Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

দিনের পরে দিন: সংবাদজগতের উত্তমকুমার

আলপনা ঘোষ

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১

Barun Sengupta
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে আমার দেখা সংবাদ দুনিয়ার এক উজ্জ্বল তারকার কথাই আজ বলব। তিনি, দীর্ঘদেহী, সুদর্শন, সুভদ্র, সদালাপী, রাজ্য-রাজনীতি সংক্রান্ত অজানা সব তথ্যের সন্ধানী দাপুটে সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত! তাঁর বয়স তখন ত্রিশের কোঠায়!

এখনও মনে পড়ে‒ লাল রঙের বুশ-শার্ট পরে ঠোঁটে পাইপ ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন বরুণবাবু! কথা বলতেন গমগমে গলায়। সব মিলিয়ে কোথায় যেন এক নায়কোচিত ভাব। ওঁর জনপ্রিয়তাও তখন তুঙ্গে। আনন্দবাজার পত্রিকায় যেদিন বরুণ সেনগুপ্তর কলাম বেরুত, শুনেছি সেদিন নাকি কাগজের বিক্রি দ্বিগুণ বেড়ে যেত! লিখতেন অতি সহজ সরল ভাষায়। লেখার গুণে বরুণবাবু তাঁর ‘রাজ্য ও রাজনীতি’ কলমকে পৌঁছে দিয়েছিলেন গৃহস্থের অন্দরমহলে। এই সবকিছু মিলিয়ে শুধু পাঠক নয়, তাঁর সহকর্মীদের কাছেও বরুণবাবু হয়ে উঠেছিলেন সংবাদ জগতের ‘উত্তমকুমার’।  


[the_ad id=”266918″]



একবার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে বরুণ সেনগুপ্তকে দেখার জন্য উপচে পড়া ভিড় আমারই নিজের চোখে দেখা। সেদিনকার অনুষ্ঠানে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিষয়ে বক্তৃতা দেবেন। ভিড়ে হল প্রায় উপচে পড়ছে
দর্শকের মধ্যে অবশ্য মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। প্রথম বক্তা বরুণ সেনগুপ্ত। মঞ্চে উঠতেই মেয়েরা করতালি দিয়ে উঠল আর ওঁর বক্তৃতা শেষ হতেই ইন্সটিটিউট হল ফাঁকা।      

Barun Sengupta
সংবাদজগতের উত্তমকুমার

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি বরুণবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয়। প্রথমদিনের কথা আজও ভুলিনি। দৈনিক বসুমতীতে তখন আমি শিক্ষানবিশ। সেই প্রথম রাইটার্সের প্রেস কর্নারে। সঙ্গে আমার কাগজের প্রবীণ সাংবাদিক কুমুদ দাশগুপ্ত। কুমুদদা আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন ওঁর সঙ্গে। উপস্থিত রিপোর্টারদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন, একটু চোখ চাওয়া-চাওয়ি।

সেই সময় সাংবাদিকতায় এখনকার মতো মেয়েদের ভিড় ছিল না। কলকাতায় তো নয়ই। পিটিআইয়ের প্রবীণ সাংবাদিক সুধীর চক্রবর্তী হাসিমুখে আমাকে ডেকে ওঁর পাশে বসিয়েছিলেন সেদিনঅন্য পাশে বসেছিলেন বরুণ সেনগুপ্ত।  তিনি বসে বসে একটি ডায়েরি খুলে কী যেন সব লিখছিলেন। আমি গিয়ে ওঁর পাশে বসতে মুখ তুলে আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাসলেন। ব্যস ওই পর্যন্ত। মুখ নিচু করে আবার নিজের কাজে মন দিলেন।

রাইটার্সে যেতে যেতে অনেকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল। অমৃতবাজার পত্রিকার অসীম সেন,   স্টেটসম্যানের ভবানী চৌধুরী, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সোমেন মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। বরুণবাবুও ততদিনে আমাকে তাঁর পরিচিত গণ্ডিতে প্রবেশাধিকার দিয়েছেন।


[the_ad id=”266919″]



