সুজাতা বউদির বাড়ি গিয়ে আমি প্রথম যাকে দেখে চমৎকৃত হই, সেই লোকটি ওর বর প্রদীপবাবু। আমি মনে মনে ওর নাম দিয়েছিলাম ‘মাটির প্রদীপ’। বিরাট শিক্ষিত মানুষ। বিদেশি ফার্মে বড় চাকরি করেন। কিন্তু সারাদিন বাড়িতে থাকলেও তাঁর গলার আওয়াজ শোনার জো নেই। সবসময় “দেখিতে না পাও ছায়ার মতো আছি না আছি” ভঙ্গি নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান। এবং পরিচিত সকলের জীবনের ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য একটা অনুতাপ ঝরে ঝরে পড়ে তার মুখ থেকে।
সুজাতা বউদির শ্বশুর মৃত্যুঞ্জয় বসু ঠিক এর উল্টো। মাটির প্রদীপের বাবা হলেও তিনি ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতি’। পড়াতে আসার দু’দিনের মধ্যেই আমি বুঝে গেলাম, এ বাড়িতে মূল লড়াইটা চলে বিপত্নীক শ্বশুরমশাই এবং তার আলোকপ্রাপ্তা পুত্রবধূর। আর এদের মধ্যে লিয়াজঁ অফিসারের কাজ করে মুন্নি।
মুন্নির অ্যানুয়াল পরীক্ষার কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যাবেলা মৃত্যুঞ্জয়বাবু বেশ গম্ভীর মখে ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসে পড়লেন। মিনিট পাঁচেক হয়ে গেল, কোনও সাড়াশব্দ নেই দেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম- “কিছু বলবেন মেসোমশাই?” মৃত্যুঞ্জয়বাবু সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন- “মেসোমশাই, মেসোমশাই কোরো না তো। যাদের জীবনে মাসিমা নেই, তাদের কাছে এই ডাকটা দুর্বিষহ।”
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম- ও, স্যরি।
মুন্নি ফোড়ন কেটে বলল- তাহলে কী বলে ডাকবে?
মৃত্যুঞ্জয়বাবু এবার আর রাগলেন না। মিষ্টি হেসে বললেন- কী আবার ডাকবে। কাকু, জ্যেঠু এসব কিছু।
তারপর আমার দিকে একটু চোখ মটকে বললেন- আমার বউমাকে যা বলে ডাকো সেটা তো আর ডাকতে পারবে না, তাই না?
আমি বিষম খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম- আপনি! আপনি জানলেন কী করে!
— পিঠে কুলোও বাঁধিনি, কানে তুলোও গুঁজিনি। যা রটে তা শুনতে পাব না কেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম- আসলে, ওই নামটা একদমই বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে …
মৃত্যুঞ্জয়বাবু হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- তোমার কাছে ও ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করতে আমি আসিনি। আমার একটা অন্য জরুরি দরকার আছে।
মাথা নিচু করে বললাম- কী, বলুন।
মৃত্যুঞ্জয়বাবু মুন্নির দিকে তাকিয়ে বললেন- তুমি দশ মিনিট একটু কার্টুন দেখে এসো তো, দিদিভাই।
আমি বাধা দিতে যাচ্ছিলাম। ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন- ওর মা সন্ধ্যায় হাওয়া খেতে বেরোতে পারে। আর ও দশ মিনিট একটু কার্টুন দেখতে পারবে না?
মুন্নি আমাকে আলতো মুখ ভেংচে বেরিয়ে গেল। আর উত্তরের অপেক্ষা না করে মৃত্যুঞ্জবাবু সিধে দরকারে ঢুকে পড়লেন- শোন, আমায় একটা বাচ্চা মেয়ে দিতে পারো? এই পার্সোনাল কাজটাজের জন্য?
আমি থতমত খেয়ে বললাম- বাচ্চা মানে, মুন্নির মতো?
— ধ্যাৎ! সে তো চাইল্ড লেবার হয়ে যাবে। এই ধরো, সতেরো-আঠারো। পড়াশুনোও করল, আবা দরকার-টরকারগুলোও একটু দেখল। তোমার মাসিমা মারা যাওয়ার পর এই সুজাতার পাল্লায় পড়ে আমার অবস্থা তো বোঝো।
এবার মৃত্যুঞ্জয়বাবু যেচেই মেসোমশাই হলেন।
কীভাবে ‘না’ করব ভাবতে ভাবতে বললাম- আমি একটা স্কুলে মাঝে মাঝে পড়াতে যাই (অবৈতনিক)। সেখানে ১৩-১৪ বছরের মেয়েরা পড়াশুনো করতে আসে। ওদের কাউকে যদি কাছে রাখেন, পড়ান, তাহলে একটা সোশ্যাল সার্ভিসও হয়, আবার …
আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়বাবু বললেন- দ্যাখো, ওসব সোশ্যাল সার্ভিসের গপ্পো টপ্পো আমায় দিও না। অমন অনেক সার্ভিস দিয়েছি সারাজীবন। এখন একটু সার্ভিস পেতে চাই। বাচ্চা মেয়ে হলে হাজার অসুবিধা। সতেরো-আঠারো বছর হলে একটু ম্যাচিওর হয়।
বুঝলাম, বুড়োকে রসে ধরেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “মাইনে-টাইনে?”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু উৎসাহিত হয়ে উঠলেন- এনি আ্যামাউন্ট। আট হাজার টাকা পেনশন পাই। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে কী কাজ করতাম, জানো?
আমি আর কোনও উত্তর দিলাম না। মুন্নির অ্যানুয়াল পরীক্ষা অব্দি এড়িয়ে এড়িয়ে চললাম। তারপর সুজাতা বৌদিকে বলে-কয়ে মানে, মানে টিউশনি ছেড়ে বাঁচলাম। মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে রসে ধরতে পারে। কিন্তু আমাকে তো ভূতে ধরেনি যে রতনের বান্ধবীর মেয়ের টিউটর আর তার শ্বশুরের সাপ্লায়ার একসঙ্গে হতে যাব। একেবারে একতারাতে দোতারার সুর? রক্ষা করো, তার ছিঁড়ে যাবে যে।
চোখে-মুখে শুধু একটু জলের ঝাপটা দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে সুজাতা বউদির বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম, মৃত্যুঞ্জয়বাবু সোফার উপর পা তুলে বসে আছেন। আর সুজাতা বউদি নীচে মেঝেয় বসে কাকুতি-মিনতি করছেন।
— আপনার একটা কিছু হয়ে গেলে আপনার ছেলে আমাকে মেরে ফেলবে।
আমি হাসি চাপতে পারছিলাম না, এই অবস্থাতেও। মেরে ফেলবে কে? না, মাটির প্রদীপ।
সুজাতা বউদি আমায় দেখে যেন ধড়ে প্রাণ পেলেন- এই যে বাবলু, তুমি এসে গেছ? উফ! বাঁচালে। এত ভোরে পি সি সরকারও আমার ড্রাইভারকে হাজির করতে পারবে না। তুমি তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি ডাকো। বাবাকে নিয়ে এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।
আমি জিজ্ঞেস করব কি করব না করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা বাড়ি নেই?”
— না, ও দিল্লি গেছে অফিসের কনফারেন্সে। আর এদিকে আমার হয়েছে জ্বালা। আর পারছি না গো… বলতে বলতে উনি কেঁদে ফেললেন। আমি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে এগোচ্ছিলাম। কিন্তু বেডসিন করে ওঠা নায়িকার মতো এমনই আলুথালু ভঙ্গিমা ওনার তখন যে, সাহস হল না। মৃত্যুঞ্জয়বাবু আড়চোখে সব দেখছিলেন। এবার একটু কেশে বলে উঠলেন- “আমি কোথাও যাব না, কোথাও না।”
ঠিক তখনই বাইরে একটা ট্যাক্সি থামার আওয়াজ। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল রতন। আমার দিকে একবার আগুনচোখে তাকিয়ে সোজা সোফার সামনে গিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে টেনে তুলল।
মৃত্যুঞ্জয়বাবু খেপচুরিয়াস হয়ে বললেন- ইয়ার্কি পেয়েছ বেয়াদব ছোকরা? আমার বাড়িতে এসে আমারই ওপর দাদাগিরি? আমি পুলিশ ডাকব।
রতন সঙ্গে সঙ্গে বাউন্সারটা হুক করল- পুলিশ কেন, মিলিটারি ডাকুন। আপনাকেও একটু ফিজিক্যাল ট্রেনিং দিয়ে যাবে। ওই ডবকা মেয়েটার সঙ্গে আরও ভাল করে কাপ-ডিশ ছোড়াছুড়ি খেলতে পারবেন।
কথাটা শুনে মৃত্যুঞ্জয়বাবু ভাঙলেন, কিন্তু মচকালেন না। ভিতরের ঘরের দিকে তাকিয়ে হাঁক পাড়লেন- “আশা, আশা!”
মুন্নিকে সঙ্গে নিয়ে যে মেয়েটি এবার ঘরে ঢুকল, তাকে আগে কখনও দেখিনি। বয়স আন্দাজ আঠেরো-উনিশ হবে। মুখখানা মিষ্টি, কিন্তু ভোলাপচুয়াস চেহারা! আর তার সঙ্গে খোলতাই গায়ের রঙ। যেন মে মাসের গরমে রাস্তার ওপর কেউ দু’ড্রাম আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে। সুজাতা বউদির সার্থক কন্ট্রাস্ট। ওকে দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কী আশা যে পূর্ণ হয়, ভগবানই জানেন। নেচে নেচে আয় মা! আশা কিন্তু এসে দাঁড়াল খুব লাজুক ভঙ্গিতে। দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে জিজ্ঞেস করল- আমায় ডাকছিলেন?
মৃত্যুঞ্জয়বাবু গম্ভীর গলায় বললেন- হ্যাঁ।
তারপর একে একে সুজাতা বউদি, রতন আর আমার দিকেও আঙুল তুলে বললেন– এই সবকটাকে চিনে রাখ। আমার কিছু হলে টিভির লোকেরা ক্যামেরা নিয়ে আসবে। তখন এদের সবাইকে চিনিয়ে দিবি। বলবি, আমার মৃত্যুর জন্য এরাই দায়ী।
সুজাতা বউদি কথাটা শুনে আবার ফোঁপাতে শুরু করলেন। এবং আশাও সেই কান্নায় যোগ দিল। আমি মনে, মনে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে কিন্তু বাইরে একটুও প্রকাশ না করে জিজ্ঞেস করলাম- আমাকে আবার এসবের মধ্যে জড়াচ্ছেন কেন? আমি কী করলাম?
মৃত্যুঞ্জবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন- তুমি হচ্ছ এক নম্বরের হাড়ঝিটে বদমাশ! পড়াশুনো শিখে ওই রতনটার চামচাগিরি করো, লজ্জা করে না? ভেবেছিলে, তুমি না দিলে আমি কাজের মেয়ে পাবো না, তাই না? এই দেখো, দু’চোখ ভরে দেখ…বলতে বলতেই তিনি আশাকে হাত ধরে টেনে আনলেন। আশা তার ঝকঝকে দাঁতের পাটি বের করে হাসল। মা কী ছিলেন জানি না, কিন্তু হয়েছেন করালবদনা।
বাইরে ট্যাক্সি হর্ন দিল। মৃত্যুঞ্জয়বাবু হঠাৎ একটা বিকট মুখভঙ্গি করে বাথরুমের দিকে ছুটে গেলেন। সুজাতা বউদি সেই দৃশ্য দেখে প্রায় ফেন্ট হয়ে সোফার উপর পড়লেন। রতন সঙ্গে সঙ্গে কাছে গিয়ে ওর ঘাড়ে-পিঠে আলতো চাপড় দিতে দিতে বলল- “বি স্টেডি, কিচ্ছু হবে না।”
পেশায় শিক্ষক | মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা | পেয়েছেন কৃত্তিবাস ও বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার | ‘নেহাত গরিব নেহাত ছোটো’, ‘দাঁড়াচ্ছি দরজার বাইরে’, ‘যতটুকু মেনে নিতে পারো’, ‘পতাকা নয় দিগন্ত’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি |