অঘ্রাণের (Agrahayana) বেলা বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসে। পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে থাকে কোন সে হিমের স্পর্শ মেখে। তখন তাকে ভারী বিষণ্ণ বোধ হতে পারে একেকদিন, কিন্তু আসলে সে যেন আস্ত একখানা মায়াবী ইজেল। আর কিছুক্ষণেই হিমে ভিজে উঠবে ঘাস মাঠ এই প্রান্তর।
ওই যে মাটি ফুঁড়ে হাত তুলতে চাইছে রসুনের ক্ষেত, পেঁয়াজের পাতা! ওরা এখন হিমে ডুবে যাবে। এ যেন ওদের অবেলার স্নান। বেগুনের ফুলেরা দেখবে এসব। গেরস্থ ঘরের একটেরে বাগান যেন গাছপালাদের বারো ঘর এক উঠোন। (Agrahayana)

যে মেয়েটি ভোর ভোর জলের ছিটায় মুখ ধুইয়ে দেয় ওদের, তাকে ওরা চেনে। সকালের সব রোদটুকু তখন বুঝি কিশোর কন্যেটির চুল মুখ মাথায় এসে পড়ে। গাছেরা তো ছাপা বই পড়ে না! এই যেন ওদের কবিতা পড়ার সুখ। ঝুড়ি ভরে সিম, বরবটি, মুলো তুলছে আঘুনের হিম সকাল। (Agrahayana)
সকাল সকাল উনোন ধরিয়েছে বাড়িগুলো। গাঁ-ঘরে এখন কচি কচি গোটা আনাজ দিয়ে ফ্যান ভাত রান্না হবে। উঠোনের কোণটিতে নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে ওই। রোদে পিঠ দিয়ে গরম ফ্যানাভাত খাওয়ায় ভারী সুখ। ভাতের গন্ধে মানুষের মৌতাত লাগে তখন। ভাতের নেশা কি কম হল!

হেমন্তের অরণ্য থেকে উঠে আসা বনজ গন্ধেরা যতই অপার্থিব সুজনি বুনে তুলতে চাক না কেন, এ জীবন বড় বেশি পার্থিব। ভাতের থালাখানি প্রতিদিন সে কথাই বলছে। তার সোচ্চার নীরবতা দিয়ে গাঁথা হচ্ছে রান্নাঘরের গান, রান্নাঘরের গল্প। সেই গল্প ঊষার আলোয় আলপথ বেয়ে বেয়ে খেজুর রসের হাঁড়ি নামাতে যায়। মেটে হাঁড়ির শীতলতা পেলাস্টিকের নেই। পেলাস্টিক কেমন করে জানবে মেটে হাঁড়িতে জীবনের সবটুকু জাড় থিতু হয়ে আছে। (Agrahayana)
আদুর গায়ে দোলাইখানা জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে তখন। মায়ের কোল ঘেঁষে কোলের ছেলেটা তখন উষ্ণতা খোঁজে। এই খোঁজকে অপার্থিব বলবো এমন বেকুব আমি নই। এই পার্থিব জীবনকে তখন অপার্থিব উপমেয় উপমানের চেয়ে ঢের বেশি কাম্য বলে বোধ হয়। সামান্য মুলোর ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খেতে তখন যে কী সুখ! (Agrahayana)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫][৬]
যাঁরা শিল্পের গুণগ্রাহী, যাঁরা রসিক তাঁরা মিনিমালিস্টিক পেইন্টিং’এর ভিতরের সত্যটিকে খুঁজে পান কত সহজ করে। এই হেমন্তের দিনে নিরাভরণ রান্নাঘর আর সামান্য শাকপাতার ঝোলে আমি একেকদিন সেই যাপন-শিল্পকে খুঁজি। সুপুরির খোলে মুলো শাক কুচিয়ে নিচ্ছে অভ্যস্ত হাত। কী নিপুণ ওর কাজ! সাঁতলে নেওয়া শাক দিয়েই একেকদিন যাদের ভাত ফুরিয়ে যায় তাঁদের আমার রসবোদ্ধা বলে বোধ হয়। (Agrahayana)
তবুও তো এ জীবন তার কত ভাষায় কত ভাষ্যে সময়ের স্বাদকে ধরতে চাইছে প্রতিদিন। আতপচালের পিঠালি দিয়ে শাকের ঘণ্ট রাঁধেন তাই ও পাড়ার খুড়ি। এক টুকরো মাছের মাথা দিলে সেই পিঠালির চচ্চড়ি তো অমৃত! কী ব্যক্তিগত দেখুন রান্নঘর! অথচ আশ্চর্য রকম সে বারোয়ারি। স্বাদের গ্রন্থিগুলোকে সময়ের তারে বেঁধে তুলতে তার কত সাধ, কত সাধনা। (Agrahayana)
কে বলতে পারে, নিয়মের রান্নাঘরে ইতুপুজোর খিচুড়ির চেয়ে এই রান্নাঘরের যাপন অনেক বেশি অন্যরকম! অঘ্রাণের দিন মানুষের হাত ধরতে চাইছে প্রতিদিন। কবেকার কোন বর্ষবরণের (অগ্রহায়ণ) গান গাইতে চাইছে বুঝি। আমরা কি দু’দণ্ড কান পেতে বসবো না!
এই সমস্তটাকে শীতকালে বলে দাগিয়ে দিলে কি চলে? কার্তিকে আর অঘ্রাণে রান্নাঘরের গন্ধ কি আর এক থাকে? পৌষে বা মাঘেও কি! নাহ্। একেকটা সময়ের স্বাদ লয় গন্ধ নিয়ে তারা যেন একেকটি নির্দিষ্ট সুর। আলাপের বিস্তারে তাকে বুঝতে হয়। কত না বছর ধরে মানুষের রান্নাঘর তাকে আত্মস্থ করতে চাইছে। ওই রসুন আর পেঁয়াজ পাতাদের অবেলার স্নানের মতোই হিম আর কুয়াশার গন্ধে ডুবে গিয়ে অঘ্রাণের রান্নাঘরকে বুঝতে হয়। (Agrahayana)
ইতুপুজোর ডালাটির মধ্যে কবেকার কোন শস্য-বন্দনার মন্ত্র সাকার রূপ পেয়েছে। মেয়েদের রান্নাঘর এই নিয়মের ইস্কুলঘরে কতই না দিন ধরে পালন আর আচারের মায়ায় ডুবে আছে। একেকদিন ওই শেষ বিকেলের আলোয়, মাঠের প্রান্তরে গিয়ে ওরা দাঁড়াবে না কি! রসুন পাতার মতো হিমে ডুবে যাওয়ার ইচ্ছে কি ওদের হবে না! আলের পাশটিতে বসে তখন ওদের অঘ্রাণের স্বাদ গন্ধে পার্থিব একখানা রান্নাঘরে গড়ে তোলার স্বাদ হতেও পারে হয়তো! (Agrahayana)

কে বলতে পারে, নিয়মের রান্নাঘরে ইতুপুজোর খিচুড়ির চেয়ে এই রান্নাঘরের যাপন অনেক বেশি অন্যরকম! অঘ্রাণের দিন মানুষের হাত ধরতে চাইছে প্রতিদিন। কবেকার কোন বর্ষবরণের (অগ্রহায়ণ) গান গাইতে চাইছে বুঝি। আমরা কি দু’দণ্ড কান পেতে বসবো না! গাছ গাছালিদের বারো ঘর এক উঠোনে কুয়াশা গন্ধ ফুরিয়ে নরম রোদ্দুর উঠেছে ওই। আমরা বরং গুষ্টির কাজ ফেলে রেখে খানিক রোদ্দুর পোহাই। রোদে পিঠ পেতে চিতই পিঠার সাজখানি ঘষে মেজে নিই। কে না জানে কাজের চেয়ে অকাজের আনন্দ ঢের বেশি।(Agrahayana)

মুলোর ঝোল, চিংড়ি দিয়ে
উপকরণ – সাদা মুলো, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন, কালোজিরে, চাপড়া চিংড়ি, নুন, হলুদ, সর্ষের তেল।
পদ্ধতি – কচি দেখে মুলো নিন দু চারটি। বাগানের মুলো হলে প্রয়োজন নেই, না হলে ফুটন্ত গরম জলে দু-তিন মিনিট ভাপিয়ে নিতে পারেন। মুলোগুলি পাতলা পাতলা গোল গোল করে কেটে নেবেন। কড়াইয়ে সর্ষের তেল দিন সামান্য, এই রান্নাটি তিলের তেলেও খুব ভালো স্বাদ হয়। তেল গরম হলে নুন দিয়ে চিংড়ি কটি সাঁতলে তুলে নিন। হলুদ দিতে পারেন, খুব সামান্য। কড়াইয়ে আরেকটু তেল দিয়ে কালোজিরে আর চেরা কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিন।

ফোড়নের গন্ধ বের হলে খুবই পাতলা করে কাটা অল্প পেঁয়াজ আর লম্বালম্বি ভাবে অর্ধেক করা রসুন ফোড়ন দিন। পেঁয়াজ রসুন পুড়বে না, কাঁচা গন্ধ চলে যাবে কেবল। নুন, এক চিমটে হলুদ আর জল দিয়ে ফুটতে দিন। ফুটে উঠলে মুলো দিয়ে দিন। মুলো সেদ্ধ হলে চিংড়ি দিন। খুব অল্প ধনেপাতা দিন। গন্ধের জন্য আরও কয়েকটি কাঁচালঙ্কা দিয়ে রান্না শেষ করুন। গরম ভাতে অঘ্রাণের গন্ধ মিলেমিশে যাবে আর কিছুক্ষণেই।
হাতে মাখা কাঁচা টমেটোর ঝাল
উপকরণ – কাঁচা টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচালঙ্কা, সর্ষের তেল, নুন, মিষ্টি আর ধনেপাতা।

পদ্ধতি – কাঁচা টমেটোগুলি গোটা অবস্থায় ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিন। বেশ কিছুটা রসুন খোসা ছাড়িয়ে কুচিয়ে নিন। রসুনের পরিমাণ আর পেঁয়াজের পরিমাণ প্রায় সমান সমান দেবেন। কাঁচালঙ্কা আপনার স্বাদ অনুযায়ী লম্বালম্বি ফালি করে নিন। কাঁচা টমেটোগুলিও পাতলা পাতলা করে কেটে নিন। কড়াইয়ে সর্ষের তেল দিন। তেল গরম হলে আগে রসুন দিন, রসুন ভাজার গন্ধ বের হলে পেঁয়াজ দিন। পেঁয়াজ স্বচ্ছ হয়ে এলে টমেটোগুলি দিন। স্বাদ অনুযায়ী নুন দিন। একটু পরে পরে অল্প অল্প নেড়েচেড়ে দেবেন। নরম আঁচে সময় নিয়ে রান্না করুন।

টমেটো সেদ্ধ হবে কিন্তু গলে যাবে না। টমেটোর টক অনুযায়ী সামান্য মিষ্টি দিন। কড়াই থেকে নামিয়ে একটু হাত সওয়া ঠাণ্ডা হতে দিন। ঠাণ্ডা হলে অল্প কাসুন্দি আর কুচিয়ে নেওয়া ধনেপাতা দিয়ে ভালো করে মেখে নিন রান্না করা টমেটো। প্রয়োজন না হলে আর সর্ষের তেল দিতে হবে না। ধনেপাতা মাখার আগেই কাটবেন, গন্ধ অনেক সতেজ থাকবে। গরম ভাতে বা ডালের সঙ্গে পরিবেশন করুন টক ঝাল কাঁচা টমেটোর ঝাল।
ছবি সৌজন্য: লেখক , সন্দীপন মুখোপাধ্যায়, Wikimedia Commons
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।