবে আমার-আপনার কানে। কোনও জায়গা ভাল লেগে গেলে একটু রিওয়াইন্ড করে ফের শুনে নিলেই হল। বই চলবে বইয়ের মতো, আমি আমার মতো। অডিওবুকপ্রেমীদের দাবি, এর আসল জিত এখানেই।
এক সমীক্ষা বলছে, মার্কিন মুলুকে ২০১৯ সালে ছাপা বইয়ের বিক্রি প্রায় ৩ শতাংশের মতো কমে গেলেও অডিওবুকের বিক্রি বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। ২০২০ সালে দুনিয়াজুড়ে অডিওবুকের ব্যবসার পরিমাণ ছিল চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। আশা করা যাচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ব্যবসার এই পরিমাণ কুড়ি বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়ে ফেলবে। এই বৃদ্ধির হার ঈর্ষণীয়। সাবেকি, ছাপা বইয়ের ক্ষমতা সীমিত। অডিওবুকের বৃদ্ধির এই উর্ধ্বমুখী হারের পাশে দাঁড়ানোরও ক্ষমতা নেই কাগজের বইয়ের। এমন তথ্যে অডিওবুকের বিপণনকারীরা হাসছেন যত, প্রকাশনা সংস্থাগুলির কর্তাদের মুখে বলিরেখা তত প্রকট হচ্ছে। মানুষের মনের এহেন বাইনারি ট্রেন্ড দেখে চিন্তায় পড়েছেন বইপ্রেমীরাও।

বই পড়া মানে তো অনেকটা নিজের সঙ্গে কথোপকথন! সাদা কাগজে বন্দি অক্ষরগুলো তাদের রুপ-রস-গন্ধ নিয়ে আমাদের কাছে এসে ধরা দেয়। মুক্ত হয়। পাতা উল্টাতে উল্টাতে বইয়ের সঙ্গে ক্রমশ তৈরি হয় একাত্মতা। বই হয়ে ওঠে প্রকৃত বন্ধু, আত্মার আত্মীয়। কবি স্যামুয়েল জনসনের কথায়, ‘একজন লেখক শুধুমাত্র একটি বই শুরু করেন। তা শেষ করেন পাঠক।’ আমার হয়ে অন্য কেউ বই পড়ে দিলে সেই আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনও ফাঁক থেকে যায় না তো? সাবেকি বইপ্রেমীদের মনে হিজিবিজবিজ প্রশ্ন জাগে।
যে মানুষরা বই পড়ছেন এবং যাঁরা বলতে গেলে সেই অর্থে বইয়ের কনটেন্ট কনজিউম করছেন, দুনিয়াজুড়ে এই দু’পক্ষের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত বিভাজন। বইপ্রেমীদের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন অনেকটা এরকম। ধরা যাক, পড়া হচ্ছে কোনও গা ছমছমে গল্প। লাইন এল, ‘..পোড়ো বাড়িটায় রাত বারোটায় দরজায় কেউ প্রবল নাড়া দিতে থাকল। বাড়ির এক কোণায়, ভিতরের একটা ঘরে একা একা আমি। বুকের মধ্যে উথাল পাথাল। ঝিঁঝিঁপোকার ডাককে করাতের মতো কেটে দিল তীব্র কড়া নাড়ার আওয়াজ। দূরে বাজ পড়ছে কোথাও। শব্দ পাচ্ছি। একটা ভয় আঁকশি বাড়িয়ে চেপে ধরছে আমায়। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি বেশ..’।
কী করবে অডিওবুক? সুকন্ঠী কোনও মানুষ ধীরে ধীরে লাইনগুলো পড়ে যাবেন। সাউন্ডট্র্যাকের সঙ্গে মিশতে থাকবে হরেকরকমের শব্দ। কোনও বইপ্রেমী ভুরু নাচিয়ে বলতেই পারেন, ওহে বিদেশি ডিগ্রিধারী সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, কোন শব্দের সঙ্গে কোন শব্দ মেশাবে? কড়া নাড়ার শব্দ না হয় জুড়ে দেওয়া গেল, আধুনিক সফটওয়্যার দিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হল বাজ পড়া কিংবা ঝিঁঝিঁর ডাকের শব্দও, কিন্তু মনের গভীরে জমে থাকা ভয়ের আঁকশির কি কোনও শব্দ হয়? বুকের ধুকপুকুনি মানে কি শুধুই হার্টবিট? নাকি তার চেয়েও অনেক বেশি এক ধরনের ‘কী হয় কী হয়’ ভাব– এই দুটো শব্দের সঙ্গে লেপ্টে থাকে?

