(Bengali Novel)
-মা তুমি আজকেও বেরোচ্ছ? চোখটা অল্প খুলে রাইমা মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
মন্ত্র পাঠ করতে করতে মোহনা ঘাড় নাড়ল।
-তুমি দেখছি একটা অঘটন না ঘটিয়ে ছাড়বে না। সারা দেশের মানুষ ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে, আর তোমাকে অফিস যেতেই হবে? (Bengali Novel)
রাইমার কণ্ঠে একইসঙ্গে বিরক্তি ও দুঃশ্চিন্তা মোহনার চোখ এবং কান এড়াল না। কিন্তু এই সব বিষয়ে তর্ক-বিতর্কে যেতে তার ইচ্ছে হল না। শুধু বলল, ‘উঠে পড়ো মা, অনেক বেলা হল।’
-ইনটলারেবল, বলে চাদরটা গা থেকে সরিয়ে রাইমা মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
মোহনা বাকি জপটা মেয়ের মাথায় হাত রেখে শেষ করে কপালে একটা চুমু খেল।
রাইমা মিনিট দুয়েক ওভাবেই মায়ের গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থেকে বিছানা ছাড়ল। (Bengali Novel)

মোহনা এবার দ্রুত পুজো সেরে ডাইনিংরুমে এসে খেতে বসে গেল। দশ মিনিটের মধ্যেই তাকে বেরতে হবে। ঘড়িতে অলরেডি এগারোটা চল্লিশ। বাবু ঠিক এগারোটা পঞ্চাশে নিচে এসে হর্ণ দেবে। (Bengali Novel)
চৌধুরী সাহিত্য কুটিরের বর্তমান কর্ণধার মোহনা। মোহনা চৌধুরী। প্রকাশনার জগতে তার পদক্ষেপ মাত্র বারো বছর। কিন্তু এর মধ্যেই চৌধুরী সাহিত্য কুটির বাংলা সাহিত্যের জগতে আলোচিত নাম হয়ে উঠেছে।
চৌধুরী সাহিত্য কুটিরের বর্তমান কর্ণধার মোহনা। মোহনা চৌধুরী। প্রকাশনার জগতে তার পদক্ষেপ মাত্র বারো বছর। কিন্তু এর মধ্যেই চৌধুরী সাহিত্য কুটির বাংলা সাহিত্যের জগতে আলোচিত নাম হয়ে উঠেছে। অবশ্য এর পেছনে তার একার কৃতিত্ত্ব নয়। একশো বছরের বেশি পুরোনো এই প্রতিষ্ঠান। শ্বশুরমশাইয়ের বাবার হাতে তৈরি এই প্রতিষ্ঠান। মোহনার স্বামী প্রমিত চৌধুরীর বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই এই পারিবারিক ব্যবসায়। পেশায় ব্যুরোক্রাট প্রমিতের বর্তমান কর্মস্থল ওয়াশিংটন। মোহনাও বিয়ের পর দশ বছর সেখানেই কাটিয়ে মেয়ের পাঁচবছরে চলে এসেছে কলকাতায়। তারপর থেকে শ্বশুরবাড়িতেই। কলকাতা ফিরে আসার নেপথ্যে তার বাপের বাড়ির প্রতি টান। বাবা- মায়ের একমাত্র সন্তান সে। দু’জনেরই বয়স বাড়ছে। এতদূর থেকে তাদের দেখ-ভাল করায় তার মন সায় দিচ্ছিল না। তাছাড়া শ্বশুর-শাশুড়িরও একটিই সন্তান। সে যখন ফিরতে পারছে না, তখন মোহনাই বিকল্প খুঁজে নিয়েছিল। (Bengali Novel)

ছেলে যে কখনও এই পারিবারিক ব্যবসায় আসবেন না এই সত্যটা অমিত চৌধুরী মানে প্রমিতের বাবা, মোহনার শ্বশুরমশাই অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাকে এ বিষয়ে জড়াবার কোনও ইচ্ছে তাঁর ছিল না, সে চেষ্টাও তিনি করেননি। বরং ভেবেছিলেন যতদিন পারবেন নিজে দেখভাল করবেন, তারপর সংস্থার অন্যান্য ব্যক্তিরা যদি চালাতে পারে ভাল, নইলে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনার কাছে নিজের সংস্থাকে বেচে দেবেন। দুটি নাম করা সংস্থার সঙ্গে তলায় তলায় কথাও বলতে শুরু করেছিলেন তিনি। (Bengali Novel)
এমনই এক সময় মোহনা ফিরে এসে বাপের বাড়িতে না থেকে উঠল শ্বশুরমশাইয়ের পৈত্রিক বাড়ি চৌধুরী ভিলায়। কন্যা রাইমাকে একটি নাম করা স্কুলে ভর্তি করে, নিজে যোগ দিল এক কর্পোরেট সংস্থার অ্যাসিস্টেন্ট মার্কেটিং হেড হয়ে। কয়েক বছরের মধ্যেই মেধা, বুদ্ধি ও পরিশ্রম এই তিনের মিশ্রনে সংস্থার অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হল মোহনা। (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: সূত্রধার: সপ্তম পর্ব
কিন্তু এত কিছুর পরেও কী যেন একটা খুঁজে পাচ্ছিল না সে। মনে হচ্ছিল যে উচ্চতায় সে পৌঁছাতে চাইছে, সেখানটা অধরা থেকে যাচ্ছে। কোম্পানি লাভের মুখ দেখলেও তার নিজের আত্মতৃপ্তি আসছে না। গতানুগতিক কাজের বাইরে কোনও ইনোভেসন বা ক্রিয়েটিভনেস নেই তাতে। (Bengali Novel)
এইসব ভাবনা চলাকালীন একদিন অফিস যাওয়ার আগে খাওয়ার টেবিলে শাশুড়ি স্নেহলতা খাবার বাড়তে বাড়তে বললেন- জানো বউমা, এখন মনে হয় তোমার শ্বশুরমশাই যদি এই বইয়ের ব্যবসায় না আসতেন, বাবা চলে যাওয়ার পরই যদি বন্ধ করে দিয়ে চাকরি করতেন ভাল হত। (Bengali Novel)
মোহনা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করল- এত বছর পর হঠাৎ তোমার মাথায় এসব ভাবনা কেন? বাবা তো ভালই আছেন এগুলো নিয়ে। এতদিনের একটা ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে, সেটা কী কম কথা! (Bengali Novel)

স্নেহলতা বললেন- ছেড়ে তো দিতেই হবে বউমা। তাঁর বয়স হয়েছে। তবু মনের জোরে আর ভালবাসেন বলে দপ্তরে যান। কিন্তু তিনি চোখ বুজলে এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে। স্টাফেদের মাইনে, লেখকদের রয়্যালটি দেওয়ার চিন্তা তো আছেই, পত্রিকাটাও অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। এসব ভেবে মানুষটার রাতে ঘুমও হয় না। তাই বলছিলাম, প্রথম থেকেই যদি খোকার মতো একটা চাকরি করতেন, তবে বৃদ্ধ বয়সে এত টেনশন নিতে হত না। তোমার শ্বশুরও তো পড়াশোনায় খারাপ ছিল না। মাট্রিকুলেশনে সেই আমলে প্রথম শ্রেণি পেয়েছিল। (Bengali Novel)
এ গল্প তোমার ছেলের মুখেও শুনেছি। কিন্তু নিজে চাকরি করা আর অন্য আরও অনেকের অন্ন সংস্থান করে দেওয়া– এই দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে মা।
-এ গল্প তোমার ছেলের মুখেও শুনেছি। কিন্তু নিজে চাকরি করা আর অন্য আরও অনেকের অন্ন সংস্থান করে দেওয়া– এই দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে মা। প্রথমটায় শুধুই ডিউটি। অন্যটায় অনেকবেশি ভালোবাসা জড়িয়ে, তাই না বাবা?
-ঠিকই বলেছ বউমা। তোমার শাশুড়ি এটা বুঝতে পারেন না। তবে তাঁকেও দোষ দিই না। দেখতেই তো পাচ্ছ আগেকার মতো কিছুই নেই আর। আমার চিন্তাগুলো স্বাভাবিক কারণেই লতাকে স্পর্শ করে।
-এখন এসব ভেবে মন খারাপ করো না। ঠিক একটা বিকল্প তৈরি হয়ে যাবে। মোহনা বলল। (Bengali Novel)
-কী করে হবে বউমা? প্রমিত কি দেশে ফিরবে? তুমি না বললেও আমি তো মা, বুঝি সে সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয় কেউ তো নেই যে এই দায়ভার গ্রহণ করবে।
মোহনা খাবার শেষ করে সেই সময়ের জন্য বিরতি টানল এই প্রসঙ্গে। শাশুড়ির অনুমান যে একেবারে অমূলক তা নয়। প্রমিতের দেশে ফেরার সম্ভাবনা প্রায় নেই। নিজেই ফিরতে চায় না। এ নিয়ে সে খোলা মনে কাউকে না জানালেও নিশ্চিত। (Bengali Novel)
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যা
বিতস্তা ঘোষাল গল্পকার, কবি,প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। আধুনিক ইতিহাসে এম এ, লাইব্রেরি সায়েন্সে বিলিস। কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। প্রকাশনা সংস্থা ভাষা সংসদের কর্ণধার। ও অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র সম্পাদক।
'বাংলা আকাডেমি' ,'সারস্বত সম্মান' 'বিবেকানন্দ যুব সম্মান', ‘একান্তর কথাসাহিত্যিক পুরস্কার,'কেতকী' কবি সম্মান, ‘চলন্তিকা’, দুই বাংলা সেরা কবি সম্মান, 'বিজয়া সর্বজয়া' 'মদন মোহন তর্কালঙ্কার সম্মান', 'বই বন্ধু সেরা লেখক ২০২৪ ' সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্ত।
বিতস্তার প্রকাশিত বই ৩৪টি। তাঁর কবিতা ও গল্প হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজি,ইতালি, গ্রীক ও স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে। সম্প্রতি ওড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত তার গল্প সংকলন রূপকথার রাজকন্যারা।
দেশ বিদেশে কবিতা ও গল্প পড়ার ডাক পেয়েছেন একাধিকবার।বাংলা সবকটি জনপ্রিয় পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত।
নিজের কাজের গণ্ডীর বাইরে অফিস ও পরিবারেই স্বচ্ছন্দ বিতস্তা কাজের ফাঁকে অবসর সময় কাটান নানান সামাজিক কাজে।
ভালোবাসা ছাড়া বাকি সব কাজ গুরুত্বপূর্ণহীন। তার নিজের কথায় ভালোবাসা ছাড়া কেউ কী বাঁচে?