আমাদের কলেজের এক অপূর্ব সুন্দরী ছিল পরমিন্দর কাউর। পরমিন্দরের বাড়িতে যারা কখনও-সখনও যেতে পারত, তাদের মুখে শুনেছি তার দিদি, যে আমাদের কলেজে পড়ত না, রভিন্দর কাউর আরও সুন্দরী। কিন্তু সুন্দরী রবীন্দ্রনাথ দেখার কালচারাল শক সহ্য করতে পারব না বলে আমি আর ও রাস্তা মাড়াইনি। তাছাড়া গলিই এত মনোরম ছিল যে রাস্তার কথা সবসময় মনেও আসত না।
তা এই পরমিন্দরকে স্বপ্নে দেখছি। সব স্বপ্নই পরে ভোরে দেখেছি বলে মনে হলেও এটা সত্যি সত্যি ভোরবেলার ঘটনা। এমন সময় জোলাপ খাওয়া ঘোড়ার মতো ফোনটা বেজে উঠল। নীল রঙের নাইটি পরা পরমিন্দর আদুরে গলায় তখন আমায় বলছে– “চাউমিন খাওয়াতে নিয়ে যাবে গো? ভীষণ ইচ্ছে করছে। শস্তার হোটেল হলেও হবে” (কেন শস্তার হোটেল? আমি স্বপ্নেও গরিব নাকি?) আমার তো আরও কত কিছু ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ফোন। জড়ানো গলায় বললাম- হ্যাঁ।
ওপাশ থেকে একটা হেঁড়ে গলায বলে উঠল- না (পড়ুন কুত্তা)
এক ঝটকায় আমার ঘুম পরমিন্দর পার হয়ে দিলওয়ালে দুলহানিয়া পার হয়ে, পাঞ্জাবের সর্ষে খেত পার হয়ে একটা গাদাগাদি বাস টার্মিনাসের সামনে এসে দাঁড়াল। রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন বাবু রতন মজুমদার।
— পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস! ওদিকে সুজাতার শ্বশুর সুইসাইড করেছে, জানিস?
স্তম্ভিত হয়ে গেলেও সামলে নিলাম। এমন একটা কিছু না ঘটলে এই সাতসকালে রতন আমায় ফোন করবেই বা কেন? একটু আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম- কখন মারা গেলেন?
— আরে মরেনি। মরলে তো ঝামেলা চুকেই যেত। বুড়ো বিচ্ছু ভোরবেলা উঠেই বেগন, ফিনাইল আর কেরোসিন খেয়ে নিয়েছে। রুচিটা ভাব একবার! বেগন আর ফিনাইল খাবি খা, তা বলে সঙ্গে কেরোসিন? একটা স্ট্যান্ডার্ড রাখল না মাইরি!
উত্তেজনায় খাড়া হয়ে বসলাম- কখন ঘটল এতসব?
— এই তো দশ মিনিটও হয়নি এখনও। সুজাতা সঙ্গে সঙ্গে আমায় ফোন করেছিল। আমি ওর ফোন ছেড়েই তোকে ধরলাম। এখন যা করার তোকেই করতে হবে।
— আমি? আমি কী করব?
— ওরে আমার ন্যাকাসোনা “আমি কী করব’? গায়ে নামাবলী জড়িয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে রাস্তায় বেরোবে। বুড়োকে নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হবে। বুড়ো গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। মতলবটা বুঝলি? বসে বসে মরবে আর আমাদের হাজতে ঢোকাবে। কিন্তু বাবা, রতন মজুমদারকে অত সহজে ফাঁসানো যাবে না। তুই এক্ষুনি যা বাবলু। লোক জানাজানি হয়ে যাওয়ার আগে বুড়োকে যোধপুর পার্কের নার্সিংহোমে ভরে দিয়ে আয়। আমি কথা বলে রাখছি।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমি নিজের মধ্যে হঠাৎ করে একটা সাহসের চারাগাছ আবিষ্কার করলাম। রতনকে অমান্য করার সাহস। বললাম, “কেন, আমি এসব করতে যাব কেন? মজা মারবে তুমি, আর ঝামেলা পোয়াব আমি? যদি যেতেই হয়, তাহলে তোকেও আমার সঙ্গে আসতে হবে।”
— বিশ্বাস কর সোনা। আমি একদম ফেঁসে গেছি। সত্যি আমাদের ডিপোয় ইনস্পেকশন। কেস তো গুবলেট জানিসই। আমি এদিকটা সামলে যত তাড়াতাড়ি সন্তব যাচ্ছি। তার আগে পর্যন্ত তুমি একটু ম্যানেজ করে দে ভাইটি। সারা জীবন তোর এই খণ …
— থাক, আর ডায়ালগ দিতে হবে না। আমি যাচ্ছি। সুজাতা বৌদিকে বলে রেখেছিস তো?
— আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। রতনের গলায় অনেকটা নিশ্চিন্তা খেলা করে। “আমি আর সুজাতা মিলেই তো তোর নামটা ঠিক করলাম। ও তোকে ভীষণ স্নেহ করে রে।”
— গ্যাস খাওয়াস না রতন। আমি এমনি এমনই যাচ্ছি। শুধু তোর জন্য এইসব কেসে জড়িয়ে চাকরিটা না যায়, সেটাই চিন্তা।
— কিচ্ছু হবে না, বস। রেপ কেস, মার্ডার কেস, সব আমি সামলে দেব। অনেক খুঁটি আমার ধরা আছে। শুধু এ ঝামেলাটা পার করে দে ভাই… রতন ফোনটা ছেড়ে দিল।
হায় পরমিন্দর! আজ তো স্বপ্নে তোমার মুখ দেখতে দেখতেই ঘুম ভাঙল। কিন্তু এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার?
রতন মজুমদার আমার ছোটবেলার বন্ধু। তবে জীবনের একটা বড় সময় এবং এখনও মাঝে মাঝে সে আমার বন্ধু কম, মনিব বেশি। নইলে দুবার ফেল করার পর রতনের মনে হয়, সে অনেক কিছু জেনে গিয়েছে? এবার “পৃথিবীর পাঠশালা’য় ইতি টেনে “পৃথিবীর পথে তার বেরিয়ে পড়া দরকার। তা বেরিয়েও সে পড়ল, নানা ঘাটের জল খেয়ে এই আকাশের বাজারে কীভাবে কে জানে একটা সরকারি বাস কন্ডাক্টরের চাকরিও জুটিয়ে ফেলল।
কিছুদিন আগে রতনকে খুব ডিপ্রেসড দেখচ্ছিল। পাড়ার আড্ডায় সবাই চেপে ধরলেও সে কিছু উত্তর দেয়নি। পরে আমাকে একান্তে বলেছিল — আমাকে প্রোমোশন দেওয়ার একটা চক্রান্ত হচ্ছে রে।
আমি হাঁ হয়ে বলেছিলাম – সে তো ভাল কথা!
রতন তৎক্ষণাৎ খেঁকিয়ে উঠেছিল — কীসের ভাল কথা? জব স্যাটিসফ্যাকশন বলে কিছু থাকবে? দুটো জ্যাবদা খাতা সামনে দিয়ে খাঁচায় ভরে দেবে।
প্রচন্ড গরম চলছিল সে সময়টায়। তার মধ্যে কন্ডাক্টরের কাজে ঠিক কী ধরনের জব স্যাটিসফ্যাকশন পাওয়া যায় জিজ্ঞেস করায় রতন হেসে বলেছিল- নিদেনপক্ষে তিরিশটা সুন্দরী মেয়ে দেখি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায়। বেশিরভাগ দিন সকালে ডিউটি পড়ায় সন্ধ্যায় অবশ্য রতন অনেক কিছুই করত- তার মধ্যে একটা ছিল ঝন্টুদার ক্যাটারিংয়ে ওয়ার্কিং পার্টনার হয়ে যাওয়া। খাওয়ানো-দাওয়ানোর ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান রতনের। পোলাওয়ে জাফরান ঠিক কতটা দিলে লোকের গা গুলিয়ে উঠবে, খেতে পারবে না, খাওয়ার টেবিলটা ক’ইঞ্চি উঁচু বা নিচু করে দিলে যে চার পিস মাচ খেত সে দু’পিস খাওয়ার পরই কনুইয়ের ব্যথায় “আর না, আর না!’ করতে শুরু করবে- সমস্তটাই ছকা ছিল রতনের এনসাইক্লোপিডিয়ায়। একটু অভিজাত বাড়িতে কাজ পড়লে ঝন্টুদা আমায় ডাক দিত। জর্দা ছোপানো দাঁত বের করে বলত- আমার আবার ইংরিজিটা ঠিক … ইয়ে … জানোই তো… তুমি একটু লোকজনকে গিয়ে হ্যালো-ট্যালো বলবে। তেমন, তেমন লোকদের ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করবে, রান্না-টান্না কেমন হয়েছে — এই আর কি। আমি রাজি হয়ে গেছিলাম। কেননা বদলে আমার এক বেলা ভাল খ্যাঁটন হয়ে যেত। একবার, একবারই অবশ্য রতন ঝন্টুদাকে ম্যানেজ করে আমায় শ’দুয়েক টাকা পাইয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া টাকা-পয়সা নিয়ে ঝন্টুদাও উচ্চবাচ্য করেনি। আমিও কিছু বলিনি।
এরকমই একটা বিয়ের ভোজে রতনের সঙ্গে সুজাতা বউদির আলাপ। কোথা থেকে পমফ্রেট মাছ আনা হয়েছিল, কে জানে। বিকেলের আগেই পচে গন্ধ বেরোতে লাগল। কটক থেকে নতুন আমদানি করা ঠাকুর ত্রিভঙ্গমুরারীর মতো বেঁকে দাড়িয়ে তারস্বরে বলতে লাগল — মু এ মছ ভাত্তি পারিবি নাহি। মাথায় হাত। এবং হাতে হ্যারিকেন। রুই মাছের কিছুটা সাইড করে কাঁটা ফেলে দিয়ে তার সঙ্গে পচা মাছের কম পচা অংশ পাইল করে আশ্চর্য দক্ষতায় রতন সবটা সামলে নিল। শুধু ফিশ ফ্রাই দেওয়ার ভারটা ও নিজে হাতে রাখল।
ফুলবাবু সেজে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। গুণছিলাম, কতজন করে বসছে। অকারণে হেঁ, হেঁ-ও করছিলাম একটু, আধটু । এমন সময় সুজাতা বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- এখানে একটা ফিশফ্রাই দিতে বলবেন। ট্যান খেয়ে গেলাম। সুজাতা বউদিরা পাড়ায় নতুন এসেছেন। কারও সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় তেমন নেই। তবে ওর কাটা-কাটা চোখ-মুখ, পাকা গমের মতো গায়ের রঙ আর জলপ্রপাতের মতো ধারালো একই সঙ্গে উজ্জ্বল ও একটু ভারী ফিগার ছিল আমাদের আড্ডার আলফালফা টনিক।
আমাদের শহরতলি এলাকায় সাজপোশাকের নভেম্বর বিপ্লব বলতে গেলে সুজাতা বৌদিই শুরু করেছিলেন। সে রাতে ওর পরনে ছিল একটা আকাশিও নীল শিফন শাড়ি। সঙ্গে ম্যাচিং পিঠখোলা স্লিভলেস রাউজ। কাছে দাঁড়িয়ে আমার পা একটু একটু কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল সমুদ্রের মধ্যে ফসফরাস এই বুঝি জ্বলে উঠবে দপ করে। কিন্তু উনি ফিশফ্রাই চাইতেই আমি নিচে গেলাম। ছাদের যেখানটায় রান্না হচ্ছিল সেখানে গিয়ে রতনকে ফিসফিস করে বললাম — ফিশফ্রাই।
রতন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল- হবে না ফিশফ্রাই।
আমি প্রায় মিনতি জানানোর ভঙ্গিতে বললাম- রতন, সেক্সি বৌদি চাইছে।
রতন কী বুঝল কে জানে, কাপড়ের ফাঁক দিয়ে যেদিকে খাওয়ার আ্যারেঞ্জমেন্ট, সেদিকে তাকাল।
আমি সুজাতা বউদিকে দেখিয়ে আবার বললাম– আর কাউকে না দিস, সেক্সি বৌদিকে অন্তত একটা দিয়ে আয়।
এবার আর দেরি না করে রতন ট্রে হাতে সুজাতা বউদির সামনে চলে গিয়ে তাঁর পাতে ঝপাঝপ দুটো ফিশফ্রাই ফেলে দিল। উনি প্রায় আঁতকে উঠে বললেন- এ কী! এ কী! আমি তো চাইনি!
সঙ্গে সঙ্গে রতন ওখানে দাঁড়িয়েই আমার দিকে ঘুরে বলল– কী রে বাবলু, তুই যে বললি সেক্সি বৌদি ফিশফ্রাই চাইছে?
অনেক প্রার্থনা সত্ত্বেও আমার পায়ের নিচের মাটি দু’ভাগ হল না। ন যযৌ ন তস্থৌ। আমি ভাবতে লাগলাম, কখন আমার গালে হিলতোলা জুতো এসে পড়বে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের পর সেকেন্ড টিক টিক করে ছুটে যেতে লাগল, কিছুই হল না। শুধু আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সুজাতা বউদি তাঁর অনাবৃত বাঁ হাত ওপরে তুলে কপালে এসে পড়া চুল পিছনে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন। আর শুনলাম, স্পষ্ট নিজের কানে শুনলাম, রতন জিজ্ঞেস করছে- আরেকটা ফিশফ্রাই দেব সেক্সি বৌদি?
এরপর নদী আপন বেগে পাগলপাড়া। পাড়ার আড্ডায় রতন নতুন করে হিরো। সবাই একবার করে তাকে সেলাম জানায় আর বলে- কী জিনিস তুল্লে গুরু! কিন্তু রতন সুজাতা বৌদির সঙ্গে তার প্রেম-ট্রেম বেমালুম অস্বীকার করে বলে, পুরো ব্যাপারটাই নাকি বন্ধুত্ব। আরও বলে — মানুষ চাঁদে আছে, মঙ্গল গ্রহে আছে। আর এই একবিংশ শতাব্দীতেও একটা ছেলে কোনও বিবাহিত মহিলার বাড়ি গেলেই তা নিয়ে বাওয়াল হবে?
একবিংশ বলার সময় রতনের গলা খাদে নেমে যায়। আমরা চার্জড হয়ে যাই। কিন্তু রতনের যাতায়াত শুধু সুজাতা বৌদির বাড়িতেই সীমাবদ্ধ রইল না। মাঝেমধ্যে ওদের দুজনকে ভিক্টোরিয়া, বিড়লা তারামন্ডল, সায়েন্স সিটি … এরকম আরও অনেক স্বাস্থ্যকর জায়গায় দেখা যেতে লাগল। সুজাতা বৌদির মেয়ে মুনি মাঝেসাঝে ওদের সঙ্গে থাকলেও সবসময় যে থাকত, তা কেউ হলপ করে বলতে পারবে না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই থাকত। নইলে তার হাফ ইয়ারলির রেজাল্ট কেন এত খারাপ হবে (দু’বিষয়ে ফেল)? আর কেনই বা তার সপ্তাহে একদিন এসে আটশো টাকা পাওয়া মাস্টারের জায়গায় আ্যানুয়ালের আগে ২-৩ মাস কাজ চালিয়ে দেওয়ার জন্য ডাক পড়বে আমারই? আর আমি রাজিও হয়ে যাব? মাইনের অঙ্ক খারাপ হবে না- রতনের এটুকু আশ্বাসেই।
পেশায় শিক্ষক | মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা | পেয়েছেন কৃত্তিবাস ও বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার | ‘নেহাত গরিব নেহাত ছোটো’, ‘দাঁড়াচ্ছি দরজার বাইরে’, ‘যতটুকু মেনে নিতে পারো’, ‘পতাকা নয় দিগন্ত’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি |