‘সব কিছু থেকে একটু একটু করে নিয়েই হয়েছে বাউল’,– বলেন বাউল সাধকরা। তা তো বটেই। তন্ত্রের শক্তিতত্ত্ব, সহজিয়া বৈষ্ণবদের রাধাকৃষ্ণবাদ, সুফিদের আল্লাতত্ত্ব,– এইসব জ্ঞাতসারে নিয়েই তৈরি হয়েছে বাউলের ধর্ম। অলৌকিকত্বে নয়, বাস্তবের দেহকে ঘিরেই তাঁদের সাধনার জগত। দেহকেন্দ্রিক সাধনায় ‘লোহা যেমন পরশ-পরশে/ মানুষের করণ তেমনি সে।’ দেহ তাঁদের কাছে মন্দির। সেই মন্দিরের ভেতরে প্রায়-অধরা হয়ে আছে পরমবস্তু। ‘মোকামের মধ্যে মোকাম/ শূন্য শিখর বলি যার নাম,/ লণ্ঠনের আলোয় দীপ্ত সে ধাম,/ ও সে ত্রিভুবনে কিরণ দেয়।।’ সেই ঘরে ‘চাঁদে চাঁদে গ্রহণ’ হয়। সাধুকথায়, মহাযোগ না এলে সেই পরমের সঙ্গে মিলন ঘটে না। ‘অমাবস্যায় পূর্ণিমা হয়,/ মহাযোগের সেই সময়।’
এসব হচ্ছে বাউল-ফকিরদের সাধনদেশের গূঢ় কথা। ‘জানে রসিক যারা’। এই সাধনার পথে যাবার মন করলে আগে যেতে হবে গুরুর কাছে। গুরুর কাছে শিক্ষা নিতে গেলে কোনও ফাঁকিজুকি চলবে না। তাঁর কাছে আগে মনোশিক্ষার পাঠ নিতে হয়। মনকে বাগাতে না পারলে অধরচাঁদের খোঁজ যে পাওয়া যাবে না, এ সাবধানীবাণী বাউলের গানে পইপই করে বলা আছে।
নিগূঢ় তত্তের বাঁধন নিয়ে বাউল সাধনকথা একটা চারিদিক বাঁধানো পুকুরের মতো। গুরুর কাছে মনোশিক্ষার পাঠ নেওয়া শেষ হলে সাধক গুরুর নির্দেশে সেই পুকুরে ডুব দিয়ে পরমবস্তুর সন্ধান করবেন। শেষে তাঁদের সেই মূলে পৌঁছনো হল কিনা, ফেল মারলেন কিনা, সেসব তাঁদের কপালের ব্যাপার। ‘ডুব না জেনে ডুবতে চাও রে মন/ আরও ভেসে উঠে কলাগাছ যেমন।’ দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, মানুষতত্ত্বের বিস্তর গানে বস্তুবাদী দর্শনের পাট বিছানো। কিন্তু আমরা জেনেছি কায়া-দর্শনেই সম্পৃক্ত হয়ে আছে অন্য এক দর্শন, যা অধ্যাত্মলোকে উত্তরণ ঘটায়। কে জানালেন এমন কথা? কেন? লালন ফকিরই তো গানে গানে বিস্তর সূত্র রেখে গেছেন। তাঁর মনসৃজিত উড়ানই তাঁকে আত্মানুসন্ধানের গভীরে টেনে নিয়ে গেছে।

ওই যে বলছিলাম, মনকে আগে বাগে আনতে হবে! এই ‘মন’ই তাঁকে ক্রমশ চেতন-স্তরে উন্নীত করে এক অতল প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছে,– ”আমার মধ্যে ‘আমি’ কে? সেই আমিকে চিনব কী করে!” এই আত্মজনকে খুঁজে ফেরার কথাই ধরা আছে তাঁর অধ্যাত্মসাধনের গানে। ‘আপনাকে আপনি চেনা/ সেই বটে উপাসনা/ লালন কয় আলেক চেনা/ হলে হয় তার দিশে।।’ বলছেন, ‘হাদিশে লেখেছে প্রমাণ/ আপনারে আপনি গে জান/ কী রূপে সে কোথা থেকে কহিছে জোরান।’ গানের মধ্যে দিয়েই বলতে চেয়েছেন আগে নিজেকে চেনো, জানো, নিজের মনটাকে খুঁড়ে বাইরের ‘আমি’র মুখোমুখি কর, তবেই জাগরণ ঘটবে। ‘আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে/ দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে/ কুবৃক্ষে সুফল পেয়েছে/ আমার মনের ঘোর গেল না।।’
‘মনের মানুষ’, ‘অচিন মানুষ’, ‘অটল মানুষ’, ‘সোনার মানুষ’– বাউলের পরমাত্মার নানা সোহাগের নাম। লালনের গানে দেখি, ‘আছে দিন দুনিয়ায় অচিন মানুষ একজনা/ কাজের বেলায় পরশমণি/ আর সে মাত্র কেউ চেনে না।।/ নবি আলি এ দুজনে/ কলমাদাতা দল আর ফিনে/ বেকলমায় সে অচিন জনে পীরের পীর হয় জান না।।’ ‘আমার মনের মানুষের সনে/মিলন হবে কত দিনে।।’ এই মনের মানুষ দেহতত্বের বাঁধনে থাকে, সাধকের কাছে তার স্থান মণিমহলে– ‘চাঁদ-চকোরে রঙমহল ঘরে/ থেকে থেকে ঝলক দিচ্ছে সদায়।/ দেখলে সেই চাঁদ সফল হয় না,/ আত্মতত্ব ঢ়ুঁড়ে দেখ না হৃদয়।।’ এ-ও লালনের পদ। কিন্তু লালন তো কোনও বন্ধনীর মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি। তাঁর ভাবজগতে চলত অন্য খেলা।
নিজেকে খোঁজা, ‘মনের মধ্যে মনের মানুষ’কে খুঁজে না-পাওয়ার দহন তাঁকে ব্যাকুল করে রাখত। খেদ করেছেন গানের পদে পদে। ‘কে কথা কয় রে দেখা দেয় না/ নড়েচড়ে হাতের কাছে/ খুঁজলে জনমভর মেলে না।/ খুঁজি তারে আসমান জমিন/ আমারে চিনিনে আমি/ এত বিষম ভুলে ভ্রমি/ আমি কোনজন/ সে কোনজনা।।’ হাহাকার করে বলছেন, ‘আমি আমি বলি আমি কোনজনা/ মরি কী আজব কারখানা/ এবার শুনে পড়ে কিছুই ঠাওর নাহি হয়।’ এই অন্তরদীপনই তাঁকে উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক জগতে অধিষটিত করেছে।
রবীন্দ্রনাথ বাউলের এই ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের সঙ্গে উপনিষদের আত্মতত্ত্বের বার্তার সাদশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ‘হারামণি’-র (বাউলগানের সংকলন) পঞ্চম খণ্ডে ১৩৩৪ সনে তিনি ‘আশীর্বাদ’-এ লিখেছেন, ‘আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হত।’ তারও কত আগে নবীন বয়সে কলকাতায় শিলাইদহ অঞ্চলের এক বাউলের কণ্ঠে শুনেছিলেন, ‘কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে।/ হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে/ দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।।’ তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁকে গানের কলিগুলি প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। মনে গেঁথে যাওয়া সেই গানটির উল্লেখ করে লিখছেন, ‘”এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে, “পুং বেদ্যং পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণ-বেদনা।” অপণ্ডিতের মুখে এই কথাটিই শুনলুম, তার গেঁয়ো সুরে, সহজ ভাষায় যাঁকে সকলের চেয়ে জানবার তাঁকেই সকলের চেয়ে না জানবার বেদনা– অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু তারই কান্নার সুর– তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। “অন্তরতম হৃদয়মাত্মা” উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন “মনের মানুষ” বলে শুনলুম, আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল।”

ভাবুক লালন। চিন্তক লালন। আত্মানুসন্ধানী লালন। এই মানুষটি গানের কলিতে কলিতে বুঝিয়ে গেছেন বাউলের ধর্মের সঙ্গে মিশে আছে সূক্ষ্ণ অনুভূতির স্তর। সেই অনুভূতির চর্চা চলে মানসিকভাবে। এটিই সাধনার প্রথম শর্ত। বাউল ধর্মে এই মানসিক উত্তরণই হচ্ছে অন্দরে প্রবেশের মূল ফটক। লালনের অনুভবী গান তেমনটাই তো জানাচ্ছে। লালন খেদ করে বলছেন, ‘মনেরে বুঝাতে আমার হল দিন আখেরী/ বোঝে না মন আপন মরণ, এ কী অবিচারী।।‘ ‘আমার আপন খবর আপনার হয় না।/ একবার চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।।’ ‘আপনারে আপনি না চিনিলে/ ঘুরবি কত ভুবনে,/ লালন বলে অন্তিম কালে/ নাই রে উপায়।।’
লালন ভাবের গভীরে ডুব দিয়ে অতলে খুঁজেছেন ভাবের মানুষকে। না-পাওয়ার বেদনায় জর্জরিত হয়েছেন, কিংবা, আর এক ‘আমি’কে পেয়েও বিরহকে সঙ্গে রেখেছেন। আবার রবীন্দ্রনাথে ফিরি। “মানুষ এমনই করেই তো আপনার মনের মানুষের সন্ধান করছে– এমনি করেই তো তার দুঃসাধ্য সাধনার ভিতর দিয়েই যুগে যুগে সেই মনের মানুষ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে; যতই তাকে পাচ্ছে ততই বলছে ‘আমি কোথায় পাব তারে?’ সেই মনের মানুষকে নিয়ে মানুষের মিলন বিচ্ছেদ একাধারেই; তাঁকে পাওয়ার মধ্যেই তাঁকে না-পাওয়া।”(শান্তিনিকেতন ১৩২০ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্ররচনাবলী খণ্ড ১৪) আত্মজ্ঞানী লালন তাঁর গানে বলছেন, ‘আমার হয় না রে যে মনের মত মন।/ আমি জানব কি সে রাগের করণ।।’
শিষ্যদল, পরিভ্রমণ, নানা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, সামাজিক কর্তব্য করা তাঁর সাধন-জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। তবুও লালন ছিলেন একা। উদাসী। মনের মধ্যে এক নিঃশব্দের কুঁড়েতে তাঁর একার যাপন ছিল। সেখানে ‘সে আর লালন’ ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা খেলতেন। এটাই লালনকে আধ্যাত্মিক স্তরে অধিষ্টিত করেছিল। সেই ভাবজগতের ভাবের মানুষটি দেহাত্মবাদের পাশাপাশি অধ্যাত্মবাদের সংলগ্নতা জানিয়ে গেছেন গানে গানে।
*ছবি সৌজন্য: Saatchiart, Pixels, Foundmyself
লীনা চাকী সুপরিচিত লোকসংস্কৃতি গবেষক ও লেখিকা। "বাউলের চরণদাসী", "বাংলার বাউলানি", "মৃত্তিকার গান", "মহাকুম্ভে সাধুসঙ্গে" প্রভৃতি বহু বইয়ের রচয়িতা৷ একদা সাংবাদিকতাও করেছেন।