(Bengali Novel)
আগের পর্ব- [১],[২],[৩],[৪],[৫],[৬],[৭],[৮]
তিনমাস কেটে গেছে।
আজ মলয়দের বাড়িতে হৈ হৈ চলছে। তাদের আরও প্রশস্ত খোলা রান্নাঘরের মাটির দাওয়ার ধার বরাবর, অপূর্ব আল্পনা। খড়ের চালে নীচে বাঁশের ভারা থেকে ঝুলছে বিভিন্ন উচ্চতায়, চটের, বেতের সুদৃশ্য সব ঝুড়ি। ইতস্তত ছড়ানো জলচৌকি বেতের মোড়া, সব বীরভূমের স্থানীয় কাজ। হাতে বানানো, বা মেলায় কেনা। আজ ঠাকুমার হাতে করা নকশি কাঁথা আর তার মামারবাড়ির গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছে নকশি কাঁথা। (Bengali Novel)

ছোট্ট এক প্রদর্শনী হচ্ছে। সাথে এসেছেন ঠাকুমার বহুবছর দেখা না হওয়া দুই মামাতো বোন ও তাঁদের এক বান্ধবী। কত যুগ পরে তাঁদের সঙ্গে দেখা, তাঁরাও বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন, তাঁদের হাতে করা কাজ। মলয়ের পিসি, কাকিমা, মামিমা, মাসি, সোনালীর বাড়ির সবাই, সব মিলিয়ে এক আনন্দ উৎসব। তাছাড়া বোলপুরে একটি গ্রামীণ মহিলা সংস্থার প্রতিনিধি এসেছেন, তাঁরা এখানে কাঁথা সেলাই শেখার ব্যবস্থা আর তাঁদের মেয়েদের নিয়ে একটি কর্মশালা করতে চায়। (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: সূত্রধার: সপ্তম পর্ব
আজ রান্নাঘরে রান্না হচ্ছে না। মলয়ের বাবা, কাকা, মামা, ভাইরা মিলে বাগানের কাছে মাটি খুঁড়ে উনুন বানিয়ে রান্না করছেন। প্রকান্ড চিতল মাছ, রুই মাছ, বাগান থেকে তোলা সব্জি। সোনালী ব্লক প্রিন্টের শাড়ি পরে ঘুরে ঘুরে সবাইকে আপ্যায়ন করছে। মলয় ক্যামেরা হাতে ভিডিও তুলছে আর মাঝে মাঝে পাঠাচ্ছে সোমদত্তাকে। সোমদত্তা আমস্টারডামে তাঁদের কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে, নিজের অফিসে বসে দেখছেন ভিডিওগুলো। একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল তাঁর। একটা নিশ্চিন্ত জায়গায় এসে পৌঁছেছে এই প্রজেক্টটি। (Bengali Novel)

বিকেল চারটে। খাওয়া শেষ করে মলয় সোনালীকে ডাকল।
সোনালী শোবার ঘরের দিকে যাচ্ছে, বাড়ির সব মহিলা তাদের শোবার ঘরে। একটু বিশ্রাম আর সঙ্গে আড্ডা।
‘আমি একটু বেরোচ্ছি। আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসব’।
গত এক সপ্তাহে প্রায় রোজ সে এই সময় বেরোয়। এখনও কেউ খেয়াল করেনি। বাড়ির অনেক লোক থাকার এই সুবিধা। (Bengali Novel)
“একটা অদৃশ্য বুদ্বুদ পৃথিবী তাকে ঘিরে। সে আটকে গেছে। স্বেচ্ছায়। ওই পৃথিবীকে নিয়েই তার চলাচল। অদৃশ্য ক্যামেরা। মানুষের চোখেও। খবর পৌঁছে যাবে। “
খানিকটা এগিয়ে গলির মোড় থেকে বিকেলের বাসটা পেয়ে গেল। কুড়ি মিনিটের মধ্যে বিউটি পার্লারটার কাছে পৌঁছে গেল। তারপর হেঁটে হেঁটে উল্টো দিকের চায়ের দোকানে। বেঞ্চে বসে একটা চা অর্ডার দিল। আজকাল সে কালো চা খায়। সে জানে আজও তার ইচ্ছেপূরণ হবে না। দশ মিনিটের মধ্যে কোনও মানুষ চিনে নেবে ভিডিও থেকে অথবা ভাইদের, তার, পিসেমশাই, বাবার কোনও বন্ধু তাকে খুঁজে নেবে। আর এক ঝলকই সে দেখতে পাবে লালী বেরিয়ে যাবে আধঘণ্টার মধ্যে। দু’সপ্তাহ আগে খবর পেয়েছে লালী মেডেন বলে এই বিউটি পার্লারে কাজ করছে। (Bengali Novel)
তবে কেউ না থাকলেও সে জানে ওই চায়ের দোকানের বেঞ্চ থেকে উঠতে পারবে না, একটা অদৃশ্য বুদ্বুদ পৃথিবী তাকে ঘিরে। সে আটকে গেছে। স্বেচ্ছায়। ওই পৃথিবীকে নিয়েই তার চলাচল। অদৃশ্য ক্যামেরা। মানুষের চোখেও। খবর পৌঁছে যাবে। (Bengali Novel)

অনেক দূরে, ভারতবর্ষের উত্তর পূর্ব সীমান্তে একটা ছোটো গ্রামে এসে পৌঁছেছেন মৌমিতা। এয়ারপোর্ট থেকে এয়ারপোর্ট, তারপর সুদীর্ঘ গাড়ির যাত্রা- তবে যাত্রাপথের অনাবিল সৌন্দর্যে মাথার আর চোখের স্নায়ুগুলো খুব আরাম পাচ্ছে। ওদের বাড়ি খুঁজে পেয়ে প্রতিবেশী একটি ছোট ছেলের কাছে খবর পেলেন মেয়েরা আর মা পৌঁছে গেছে নদীতে। উনিও আস্তে আস্তে হেঁটে এসে পৌঁছলেন নদীর কাছে। খাড়া ঢাল নেমে গেছে বেশ খরস্রোতা নদীতে। এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন নদীতট থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে, নীল-সবজে নদীটার পারে মেয়েদের মেলা। তারা আনন্দে স্নান করছেন, ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে নদীর পুজো করছেন, ওঁর চোখদুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে এই ভিড়ের মধ্যে দিয়া আর দেৱেকে-একটি কিশোরী একটি এখনও বালিকা- এত অপাপবিদ্ধ সুন্দর দু’টো মুখ। কাছের শহরে থাকা, সম্পর্কে এক দিদিকে দেখে দিয়া সবে শুরু করেছে ভিডিও। দিয়া হাত নাড়ছে, একটু ঝুঁকে দেখলেন, একটি অল্পবয়সী মেয়ের হাতে সেলফোন, সে দিয়ার ভিডিও তুলছে। দিয়ার গ্রামের পাশের পাহাড়ের ওপর এক মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার ভিডিও দেখেছিলেন, খুব পছন্দ হয়েছিল। (Bengali Novel)
“মৌমিতা এড্রিনালিন রাশ অনুভব করছেন, প্রত্যেকবারই এটা হয়। আস্তে আস্তে তিনি এগিয়ে চললেন নদীর দিকে- নদীর পুজোর দিকে। এলোমেলো হাওয়ায় মাটির প্রদীপ নিভে যাচ্ছে, উজ্জ্বল রঙের ফুল ভেসে যাচ্ছে জলে।”
তারপর থেকে ওদের জীবনযাত্রা অনুসরণ করছেন। ওদের মা প্রতিমার মতো সুন্দর। বাবার ছোট একটা মুদি দোকান আছে। বাড়ির সাথেই। মা ঘরের কাজ সামলেও দোকান দেখে। দাওয়ায় রান্না, ছোট্ট বাড়ি, বাড়ির খুব কাছে নদী, বনে ঘেরা। এখনও শহর স্পর্শ করেনি- এদেরকে গড়ে পিটে নেওয়া যাবে। তবে এবার আরও অনেকখানি হোমওয়ার্ক করে এগিয়েছেন তিনি। ওর সম্পর্কিত ওই দিদির ভিডিও জনপ্রিয় হচ্ছে। সে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে আর এই দিদির সমর্থন ছাড়া এদের থেকে কাছাকাছি শহরের দূরত্ব আড়াইঘণ্টার। গ্রামটাও নিরিবিলি, প্রকৃতির বড় কাছে। একদম তার পরিকল্পনার সাথে মানানসই। কিছু সপ্তাহ আগে আমেরিকার অস্টিন থেকে এই প্রজেক্টের সুপার বসের একটি মেসেজ আসে গ্রীন ভিশনের কাছে। তিনি ভিডিওগুলোতে আরও মৌলিকত্ব চান। আরও নানা ধরণের জীবনযাত্রা। তখনই মাথায় আসে। ইজরায়েলের কমিউনিটি লিভিং – কিবুৎস। সমবায় প্রথায় বসবাস, চাষ। উত্তর-পূর্ব ভারতের দু’একটি রাজ্যে চালু হয়েছে সমবায় কৃষি, বিশেষতঃ মহিলারা এইভাবে সবজি, ফল চাষ করছেন। সার পর্যন্ত নিজেরা করেন। মৌমিতা এই গ্রামে শুরু করবেন। দিয়া আর তার মা হবে এই প্রজেক্টের মুখ। তাদেরকে দিয়ে শুরু, তাদেরকে কেন্দ্র করে। (Bengali Novel)

এই গ্রামের মেয়েরা খুব পরিশ্রমী। তারা পারবে। তিনি তাঁর টিমের সাথে অনেকটা প্ল্যান করেছেন, তাদের টিমের দু’জন অত্যন্ত করিৎকর্মা ছেলে মেয়ে এই গ্রামের কাছেই থাকবে। দেড় মাস। এখানে, তারা কাল এসে পৌঁছাচ্ছে। একজন স্থানীয় ভাষা কাজ চালাবার মতো বলতে পারে। সমবায় কৃষির জন্য জমি নেওয়া আর তাতে খানিকটা কাজও শুরু হয়ে গেছে। সমবায় কৃষির সাথে উত্তরপূর্ব ভারতের মাতৃপ্রধান সমাজ। মৌলিকত্বের ডবল ডোজ। সবকিছু ঠিকঠাক চললে আগামী বছর তাদের সাউথ এশিয়া রিজিয়নের জন্য আরও পাঁচ মিলিয়ন ডলার নিশ্চিন্ত। মৌমিতা এড্রিনালিন রাশ অনুভব করছেন, প্রত্যেকবারই এটা হয়। আস্তে আস্তে তিনি এগিয়ে চললেন নদীর দিকে- নদীর পুজোর দিকে। এলোমেলো হাওয়ায় মাটির প্রদীপ নিভে যাচ্ছে, উজ্জ্বল রঙের ফুল ভেসে যাচ্ছে জলে। (Bengali Novel)
ইশ, একটা ড্রোন ক্যামেরা যদি থাকত!
(সমাপ্ত)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় বস্টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মূলতঃ ছোট গল্প এবং আর্টিকেল লেখেন। ছোট গল্প সংকলন ক্যালাইডোস্কোপ এবং অপরাজিতা প্রকাশিত হয়েছে, কমলিনী,দেজ পাবলিকেশন থেকে।একটি ছোট গল্পের অনুবাদ শর্টলিস্টেড হয়েছে, ‘Armory Square Prize for women writers in South Asian literature’ এ। অনুদিত গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত Words Without Borders এর পাতায় ।আনন্দবাজারের বিদেশ পাতার নিয়মিত লেখেন তাছাড়া রোববার-সংবাদ প্রতিদিন, বাংলা লাইভ, গুরুচণ্ডালী এবং আরো কিছু ম্যাগাজিনে গল্প এবং ছোট বড় প্রবন্ধ নিয়মিত লেখেন।