বৃষ্টি এখনও কালো রাতের ফাঁকফোকর গলে নেমে আসেনি। তবে বাদলা মেঘের সঙ্গে হাওরের জলের দূরত্ব খুব বেশি নয়। সাম্পানে ফিরে এসে দেখি হলদে বাল্বের হালকা আলোয় এক মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যুবক সহযাত্রীর দল। তাঁদের হাতে গিটার আর গলায় সুর। একের পর এক গান গেয়ে চলেন ওঁরা। কোনও গান ব্যর্থ ভালোবাসার আবার কোনও গানের শব্দে ভাটি অঞ্চলের মাঝিদের হতাশার মেঠো বিলাপ। ইচ্ছে হল এক কাপ চায়ের। কিন্তু এত রাতে চা জোগাড় সহজ কাজ নয়। বোটের রান্নাঘরে মুরগি আর গরম ভাতের রান্নায় ব্যস্ত মিজান ভাইয়ের দল। কী যে করি…
– ভাইয়া, কই ছিলেন? চিল্লাইয়া হাঁকাহাঁকি করলাম। উত্তর করলেন না যে!
সামনে দেখি জনা চারেক ছেলের দল দাঁড়িয়ে। উত্তর দেওয়ার আগেই হাত বাড়িয়ে গরম চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। ভোজবাজির মতো বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে আমার গল্প শোনানোর মেজাজ তূরীয় হয়ে উঠল। হেসে বললাম,
– কই ছিলাম আবার? এখানেই। সাম্পানের আশপাশে। যাইহোক দুপুরে বলছিলে না আমার কাছে গল্প শুনতে চাও? তো হবে নাকি গল্প সেশন?
বাধ্য ছাত্রের মতো ওরা বসে পড়ল মেঝেতে। ওদের দেখে এগিয়ে এল আরও বেশ ক’জন। শুরু হল গল্প। হিমালয়ের গল্প। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের গল্প। ওদের নন্দনকাননের গল্প শোনাতে শোনাতে আমিও যেন মার্গারেট লেগির সঙ্গে পথ চলতে শুরু করেছি। তাঁর সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে একটি ব্লু পপি রেখে হিমালয়কে বলছি এবার পথিক থেকে চিরবাসিন্দা করে নাও তোমার বাগানে। গল্পের রেশ ধরেই অনন্ত জলরাশির মাঝে যেন উত্তরের দরজা খুলে গেল। হিমালয় তার জীবন্ত স্বরূপে ধরা দিল আমাদের সকলের সামনে। আমার সামনে বসে থাকা বাঙালি পোলাপানের দলও যেন বিভোর হয়ে বাঁ পাশের খাসি, জয়ন্তীয়া আর গারো পাহাড়শ্রেণীকে হিমালয় জ্ঞানে অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিল। নগাধিরাজকে যে দেখেছে আর যে দেখেনি এই দুই ধরনের মানুষের কাছেই প্রকৃতি তার সম্মোহনের খেলা দেখিয়ে লুকিয়ে পড়ল হাওরের কালো রাতের নিঝুম পর্দার আড়ালে। গল্পসভা ভাঙলে ছেলের দল আমার গল্প বলার কায়দার খুব তারিফ করল। আমি মুচকি হেসে টেকেরঘাটকে বললাম ‘এইটুকু তারিফ আমাকে পেতে দাও। ওদের বলবে না যে বিশ্বপ্রকৃতি এমন করেই তাঁর কথা বলিয়ে নেন। নাহলে মানুষের সাধ্য কী তাঁকে বর্ণনা করে?
রাতের খাবার পরিবেশন করা শুরু হয়েছে। প্রথমেই ডাক পড়ল আমার। কোনও ওজর আপত্তি কানেই তুলল না কেউ। গরম ভাতে সুস্বাদু দেশি মুরগির ঝোল যে কোনও বাঙালিকেই কাবু করবে। আমাকেও করল। সাধ্যমতো উদরপূর্তির পর সাম্পানের মাথায় চড়ে বসলাম। কানে নেকব্যান্ড গুঁজে গান শুনছি। গানের লাইনগুলো আজ যেন বেশি অর্থবহ হয়ে উঠেছে।
“লোকে বলে বলেরে
ঘর বাড়ি ভালা নাই আমার
কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।
লোকে বলে বলেরে
ঘর বাড়ি ভালা নাই আমার।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর,
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।
লোকে বলে বলে রে
ঘর বাড়ি ভালা নাই আমার”
সত্যিই তো তাই। এই যে আমি আমার চেনা ঘরের থেকে কতদূরে আশা ও আশংকা নিয়ে বসে রয়েছি, সে তো মিথ্যা। হাওরের বুকে যে জীবন ভাসছে তা পরের ভোর দেখতে পাবে কিনা জানা নেই। তবু কত অহংকারী আমি। কত পথ পার করলে পথই ঘর হয়ে ওঠে তার খোঁজ আজও পেলাম না। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। স্বর্গীয় জলের স্পর্শে আমার ভিতরের আমিত্ব ধুয়ে যাক। নিজের হাতে ধুয়ে দাও হে প্রকৃতি।

– ভাই, নাইমা আসেন। জেনারেটর বন্ধ করমু।
আলম ভাই ডাকে আমায়। ইচ্ছে ছিল না, তবু দলে থেকে অনুশাসন ভাঙা কাজের কথা নয়। অগত্যা নেমে এসে বোটের কিচেনে কাঠের চৌকির একপ্রান্তে শোওয়ার জায়গা দখল করলাম। বোটের কর্মচারীদের সঙ্গে আমার রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। সামনের হলঘরে সারি দেওয়া বিছানায় ছেলেদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। এমনতর হওয়াটি স্বাভাবিক। দেখতে গেলে ওরাই বোট ভাড়া করেছে। আমি একজন অনাহুত।
– সম্রাট ভাই, খারাপ পায়েন না। এইহানে শুইতে কষ্ট হইব জানি, কিন্তু ভালো বিসনাপত্তর কিসুই খালি নাই। অগো ভাড়া করা জাইগা। অগোরেই দিসি।
আমি হাসন রাজার গানের চারটি লাইন সুর করে গাই।
“জানত যদি হাসন রাজা
বাঁচব কতদিন,
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।
লোকে বলে বলে রে…..…”
জনাব আলম চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই দীর্ঘশ্বাস যে একটু পরেই ঝড়ের রূপ নিয়ে সাম্পানের ধাতব দেওয়ালে মাথা কুটে মরবে তা কি আর জানা ছিল? সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ হয়তো ক্লান্তিতে, কেউ হয়তো আনন্দ ও সুখের আতিশয্যে। শুধু আমার চোখে ঘুম নেই। ইনসমনিয়া হতেও পারে, না-ও পারে। রাত আমার ভাবনার জগতে পায়চারি করবার সময়। তবে আজ সেটি সম্ভব হল না। ঝড়ের তীব্র শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পেলাম আর তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে হাওরের বুকে সদ্য ওঠা তীব্র ঢেউ। ভয় ধরিয়ে দিতে এই দুটিই যথেষ্ট। উঠে বসলাম। অন্ধকারে কান পেতে বাইরে ঘটে চলা তুমুল বিক্ষোভকে অনুভব করবার চেষ্টা করলাম।
– শুইয়া পড়েন। আফাল আইসে। চলব অনেকক্ষণ।
– আফাল? ইস!! একবার যদি চোখের দেখা দেখতে পারতাম।
– হেই চ্যাষ্টাও করবেন না। জানলা-দরজা খোলা মানা।
– কে মানা করল?
– ক্যা? আমিই করসি।
বুঝলাম আলম সাহেবের পাষাণ হৃদয় আফালের ধাক্কায় একফোঁটা নড়বে না।
– আলম ভাই, বোট যে দোলে।
– দুলুক। ইস্টিল বডি। ডুবব না।
কথাটা বলেই আলম সাহেবও উঠে বসে। সিগারেট ধরায়। মুখ থমথমে কিন্তু কথা বলে না। আমিও বিশেষ সুবিধা না করতে পেরে শুয়ে পড়ি।
হাওর অঞ্চলের বন্যার সময় ঝড় উঠলে প্রবল ঢেউ তৈরি হয়। সেই ঢেউয়ের অভিঘাতে জলের সীমানা ছাড়িয়ে আকাশে মুখ তোলা ছোট ছোট খণ্ড জমির পাড় ভাঙতে থাকে দ্রুত। মানুষের ঘর বাড়ি ভাঙতে থাকে এক সময়। শেষ পর্যায়ে আল্লাহ রহমত অথবা ভগবানের কৃপার ওপর নিজেদের টিঁকে থাকার ভার ছেড়ে দেয় হাওরের সব হারানো মানুষগুলো। এরই নাম আফাল। আচ্ছা ওদেরও যদি স্টিল বডির ঘরবাড়ি থাকত? এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। তবে বিপদ শিয়রে এলে এর আগেও দেখেছি আমার ঘুম গাঢ় হয়। দুয়ারে বিপদ নিয়ে তোফা ঘুমের পিরিয়ড শেষ করে যখন চোখ মেলে তাকিয়েছি তখন সকালের আলো সাম্পানের ভিতর আলোকিত করেছে। তবে সেই আলো ফুটফুটে হাঁসের বাচ্চার মতো আদুরে নয়। মনে ভয় ধরানো আলো। খোলা জানালার ওপারে তেজিয়ান বৃষ্টি চোখে পড়ল। সামনেই মিজান ভাই বসে। জানতে চাইলাম,
– বৃষ্টি থামেনি? শিমুলতলায় যাওয়া হবে না?
– আর শিমুলতলা!! ভালায় ভালায় সুনামগঞ্জের ঘাটে ফিরি। আল্লাহ রহমত।
বাকিদের খোঁজ করি। জানতে পারি টেকেরঘাটের থেকে যেদিকে আজ মোটরবাইকের সওয়ারি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকজন চেষ্টা করেছিল ঠিকই, কিন্তু হাওরের জল ওদিকের সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ওরা ফিরে আসছে। এমন খবরে মনখারাপ হওয়া উচিত অথচ আমার মধ্যে তেমন কিছুই হচ্ছে না। দীর্ঘদিন একা ভ্রমণ করবার সুফল পাচ্ছি। আমার কোনও গন্তব্য নেই। যতটুকু পৌঁছলাম ততটুকুই আমার পরম প্রাপ্তি। ফ্রেশ হয়ে উঠে এলাম বোটের ছাদে। গায়ে নীলরঙা রেইন কোট আমাকে সাহসী করে তুলেছে। ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা বাজলেও দেখে মনে হবে ভোর পাঁচটা। জলের রং বদলেছে। বুঝতে পারলাম গতরাতের অঝোর ধারা টাঙ্গুয়ার হাওরকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর সুন্দর করে তুলেছে। এমন রূপে হাওর জীবনকে দেখার অভিজ্ঞতাও যে সবার হয় না। জীবনকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় কোথায়?
বোট ছাড়ল সকাল ন’টায়। জলখাবার শেষ করে নতুন উদ্যমে আমরা চলেছি ওয়াচ টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। ঘণ্টা দুয়েক সময় খরচ হবে। তবে সমস্যা নেই। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে। দূরের মেঘালয় পাহাড়কে ধীরে ধীরে দিকচক্রবালে হারিয়ে যেতে দেখছি। ভেজা ভেজা ভাব হাওরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। উঁচু উঁচু কান্দাবন এখন সম্পূর্ণভাবে জলের তলায়। বাড়ি ঘরের পাশ কাটিয়ে সাম্পান যখন এগোচ্ছে তখন চোখে পড়ল বাসিন্দাদের ব্যস্ততা। সেই ব্যস্ততায় রয়েছে প্রকৃতি বনাম মানুষের অসমসাহসী লড়াইয়ের টাটকা ছবি। আকাশের মতো আমারও মন ভার হয়। এরা কত কাছে তবু কত দূরে। ওই জীবনকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় না। তাঁর জন্য প্রয়োজন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের গভীর অধ্যাবসায়। আমার এমন মানসিক গড়নের যে বড় অভাব। বোটের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পার হয়ে গেলাম অসুখের মহামারীতে অভ্যস্ত মানবজমিন। সামনে এখন শুধু অকূল জলরাশি। কূল নেই। নেই কোনও টুকরো জমি যেখানে এক দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যায়। হৃদয় এখানে অলকানন্দায় নয়, ভেসে যায় হাওরের জলে।
এরপর ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছে কী দেখলাম তার হিসেব দেব পরবর্তী ও অন্তিম পর্বে। ফিরে আসার পথটুকু কি নির্বিঘ্নে শেষ করেছিলাম? শেষ বলা ভুল হল। বলা ভালো নতুন করে শুরু করার মতো কিছু দুর্লভ ক্ষণ কি সাজানো হয়েছিল আমার অজ্ঞাতে? জানবার জন্য আর মাত্র একটি পর্বের ধৈর্য ভিক্ষা করছি পাঠকের কাছে। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: লেখক
সম্রাট মৌলিক পেশাদার কর্পোরেট জগতকে বিদায় জানিয়ে কাজ করছেন নদীর সঙ্গে। জল ও নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঘুরে দেখছেন ভারত-সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নদীব্যবস্থা, জানছেন ব্যবহারযোগ্য জলের সুষম বন্টনের পরিস্থিতি। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও রাশিয়া- পাঁচটি দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার একা ভ্রমণ করেছেন দু চাকায় সওয়ার হয়ে। এছাড়াও প্রায় দু দশক ধরে হেঁটেছেন অনেক শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম,অজানা পাহাড় ও জঙ্গল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের স্নাতক সম্রাটের শখ প্রজাপতি ও পোকামাকড়ের ছবি তোলা। প্রথম প্রকাশিত বই 'দাগ'।