এমনিতে হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ হলেও লক্ষ করেছি, যেদিন মাথায় কোনও বিশেষ খবর নিয়ে ভাবনা থাকত, সেদিন একেবারে অন্য মানুষ। মুখে কথা নেই। প্রেস কর্নারের একদিকে বসে নোটবুক খুলে কিছু একটা লিখছেন বা আঁকিবুকি কাটছেন।
আবার হাতে যেদিন কাজ কম, সেদিন দেখেছি তাঁকে অন্য রূপে। কখনও হাসিঠাট্টা করছেন, কখনও বা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। তবে খবরের কাগজের আড্ডা তো! কোন কাগজ কোন খবরে মার খেল, কোন মন্ত্রী দলবদলের কথা ভাবছেন, কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের কী নিয়ে কাজিয়া শুরু হতে চলেছে‒ সেসব নিয়েই কথা হত। 

Barun Sengupta
চোখে ভাসে বুশ-শার্ট পরে ঠোঁটে পাইপ ঝুলিয়ে কাজ করছেন বরুণবাবু

মনমেজাজ ভাল থাকলে সহকর্মীদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করতেন বরুণবাবু। বড় ছোট কেউ বাদ যেতেন না। পিটিআইয়ের সুধীর চক্রবর্তী ছিলেন বয়সে প্রবীণ‒ সবাইয়ের সুধীরদা। তাঁর নস্যি নেওয়ার বদভ্যেস ছিল। তাই নিয়ে বরুণবাবু ভদ্রলোকের এমন পিছনে লাগতেন এক একদিন, যে উপস্থিত সবাই হেসে কুটোপাটি হত। কিন্তু ওঁর সেই হাসি-ঠাট্টার মধ্যে কোন অসূয়া বা হেয় করার উদ্দেশ্য থাকত না। তাই কারও মনে লাগত না। সুধীরদাও হাসতেন। কখনও রেগে যেতেন না। আমি নিজেও বাদ যাইনি বরুণবাবুর কৌতুকের নিশানা থেকে।  

রাইটার্সের প্রেস কর্নারে তখন আমার নিয়মিত আসা যাওয়া। লবঙ্গ খেতে ভালবাসতাম। আমার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের সাইড পকেটে একটা কৌটোতে তাই লবঙ্গ রেখে দিতাম। প্রেস কর্নারে বসে সে কৌটো খুললেই যাঁরা এসে হাত পাততেন, তাঁদের মধ্যে বরুণবাবুও থাকতেন। ঠাট্টা করে আমার নাম দিয়েছিলেন ‘লবঙ্গলতিকা’। বয়স অল্প ছিল। খুব রাগ করতাম আমি। আর সেই রাগ দেখে বরুণবাবু হাসতেন। 


[the_ad id=”270084″]



স্বাস্থ্যগত কারণে আমার প্রত্যক্ষ সাংবাদিকতার পাট চুকলেও, স্বামী শংকর ঘোষের সূত্রে সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে একটা যোগাযোগ থেকেই গিয়েছিল। স্কুলে পড়াবার পাশাপাশি ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’-এ আমার লেখাজোকা বরুণবাবুর উৎসাহেই শুরু করেছিলাম। শুধু রান্নাবান্না নয়, অন্য নানা বিষয়ে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন তিনি। উৎসাহ দিয়েছেন লেখালিখি চালিয়ে যেতে। মনে পড়ছে কোনও একটা নির্বাচনের আগে শংকর ঘোষ, স্টেটসম্যানের ফণী চক্রবর্তী আর বরুণবাবু ঠিক করলেন একটা রোববারে তাঁরা নদিয়ায় যাবেন সেখানকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। 

স্থির হল বরুণবাবু আনন্দবাজারের গাড়ি নেবেনওঁরই উৎসাহে আমিও সঙ্গ নিলাম। তখন সবে আমার রান্নায় হাতেখড়ি হয়েছে। শীতকাল। ভোর ভোর বেরুতে হবে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। আমি জানিয়ে দিলাম খাবারের দায়িত্ব আমার। খুব উৎসাহ করে সকালে খাবার জন্য স্যান্ডউইচ, ডিমসেদ্ধ, নলেন গুড়ের কড়াপাকের সন্দেশ আর কমলালেবু নিলাম। সঙ্গে মস্ত ফ্লাস্কে গরম কফি। দুপুরের জন্য লুচি, ঘন ছোলার ডাল আর আলুরদম। শেষ পাতে নলেন গুড়ের পায়েস। কথামতো ভোর ভোর বেরুনো হল। কলকাতা পেরতেই গাড়ি থামিয়ে পথের ধারে কফি আর আমার আনা খাবার দিয়ে প্রাতঃরাশ সারা হল।


[the_ad id=”270085″]



মাঝপথে বিধি বাম। বরুণবাবুর গাড়ির টায়ার পাংচার। কোম্পানির গাড়ি। স্টেপনির হালও যে ঠিক নেই, সেটা বরুণবাবুর জানা ছিল না। প্রায় এক ক্রোশ দূরের এক মিস্ত্রির কাছ থেকে চালকমশাই দুটো চাকাই সারিয়ে আনলেন। সে সময়টা তিন সাংবাদিক কাটালেন কাছের এক চায়ের ঠেকে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খেয়ে আর ভোটের আলোচনা করে। আমি নীরব শ্রোতা। গাড়ি চালু হতে আবার এগিয়ে চলা। পথে  বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় দফতরে ঢুকে নেতা এবং সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা। কখনও আবার গাড়ি থামিয়ে গ্রামবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা। সব জায়গাতেই লক্ষ করলাম, বরুণ সেনগুপ্তর নাম গ্রামেগঞ্জেও বিশেষ পরিচিত। ওঁর পরিচয় পেতেই সবাই আগ্রহী কথা বলতে। বরুণবাবুর দৌলতে অন্য দুই সাংবাদিকেরও গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে সুবিধেই হল। এখানেও সেই বরুণ সেনগুপ্ত ম্যাজিক নিঃসন্দেহে কাজে লেগেছিল। কাজ শেষ হতে বেলা প্রায় তিনটে বাজল। তার পরে লুচি, আলুরদম ও পায়েস দিয়ে পিকনিক।

Barun Sengupta
ফোটোগ্রাফার বরুণবাবু

বরুণ সেনগুপ্ত আনন্দবাজার পত্রিকায় কর্মরত থাকাকালীন ওঁর দফতর সপ্তপর্ণী আবাসনে একটি মস্ত ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। আমরা তখন ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। হঠাৎ বরুণবাবু ওই ফ্ল্যাটে এলেন আমাদের প্রতিবেশী হয়ে। সে সময়ে প্রায় প্রতি রোববার আমাদের বাড়িতে এসে নিয়মিত গল্পগুজব করতেন। বিকেলের চা আমরা একসঙ্গে খেতাম। পুত্র আনন্দরূপ তখন বছর পাঁচেকের। বরুণবাবুর সে সময়ে ছবি তোলার নেশা। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে কোনও কোনওদিন সকালে চলে আসতেন আর আমার আর পুত্রের প্রচুর ছবি তুলতেন। সাদা-কালো অথবা রঙিন। মাঝে মাঝে শংকরবাবুও রেহাই পেতেন না। আজও সেসব ছবি আমার অ্যালবামে সযত্নে রাখা আছে। 

আমার পুত্রের প্রতি বরুণবাবুর একটা অদ্ভুত টান ছিল। সেও তার বরুণকাকুকে বড় ভালবাসত। একবার নবর্ষের দিন সে উপহার পেল সত্যজিৎ রায়ের মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প। বইয়ের প্রথম পাতায় লিখে দিয়েছিলেন‒ আনন্দকে বরুণকাকা – ১ বৈশাখ ১৩৯২। বরুণবাবুর ইচ্ছে ছিল, লেখাপড়া শেষ করে আনন্দরূপ ‘বর্তমান’ কাগজে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিক। অর্থনীতিতে মাস্টার্স করতে আনন্দ জেএনইউ-তে গেলপড়া শেষ হলে দিল্লিতে লিনটাস কোম্পানিতে শুরু করল তার কর্মজীবনবরুণবাবু কিন্তু খুশি হয়েছিলেন এ খবরে। ওঁর ইচ্ছে পূরণ হয়নি বলে মনে কিন্তু কোনও ক্ষোভ রাখেননি তিনি।   