দুনিয়াজুড়ে মনোবিদদের একটা বড় অংশ এই অডিওবুকের ঘোর বিরোধী। তাঁরা বলছেন, মানুষের কল্পনাশক্তিকে ক্রমশ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য অডিওবুকের জুড়ি নেই। তাঁদের মতে, ইংরিজিতে ‘রিডিং বিটুইন দ্য লাইনস’ বলে যে শব্দবন্ধটি আছে, অডিওবুক তার কফিনে পেরেক ঠুকে চলেছে অবিরত। গল্পের বইয়ের প্রতিটা লাইনের সঙ্গে আমাদের কল্পনাশক্তি যেমন পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো ছুটে চলতে চায়, কোনও গলা ও সাউন্ডট্র্যাকের সমস্বর সেই ঘোড়ার গলায় লাগাম পরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মনোবিদদের হুঁশিয়ারি, এই অডিওবুকের কল্যাণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও কিশোররা। তাঁরা কপাল কুঁচকে বলছেন, ঝমঝম করে বৃষ্টি নামার কথা কোনও গল্পে পড়লে একটি শিশু কিংবা কিশোর বৃষ্টির আওয়াজের সঙ্গে মাটির যে সোঁদা গন্ধটাও কল্প-উপভোগ করে এসেছে এতদিন, সাউন্ডট্র্যাকের বৃষ্টি তা কেড়ে নেবে না তো? অনেকেরই আশঙ্কা, সাজিয়ে দেওয়া শব্দের ফলে শিশুদের কল্পনাশক্তিও ক্রমশ হয়ে উঠবে ফ্রেম নির্ভর।
কট্টর বইপ্রেমীরা হাত জোড় করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বই আর যাই হোক না কেন, কনজিউম করার মতো কোনও বস্তু হয়ে ওঠেনি এখনও। বই আত্তীকৃত হতে পারে, কনজিউমড্ নয়। অন্য কাজ করার সময় মনের একটা যান্ত্রিক সঙ্গ চাইছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য হাজারটা রাস্তা খোলা আছে এই দুনিয়ায়। ওটিটিতে মজে থাকতে পারেন, গান শুনতে পারেন, সঙ্গে রাখতে পারেন খবরের চ্যানেলও। শুধু শুধু সাহিত্যকে সেখানে টেনে আনা কেন? বিদ্রুপ করে তাঁদের দাবি, টানা বসে সিনেমা দেখার সময় না হলে আমরা তো কখনও ডায়লগ শুনে প্রাণ ভরাই না। সিনেমা যেমন না দেখলে সাধ মেটে না, সঙ্গত কারণেই বই না ‘পড়লে’ সেই পাঠ অপূর্ণ থেকে যায়। কেউ কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে এসে বলছেন, এভাবে বই পড়া হলে দিনের শেষে আসলে বইকে অসম্মান করা হয়।
চিরায়ত অভ্যেসকে আঁকড়ে ধরে এক দল লোক বেঁচে থাকতে চাইলেও বাস্তব কিন্তু আসলে অন্য কথা বলে। নতুন ফর্ম্যাটের বইয়ের বেড়ে চলা বিক্রির হার বদলে যাওয়া সময়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। অডিওবুক নির্মাতারা ওয়ালেটে আদর করে দাবি করছেন, সাহিত্যের সঙ্গে একাত্মতা নাই বা হল, কিন্তু ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর জীবনে কিছুক্ষণ সাহিত্যের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ তো অন্তত করে দিতে পারছে অডিওবুক। এটাই বা কম কী!
শ্রাব্য বই নিয়ে কাজ করা এক ভদ্রলোক সেদিন বলছিলেন, ‘তোমাদের এই জেন-জ়ি-রা সবাই ইংলিশ মিডিয়াম। বাবুদের কারও বাংলা আসে না। লেখা তো দূরের কথা, পড়তেই পারে না ঠিকঠাক। ইংরিজিতে ফেলুদা পড়ার থেকে রবিবারের কোনও রেডিও অনুষ্ঠানে তা বাংলায় শুনে নেওয়া ঢের ভাল।’ আর রক্তে সাহিত্য থাকলেও কর্পোরেট শরশয্যায় শুয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন যে কয়েক কোটি মানুষ, তাঁদের কাছে বই শুনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই আপাতত। চরিত্রগুলো চোখের সামনে না থাক, কানের পাশে তো ঘোরাঘুরি করে কিছুক্ষণ। অনেকেই বুঝে গিয়েছেন, ব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি না পাওয়া পর্যন্ত এই অভ্যেসকেই মেনে নিতে হবে। সেই ‘ছুটি’ শব্দটির সঙ্গে কেন জানি না, দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে।

বইয়ের পাঠক এবং শ্রোতাদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব হয়তো মিটবে না কোনওদিন। প্রত্যেকেই তাঁর আবেগ-অস্ত্র নিয়ে তর্কের এই লড়াইয়ে সামিল। তবে মজার ব্যাপার হল, এর মধ্যেই বেশ কিছু লেখকের উদয় হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। এতদিন জানতাম, লেখকেরা কোনও নতুন সৃষ্টির সময় পাঠকের কথা ভেবে লেখেন। আমি পাঠক হলে আমার পড়তে কেমন লাগত— এই প্রশ্নটা হয়তো প্রতি পাতা লেখার পরই লেখককে নাড়া দিয়ে যায়। উদয় হওয়া নতুন লেখকরা খুল্লমখুল্লা বলে দিচ্ছেন, পাঠকদের পড়তে কেমন লাগবে তা নিয়ে আপাতত অত ভাবছি না, শুনতে ভাল লাগলেই যথেষ্ট। তাঁরা ঠিকই করে নিয়েছেন, লেখা শেষ হলে কোনও ছাপাটাপার ব্যাপার নেই। পান্ডুলিপি থেকে একেবারে স্ট্রেট অডিওবুক।
কয়েক বছর পরের ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো হয়তো আমাদের এমন গল্পই শোনাবে। তাই, রেডি হওয়া জরুরি।
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
One Response
কী সুন্দর বিশ্লেষণ! গল্পকার হয়েও ভালো নিবন্ধ লেখা যায়। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।