মেট্রোয় উঠেছি যতীন দাস পার্ক থেকে। ময়দান স্টেশনে অনেক লোকের মধ্যে বছর কুড়ির যে ছেলেটি উঠল তার এক কানে দুল, দু’কব্জিতে হায়রোগ্লিফিক লিপির ধাঁচে ট্যাটু। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ছেলেটির টিশার্ট। ওতে লেখা, ‘এসো, কাছে বসো, কিছু কথা বলো।’ সিট পেয়ে ছেলেটি বসল। পরের স্টেশন থেকে আরও অনেক লোকের মধ্যে কামরায় উঠল ওই বছরকুড়িরই একটি মেয়ে। তার পরনেও টি শার্ট। তাতে লেখা, ‘না না না, কাছে এসো না, মায়াবী এ রাতে।’ ছেলেটির পাশের সিটটা ফাঁকা তখনও। মেয়েটি বসল। পুরো কামরার নজর চকিতে গিয়ে পড়ল ওদের উপর। তবে এই ক্ষণিক নৈকট্য স্থায়ী হয়নি। পরের স্টেশনে দুজনেই ঝপ করে ট্রেন থেকে নেমে যায়, দুটো আলাদা দরজা দিয়ে। ওদের গন্তব্য যে ওই স্টেশন ছিল না, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
একটু এদিকওদিক তাকালে বোঝা যায়, চিরাচরিত টিশার্টের ধারণা বদলে গিয়েছে বিলকুল। কবিপক্ষে নন্দনচত্বরে এক পনিটেলধারী যুবককে দেখেছিলাম। ক্যাটক্যাটে নীল টিশার্টে কালো রেখায় কবিগুরুর অবয়ব। বিশ্বকবির মুখে হাসি নেই মোটে। পাশে বিরাট বড় ফন্টে লেখা ছিল, ‘ফিরিয়ে দাও। আমার ও নোবেল তুমি ফিরিয়ে দাও। এভাবে ঝেড়ে দিও না।’ পাশে থাকা বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপককে বলতে শুনেছিলাম, ‘এমন টিশার্টের সন্ধান আগে থেকে পেলে রবীন্দ্রনাথ নোবেল নেওয়ার আগে দু’বার ভাবতেন। একই বছরে দুটো এসেছিল তো। একটা চোরে নিল। অন্যটার বারোটা আমরা বাজিয়ে দিলাম সম্মিলিতভাবে।’ গুগলরাজাকে জিজ্ঞেস করে দেখি সত্যিই তাই। বিশ্বকবির নোবেল আর বিশ্বলোকে টিশার্ট—দুটোই এসেছিল ১৯১৩ সালে।
টিশার্টের আবির্ভাবকাল নিয়ে একটু মতান্তর থাকলেও বহু বিশেষজ্ঞই ১৯১৩-র পাশেই ভোট দেন। এর নাকি প্রথম চল হয়েছিল মার্কিন নৌসেনার অন্দরে। এই ‘অন্দরে’ শব্দটা আক্ষরিকভাবেই সত্যি! কারণ, তখন এটা পরা শুরু হয়েছিল জামা, অর্থাৎ ইউনিফর্মের নীচে। হালকা সাদা রঙের সুতির গেঞ্জি ছিল এটি। আঁটোসাঁটো। তবে দেখিতে না পাই, ছায়ার মতন আছি না আছি-র বেদনা টিশার্টকে বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি। মূলত অন্তর্বাস হিসেবেই যার আত্মপ্রকাশ, প্রবল বিক্রমে কে প্রথম তাকে মূল পোশাকের মান্যতা দিলেন, তা জানা যায় না। তবে বলাই বাহুল্য, টিশার্ট শুধুমাত্র বাইরে ‘এলেন’ এবং ‘দেখলেন’ না। দুনিয়া জয় করলেন।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে দুনিয়াজুড়ে টিশার্টের ব্যবসার পরিমাণ হবে প্রায় ৪৩,৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর মাত্র তিন চার বছরের মধ্যেই নাকি টিশার্টের ব্যবসার বহর ছুঁয়ে ফেলবে বার্ষিক ৮,০০০ মিলিয়ন পিস। মিলিয়নকে পূর্ণ সংখ্যায় গুণ করে লাভ নেই কোনও। শূন্যের লকগেট খুলে চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে।
সাদা সুতির এক নিরীহ পোশাকের ওপরে প্রথম স্লোগান লাগালেন কে? উঠে আসে ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার ক্যাথরিন হ্যামনেটের নাম। ১৯৮৩ সালে একটা দুধসাদা টিশার্টের উপরে তিনি ছেপে দিয়েছিলেন, ‘চুজ লাইফ।’ ‘জীবনকে বেছে নাও।’ অনেকেই বলেন মাত্র এই দুটি শব্দের মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী এক কড়া বার্তা দিতে চেয়েছিলেন হ্যামনেট। একটা মিউজিক ভিডিওতে এই টিশার্টটা পরে ফেললেন গায়ক জর্জ মাইকেল। দুটো শব্দ আর টিশার্টের ওপরে স্লোগানের ভাবনা— দুটোই তুমুল বিখ্যাত হল বিশ্বজুড়ে। বার্তা দেওয়া টিশার্টের জননী কি তবে হ্যামনেটই? বিষয়টা বিতর্কিত। কেউ একমত হবেন। অনেকেই হয়তো হবেন না। সত্যি কথা বলতে গেলে এই তর্কের শেষ নেই কোনও।
একটা খুব সহজ, সরল, গোবেচারা প্রশ্ন করা যায়। প্রিয় শব্দ কিংবা লাইন তো থাকবে বইয়ের পাতায়। প্রতিবাদ গর্জে উঠতে পারে হাতে উঁচিয়ে রাখা প্ল্যাকার্ডে। সব ছেড়ে তা টিশার্টে কেন? ফ্যাশন টেকনোলজিস্টরা, শিল্পীরা লক্ষ স্লোগানে কোটি টিশার্ট রাঙিয়েছেন। আর মনোবিদরা তার উত্তর খুঁজেছেন। তাঁরা বলছেন, মনের কোণে জমে থাকে যে সুপ্ত বাসনা, তা প্রোজেক্টরে ফেলে ইয়া বড় করে দেখানোর একটা অন্যতম মাধ্যম হতে পারে টিশার্ট। মানে, আমি বলতে চাইছি অনেক কিছু। বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। মনের জমানো কথা ফুটে উঠতে পারে টিশার্টের রেখায় কিংবা স্লোগানে। কাউকে কোনও কারণে অনুপ্রেরণা দিতে চাইলে তা ফুটিয়ে তোলা যায় টিশার্টের মধ্যে ছাপা অক্ষরমালায়। মনোবিদদের দাবি, মুখচোরা যারা, তাদের জন্য কথোপকথন শুরু করার ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা নিতে পারে টিশার্টের উপরে ছাপা স্লোগান, কিংবা প্রিয় লাইন। এক তরুণীকে জানি, যিনি তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজে পেয়েছিলেন শুধুমাত্র টিশার্টের জন্য। তরুণীর টিশার্টে লেখা ছিল, ‘হোয়াট ইজ ইওর মোবাইল নাম্বার?’
বুকের মধ্যে কষ্ট জমে পাথর হয় যাঁদের, তাঁরা কি টিশার্টের লেখার মাধ্যমে দুঃখ লাঘব করার কোনও মহৌষধ খোঁজেন? ইংরিজিতে একেই হয়তো প্যানাসিয়া বলে। না হলে কেন একজন লিখবেন, ‘আমি বড্ড একা। আমার বন্ধু হবে?’ একটা টিশার্টে লেখা দেখেছিলাম, ‘প্রিয়তম হে। জাগো, জাগো, জাগো।’ বিশেষজ্ঞরা বলেন, হৃদমাঝারে ইচ্ছের যে গুটিপোকারা লুকিয়ে থাকে, তারা পাখনা মেলতে চায় এমন স্লোগানে। এমনই এক টিশার্ট পরে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যে আপাতনিস্পৃহ মানুষটি, তাঁর মনের কথাগুলো হয়তো উথলে উঠতে চায় এমন টিশার্টের আঁকায় ও রেখায়। বড় বেরঙিন আজকালে মানুষ তো আসলে বন্ধু চায়, সঙ্গী চায়। কিংবা হয়তো চায় অবসাদ ভাগ করে নিতে। তার জন্যই কি এত আয়োজন?

ইংরিজি টিশার্টের প্রসঙ্গ এ যাত্রায় থাক। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। বিভিন্ন দোকানে হ্যাঙার থেকে ঝোলা কিংবা অনলাইন বাজার আলো করে থাকা বাংলা টিশার্টে যে স্লোগানগুলো দেখেছি, তার কথা বলা যেতে পারে। শহরের যে ব্যস্ত এন্ট্রি এগজিট গেটগুলো মানুষ বমি করে দিনরাত, সেখানে একটু চোখ রাখা যাক। দেখা যাবে, একতাল জনতার মধ্যে হঠাৎই একজন বেরিয়ে এলেন। তার পরনে যে টিশার্টটি আছে, তাতে হয়তো জ্বলজ্বল করছে ‘ল্যাদখোর’। দেখেছি, ‘ভেতো বাঙালি’, ‘এই তো জীবন কালীদা’, ‘আমায় ফার্স্ট হতেই হবে’— এমন কিছু বিস্ময়কর লাইন। বইমেলায় হাত ধরাধরি করে চলা এক কলেজপড়ুয়া কপোতকপোতীর টি শার্টে লেখা দেখেছিলাম, ‘হবু বর’, ‘হবু কনে।’ এক কবি, যিনি নিজেকে ব্যর্থ কবি বলে দাবি করতেই ভালোবাসেন, তাঁর সাদা টিশার্টে কালচে লাল অক্ষরমালায় লেখা দেখেছিলাম, ‘রাস্তায় কেন, পিক ফেলুন এখানে’। পিঠের দিকে লেখা ছিল, ‘সবই হল, পদ্য হল না।’
এমন টিশার্টের সন্ধান মেলে হাজারে হাজারে। নির্বাচিত কয়েকটি পাঠকের জন্য তুলে দিলাম:
১) তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো
২) সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে
৩) ভূতের রাজা দিল বর
৪) দেখো ভাল জনে রইল ভাঙা ঘরে
৫) দূরত্ব বজায় রাখুন
৬) যা কামাই, সবই ইএমআই
৭) কিচ্ছু খাইনি আমি, আজীবন কেস খাওয়া ছাড়া।
আমিও তাদেরই দলে দোষ না করেও ফেঁসে যায় যারা
৮) আমি বুড়ো সাধুর শিষ্য (সঙ্গে রামের বোতলের ছবি)
৯) আমি রামভক্ত হনুমান
১০) জীবনটা ধনেপাতা, বাটো আর চাটো
১১) জীবনে প্রচুর চাপ
১২) তোমায় নিয়ে বেকার ভাবি, তুমি পরের ঘরের চাবি
১৩) এ শালা বেইমানের দুনিয়া
১৪) তাতে তোর কি?
১৫) ওরম তাকিও না
১৬) এটা ভুঁড়ি নয়, ফিক্সড ডিপোজিট
১৭) পে-স্লিপ নেই, প্রেম রয়েছে
১৮) যতটা কচি নিজেকে ভাবো, ততটা কিন্তু নও
১৯) তুই কি চিনিস আমি কি জিনিস?
২০) অভাবের নবাব
মনের সার্কিট বোর্ড নিয়ে মাথা ঘামানো লোকেরা টিশার্টের উপরে সাজিয়ে রাখা এই বিবিধ ‘অলংকার’ দেখে প্রশ্ন তোলেন, প্রাণভোমরার মধ্যে লুকিয়ে থাকা কষ্টই কি আমরা প্রকাশ্যে আনতে চাইছি বারবার? বাহারি মেশিনগুলোও হয়তো এমন টিশার্ট ছাপার সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে! আমার অবসাদ কি আমার আর একার নয়? এই স্লোগানগুলোর অধিকাংশের মধ্যেই তো আসলে ঘাপটি মেরে রয়েছে জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা। প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা কি তবে মাসমাইনের সঙ্গে সমানুপাতিক? কে জানে! নাকি দিনের শেষে এই শ্লোগান আসলে জিওল মাছের মতো আশাকে বাঁচিয়ে রাখার কথা বলে? এ নিয়ে হয়তো গবেষণা হবে একদিন। এখনও ছাপা না হাওয়া আগামী দিনের ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো জানে।
ওয়েবসাইটের অলিগলি ঘুরলে বাংলা টিশার্টের বাজারচলতি স্লোগান নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। এমন টিশার্টের কলার থাকে না। তবে বিপন্নতাময় সাহসী লেখায় প্রতিটা পোশাকেই জুড়ে যায় এক অদৃশ্য কলার। গোলগলা টিশার্টগুলো কার্যত কলার তুলে ধরে। অক্ষিগোলকে বিস্ময় মাখিয়ে আমরা তা জুলজুল করে দেখি। মন্দারমনিতে বার্ষিক রিভিউ মিটিংয়ে আমি যে টিশার্টটা পরে গিয়েছিলাম তাতে লেখা ছিল, ‘হাজারটা লক্ষ হবে কবে?’ ক্যাপশন লেখা টিশার্ট পরেছিলেন আমার বসবাবুও। জ্বলজ্বল করছিল, ‘কোটিতেই সুখ।’
*ছবি সৌজন্য: LBB, Werbengali.com, Goodsbazaar
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
One Response
তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। চমৎকার বিশ্লেষণ।