Barun Sengupta
বর্তমান ভবন

সেই ষাটের দশক থেকে দেখেছি বরুণ সেনগুপ্ত ও শংকর ঘোষের মধ্যে এক অসম বন্ধুত্বের সম্পর্ক। যুক্তফ্রন্টের সময় প্রায় রোজই নতুন নতুন খবর। প্রেস কর্নারে রিপোর্টারদের গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে লক্ষ্য করেছি শংকর ঘোষ ও বরুণ সেনগুপ্তকে একটু আলাদা হয়ে বসতে, কোন গূঢ় বিষয় নিয়ে নিভৃত আলাপে মগ্ন থাকতে। দু’জনের মধ্যে যে শুধু বয়সের ফারাক ছিল তাই নয়, রাজনৈতিক মতামত, কাজের ধরন ইত্যাদি নিয়ে ওঁদের মধ্যে কিন্তু মিলের থেকে অমিল ছিল বেশি। অথচ সব ছাপিয়ে এই অনুজ সাংবাদিকটির সঙ্গে শংকরের ছিল এক আন্তরিক সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক। কাজের ব্যাপারে একটা আস্থা ছিল পরস্পরের প্রতি। প্রায় রোজই দিনের খবর নিয়ে আলোচনা হত দু’জনের মধ্যে। প্রয়োজন হলে দু’জনে একসঙ্গে একই সংবাদসূত্রের কাছে যেতেন। এসব কথা শংকর ঘোষ তাঁর ‘খবরের অন্তরালে খবর’ গ্রন্থে লিখে গেছেন। 

Barun Sengupta
কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানে হাতির পিঠে বরুণবাবু ও শংকর ঘোষ (ডানদিকে)

বরুণ সেনগুপ্তর চরিত্রে একটা দৃঢ়তা ছিল। তার পরিচয় পেয়েছিলাম দূরদর্শনে অনুষ্ঠিত একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তখন ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকাল। দূরদর্শনের কোনও একটা রাজনৈতিক পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে শংকর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত এবং আরও এক সাংবাদিক আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আলোচনা চলাকালীন শংকর ঘোষ এবং বরুণ সেনগুপ্ত দু’জনেই কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু কার্যকলাপের কড়া সমালোচনা করেন। অনুষ্ঠানটি যেদিন প্রচারিত হল, দেখা গেল ওঁদের দু’জনের সেই বিরুদ্ধ আলোচনার অংশটি পুরো ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনায় দু’জনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। বরুণবাবু স্থির করেছিলেন যে আর কোনওদিন তিনি দূরদর্শনের কোনও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না।


[the_ad id=”270086″]



জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বারবার কলম ধরেছেন বরুণবাবু। তারই জেরে তিনি নয়াদিল্লিতে মিসায় আটক হন। প্রায় ন’মাস এই রাজ্যের বিভিন্ন জেলে তাঁকে আটক থাকতে  হয়েছিল
। সরকারের পক্ষ থেকে আলিপুর জেলের মিসডেমিনার সেলে একেবারে একা, নিঃসঙ্গ রেখে চেষ্টা করা হয়েছিল ওঁর মনোবল ভেঙে দেওয়ার। সে চেষ্টা অবশ্যই সফল হয়নি। মুক্তি পাওয়ার পরেই তিনি তাঁর তৎকালীন কর্মক্ষেত্র আনন্দবাজার পত্রিকার দফতরে হাজির। মুখে একগাল হাসি। যেন কিছুই হয়নি। কে বলবে গত কয়েক মাস তিনি জেলে বন্দি ছিলেন!

১৯ জুন, ২০০৮। বেশ রাত তখন। বর্তমান অফিস থেকে ফোন। আলপনাদি, বরুণদা নেই আজ সন্ধ্যেয় চলে গেলেন। হতবাক আমি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। এইতো ক’দিন আগে শুভার সঙ্গে কথা হল। শংকর ঘোষের অসুস্থতার খবর কীভাবে যেন পৌঁছে গিয়েছিল বরুণবাবুর কাছে। বোন শুভাকে বলেছিলেন ফোন করে খোঁজ নিতে। তখনই সে জানিয়েছিল তার মেজদাও ভাল নেই। অবাক হয়েছিলাম সে খবরে।

Barun Sengupta
বরুণবাবুর তোলা আমাদের পারিবারিক ছবি

ক’দিন আগেই তো বর্তমান কাগজের সম্পাদকীয় পাতায় ওঁর লেখা পড়েছি। শুভা বলল কোনওরকমে ডিকটেশন নিয়ে লেখাটি বের করা হয়েছে। অত অসুস্থ অবস্থায় লেখা ওই প্রবন্ধেও কিন্তু গুণগত মানের এতটুকু ঘাটতি ছিল না। তাই বোধ হয় বুঝতেও পারিনি ওঁর অন্তিম সময় এত কাছে! আমার কাছে প্রায় অপ্রত্যাশিত ছিল এই দুঃসংবাদ। মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল।    

বরুণবাবু সম্বন্ধে লিখতে বসে নানা স্মৃতি ভিড় করে আসছে। খেতে ভালবাসতেন যেমন, তেমনি খাওয়াতেও ভালবাসতেন বরুণবাবু। বর্তমান কাগজের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক হয়েও অধীনস্থ কর্মীদের সঙ্গে সমান ভাবে মিশতেন। মনে পড়ে যাচ্ছে একটি ব্যক্তিগত ঘটনার কথা। ওঁর পরিহাস-প্রিয় স্বভাবের কথা আগেও উল্লেখ করেছি। শংকর ঘোষকেও ছাড় দিতেন না। একবার  তো উল্টোপাল্টা কাণ্ড করে বেশ জ্বালিয়েছিলেন আমাকে।

শংকর মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে। পোশাকের প্রতিও বিশেষ নজর ছিল না। ওঁর ঘরণী হয়ে আসার পরে আমার মনে হল ওঁর জন্য কিছু জামাকাপড় কেনা প্রয়োজন। লেক রোডে তখন আমাদের বাস। সাউথ পয়েন্ট স্কুলে আমি ২৭৫ টাকা মাইনের শিক্ষিকা। বিয়ের পরে প্রথম মাসের  মাইনে হাতে পেয়েই ছুটে গেলাম ট্রাঙ্গুলার পার্কের ঠিক উলটো দিকে আশা ব্রাদার্সে। পোশাকের মস্ত দোকানতখন লিবার্টি কোম্পানির শার্টের খুব নামডাক! গোটা ছয়েক শার্ট কিনে বাড়ি ফিরলাম। যতদূর মনে পড়ে এক একটি শার্টের দাম পড়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে। সাতের দশকের তুলনায় বেশ দামিই ছিল শার্টগুলি। অফিস থেকে রাতে বাড়ি ফিরলে কর্তামশাইকে শার্ট দেখাতে মুখ গম্ভীর। চিরদিনই মিতব্যয়ী প্রকৃতির মানুষ। প্রথম প্রশ্নবাণ,কত দাম? আমি প্রস্তুত ছিলাম। চোখের পলক না ফেলে আমার উত্তর, খুব সস্তা। মাত্র ১৫ টাকা।


[the_ad id=”270088″]



পরের দিন আমার অনেক অনুরোধ উপরোধে নতুন শার্ট পরে অফিস গেলেন শংকর।
রাইটার্সের প্রেস কর্নারে ঢুকতেই গুঞ্জন শুরু হল।কী ব্যাপার, শংকরবাবু আজ এত দামি শার্ট পরেছেন! বরুণবাবুদের জানা ছিল, দামি জামাকাপড় পরা, হোটেল-রেস্তরাঁয় খাওয়া ইত্যাদিকে শংকর ঘোষ বেজায় অপচয় বলে মনে করেন। ওঁর ব্যক্তিত্বের জন্য অন্যরা ওঁর সঙ্গে পরিহাস করতে সাহস না পেলেও, বরুণবাবু সেই দলে  পড়তেন না। বলে উঠলেন‒ ‘কী ব্যাপার, শংকরবাবু? নতুন শার্ট মনে হচ্ছে! কে কিনে দিল, আলপনা বুঝি?’ অপ্রস্তুত শংকরবাবু একটু লাজুক হেসে মাথা নাড়লেন। 

এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু বরুণবাবু তো ওখানে থেমে যাবার পাত্র নন। ‘শার্টটার দাম জানেন? বেশ দামি কিন্তু।’ এবারে বেশ বিরক্ত শংকর ঘোষের জবাব, ‘দামি নয়তো! মাত্র ১৫ টাকা দিয়ে আলপনা কিনে এনেছে।’ ওঁর উত্তরে বরুণবাবু সশব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘কী বলছেন,শংকরবাবু? এ শার্টের দাম কম করে ৪০/ ৪৫ টাকা তো হবেই।’ রাতে যখন কর্তা বাড়ি ফিরলেন, মুখ গম্ভীর। একটি কথাও বললেন না সে রাতে। আমিও ওঁকে ঘাঁটালাম না। ইতিমধ্যে সন্ধ্যেতেই বরুণবাবু ফোন করে ওঁর কীর্তির কথা জানিয়েছিলেন আমাকে। খুব বকুনি দিয়েছিলাম ওঁকে, তবে পুরো ঘটনার সরস বিবরণ শুনে না হেসেও পারিনি।  

Author Alpana Ghosh

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

Picture of আলপনা ঘোষ

আলপনা ঘোষ

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।
Picture of আলপনা ঘোষ

আলপনা ঘোষ

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

16 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস