দৃশ্য ১
রাত। একটা ঘুমিয়ে থাকা ফাঁকা পাড়া।
[ল্যাম্পপোস্টের আলো দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে বৃষ্টি। জল জমছে খালি টিনের বাক্সে। টালির ছাদে। ভিজছে গায়ে গায়ে লাগানো কার্নিশ। বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়া খোলা নাইটি। উড়ে যাচ্ছে নাইটগার্ডের বাঁশির শব্দ ঝোড়ো হাওয়ায়। আবার বৃষ্টি নামল মুষলধারে।]
দৃশ্য ২
রাত। ট্রেনের কামরার ভেতর।
[সাইড লোয়ার বার্থে হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা মেলে বসে আছে ঝিলিকের শরীর। দুরন্ত হাওয়ায় সবথেকে উঁচু ইউক্যালিপটাসটার মতো হেলে পড়ছে চুল চোখের উপরে। পলক পড়ল দু’বার খোলা জানলায়। ভেতরটা অন্ধকার। পাশে থেকে যাওয়া স্টেশনের আলো ঢুকছে বেরোচ্ছে ইচ্ছেমত। এবারও স্টেশনের নামটা ঝাপসা হয়ে গেল গতিবেগে।]
দৃশ্য ২(ক)
রাত। একটা নির্জন প্রান্তরের মাঝখানে।
[মাঠের মাঝখানে একটা একতলা বাড়ি। বাঁশের কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে। বাল্ব ঝুলছে। একটা তেপান্তরের শিরদাঁড়ার উপর থেমে গেল ট্রেনটা। এসেমেস এলো ঝিলিকের ফোনে। অর্কর লেখা।]
অর্ক [ভয়েসওভার]-
স্বপ্ন মনে থাকে না আজকাল।
কিছু শব্দ মনে থাকে
ভাঙার শব্দ, জোড়া লাগার শব্দ
এমনকি খসে পড়ারও।
দৃশ্য ২(খ)
রাত। ট্রেনের দরজার সামনে।
[প্রায় সবটাই কালো বাইরের অন্ধকারে। সাপের ব্যাঙ ধরার শব্দের মত রহস্যময়। বড় নিশাচর। ঝিলিক দাঁড়িয়ে ট্রেনের দরজায়। জলখোলা বেসিনের আলোয়। লিখে ফেলল কয়েকটা লাইন। মোবাইলে।]
ঝিলিক [ভয়েসওভার] –
আঁধার বৃত্তের মাঝখানে
একটা বাড়ি বাক্সের মতন
যেন কেউ শব্দ রেখে চলে গেছে
বাল্বের পাহারায়
আসছে মাসের মেঘে ওরা হয়ত
কথাগাছ হয়ে বেরোবে
বাড়িটার গা’য়।
দৃশ্য ৩
দিন। সমুদ্রের বালিয়াড়ি।
[ভেজা বালিতে কয়েকটা পায়ের ছাপ। ভাঙা ঝিনুক। ফেনার বুদবুদ। একটা ঢেউ এসে সব নিয়ে চলে গেল। ফিরে যাওয়া জলের স্রোতে বালি সরে যাচ্ছে লেগিংস পরা একটা মেয়ের পায়ের তলায়। ঝিলিক। সমুদ্রের গভীরে চোখ। যেন কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে।]
দৃশ্য ৪
দিন। জলমগ্ন কলকাতার রাস্তা।
[চটি হাতে নিয়ে হাঁটুজল পেরিয়ে হেঁটে আসছে দুজোড়া পা। একটা ছেলের। একটা মেয়ের। অর্কর জিন্সের রঙটা বদলে গেছে ভিজে। ঝিলিকের লেগিংস পরা পা’টা যেন ভিজে ভারি। তাই জল সরাচ্ছে না। যেন বারবার ভাসিয়ে দিচ্ছে। দুজনের হেঁটে চলার সাথে কিছু কথা শোনা যায়। হাতদুটো ধরা।]
ঝিলিক – কালকের লেখাটা আরেকবার বলবে … এক্ষুনি।
[কয়েকমুহুর্তের নীরবতা। অর্ক র হাত থেকে সিগারেটের ছাই খসে পড়ে রাস্তার স্রোতে। শুরু হয় তার আড়ম্বরহীন বলা।]
অর্ক –
এখন দুপুর
আস্ত চানঘর একটা শহর
কাপড়চোপড় শরীরগুলো নিয়ে ভিজছে
শুধু একটা ন্যাংটো ছেলে
অপেক্ষা করছে বাস আসার
ছেলেটা ঢেউ হয়ে যাচ্ছে
মেখে নিচ্ছে সমুদ্র
এখন শহর
ওর সমুদ্রওয়ালা।
দৃশ্য ৩(ক)
দিন। সমুদ্রের বালিয়াড়ি।
[একটা ঢেউ এসে ফেনা হয়ে গেল নৌকার গা’য়। নৌকাটা বালির পিঠে আঁচড় কেটে চলে যাচ্ছে গভীরের দিকে। কয়েকটা মানুষ চামড়ার কালো চাবুক বেঁধে আছে নৌকায়। সমুদ্রের জ্বর ওদের গায়ে। তাই ওদের শীত নেই। ওদের শরীর ঠান্ডা হয় না। তাই ওদের মৃত্যুভয়ও নেই। ঝিলিকের তোলা ক্যামেরায় ওদের ছবিতে সেই উদ্যমটা ছাড়া আর সব আছে। মাছধরার জালের প্রেক্ষাপট। স্টোভের উনুনের কালি। আয়না। গামছা। স্যান্ডো গেঞ্জির উপর ফেলে রাখা বিড়ির প্যাকেট, আগুন। ঝিলিক সেই উদ্যমটা খোঁজার জন্য সমুদ্রের দিকে তাকাল। তারপরে আনমনে মুছে ফেলল ছবিটা।]
দৃশ্য ৪
ছাদ। বিকেল।
[নরম আলোর বিকেল। কার্নিশে পুরুষ পায়রাটার ডাকে একটা অদ্ভুত কাম। সেই অদৃশ্য যৌনতায় সাড়া দিয়েও যেন দিচ্ছে না সঙ্গিনীটি। শরীরের স্পর্শে শূন্যতার দিকে ঝুঁকে আছে দুটো মানুষের নীরবতা। পায়রাগুলো উড়ে যাবার শব্দে নীরবতা ভাঙল।]
অর্ক – সমুদ্রের উচ্ছ্বাসটা মাঝেমাঝে একঘেয়ে লাগে। আস্ফালন মনে হয়। কিন্তু পাহাড় অনেকটা ভাবনার অবকাশ দেয়। সেও খাদের কাছে টেনে নিয়ে যেতে চায় আরও বেশী কাছে আসার জন্য। কিন্তু সেই চাওয়াটার মধ্যে দাবী নেই। ডানা আছে। উড়তে শেখার।
ঝিলিক – সমুদ্রকে গায়ে পড়া বলছ? সমুদ্র কিন্তু গায়ে পড়া মানুষ নয়। জাস্ট একটা উন্মাদনা। দিগন্তহীন। দিক্বিহীন।
অর্ক – এখান থেকে শহরটাকেও সমুদ্র মনে হচ্ছে তাই না?
ঝিলিক – হুঁ … মনে হয় মাঝেমাঝে। তোমার সঙ্গে দাঁড়ালে মনে হয়।
অর্ক – তাতে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। ওটা তোমার। হয়ত ওটাকেই মন বলি আমরা।
ঝিলিক – হুঁ … কি জানি … তবে এটা তো ঠিকই মন ভালো থাকলে সবকিছুই মনে হয় সমুদ্র। যেটা নেয় সেটা ফিরিয়েও দেয়।
অর্ক – আর তারপরেই মন খারাপ হয়ে যায় হঠাৎ। কারণ সমুদ্র থাকতে জানে না। আসে চলে যায়। আসে চলে যায়।
ঝিলিক – হয়ত কিছুটা পাহাড়ি বৃষ্টির মতো খামখেয়ালি। আমার বোধহয় তোমার সঙ্গেও থাকা হবে না। মানে থাকতে চাই না আর কি। থাকলেই উচ্ছ্বাসটা একঘেয়ে হয়ে যাবে। আস্ফালন মনে হবে অনেককিছু। আবার অনেককিছু আস্ফালন নয় বলেও মন গুমোট হয়ে যাবে। বদ্ধ লাগতে পারে।
[অর্ক তাকায়। রেলিঙে কনুই রাখা হাতের মুঠোয় চিবুক রেখে অর্ক তাকিয়েই থাকে। অপলক। হাসির দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস দাঁড়িয়ে থাকে।]
দৃশ্য ৫
সমুদ্রের বালিয়াড়ি। বিকেল।
[ডাবের স্ট্র কিছুটা রঙ মেখে নিয়েছে ঝিলিকের ঠোঁট থেকে। নোনা হাওয়ায় এলো হয়ে যাচ্ছে রামধনু রঙের ছাতা, ছায়া। ঝিলিক কিন্তু চোখের উপর মেলে রাখা চুলগুলো সরাচ্ছে না। ঝিনুকের মালা নিয়ে একটা বিনুনি বাঁধা বাচ্চা সমুদ্রটাকে আড়াল করে দাঁড়ালো।]
বাচ্চা – ও দিদি দিদি … একটা মালা নাও না … তোমাকে হেব্বি লাগবে। সত্যি বলছি।
[ঝিলিক একটা মালা বেছে নেয় একঝলক তাকিয়ে। সেটা জড়িয়ে নেয় হাতে। কয়েক পাক। হাতটা নড়লেই ঝিনুকগুলো যেন কথা বলে।]
দৃশ্য ৬
একটা জঙ্গলের ভেতর কটেজের বাইরে। রাত।
[একটা আবছায়া মাখা কটেজের সামনের ঘাসজমি। শুকনো পাতায় আগুন জ্বলছে। দূরে কেয়ারটেকারের ঘরে একটা বাল্বের আলো পাতার ফাঁকে কাঁপছে।]
অর্ক – একটা অদ্ভুত শান্তি আছে অন্ধকারের মধ্যে!
ঝিলিক – অনেকরকমের অন্ধকার হয়।
অর্ক – হুঁ কিন্তু এটা ঠিক অন্ধকার নয়।
ঝিলিক – এটা আলোআঁধারিও নয়। অন্ধকারের আলো।
[ঝিলিক মাথা রাখে অর্ক র কাঁধে। তারপর একমুহুর্ত চুপ করে থেকে বলে -]
ঝিলিক – একটা মিহি শব্দ কানে আসছে একটানা। মন দিয়ে শোনো। বুঝতে পারবে। আসলে দূরে কোথাও একটা রেডিও চলছে।
অর্ক – বা হয়ত আদিবাসী গান।
ঝিলিক – না। মাদল নেই।
অর্ক – গতকাল বাজছিল। মাঝরাতে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বারান্দায় এলাম। সিগারেটটা ধরাতে গিয়ে অদ্ভুত একটা শিহরণ হল। বাইরে বেশ ঠান্ডা তখন। তোমার দরজার দিকে তাকিয়ে মনে হলো কি জানি হয়ত চাদর সরে গেছে গা থেকে। কুঁকড়ে শুয়ে আছ।
ঝিলিক – আমার ঘরটায় একটা গা ছমছমে ব্যাপার ছিল।
অর্ক – ভয় পেয়েছিলে?
ঝিলিক – উঁহু, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবে একবার ডাকলে পারতে।
[ঝিলিকের আঙুলের উষ্ণতায় বাঁধা অর্কর আঙুলগুলো। অর্ক বলে-]
অর্ক – দুটো আলাদা ঘর নেবার কি কোনও দরকার ছিল?
ঝিলিক – শেষবার দেখলাম। তোমার সাথে থেকেও আলাদা থাকতে কেমন লাগে।
অর্ক – মানে?
ঝিলিক – কিছু কিছু জিনিস তোমায় বড্ড গোদা করে বোঝাতে হয়।
অর্ক – যেমন ?
ঝিলিক – আসলে তুমি ছেলে, তাই।
অর্ক – আবার এটাও তো ঠিক কিছু কিছু কথা খোলামেলা বলাই ভালো।
ঝিলিক – খোলামেলা বলাই যায় কিন্তু সোজাসাপ্টা নয়।
অর্ক – হুঁ …
ঝিলিক – আমার সাথে থাকবে? যদি কোনওদিন বিয়ে না করি?
[শুকনো পাতার আগুনটা নিভুনিভু। ঝিলিকের পায়ের পাতায় অর্কর পা। ধোঁয়াটা পাশ কাটিয়ে যেতে পারছে না যেন।]
অর্ক – কফি খাবে?
ঝিলিক – খেতে পারি। তুমি করবে?
দৃশ্য ৭
কটেজের বারান্দা। ভোর।
[কুয়াশা ভেজা বারান্দার রেলিঙ। ঝিলিক জল মুছে দিচ্ছে আঙুল দিয়ে। পেছনে এসে দাঁড়াল অর্ক। হাতে দুটো কফির কাপ। ধোঁয়া উঠছে। একটা কাপ আলতো ছোঁয়ায় ঝিলিকের শরীরে। চমকায় না সে। শুধু হাসে। অর্কর বুকে মাথাটা আলতো ঠেকিয়ে কফির কাপটা নেয়। বুকের থেকে চোখ তুলে ঝিলিক অর্কর চোখ খোঁজার জন্য তাকায়।]
ঝিলিক – তোমার চেনটা বালিশের তলায়। ওই অবস্ট্রাকশন না থাকলেও ভালো লাগে না।
দৃশ্য ৮
জঙ্গলের ভেতর। সকাল।
[একটা রাস্তা চলে গেছে কুয়াশার দিকে। ভেজা ভেজা সবুজের মশারির ফাঁক গলে নামতে চাইছে প্রথম রোদ্দুর। কিছু নাম না জানা পাখিদের ক্যাক্যাফোনি। অর্কর গলা শোনা যায়।]
অর্ক – একদিন কেউ এসে বলবে তোমার ঘর অনেকদিন ঝাড়পোঁছ করা হয়নি/ আমি একটা আস্ত নদী এনেছি।
দৃশ্য ৯
রাস্তা। দিন।
[একটা ভ্যান রিকশার চাকার সামনে ঝিলিকের পা দুটো দুলছে। সরে যাচ্ছে পিচরাস্তা। সঙ্গে ঝিলিক আর চালকের কথোপকথন।]
ঝিলিক – মোহনাটা এখান থেকে কতদূর গো?
চালক – আরও আধা ঘন্টার একটু বেশি লাগবে দিদি।
ঝিলিক – তুমি কাল ভোরবেলায় আমায় নিয়ে যাবে?
চালক – এখন যাবেন না?
ঝিলিক – না।
চালক – কেন দিদি?
[ভ্যানের চাকার স্পোকগুলো ঝাপসা লাগে না আর। ঝিলিক আনমনা। হঠাৎ বলে-]
ঝিলিক – কাল না পারলেও ব’লো।
দৃশ্য ১০
লেক। বিকেল।
[রেলিঙে কনুই এর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক । পাশে ঝিলিকও। সামনে অনেকটা ঝিল। শান্ত। আকাশের ছায়া। গভীর। জলের উপর খসে পড়ল সিগারেটের ছাই। পাশে দাঁড়ানো ঝিলিকের চুলে লেগে থাকা একটা শুকনো পাতা ফেলে দিতে দিতে অর্ক বলে-]
অর্ক – কী করে বুঝলে ওটা হাসব্যান্ড নয়?
ঝিলিক – [দূরে আঙুল দেখিয়ে] পানকৌড়ি…
অর্ক – মেয়েটাকে তুমি চেনো?
ঝিলিক – ভেলপুরি খাচ্ছিল আমি লোভ দিয়েছি।
অর্ক – আমি যখন বললাম, না বললে কেন?
ঝিলিক – ওই যে আরেকটা।
অর্ক – এটা আগেরটাই।
[একটু দূরে জলের মধ্যে নানা বয়েসের বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বড় ছোট। আরও ছোট। একটা সময় বড় হবার খেই হারিয়ে যাচ্ছে বৃত্তগুলোর। মানুষের মতোই। সূর্যটাও ক্রমশ আকৃতি হারিয়ে ফেলছে। ভাঙা কুসুমের মতো। ঝিলিক বলে-]
ঝিলিক – তুমি কি আমায় কোলের উপর বসিয়ে ভেলপুরি খাইয়ে দিতে?
অর্ক – এখানে! তোমার লজ্জা করত না?
ঝিলিক – তোমার করত। তুমি অতটা সাহসী নও।
অর্ক – এতে সাহসের কি আছে ?
ঝিলিক – একটা না জানো, অ্যাকচুয়ালি দুটো পানকৌড়ি। একটার মাথার উপরে একটুখানি লোম ওঠা।
অর্ক – হতে পারে। বর বৌ।
ঝিলিক – নামহীন হতে পারে না?
অর্ক – সম্পর্ক?
ঝিলিক – হুঁ।
অর্ক – চলো ওই দিকটায়। বসি।
ঝিলিক – কোলে?
[চোখে হাসলে অদ্ভুত সুন্দর লাগে ঝিলিককে। অর্ক লোভীর মত তাকিয়ে থাকে। বলে- ]
অর্ক – সেটা তো বাড়িতেই হতে পারে।
ঝিলিক – যদি না থাকত বাড়িটা?
অর্ক – মানে?
ঝিলিক – পারতে একটু বেশি কাছাকাছি, শরীরে শরীর ছুঁইয়ে, গলার কাছে মুখ এনে, ঠোঁট
কামড়ে, জাপটে ধরার লোভ সামলাতে?
অর্ক – বুঝলাম। আর ওই মেয়েটা ?
ঝিলিক – মেয়েটা তো পানকৌড়ি। বারবার জলে ডুবও দেবে, আবার ডালের উপর ডানা মেলে গা’টাও শুকিয়ে নেবে। নাকের কাছে সিঁদুরের গুঁড়ো সব নতুন বৌদেরই থাকে। ওটা আসল না নকল তাতে কী এল গেল!
দৃশ্য ১১
লিফটের ভেতর। রাত।
[একটা কোণ ঘেঁষে লিফটের কাচে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝিলিক। নতুন বৌ বৌ টাইপ একটা বেঁটে স্বাস্থ্যবতী মেয়ে একটা লম্বা ঝকঝকে ছেলের হাতটা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তাকে জিরাফের মতো লাগছে মেয়েটার পাশে। বা উল্টোদিক থেকে বললে মনে হচ্ছে একটা মই রাখা আছে শহীদ মিনারের পাশে। সদ্য বিবাহিতা মেয়েটার নাকের উপর সিঁদুর। চোখগুলো বড় বড়। বাদামী। উচ্ছল। ছেলেটার গলাটা স্বরটা বেশ। ভরাট।]
ছেলেটা – আপনার রুমালটা বোধহয় পড়ে গেছে।
[ঝিলিক দেখে পায়ের কাছে রুমালটা পড়ে আছে। তুলে নেয়। সৌজন্যের হাসি নিয়ে জানতে চায়-]
ঝিলিক – আপনারা আজই এলেন?
ছেলেটা – না আজ থার্ড ডে। কাল ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।
মেয়েটা – উফ্ আবার কলকাতা!
ঝিলিক – কলকাতা ভাল্লাগে না?
মেয়েটা – উঁহু ।
ছেলেটা – আসলে বালিতে ওদের যে বাড়িটা সেটা একদম গঙ্গার ধারে। মানে অলমোস্ট ঢিল ছোঁড়া দূরত্ব। আর এখন ঘুম ভাঙছে [কথা কেড়ে নিয়ে ঝিলিক বলে-]
ঝিলিক – বাস অটো ট্যাক্সির চিৎকারে।
[মেয়েটা চোখের পাতাগুলো বড় বড় করে একটা দারুণ আপত্তি নিয়ে বলে-]
মেয়েটা – আরে না! সেটা হলে তো তবু কথা ছিল!
[লিফট থামে। দরজা খোলে। তিনজনে বেরিয়ে আসে।]
দৃশ্য ১১এ
হোটেলের করিডর। রাত।
মেয়েটা – আমার বৌভাতের পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙেছিল একটা অ্যাক্সিডেন্টের চেঁচামিচিতে। ক্যান ইউ ইমাজিন? সকালে বোধহয় লেকে মর্নিং ওয়াক-এ বেরিয়েছিল। রাস্তা পার হতে গিয়ে। ওমা ওকে দেখছি কি কুল! কোনও তাপ উত্তাপ নেই। অষ্টমঙ্গলার পর ফিরেছি, খুব টায়ার্ড, হঠাৎ রাতে অটোস্ট্যান্ডে সাটল ট্যাক্সি আর অটোওয়ালাদের ঝামেলা। এ ওকে বোতল ছুঁড়ছে, রড নিয়ে তেড়ে যাচ্ছে! কী অবস্থা! পরদিন তো নিউজ চ্যানেলেও দেখিয়েছিল।
[হালকা আলোর করিডোরে দরজাগুলো সরে সরে যাচ্ছে। কোনওটা বন্ধ। কোনওটা খোলা। পর্দা ফেলা। কোথাও টিভির শব্দ। কোথাও টুকরো কথা বা হাসির। হাঁটতে হাঁটতে তিনটে শরীর করিডরটাকে বেশ অনেকটা লম্বা করে দিয়ে একই জায়গায় এসে দাঁড়াল। ছেলেটা চাবি দিয়ে দরজা খুলতে যেতেই ঝিলিক বলল-]
ঝিলিক – ও আপনারা এই রুমটায়? খেয়াল করিনি তো!
[একটা দরজা খোলার শব্দ। পর্দা সরানো। এলোমেলো বিছানা। ছেড়ে রাখা পোশাক। এইসব টুকরো দৃশ্যের উপরেই ছেলেটির গলা শোনা গেল-]
ছেলেটা – অ্যাকচুয়ালি আজই চেক ইন করেছি আমরা।
[ঝিলিক যেন ঠিক মেলাতে পারে না। ওর মনে পড়ে যায় লিফটের ভেতরে কথাগুলো – “ঝিলিক – আপনারা আজই এলেন? / ছেলেটা – না আজ থার্ড ডে। কাল ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।” মেয়েটা হঠাৎ বলে -]
মেয়েটা – আপনার কোন রুমটা?
ঝিলিক – আমি তো পাশেরটাই। আমি সেই সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বেলার দিকে একবার এসে স্নান করেই আবার বেরিয়ে গেছি।
[মেয়েটা ঘরের ভেতরে যাবার জন্য উসখুস করছে। তবু বলল -]
মেয়েটা – ভেতরে আসুন না। যা অবস্থা রুমের!
[ঝিলিকের ঠোঁটের কোণে হাসি। অসম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।]
ঝিলিক – নাহ্। আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন।
মেয়েটা – বেশ। গুড নাইট। আপনাকেও খুব টায়ার্ড লাগছে।
[দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ঝিলিক ঘরে ঢোকে না। করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে ঢেউ ভাঙার শব্দ। সমুদ্রের অন্ধকার। রাস্তার হলুদ আলো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ঝিলিকের। বন্ধ হয় চোখের পাতা। ‘এল’ আকৃতির করিডোরে শেষ প্রান্তে একটা থামের গায়ে মাথা রাখে ঝিলিক।]
দৃশ্য ১২
রাস্তা। রাত।
[হলুদ আলো জ্বলা অনেকটা রাস্তা। ধোঁয়াটে কুয়াশা। হোটেলের বিজ্ঞাপন। বন্ধ দোকানের সাটার। রাস্তার ধারে আগুনের আঁচ। হাঁটুমুড়ে বসে থাকা স্থানীয় নিশাচর। রাস্তাটার বুক চিরে হেঁটে আসছে অর্ক আর ঝিলিক।]
ঝিলিক – হোটেলের গেট তো আর খুলবে না। কী করবে?
অর্ক – সমুদ্র পাহারা দেব!
ঝিলিক – আমি ভাবছিলাম ওয়েসিস। বালি দিয়ে মরুদ্যান। বলতে পারো ঝুলন।
অর্ক – ইউটোপিয়ান। শীতে সমুদ্রে আসার মতো।
ঝিলিক – আমরা তো বর্ষাতে জঙ্গলেও গেছিলাম। যখন যেটা ডাকে।
[ঝিলিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অফুরন্ত সমুদ্র। ঢেউ-এর ফসফরাস।]
ঝিলিক – পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি।
[ঝিলিক কাছে টেনে নেয় অর্ককে। বলে-]
ঝিলিক – যেমন তোমাকেও বেঁধে রাখিনি।
দৃশ্য ১৩
হোটেলের করিডর। রাত।
[করিডোরে ঝিলিকের মাথাটা নীচু। খোলা চুল এলিয়ে। বেখেয়াল। নীচে হোটেলের দোলনা, বাগান, রাজহাঁসের বাড়ি, ঘাসজমি, বদ্রির খাঁচা, মোরাম দেওয়া রাস্তা। হঠাৎ শোনা যায়।]
ছেলেটা – আপনি রুমে যাননি?
[সেই সদ্যবিবাহিত ছেলেটি। বারমুডা আর গেঞ্জিতে। এখন ফ্রেশ। সিগারেট খাচ্ছে। আনমনা ঝিলিক মুখ তোলে। আলতো হাসে। দায়সারা।]
ছেলেটা – ডিস্টার্ব করলাম?
[অসম্মতিসূচক মাথা নাড়ে ঝিলিক। ম্লান। কয়েকটা মুহুর্ত কোনও কথা নেই। ছেলেটার পারফিউমের গন্ধটা খুব চেনা ঝিলিকের। অয়ন ব্যবহার করত। গন্ধটা অসহ্য লাগছে এখন। হাতের তালুটা কায়দা করে নাকের কাছে এনে চেপে রাখে। ঝিলিকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটুকরো ছবি। ]
দৃশ্য ১৩(ক)
অর্কর বাড়ির বেডরুম। রাত।
[একটা নীল টাওয়েল পরা পুরুষালি খোলা শরীর। ঘাড় অবধি ভেজা চুল। অর্ক একটা বডি স্প্রে মাখছে।]
দৃশ্য ১৩
হোটেলের করিডোর। রাত।
ছেলেটা – আপনি একা?
[ঘোর কাটে ঝিলিকের। তাকায়। হাসে না। অস্বস্তি নিয়ে ছেলেটা বলে -]
ছেলেটা – না মানে …
ঝিলিক – সমুদ্রের কাছে সবাই একা।
[ছেলেটা বোকা বোকা হাসে।]
ছেলেটা – সরি ডোন্ট মাইন্ড!
ঝিলিক – আপনার স্ত্রী হয়ত অপেক্ষা করছে।
[ঝিলিকের মুখটা অন্যদিকে ফেরানো। একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ। ঝিলিক তাকায়। দেখে ছেলেটা আর নেই।]
দৃশ্য ১৪
বিবাহিত দম্পতির হোটেলের রুম। রাত।
[বিছানাটা টানটান। দুটো বালিশ। মেয়েটা চুপচাপ ব’সে। সামনে লাগেজ ব্যাগ খোলা। ছেলেটা পাশে বসে।]
ছেলেটা – কী হয়েছে?
মেয়েটা – ওই হোটেলে গয়না হারানোর কথাটা বললে?
ছেলেটা – না। কেন হঠাৎ?
মেয়েটা – দু’বার দু’রকম বলা হলো তো।
ছেলেটা – ছাড়ো তো।
মেয়েটা – দুলদুটো পেয়েছি। বাথরুমে খুলিনি। মানে খুলে বাথরুমেই তোমার একটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। এখন জিনিসপত্র গোছাতে পেলাম।
[অপরাধবোধ নিয়ে সে তাকায়।]
মেয়েটা – সরি। আমার জন্য ওই হোটেলে তোমায় ঝামেলা করতে হল। ইশশ! তোমাকে এতটা রাগতে আগে কখনও দেখিনি। মাই মিস্টেক!
