ভেঙে গেছে মালিহাটির বিতর্ক সভা। কবি কর্ণপুর লিখেছেন “এই সভার পরেই বৃন্দাবনে শ্রী শ্রী রাধাকুন্ডে পরকীয়া ধর্মের ঝাণ্ডা গাড়া গেল। “যে কয়জন বাঙালি বৈষ্ণব পূর্বেই জয়পুরে ব্রজদেবের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে পরাভূত হয়ে স্বকীয় মত মেনে নিয়েছিলেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব স্বীকার করেছিলেন তাঁদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পঞ্চ শাখা থেকে তাঁরা বহিষ্কৃত হয়ে গেলেন। সুবে বাংলার পঞ্চ পরিবার থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ায় রাধামোহন সহ সুবাহুর প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেল, বৃন্দাবনে আধিপত্য বিস্তারে সুবিধা হল। আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা অস্বীকার করে কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছায় সুবাহু আত্মসমর্পণ করল।
এতকাল আড়ালে থাকা শিখী উপলব্ধি করেছে যাকে ভালবাসো তাকে নয়নের আড় কোরও না। যদি বন্ধন দৃঢ় রাখতে চাও তবে সুতা ছোট করো। রূপ মোহ মাত্র। শরীর আগুন। যদি অবিচ্ছিন্ন উত্তাপ চাও, চুল্লি চোখে চোখে রেখো। চুল্লি অবিকৃত থাকলে অন্ন সুসিদ্ধ হয়। উদর শান্ত হয়। গৃহে শান্তি থাকে।
শিখী শোনে উঠোনে ভক্তদের সামনে একই তলে উপবিষ্ট সুবাহুদেব বলেন, সোনাকে যেমন পুড়িয়ে নিখাদ করে তুলতে হয়,তেমনই মর্তের প্রাকৃত দেহ-মনকে পুড়িয়ে বিশুদ্ধ করে নিতে হয়। বিশুদ্ধতম দেহমনকে অবলম্বন করে যে প্রেম তখন হয়ে ওঠে নিকষিত হেম।
এক ভক্ত প্রশ্ন করে, মর্ত এবং বৃন্দাবন,এ তো প্রাকৃত ও অপ্রকৃত। উভয়ের ভেদ দূর করা কি সম্ভব?

কেন নয়? উত্তর দেয় সুবাহু। প্রাকৃতকেই সাধনা দ্বারা অপ্রাকৃতে রূপান্তরিত এবং ধর্মান্তরিত করা যেতে পারে। উপনিষদে আমরা দেখি একই দেবতা নিজের রমণেচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য দুই রূপ ধারণ করেছেন। সুরেলা কন্ঠে গুনগুন করে পদ শোনান সুবাহু।
অর্ধেক অঙ্গ হইতে আমি প্রকৃতি হইবো
অংশিনী রাধিকা নামা তাহার হইবো
সেইরূপেতে করে কুঞ্জেতে বিহার
সেই কৃষ্ণ সেই রাধা একুই আকার
শিষ্য ভক্তরা বাহবা দিয়ে ওঠে।
বেলা গড়ায়। শিখী কুটনো কোটে। দাসীদের দ্রুত হাত চালাতে নির্দেশ দেয়।
দুটি শিশু সন্তান সামলে বৈষ্ণব গৃহস্বামীর শিষ্য যজ্ঞের রসনা জোগাড় সহজ কথা নয়। তার মনেও পড়ে না রাগলেখার কথা।
বহুদূরে শ্রীবৃন্দাবন আশ্রমে বসে তখন রাগলেখা বাংলা প্রত্যাগত বৈষ্ণবদের মুখ থেকে শোনে, সুবাহুদেব নামে মালিহাটির বাঙালি বৈষ্ণব পণ্ডিতের কথা, যিনি শাখা বদল করে আজ সহজিয়াদের প্রধান। রাধা নাকি সহজিয়াদের কাছে পরকীয়া স্বকীয়া কিছুই নয়। এক অখন্ডের খন্ডিত সত্তা মাত্র। সহজিয়ারা নাকি নায়িকা ভজনার কথা বলে। সাধক হতে হলে প্রত্যেক নায়ক-নায়িকাকে তাদের প্রাকৃত নায়ক নায়িকাদের ভিতর কৃষ্ণ রাধার স্বরূপকে উপলব্ধি করতে হবে!
রাগলেখা এখন কৃষ্ণের পায়ে সমর্পিত সুনয়নী দাসী। রাগলেখা ভাবে, তাহলে আমিত্বময় সুবাহু নিজেকে সমর্থন করার মন্ত্র খুঁজে পেয়ে গেছে! মন্দিরে পুষ্পরচনার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছে সুনয়নী। আপন মনে এসব ভাবতে ভাবতে সেই কৃষ্ণ রাধার জন্য ফুলের শয্যা প্রস্তুত করে। মালার পর মালা গাঁথে।
সেসময় সুদূর মালিহাটিতে এক পন্ডিত তাঁর শিষ্যদের বলে চলেন, আরোপ সাধনের অর্থ হল, যে রূপের ভেতর স্বরূপের পরিপূর্ণ উপলব্ধি করতে না পারে, সেও নায়ক-নায়িকা পরস্পরের ভিতরে রাধা-কৃষ্ণকে আরোপ করে সাধনা করতে থাকবে। রূপের ভিতর দিয়ে স্বরূপের উপলব্ধি সহজ নয়। নায়িকার প্রতি অণু-পরমাণুর ভেতরেও তার স্বরূপ মিশে থাকে।
স্বরূপ ছেড়ে শুধুমাত্র রূপাশ্রয় হল বন্ধন। রূপের ভেতর স্বরূপের উপলব্ধিই মুক্তি।
সুনয়নী দাসীর এসব শুনলেও আর কিছু যেত আসত না। সে জেনে গেছে শেষ পর্যন্ত প্রথার জয় হয়। প্রেম বন্ধুত্ব সমমনস্কতা পড়ে থাকে চমৎকার বাক্যবিন্যাসে তথ্যের এঁটো পদ্ম পাতার মতো। পন্ডিত পুরুষ জ্ঞান ও ঔদার্যে ভিন্নমত নির্মাণ করে, ব্যক্তি জীবনে তার ছায়ামাত্র পড়ে না!
সুনয়নীর দূরদৃষ্টি নেই। থাকলে দেখত প্রাকৃতজনের মতোই সুবাহুদেব জ্ঞান দান, স্নান প্রক্ষালনাদি সমাপনে জমি জায়গার হিসাব কিতাব নেন! নায়েবদের সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলেন! নিখুঁত ভাবে ভৃত্য শাসন করেন! আহারে বসেন। কাঁসার থালার উপর পদ্মপাতায় শিখীর তৈরি কচুশাক কুলের অম্বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। কচুশাকেই আছেন স্বয়ং রাধা স্বয়ং কৃষ্ণ! তাকেই প্রণাম জানান সুবাহুদেব। রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনে যেহেতু পুরুষের ভূমিকাই প্রবল ও মুখ্য, শিখী আর রাগলেখারা মিলিয়ে যায় অপরিচয়ের অন্ধকারে।
বেলা গড়ায়। শিখী কুটনো কোটে। দাসীদের দ্রুত হাত চালাতে নির্দেশ দেয়।দুটি শিশু সন্তান সামলে বৈষ্ণব গৃহস্বামীর শিষ্য যজ্ঞের রসনা জোগাড় সহজ কথা নয়। তার মনেও পড়ে না রাগলেখার কথা।
বৈষ্ণবদের ক্রমবিজয়ে সংঘাত পরিস্থিতি তৈরি হয় অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে। লাহোরের বৈষ্ণব ও নাগা সন্ন্যাসীদের সংঘাতে নাগারা হত্যা করে বৈষ্ণবদের। বৈষ্ণব ধর্মের বিচিত্র প্রসারী শাখায় বিচিত্র বিষয়ে কৌতূহল তৈরি হয় ভিন্ন জাতের, ভিন্ন ধর্মের মানুষদের। অঙ্গুলি তলায় সখিভাবের বৈষ্ণবদের আখড়া দেখা যায়। বল্লভাচার্য সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবরা তাদের স্ত্রীদের গুরুর কাছে সমর্পণ করে। কেউ পর্দাপ্রথা মানে। কেউ পথে খোল করতাল নিয়ে পথে নেমে পড়ে। গ্রিক বৈষ্ণব থেকে ইংরেজ বৈষ্ণব বৈচিত্রের বহমান স্রোতে ভেসে থাকে চির কদম্ব কুঞ্জের কৃষ্ণ শ্রীরাধা। কোথায় হারিয়ে যায় রুক্মিণী সত্যভামার মতো কৃষ্ণের বৈধ ও সাধ্বী স্ত্রীরা।

কৃতজ্ঞতা: বাংলা ভাষায় প্রকাশিত যাবতীয় সাহিত্যের ইতিহাস। কাল্পনিক এই কাহিনির কিছু চরিত্র ও ঘটনা ঐতিহাসিক। মুর্শিদকুলি ও তাঁর পারিবারিক পরিচয় সত্য হলেও তা নিয়ে মতভেদ আছে। তিনি বৈষ্ণবদের জন্য মালিহাটি স্বকীয়া পরকীয়া তর্ক সভার ব্যবস্থা করেছিলেন। নাটোর দিঘাপতিয়ার বিখ্যাত হিন্দু জমিদারকূল তাঁরই আনুকূল্যে গঠিত। বৈষ্ণবের পঞ্চসাখা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ঘটনাটি ঐতিহাসিক। কাহিনীতে ব্যবহৃত কবিতাগুলি মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিদের কবিতা বা পদাবলী থেকে নেওয়া হয়েছে। ধর্মে মুসলমান বৈষ্ণব পদাবলীর কবিদের পদগুলি অবিক্রিত ভাবে রাখা হয়েছে।
বিশেষ ঋণ: গোদা অণ্ডাল, রাগমালা ছবি, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বৃন্দাবন দাস, সুখময় মুখোপাধ্যায়, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আহমদ শরীফ ও গোলাম মুরশিদ।
ছবি সৌজন্য: Pinterest
সমাপ্ত
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।