ঘরে আর জায়গা নেই। তার উপরে নিজের আগ্রহও ক্রমে সংকুচিত হতে হতে নির্দিষ্ট হয়ে পড়ছে। ফলে গত তিন-চার বছরে বই ও পত্রপত্রিকা কেনা অনেক কমে গিয়েছে, নির্বাচিত হয়ে পড়েছে। এমনকী, মাগনায় সৌজন্য কপি পেলেও সবসময় আর ভালো লাগে না। লিটল ম্যাগাজিন মেলাগুলিতে, বইমেলায় এখন নানাবিধ কনটেন্টের সঙ্গে একরকম লড়াই-ই চলে ভেতরে ভেতরে – আমি কিনতে চাই না, কাজগুলির গুরুত্ব ও মান আমার মতো খারাপ ক্রেতা ও ততধিক খারাপ পাঠককেও ঘাড় ধরে তা কিনিয়ে নিতে বাধ্য করে।
সদ্য প্রকাশিত এরকমই কিছু পত্রিকা গত কলকাতা বইমেলা থেকেও সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছি। তার সবটা যে এর মধ্যে খুব মন দিয়ে পড়ে ওঠা গিয়েছে, এমনও নয়। তবু একদম সংক্ষেপে দু-চার কথা, তাদের কয়েকটি সম্পর্কে, খুব প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বলা যাক।

প্রথম যেটির কথা বলব, তা ঠিক লিটল ম্যাগাজিন নয়। মাসিক এই পত্রিকাটিকে সাময়িকপত্র বলাই বাঞ্ছনীয়। বোলপুর থেকে প্রকাশিত ‘এখন শান্তিনিকেতন’ (সম্পাদক: আবীর মুখোপাধ্যায়)। তার জানুয়ারি ২০২০ সংখ্যাটির ‘কভার কাহিনি’ জুড়ে রয়েছে লিটল ম্যাগাজিনেরই এক তরুণ। প্রেমিক ও কবি। আলাভোলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। ইডিয়েটের মতো সে এইসব বইমেলা-ফইমেলাকে টুসকি মেরে কেটে পড়েছে বছর দুয়েক হল। তার ম্লান হাসি এবারও ছড়িয়েছিল বইমেলার রোদে, ধুলোয়, দু-এক পশলা বৃষ্টিতেও। কবি সুপ্রভাত রায়কে নিয়ে এই মন-খারাপ-করা সংকলন যুগপৎ সেপিয়া ও সবুজ।
‘নাটমন্দির’। পুরুলিয়া থেকে প্রকাশিত বইমেলার কালো ঘোড়া। চুপিসাড়ে কীভাবে অন্তর্ঘাত করতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই ‘নাটমন্দির’। তার চিরাচরিত সাদামাটা লুকে বাংলা কবিতার বারুদ-বিশেষ! ‘আড্ডার পাতা’-য় অন্যতম সম্পাদক অংশুমান করের বয়ানের সঙ্গে সহমত – ‘‘আজ ‘নাটমন্দির’ একটা ব্র্যান্ড। রঞ্জন আচার্যর নেতৃত্বে এই পত্রিকা প্রমাণ করেছে যে, ছোটো পত্রিকারও ব্র্যান্ডভ্যালু (সদর্থে) থাকতে পারে।’’ এই সংখ্যায় মুগ্ধ হলাম সোহেল ইসলাম, শক্তি কুম্ভকার, অনির্বাণ মজুমদার, জিশান রায়ের কবিতায়। সৌম্যজিৎ রজকের ব্যক্তিগত গদ্যও মনে-মগজে ধাক্কা মারে।
এই সময়ের বাংলা কবিতাকে ধরে রাখার জরুরি কাজটি গত আট বছর ধরে করে চলেছে হাওড়ার ‘শুধু বিঘে দুই’ (সম্পাদক: সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়)। প্রতিবারের মতো এবারেও সূচিপত্রের পরই একটি সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার। অনুজের নেওয়া অগ্রজের সাক্ষাৎকারের চেনা প্যাটার্ন ভেঙে কবি মিতুল দত্তের সঙ্গে কথা বলেছেন কবি যশোধরা রায়চৌধুরী। বিষয় বৈচিত্র্যে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই সংখ্যার প্রবন্ধ তিনটিও – দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘‘‘গল্পই কবিতার প্রাণবায়ু’: একটি নিরীক্ষা’’, পার্থজিৎ চন্দর ‘‘দুই দশকের আলো ও ‘অন্ধকার’ – একটি খণ্ডিত সফর’’ এবং যশোধরা রায়চৌধুরীর ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার অন্নময় ভুবন’। এই কাগজের প্রতি পাঠকের আগ্রহের প্রধানতম কারণ সম্ভবত এক ঝাঁক তরুণ কবির গুচ্ছ কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থের আলোচনা। সেসব এবারও যথাযথ। তবে পাঠের সময় একটি প্রশ্ন জাগে; এই সংখ্যাটিতে প্রত্যেক কবির জন্যই এক পাতা করে স্থান বরাদ্দ, তাতে কারো তিনটি, কারো-বা ছ-সাতটি কবিতার সন্নিবেশ। কিন্তু কারো ক্ষেত্রেই তা এক পাতার সীমা লঙ্ঘন করে না। এ কি ঘটনাচক্রে না খানিক সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তই? ভালো কবিতাকে সংখ্যায় আটকে না রাখা প্রশংসনীয়, কিন্তু ক্ষেত্রফলে বেঁধে ফেলার প্রবণতা সর্বদা উচিত কাজ কি? ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই।
বাংলার জেলায় জেলায় লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণবায়ু আজও কতটা সতেজ, তা টের পাই হুগলি জেলার ‘দাহপত্র’ হাতে নিলে। তার এবারের সংখ্যা কবি

অমিতাভ মৈত্রকে নিয়ে। পত্রিকা শুরুতে ‘দাহপত্র কথা’ অংশেই স্পষ্ট হয়ে যায় পত্রিকার বাঁধুনিতে সম্পাদক কমলকুমার দত্তর ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি। অমিতাভ মৈত্রের অপ্রকাশিত গদ্য, কবিতা, সাক্ষাৎকার, পাণ্ডুলিপির ফ্যাকসিমিলি – ইত্যাদি নানাকিছুর মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে বাংলা কবিতার হ্যালোজেন থেকে দূরে থাকা এই কবির ছায়া ক্রমে পাঠকের চোখে ফুটে ওঠে।
কবি সুমিতাভ ঘোষালকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘কাগজের ঠোঙা’ (সম্পাদক: প্রিয়াঙ্কা ও সুপর্ণা)। পাতলা, কিন্তু ধারালো। সাড়ে তিন ফর্মা আর আধা জ্যাকেটে ধরা দিয়েছেন ‘মায়াজলে ছায়াময় সুমিতাভ’। তসলিমা নাসরিন, সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজীব সিংহের অকপট গদ্য কিংবা কবিতার আলোচনা, সুমিতাভর সাক্ষাৎকার, গদ্য, কবিতা – সব মিলিয়ে আদ্যন্ত ন্যাকামি-বর্জিত এই কাজ চমৎকৃত করে!
‘চমৎকার’ অবশ্য এই নিয়ে চতুর্থ বারও চমৎকার! লিটল ম্যাগাজিন নয়, ‘৯ঋকাল’ প্রকাশনীর মুখপত্র। এবারের বিষয়: প্রুফ রিডিং। কিছু পুনর্মুদ্রণ, কিছু নতুন লেখায় অবশ্য-সংগ্রহযোগ্য একটি কাজ। বাংলা ছাপাছাপির দুনিয়ার এই দীর্ঘায়িত ‘খোকাকাল’ থেকে মুক্তি পেতে এমন দাওয়াই, তার পাঠ ও অনুধাবন আজ অত্যন্ত জরুরি বলেই বোধ হয়। তবে, দুইখান কথা এইখানে কইবার! এক, প্রুফ রিডিং বিষয়ক এই কাজে আরেকটু প্রুফ রিডিং প্রয়োজন ছিল বলে মনে হচ্ছে। দু-একটি উল্লেখ করি। শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের তুখোড় সম্পাদকীয় ‘সংশোধনবাদ জিন্দাবাদ’ লেখার পঞ্চম প্যারাগ্রাফের প্রথম লাইনেই ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’ য-ফলা খুইয়ে হয়ে রয়েছে ‘স্টান্ডার্ডাইজেশন’। অনির্বাণ রায়ের ‘প্রুফ নিয়ে দু-চার কথা’-র দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে (পৃ. ৩১) ‘গৌরীপ্রকাশ ঘোষ’ নিশ্চয় হবেন ‘গৌরীপ্রসাদ ঘোষ’। রাজীব চক্রবর্তীর ‘স্টাইলশিট’ শীর্ষক ছোট কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক খাসা লেখাটির (পৃ. ৩৭) ‘যতিচিহ্ন’ আর ‘যতি চিহ্নের’ – কোনটি ঠিক? স্পেস থাকবে না কি থাকবে না? দ্বিতীয় যেটি বলার, তা আমাদের চলতি অভ্যাস নিয়েই। এই সংকলনে চঞ্চলকুমার ঘোষের ‘প্রুফরিডার’ গল্পেই দেখি হতদরিদ্র প্রুফরিডার নিমাইবাবু আক্ষেপ করছেন – ‘বইতে লেখকের নাম থাকে, প্রকাশকের নাম থাকে, শিল্পীর নাম থাকে, ছাপাখানা, এমনকী বাইন্ডারের নামও কোথাও কোথাও থাকে, কিন্তু প্রুফরিডারের নাম কখনো দেখেছেন?’ না, প্রুফ রিডিং বিষয়ক এই সংকলনেও প্রুফরিডারের নাম নেই কোথাও।
তবে, আছে। এই সময়ের বাংলা লিটল ম্যাগাজিনেও যথাযথ গুরুত্ব-সহ প্রুফরিডারের নাম আছে। জিৎ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘উত্তরকাল’ পত্রিকার টাইটেল ভার্সো জানান দিচ্ছে এই সংখ্যার ‘প্রুফ সংশোধক অভিরাম ঘোষ’। ছিমছাম ও নিটোল এই সংখ্যাটির সম্পদ তিন কবির সাক্ষাৎকার – শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও জয় গোস্বামী। নরেশ গুহকে লেখা বুদ্ধদেব বসু ও অশোক মিত্রের অপ্রকাশিত চিঠিগুলি চমকে দেয়। ভূমিকা ও টীকা-সহ বোরিস পাস্টেরনাকের অনুবাদে কবি-অনুবাদক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় স্বকীয় ঢঙে হাজির।
সম্পাদনা ও সামগ্রিক বিন্যাসে বেশ কাঁচা কাজ হলেও কলকাতা সাইকেল সমাজের পত্রিকা ‘সাইকেল ও সমাজ’ এই বইমেলার অন্যতম প্রাপ্তি। বাংলা ও ইংরাজি লেখায় সাজানো এই চটি পত্রিকাটি। মুখ্যত সচেতনতামূলক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা গ্রন্থিত হয়েছে। শতঞ্জীব গুপ্ত, শিলাদিত্য সিংহ, পৃথা মুখোপাধ্যায়, সুনীশ দেবের মতো নানা ক্ষেত্রের মানুষজন সাইকেল নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতাও জানিয়েছেন।

বইমেলায় প্রকাশিত কিছু জরুরি পত্রিকার কথা এ-লেখায় নিশ্চিতভাবেই বাদ পড়ে গেল। এ আমার অক্ষমতাই। তবে, সচেতনভাবে বাদ দিয়েছি সেই পত্রিকাগুলির কথা, যাদের সঙ্গে আমি নিজেও কোনো-না-কোনওভাবে জড়িয়ে ছিলাম। শেষে, নিয়ম ভেঙে, সেই তালিকার একটি পত্রিকার কথা না বললেই নয়। বহরমপুর থেকে প্রকাশিত, শান্তনু সরকার সম্পাদিত ‘শুভশ্রী’। বিপুলাকায় এই সংখ্যাটির বিষয়: ‘খাবারের স্বাদ কাহন’। খাবার নিয়ে নানাবিধ বিচিত্র বিষয় উঠে এসেছে এই অসামান্য সংকলনটিতে। ‘বাঙালিনীর রান্নাঘরের বিবর্তন’ (যশোধরা রায়চৌধুরী), ‘বাঙালির মেনুকার্ড-এ খাদ্য-খাবারের সুলুকসন্ধান’ (গৌতমকুমার দে), ‘বাংলা খাবারের ডিজাইন’ (শঙ্খশুভ্র গঙ্গোপাধ্যায়), ‘বাংলাদেশের ব্যঞ্জন বৃত্তান্ত’ (রজতকান্তি রায়), ‘আম নিয়ে সাতসতেরো’ (প্রকাশ দাস বিশ্বাস), ‘জেলের খাবার’ (শিলাদিত্য চক্রবর্তী), ‘খাবার-ফেরিওলার ইতিবৃত্ত: কলকাতার সেকাল-একাল’ (শিমূল সেন) – রয়েছে এমন আরও বহুবিধ ইন্টারেস্টিং বিষয়। মিলন দত্ত, বরুণ চট্টোপাধ্যায়, হরিপদ ভৌমিক, রাজদীপ রায়, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, নবকুমার ভট্টাচার্য, মনন ঘোষ, পল্লব মুখোপাধ্যায়, অপূর্বকুমার পাণ্ডার লেখাও বিশেষভাবে নজর কাড়ে। তবে, পত্রিকা হাতে নিয়ে শুরুতেই বিস্বাদ করে দেয় প্রচ্ছদ। এমন সংকলনের সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি। টিপিক্যাল কলকাত্তাইয়া, খানিক অখাদ্যও।
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত সুস্নাত এখন মুদ্রণশিল্পের ওপর মনযোগ দিয়েছেন। বোধশব্দ পত্রিকা ও প্রকাশনীর সম্পাদকের দায়িত্ব সামলে সময় পেলেই লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বই প্রকাশের নানা দিক নিয়ে ওয়র্কশপ পরিচালনা করে থাকেন।
4 Responses
সুন্দর বিশ্লেষণ।
ভালো লাগল।
চমৎকার লেখা।
সত্যি, শুভশ্রীর প্রচ্ছদটি একদমই ভালো নয়।খুবই রুচিহীন।দেখেই আপত্তি জানিয়েছিলাম। ততদিনে ছাপা হয়ে গেছে।
চমৎকার রিভিউ… শার্প, ক্রিস্প…