‘বীরবিক্রম’পর্বের পরের দিন সকালে আমার স্কুলজীবনের বন্ধুর সঙ্গে তার বসের কথোপকথনটা হয়েছিল অনেকটা এরকম। তখন ঘড়িতে সাড়ে নটা।
— রাস্তায় বড্ড জ্যাম স্যার। মিনিট পনেরো-কুড়ি দেরি হবে পৌঁছতে।
— মিনিট পনেরো না মিনিট কুড়ি?
— ওই আর কি। মিনিট পনেরো কুড়ি।
এটা শোনার পরেই নাকি গর্জে উঠেছিলেন আমার এরিয়া সেলস ম্যানেজার বন্ধুর উপরওয়ালা জোনাল সেলস ম্যানেজার। কোম্পানিটি মন দিয়ে গুঁড়ো মশলা বিক্রি করে।
— আর ইউ শেমলেস? এত বড় কাণ্ড ঘটার পরেও লজ্জা করে না তোমার?
আমার বন্ধু ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে মিনমিন করে। কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে ওঠে, এই হাওড়া হাওড়া হাওড়া।
— চাঁদ কত দূরে?
— অ্যাঁ?
— আই সে, চাঁদ কত দূরে?
টুক করে গুগল করে নেয় আমার সুহৃদ। লংকা-হলুদ-ধনে-জিরে গুঁড়োর বাইরেও রয়েছে মস্ত এক জগৎ।
— তিন লক্ষ চুরাশি হাজার চারশ কিলোমিটার স্যার।
— টুকে পাশ। এটাও টুকলে। গট ইট। কত মিনিট লেট করেছে?
— কে স্যার?
— চন্দ্রযান বলে একটা ব্যাপার কাল হয়েছে জানো?
— জানি স্যার। আজাদির অমৃত মহোৎসব স্যার। এক্কেবারে টাইমে পৌঁছেছে।
— চল্লিশ দিন টানা জার্নির পরে কটায় নেমেছে চাঁদে? চার লাখ কিলোমিটার উজিয়ে আসার পর?
— সন্ধে ছটা চার স্যার।
— কটায় নামবে বলা হয়েছিল ইসরো থেকে? বহুদিন আগে?
— ছটা চার স্যার।
— তুমি আর কত কিলোমিটার দূরে রয়েছ অফিস থেকে?
— তিন স্যার।
— তোমার কতক্ষণ লাগবে অফিসে পৌঁছতে? পনেরো মিনিট না কুড়ি মিনিট? হোপলেস।

এর পরে ফোনটা নাকি ঝট করে কেটে দিয়েছিলেন জোনাল ম্যানেজার বাবু। বন্ধুটি সন্ধেবেলা আমায় ফোন করে সব ঘটনা জানায়। ওর চোখের কোণগুলো চিকচিক করছিল কিনা জানি না। গভীর রাতে আমায় তিরিশ সেকেন্ডের একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছিল। দেখি কোথা থেকে জোগাড় করেছে ইসরোর কর্তা এস সোমনাথের ছবি। ওঁর দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গেয়ে চলেছে, ‘কেন করলে এরকম, বলো…। কেন করলে এরকম?’ হাতে একটা রুমালও ছিল ওর। কেন কে জানে!
পরিসংখ্যান বলছে, ভারত চাঁদে নামার পরে আপাতনিরীহ ইসরোর ইউটিউব চ্যানেলে ভিউয়ের সংখ্যা নাকি ৭ কোটি ছাড়িয়েছে। কোভিডকালে কেন্দ্র থেকে ভ্যাকসিন দেওয়ার যে অনলাইন কাউন্টার চালু হয়েছিল ওয়েবসাইটে, সেখানে যেমনভাবে বাড়ছিল মিটার রিডিং, ইসরোর ইউটিউব চ্যানেলের ভিউয়ারশিপ তাকে দশ গোল দিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। আপাতত কিছুদিন যাদবপুর-কাণ্ডের ছুটি। কয়েকদিনের জন্য বিশ্রামে গেলেন রাহুল গাঁধী। অনুব্রতের খবর কী? ধর্মতলায় ওই তরুণ তরুণীদের চাকরির দাবিতে ধর্না অভিযানের কী হল? টমেটোর দাম কি কমবে? ডায়মন্ডহারবারে আবার ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসবে কবে? সে প্রশ্ন থাক। এ শুধু চাঁদের দিন, এ লগন চাঁদ শোনাবার, দেখিবারও বটে।

২৩শে ফেব্রুয়ারি, বুধবার বিকেল থেকে চাঁদ গিলছি আমরা। সেদিন সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শুরু হয়েছিল মহাজাগতিক সিরিজের গ্র্যান্ড ফিনালে। বাসে ট্রামে মেট্রোতে সব মানুষের মুঠোফোনে শুধু উথলে পড়েছে চাঁদ। হলফ করে বলতে পারি, ভিডিও দেখার সময় বহু মানুষ হতাশ হয়েছেন। যাঁরা বিমানের ল্যান্ডিংয়ের মতো কিছু একটা দেখবেন আশা করেছিলেন, তাঁরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না কিছুই। ভারতের চাঁদে নামার দিনের সন্ধে ছটা বাজতে দশে আমি মেট্রোতে। ধর্মতলা থেকে উঠেছি। পরবর্তী স্টেশনের ঘোষণা শুনেই সমস্বরে কয়েকজন বলে উঠলেন, “ও দাদা, বন্ধ করুন ফালতু এসব। এটা দমদম যাচ্ছে আর ওটা চাঁদে। বন্ধ করুন, করুন বন্ধ। এক্ষুনি।” চালকের কানে তা পৌঁছেছিল কী না জানা নেই। এক যাত্রী পাশের যাত্রীকে বলে উঠলেন, “দাদা বুঝতে পারছেন কিছু? নীচ থেকে এমন লাইট মারছে কেন? মেলায় দেখা দশ টাকা দামের খেলনাগুলোর মতো লাগছে তো।” অন্যজন বললেন, “নামছে, না উঠছে কিছুই আন্ডারস্ট্যান্ড করতে পারছি না।” আরেকজন বললেন, “পড়াশোনা করেছেন কিছু এই প্রজেক্ট নিয়ে? ওটা লাইট না। আসলে ওটা হাওয়ার জেট। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে কেউ যায়নি তো কখনও। তাই ল্যান্ডিংয়ের জায়গাটা পরিষ্কার করে নিচ্ছে। গতবার কীভাবে ভেঙে পড়েছিল মনে নেই?” আরেকজনের তুমুল আপত্তি ছিল এতটা উঁচুতে থাকা অবস্থাতেই গতিবেগ প্রায় শূন্য করে দেওয়া নিয়ে। বললেন, “আরে ধপ করে পড়ে যাবে যে। ভেঙে গেলে?” পাশের জন বলে উঠলেন, “কোনও চিন্তা নেই। বেশি খরচ হয়নি দাদা। সলমনের একটা সিনেমা দিয়ে এমন দুটো মেশিন বানানো যাবে! কোন জগতে যে থাকেন না আপনারা!” এমন কথার ফাঁকে হঠাৎ দেখলাম চন্দ্রযানের ছবির আধখানা খেয়ে নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ। তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছে ইসরো অফিসের অভ্যন্তরে। শূন্যে ঘুষি চালাতে শুরু করে দিয়েছেন বেঙ্গালুরুর বিজ্ঞানীরা। বোঝা গেল, চন্দ্রযান, না না, ভারত নেমে গিয়েছে চাঁদে। কী হইতে কী হইয়া গেল। রথের মেলার খেলনা তখনও জ্বলছে, নিভছে।

ল্যান্ডিং শব্দের আগে সফট কথাটা জুড়ে দিলে তা আরও কোমল হয়ে যায় কিনা জানা নেই। চন্দ্রজয়ের পরের দিন বাসে এক স্থূল ব্যক্তি কোনওমতে একটু জায়গা দখল করে সিটে বসার পরে একগাল হেসে বলেছিলেন, “বসলাম বটে ভাই। কিন্তু সফট ল্যান্ডিং হল না। দেখ, আমার আধা শরীর বেরিয়ে রয়েছে সিট থেকে।” আমার এক কবিবন্ধু সম্প্রতি তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিল, “লিখতে পারছি না আর। এ বেঁচে থাকা কয়লাখনির গর্ভ গ্রাস করা কালো গুঁড়োর মতো। হে ট্রান্সলুনার ইঞ্জেকশন, তুমি কোথায়?” ভাবলাম বিপদে পড়েছে বুঝি। মোবাইলে গোটাদুয়েক ওষুধ ডেলিভারির অ্যাপে সার্চ মারার পরে স্ক্রিন লাল হয়ে গিয়ে জানালো, “দুঃখিত। নো ম্যাচ ফাউন্ড।” গুগুলে বাজার করতে গিয়ে দেখি আমার কবিবন্ধুর ভাবনা অন্য। রকেটবিজ্ঞানের ভাষায়, এ নাকি এমন এক ইঞ্জেকশন, যার মাধ্যমে পৃথিবীর আকর্ষণের বাধা কাটিয়ে চাঁদের স্বপ্ন-কক্ষপথে পাড়ি দিতে পেরেছিল চন্দ্রযান। শ্রীহরিকোটা থেকে ১৪ জুলাই উড়ে যাওয়ার সতেরো দিন পরে এই ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ধনধান্য বসুন্ধরার মায়া কাটায় এই আশ্চর্য যন্ত্র। দিনটা ছিল ১লা অগস্ট। কবিবন্ধুকে ফোন করেছিলাম। ও বলেছিল, “আমার না লেখা কবিতার খাতার মতো অঙ্কের ফর্মুলাও কত নিঃসঙ্গ দেখেছিস। পৃথিবীর মায়া কাটল পয়লা অগস্ট নয়। একলা অগস্ট। একাকী এ ধরণীর কতটুকু জানি!” ফোনের ও প্রান্ত থেকে বিড়বিড় করে আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল ও। বলেছিলাম, “আর ক’দিন পরেই চাঁদ যে আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে রে। মনের মধ্যে তুমুল আনন্দ হচ্ছে না তোর?” কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতার পরে ভেসে এসেছিল, “জোছনার সঙ্গে আড়ি হয়ে গেছে কবে। আসে না আমার বাড়ি। গলি দিয়ে চলে যায়। চাঁদে গিয়ে কী হবে যদি জোছনা না দেখতে পাই?”

পাড়ায় রক্তদান শিবির হল দিনকয়েক আগে। সান্ধ্য অনুষ্ঠানে শিল্পী গেয়ে উঠলেন, ‘এত বড় আকাশটাকে ভরলে জোছনায়। ওগো চাঁদ এ রাতে আজ তোমায় বোঝা দায়।’ আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। চকিতে কর্ডলেস মাইক্রোফোন উঠে এল পাড়ার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারির হাতে। বললেন, “মার্জনা করবেন ম্যাডাম। চাঁদকে বোঝা দায় আর নয়। আমরা জিতে গিয়েছি। মাননীয়ার অনুপ্রেরণায় ইসরোর উদ্যোগে সোমনাথ সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চাঁদ এখন আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে। গীতিকার যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে কি লিখতেন এই লাইন? সরি ম্যাডাম, আপনি গান শুরু করুন আবার। জয় চাঁদ। জয় বাংলা।”
চাঁদের ছবি ঠিক মনের মতো না হওয়ার বেশ কয়েকজনের মন খারাপ। চায়ের দোকানের প্রভাতী আড্ডায় শুনেছি, “এত খরচ করলি, আর একটু বেশি মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা সেট করে দিতে পারলি না ভাই? আমার মোবাইলে তোলা ছবির তো এর চেয়ে বেশি ক্ল্যারিটি।” প্রত্যুত্তরে কানে এসেছে, “ছবিগুলো আসলে খুবই এইচডি কোয়ালিটির। কিন্তু এতটা ডিসট্যান্সের জন্য ঝাপসা হয়ে আসছে পৃথিবীতে। চাঁদে তো ব্রডব্যান্ড নেই।” এক শেয়ারভুক আফশোস করে বলছিলেন, “যা যা মেটাল পাওয়া যাবে চাঁদে, জেনে রাখবেন তার দাম আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কমবে। ফলে মার্কেটে এমন কোম্পানিতে পয়সা লাগাতে সাবধান।” বাজিব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মনে এখন থেকেই আশার তুবড়ি। জানতে পারলাম, কালীপুজোর সময় অন্যবার যা রকেট তোলা হয়, এবার তার অন্তত দশগুণ তুলবেন।

আশার সঙ্গে চিন্তাও জুড়েছে বেশ। কয়েকদিন পরেই তো কাজ করা বন্ধ করে দেবে বিক্রম ও প্রজ্ঞান, মানে চন্দ্রযানের ল্যান্ডার ও রোভার। সূর্যের আলো না পেলে তো ওদের নড়নচড়ন বন্ধ। অপেক্ষা করতে হবে আবার অনেকগুলো মাস। চাঁদে আবার আলো আসবে কবে? এক অটোচালককে বলতে শুনেছিলাম, “রোজ একবার অন্তত স্টার্ট না দিলে মেশিনে জং পড়ে যায় দাদা। পরের আলো আসতে আসতে যন্তরটা টিকলে হয়। আর কিছুদিন আগে পাঠালেই তো হতো।”
সামাজিক মাধ্যম থেকে জানলাম, এক বিখ্যাত প্রকাশনীর কর্তা নাকি ইসরোকর্তা সোমনাথবাবুকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। স্ক্রিপ্ট রেডি। চাঁদের দক্ষিণ মেরু অভিযানে আমি ফার্স্ট হয়েছি। আমার এই সাফল্যের পিছনে অমুক বিচিত্রার অবদান অনস্বীকার্য। আহারে। সোমনাথবাবু যদি দুটো লাইন বলে দিতেন!
আনতাবড়ি বহু কথার শেষে কলার তুলে বলা যায়, বিক্রম বললেই আর ছায়ার মতো বেতাল কথাটার উদয় হবে না মনে। বহু লক্ষ কিলোমিটার দূরে আমাদের বিক্রমের সঙ্গে আমরা মিশিয়ে দিয়েছি প্রজ্ঞা।
ওদের জয় হোক।
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।