ভাদ্র (Autumn) ফুরিয়ে আসছে। রোদ্দুরে দুপুরগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছে পিঠ। ছাদে ছাদে এখন তোরঙ্গ মেলে দেওয়ার অবসর। আসলে অবসর বলে কিছু নেই। মানুষেরা তবু ভাদ্রের (Autumn) আকাশে চেয়ে চেয়ে উত্তাপ পোহাতে চায় তোরঙ্গ আলমারি আর সুজনি ভরে। উঠোনে পাটি পেতে মেলে দেয় কাঁথা কম্বল আলোয়ান। ভাদ্র (Autumn) যেন রোদ্দুর বিলি করে বন্ধ দেরাজের ওপারে। এও যেন এক শুশ্রূষা। স্থবির জীবনের বিপ্রতীপে উত্তাপের আশ্রয় চাওয়া মানুষেরা জেনেছে এসব, অনেক অনেক কাল ধরে।
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪]
শরতের (Autumn) মেঘে কি কেবল ছুটির ছায়া পড়ে! ঘরে ফেরা মানুষ আসলে উত্তাপ খুঁজে ফেরে অহরহ। রোদ্দুর নিংড়ে গেরস্তের এও যেন এক সঞ্চয় তাই। গাছে গাছে কালো কুচকুচে তাল পেকেছে ওই। কী অমোঘ সেই মাধ্যাকর্ষণের টান। মাটির পৃথিবীর টান। কবেকার কোন তালের মইয়ে ঘষে ঘষে তালের মাড়ি জড়ো করেছেন অশীতিপর হাত। ওই হাত কত কত ভাদ্রদিনে (Autumn) বড়া ভেজেছেন, ভাজা মালপো রসে ফেলেছেন। শরতের (Autumn) দুপুর গুলোয় ওই হাতের বুঝি ছুটি পেতে ইচ্ছে করে না! মিঠে হাওয়ায় চোখ জুড়িয়ে আসা দাওয়ায় তালাই পেতে সুপুরি কুচানোর সুখ কী কম!

বয়মে বয়মে আচারেরা রোদ্দুর পোহাবে এখন। বিলাতি আমড়ার পাতায় রোদ্দুর পিছলে যাচ্ছে ওই। ছুটি চাওয়া অশীতিপর হাত গুড়ের জ্বালে বিলাতি আমড়ার আচার বানাচ্ছে দুপুর ভর। এই কি ছুটি? ও কি ভুলে গেছে ছুটি পেতে? ভুলে যায় যারা, ভুলিয়ে দেয় যারা তারা কি একে অপরের বন্ধু হতে পারে? রান্নাঘর তো আর খেলার মাঠ নয়। তবু কী আশ্চর্য দেখুন, কবেকার কোন কৌম সমাজ রান্নাঘরে বন্ধুত্বের গল্প বুনে দিতে চেয়েছিল। এও যেন এক যৌথ খামার। আগুন আর উত্তাপে বোনা সেসব গল্প তামাদি হয়ে যেতে বসেছে হয়তো বা।

তবুও তো কেউ কেউ ভাদ্র (Autumn) সংক্রান্তির ডাকে রান্নাঘরে ফিরে আসে অরন্ধনের নিয়মে। অনেক ভেবে দেখেছি, এই অরন্ধন কি আসলে ছুটির গল্প বলে? এ ছুটি বোধহয় আগুনের ছুটি, উনোনের ছুটি। তালের ফুলুরি ভাজা হাত কি আদৌ ছুটি পায়? সে বরং ওলের বড়া ভাজে, নারকেল ভাজে, ঝুরো ডালে ভাজা মশলা ছড়িয়ে দেয়। পার্বণ মানুষের রান্নাঘরকে ছুটি দেয় বটে, মানুষকে না। সংক্রান্তির রান্নাঘর তাই পার্বণের সুখ মেখে সেজে ওঠে হাড়ি কড়াই হাতা খুন্তির উৎসবে। সুপারির খোল ভরে কুটনো কোটে হাসিমুখ, বচ্ছরকার দিনে শাপলার মালায় সেজে ওঠে পান্তার হাড়ি।

কী অপূর্ব সেই বিনিসুতোর মালাখানি। অমন একখানা মালায় সেজে উঠেছে কোন সে অপাপবিদ্ধা কিশোরমুখ! এসবই ভাবি বসে বসে। কী অপূর্ব নন্দন ওই মালাখানিতে। আগুনের আবিষ্কার জরুরি ছিল বৈকি! মালা গাঁথাও তো শেখার ছিল, তাই না? এমন শরতের (Autumn) দিনে গাছে গাছে স্থলপদ্মের কুঁড়ি ভরে উঠেছে, ফুল ফোটাবে বলে সেজে উঠেছে শিউলির শরীর। খুব ভোরে হিমে জবুথবু এই গাছ মাঠ আর অনন্তলতা কী শান্ত সবুজ। সেসব দেখলে টের পাওয়া যাবে না ওর রৌদ্রদীপ্ত দুপুরের সজ্জাখানি। অমন দুপুরে রোদ্দুরে পিঠ পেতে দিয়ে এ পাড়ার কিশোরী নদীতে শামুক কুড়োতে যায়। ঝুড়ি ভরে তাল শামুক কুড়োয়, ঝিনুক কুড়োয়। ওর মুখে তখন কী খুশি! ওকে তখন শারদলক্ষ্মীর মুকুটখানি পরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

কাদা পায়ে মেয়ে আমাদের ওই চলেছেন। ওর মন্দাক্রান্তা গতি, ওর রুক্ষ চুলের প্রান্ত…সে বড় সুন্দর। ঘরে ফেরা মেয়ে এখন মা’কে বলছে, – কাল ভোরে শালের জঙ্গলে যাবি মা? ছাতু কুড়োতে? মা’য়ে বলছে, – দাঁড়া ক্যানে! ভাদ্র (Autumn) ফুরোলে দুর্গাছাতু হবে এখন। দুর্গাছাতু তুলবি তখন। উনোনের পাশে বসে বসে পায়ের গোড়ালিখানায় সর্ষের তেল মাখছে এখন মন্দাক্রান্তা মেয়ে। কবেকার কোন মেঘদূত পেরিয়ে আসা কথাকাব্য প্রাণ পাচ্ছে ওর শরীরে, ওর রান্নাঘরে। কাঠের জ্বালে ভাত ফুটছে। আগুনের কী তাপ! ভাদ্রের আকাশ, তুমিই কি কেবল উত্তাপ ফেরি করো! মানুষের রান্নাঘরে পিড়ি পেতে বোসো খানিক। না হয় খানিক উত্তাপ বিনিময় হোক।

কলাপাতায় তালের পিঠে
উপকরণ : তালের মাড়ি এক দেড় কাপ, চালের গুঁড়ো এক দেড় কাপ, কাঁঠালি কলা একটি বা দুটি, এক কাপ নারকেল কোরা, চিনি চার-পাঁচ চামচ, কলাপাতা।
পদ্ধতি : তালের মাড়ি আর চালের গুঁড়ো ভালো করে মেখে নিন। যেমন রুটির আটা মাখেন। অল্প চিনি দেবেন, তালের মিষ্টতা অনুযায়ী। অন্যদিকে নারকেল কোরা, পাকা কলা আর স্বাদ মতো চিনি সব এক সঙ্গে মেখে নিন। এই রান্নাগুলিতে উপকরণের পরিমাণ প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তিগত স্বাদের উপর। কলাপাতা কেটে ধুয়ে আগুনের তাপে নরম করে নিন। নরম করে নিলে কলাপাতা আর ফেটে যাবে না। চৌকো করে পাতাগুলি টুকরো করে নিন।

হাতে সামান্য জল বুলিয়ে কলাপাতায় তালের মণ্ড বুলিয়ে দিন। এর উপরে নারকেল কোরার পুর দিন। উপরে আবার তালের মণ্ডের প্রলেপ দিন। এরপরে কলাপাতা রোল করে নিন। একেকটি পাতার রোল চাটুতে সাজিয়ে রাখুন। চাটুতে পিঠা সাজানো হয়ে গেলে আগুন জ্বালান। ঢাকা দিন। নরম আঁচে, সময় নিয়ে একেকদিন ভালো করে সেঁকে নিন। পোড়া ভাব এসে যাবে। আবার অন্যদিকে উল্টে দিন। চারিদিক ভালো ভাবে হয়ে গেলে আগুন নিভিয়ে আরও কিছুক্ষণ গরম চাটুতে পিঠাগুলি রেখে দিন। মিনিট সাত-আট পরে পরিবেশন করুন গরম গরম তালের পিঠে। তেলবিহীন সুস্বাদু এই পিঠে খেতেও ভালো, পেটও ভরায়।

বিলাতি আমড়ার আচার
উপকরণ : বিলাতি আমড়া আট-দশটি, গুড় স্বাদ মতো, সর্ষের তেল দুই টেবিল চামচ, শুকনো লঙ্কা দুটি, পাঁচ ফোড়ন এক চিমটে, পাঁচ ফোড়নের গুঁড়ো এক চা চামচ, ভাজা জিরের গুঁড়ো এক চামচ, দুই চামচ তেঁতুলের কাথ, প্রয়োজন মতো নুন, হলুদ, লঙ্কার গুঁড়ো।
পদ্ধতি : বিলাতি আমড়া গুলি খোসা ছাড়িয়ে টুকরো করে নিন। আগেই ধুয়ে মুছে নেবেন। আর জল দেবেন না। এবারে, আমড়া গুলি নুন মাখিয়ে চাপা ঢাকা দিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। কড়াই গরম করে তেল দিন। তেল গরম হলে শুকনো লঙ্কা ছিঁড়ে ফোড়ন দিন, পাঁচ ফোড়নও দিয়ে দিন। সুন্দর গন্ধ বের হলে আমড়া গুলি হাতে চিপে দিয়ে দিন। নুন মাখানো আমড়া জল ছেড়ে দেবে। এই নরম হয়ে আসা আমড়া ভালো করে নেড়ে চেড়ে জল শুকিয়ে নিন।

অল্প হলুদ দিয়ে কষিয়ে নামিয়ে রাখুন। আরেকটি পরিষ্কার কড়াইয়ে গুড় জ্বাল দিন। জ্বাল ফুটে উঠলে তেঁতুলের কাথ দিন। মিলেমিশে গেলে আমড়াগুলি দিয়ে নেড়েচেড়ে লঙ্কার গুঁড়ো, পাঁচ ফোড়নের গুঁড়ো দিন। সামান্য নুনও দিন। বেশ মাখা মাখা হয়ে এলে তেল ছেড়ে দিলে আগুন নিভিয়ে দিন। অল্প ঠাণ্ডা হলে ভাজা জিরের গুঁড়ো মেশান। পরিষ্কার শুকনো বোতলে আচার ঢেলে নিন। চাইলে একবেলা রোদ খাইয়ে নিন। বিলাতি আমড়ার টক মিষ্টি আচার বড়ই উপাদেয়।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Bing.com, Facebook, Bing.com
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
One Response
অসাধারণ