[মেয়েটা জড়িয়ে ধরে ছেলেটাকে। ছেলেটা আদর করতে উদ্ধত। পিঠে মেয়েটার আঙুলগুলো বিঁধে যায় যেন। মেয়েটা বলে-]
মেয়েটা – আজ থাক। শরীরটা ভালো নেই। বাথরুমে গিয়ে বুঝলাম।
দৃশ্য ১৫
বাথরুম। রাত।
[কল খোলা। বালতি থেকে উপচে পড়ছে জল। ঝিলিকের পোশাকহীন পা। খোলা পিঠে এলিয়ে থাকা রঙিন চুল। বাথরুমের র্যাকে একটা ভেজা ইঁট রঙের হটপ্যান্টের দিকে এগিয়ে যায়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো বালি বার করে। ভেজা। জমাট। ঝিলিক হাতের তালুতে বালিটা মেখে নেয় ধীরে ধীরে। তারপর আঙুলগুলো খুলে দেয়। ফাঁক গলে কিছুটা বালি ঝরে পড়ে সাদা পাথরে। পায়ের কাছে। কিছুটা ধুয়ে যায় জলে।]
দৃশ্য ১৬
হোটেলের রুম। রাত।
[ফ্যান ঘুরছে। বিছানার উপর অন্তর্বাস। রাতপোশাক। হেডফোন। মোবাইল। একটা পেন আর হ্যান্ডমেড পেপারের ডায়েরি। হাওয়ায় পাতাগুলো উড়ছে। খোলা পাতায় কয়েকটা লাইন। লেখা –
মন দূরত্ব বোঝে না। রাত বিরেত অসময় জানে না। ঘড়ির কাঁটা ট্রেন লাইন জেব্রা ক্রসিং বা ঠিকানা শোনে না। মন ছুটতে পারে। পালাতে জানে। জানে কোথায় পালাতে হয়। ঠিক যেভাবে আমি পৌঁছতে চাই তোমার কাছে অথচ পারি না, মনে চলে যায় ঠিক। যেভাবে আমি থাকতে চাই, বাসতে চাই, কাছাকাছি আরও বেশি তোমার। মন ঠিক সেভাবেই খেয়ালখুশি। সব ভৌগলিকতা বা সাধ্যের উর্দ্ধে।
মনের সঙ্গে আমার দেখা হয় না, যেমন তোমার সঙ্গেও হয়নি অনেকদিন। তবু কেউ পিঠের কাছে নিঃশ্বাস ফেললে, কাঁধের কাছে ছুঁয়ে দাঁড়ালে মনে হয় তোমার ছায়া নিয়ে ফিরে এসেছে। বা হয়ত মন।
এখন নিজের সঙ্গে কথা বলার মতই সহজ হয়ে গেছে তোমার সঙ্গে সময় ভাগ করে নেওয়ার বিশালতা। ইচ্ছের গাছে জল দেওয়া, বারান্দা, জানলার বাইরে রোদ, হাওয়ার শীতে শুকিয়ে যাওয়া রাতপোশাকের অন্তর্দেশ। এসব এখন একলা লাগার অভ্যেসের মতই প্রিয়।
কটেজ। হিম পড়া সবুজের অন্ধকার। ফিকে হয়ে আসা অন্ধকারের আলোয় চোখ সয়ে যাবার মতো নরম হয়ে গেছে চুমুক। লেগে আছে দাগ কফির দাগ এসব এখন আদিবাসীদের মতই নিখাদ সুগঠন।
এমন অনেক বেয়ারা ইচ্ছের ভারসাম্য নড়ে যাচ্ছে অবচেতনে, এক অদ্ভুত চুম্বক জন্মেছে যেন।
তোমার চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে পাবার না পাওয়ারা মজে যাচ্ছে চেনা হয়ে যাওয়া কোনও নিশানায় । যদিও সব চেনাই চেনাদের মত করে দেখা যতটা চেনাতে চায় । তবু একটা ঢেউ থাকে যেটা আছড়ে পড়ে । ঢেউ দিয়ে মানুষ চেনা যায় । সকালের রোজগুলোর ঘুম ভাঙলে মাথার ভেতরটা খালি হয়ে গেছে বলে মনে হয়। যেমন সন্ধ্যেবেলা আমার ফাঁকা ফ্ল্যাট থেকে আলোদের নিয়ে চলে যায় রাত সাজবে বলে।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে কলকাতায় জন্ম অভিরূপের। স্কুলজীবন থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার পাশাপাশি পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ। কিছুদিন ফ্রিলান্স সাংবাদিকতাও করেছেন। এরপরেই ঢুকে পড়া টেলিভিশনের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার আঙিনায়। সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ এবং প্রস্তুতির সঙ্গে পরিচয়। একইসাথে চলতে থাকে গল্প-কবিতার পালা। দেশ, এই সময়, আজকের সম্পূর্ণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা।