আগের পর্বের লিঙ্ক [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২]
বেরোতে তো একদিন হবেই সুরেশভাই। তখন কী করবেন?
সুরেশ:- অন্য কোনেও রাস্তা খুঁজব। হয় আমার বন্ধু গীতিকার নরেন্দ্র চৌহানের মতো পালটি খেয়ে অন্য দলে চলে যাব, নয় ওই সুপারিওয়ালাদের মতোই পুরোপুরি খুনে হয়ে যাব। সে তো পরের কথা পরে ভিকি। দেখা যাবে তখন। আসল ট্র্যাজেডিটা আরও অন্যখানে।
ভিকি:- কোথায়?
(সুরেশ গ্লাস শেষ করেন। ভিকির দিকে তাকান)
সুরেশ:- আচ্ছা, এই যে তখন গঙ্গাধর চাপেকার, তারপর বিনায়ক শিন্ডে, ওদের দেখলি, ওরা আমাকে কি চোখে দেখে বলে তোর মনে হয়?
ভিকি:- ওরা ইজ্জত করে আপনাকে, ভালবাসে।
সুরেশ:- ঠেঙ্গা। বাইরে থেকে ওরকম মনে হয়। আসলে আমাকে ঘৃণা করে।
ভিকি:- কী বলছেন?
সুরেশ:- ইয়েস স্যার। কারণ, ওরা মনে করে আমরা হচ্ছি পলিটিকসে হয় শরণার্থী নয় অনুপ্রবেশকারী। কারুর দয়ায় ঢুকে পড়ে ওদের এতদিনকার তৈরি করা রান্নাঘরে বসে চুপিসাড়ে গুড়রুটি খেতে এসেছি। তোর মতো স্টারদের কথা আলাদা। তোদেরও ওরা ঘৃণা করে, কিন্তু জানে তোদের ছাড়া চলবেও না। তোরা হচ্ছিস ওদের টুপির পালক, আর ওরা ভাবে আমরা হচ্ছি ওই টুপির দোকানদার, যেটা আমরা ওদের মাথায় পরাতে এসেছি। ওইজন্য দেখবি বিরোধী পলিটিশিয়ান বললে এরা যত না ক্ষেপে, তার থেকে ওরা বেশি ক্ষেপে যায় ওই টুকরে টুকরে গ্যাং-এর কথায়।
ভিকি:- সেইজন্য ঘেন্না করে আপনাদের?
সুরেশ:- শুধু ঘেন্না নয়, ঈর্ষাও করে। সেটা অবশ্য তোর মতো স্টারদেরও ওরা করে, কিন্তু তোদের ক্ষেত্রে সেই ঈর্ষা ওরা চেপে রাখতে জানে, কিন্তু আমাদের বেলায় সেটা থেকে থেকেই প্রকট হয়ে ওঠে। বাইরে ভাব দেখায় যেন তাচ্ছিল্য করছে। হাত নেড়ে মাছির মতো উড়িয়ে দিচ্ছে, আসলে কিন্তু ওটা ভেতরের গনগনে ঈর্ষা।
ভিকি:- কিন্তু কেন?
সুরেশ:- কারণ তোদের যে পপুলারিটি, সেটা ওদেরও আছে। কিন্তু আমরা সমাজে যে ইজ্জত পাই, তার জন্য ওরা সত্যিকারের ভেতর থেকে কাঙাল। কিন্তু ওরা টের পায়, সেই সামাজিক ইজ্জত ওদের নেই। এত ক্ষমতা, এত ঠাটবাট, এত মনসবদারি সেলাম পাবার পরেও নেই। গান্ধী কি পারবেন কোনদিন টেগোর হতে? অতগুলো কবিতা লেখার পরেও? পারবেন না। কিন্তু গান্ধী সেটা বুঝতেন। অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। জানতেন যে টেগোর যেমন টেগোরের জায়গায়, তেমন উনিও সমাজে পপুলারিটির পাশাপাশি অন্য ইজ্জত পান। কিন্তু এদের বেলায় তো তা নয়। আরে আমি যেমন টেগোর নই, এরাও তো তেমনই গান্ধী নয়। তখন ওই গনগনে ঈর্ষাটা একটা ঘেন্নায় বদলে যায়। বাইরে আমাদের বোঝাতে চায়, কি মূল্য আছে তোর? কানাকড়িও নয়। ভেতরে ভেতরে টের পায়, আছে। আছে। তাই যতই চাপেকার, সিন্ধেদের সামনে হাতজোড় করি, ওরা তত ভেতরে ভেতরে আমার ওপর ক্ষেপে যায়। ভাবে ফাজলামো করছি। আমি যত মাথা নোয়াই, ওরা তত চটে। আর এই খেলাটা চলতেই থাকে। হয়তো সংখ্যালঘু শিল্পের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও লাশ পড়ে থাকবে কোনও পার্টি অফিসের সামনে বা কোন আইনসভার চাতালে।
ভিকি:- এ তো সাংঘাতিক সুরেশভাই। দু দিকেই খুন হচ্ছেন। শাঁখের করাত। কী লাফড়া রে বাবা!
সুরেশ:- ঠিক, একদম তোর মতোই। (মদ খায়) তুই নানা পাটেকরের ‘অবতক ছপ্পন’ সিনেমাটা দেখেছিস? সেখানে শেষে গিয়ে দুঁদে পুলিশ থেকে ক্রিমিনাল বনে যাওয়া নানার ক্যারেকটার সাধু আগাসে বলে, ‘আ কপ ইজ অলওয়েজ আ কপ’। আমিও তোকে বলছি ভিকি, ‘অ্যান আর্টিস্ট ইজ অলওয়েজ অ্যান আর্টিস্ট’। একজন সত্যিকারের দালাল যেমন সবসময়ই দালাল, একজন সত্যিকারের সন্ন্যাসী যেমন সবসময়ই সন্ন্যাসী। যারা পলিটিকসে এসে ওদের ওই মূল শিকড়কে ভুলে যায়, তাদের কথা আলাদা। হয়তো তারা কোনওদিন আর্টিস্ট ছিলও না। কিন্তু তুমি যে রুট থেকে উঠে আসছো, সেটাকে যদি তুমি অস্বীকার করো তাহলে আমি বলব তুমি একজন জারজ, বাস্টার্ড। আর আমি অন্তত জারজ হতে চাই না।
ভিকি:- তাহলে কি এইভাবেই চলবে? এর থেকে বেরনোর কোনও উপায় নেই?
সুরেশ:- (মাথা নাড়ে) না। আছে একটা রাস্তা। একটা উপায় আমি অন্তত ভেবে বার করেছি।
ভিকি:- কি? কী উপায়?
সুরেশ:- বলছি। তৃতীয় বিশ্বের নয়া রাস্তা রে ভিকি। ওই যে বলছিলি এখানে এটা একটা খাটা পায়খানা।
(সুরেশ মদ ঢালতে যায়। এইসময় দিব্যা আসে। ভিকি দিব্যার দিকে তাকায়)
দিব্যা:- চলো। অল সেটেলড। তুমি একবার গিয়ে ইয়ে রুটটা শুনে নেবে চলো।
ভিকি:- তুমি যাও। আমি দু’মিনিটে আসছি।
দিব্যা:- ও.কে। কিন্তু তাড়াতাড়ি এসো।
[দিব্যা সুরেশের দিকে হেসে তারপর চলে যায়। ভিকি অসহিষ্ণু গলায় বলে]
ভিকি:- কি সুরেশভাই বলুন। কোন আখরি রাস্তার কথা আপনি বলছিলেন? (সুরেশ চুপ) আরে বলুন।(সুরেশ চুপ) কি হল বলুন? খুব কৌতূহল হচ্ছে আমার।
(সুরেশ মদ খায়। তারপর ভিকির দিকে তাকায়)
সুরেশ:- অন্য একদিন বলা যাবে। আমি আসছি নেক্সট উইকে তোর বাড়িতে। ডিনার খাব। সেইদিন বলব। তাড়া নেই তো কিছু। তুই যা, ওদের কাছে যা। আমি টেরেসে গিয়ে শরাফদের সঙ্গে জয়েন করি। অনেকদিন সিগারেট খাই না। আজ একটা খেতে বড় ইচ্ছে করছে। তোরা কখন বেরোবি জানাস। আমিও শ্মশান যাব। শিব-জির দাহ সম্পূর্ণ হলে তারপর তোকে গাড়িতে তুলে বাড়ি ফিরব। যারে ভিকি যা, রাত বাড়ছে। যা তুই।
[সুরেশ সেলারের দরজা খুলে ভেতরে চলে যান। ভিকি কিছুক্ষণ বসে থাকে। ওর মদ শেষ করে। আবহ আসে। প্রথম ঘরে আলো জ্বলে। সেখানে অরুণা, প্রমোদ, নবনীত, হিমাংশু ও দিব্যা বসে আছে। ওদের হাতে ওয়াইন ও হুইস্কি গ্লাস। ওরা সবাই মিলে হাসছে। ভিকি ওদের কিছুক্ষণ দেখে। তারপর উঠে হেঁটে এসে ওদের সঙ্গে জয়েন করে। হিমাংশু একটা গ্লাসে ভিকির জন্য পানীয় বানিয়ে দেয়। ভিকিও হাসিতামাশায় মেতে ওঠে। কিছুক্ষণ পর আলো নেভে। একইসঙ্গে প্ল্যাটফর্মের ওপর অল্প আলো ও রাস্তায় উজ্জ্বল আলো আসে। প্ল্যাটফর্মের ওপর যেন একটি টেলিভিশনের সেট। সেখানে মাঝখানে অ্যাংকর বসে। তাঁর বাঁদিকে একটি ডাবল সোফায় ইন্দীবর ও জাফর বসে। ডানদিকে সিঙ্গল সোফায় গঙ্গাধর চাপেকার বসে আছেন। সবাই কথা বলছেন। কিন্তু শোনা যাচ্ছে না। রাস্তায় অর্থাৎ ডাউন লেফটে পুনম দাঁড়িয়ে ‘ফোনো’ দিচ্ছে। পুনমের ‘ফোনো’ শুরু হওয়ার একটু বাদে শিবকুমার খান্নার দেহ খাটিয়ায় চাপিয়ে ডাউন রাইটে একদিকে ভিকি ও হিমাংশু এবং পেছনে প্রমোদ ও সুরেশ বেরিয়ে আসে। তাদের পাশে অরুণা, নবনীত, দিব্যা, শরাফ ও জয়দেব আছে। জয়দেব খই ছড়াতে ছড়তে ‘রাম নাম সত হ্যায়’ বলছে। কিন্তু আবহ মিশ্রিত পুনমের গলার জন্য সেটা শোনা যাচ্ছে না। ওরা দেহ নিয়ে একদিক থেকে ধীর লয়ে বেরিয়ে যায়। পুনম বলতে থাকে]
পুনম:- সমাচার চ্যানেলের জন্য ব্রেকিং নিউজ। আজ রাতে প্রয়াত অভিনেতা রাজনীতিবিদ শ্রদ্ধেয় শ্রী শিবকুমার খান্না নিয়ে আমাদের চ্যানেলে বসছেন প্রখ্যাত দুই প্রজন্মের দুই সুপারস্টার, যথা ইন্দীবর খুরানা ও জাফর আলি খান। আর এই অনুষ্ঠানে নিজের বাড়ি থেকে লাইভে যুক্ত হবেন আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী গঙ্গাধর চাপেকার। এইমুহূর্তে শিবকুমার খান্নার মরদেহ ধীর লয়ে এগিয়ে চলেছে ওরলির জিজামাতা নগরীর শ্মশানঘাটের দিকে। একটু পরেই বর্ষীয়ান এই অভিনেতার অন্ত্যেষ্টি সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। আপনারা আমাদের চ্যানেলের দিকে চোখ রাখুন। একটু পরেই লাইভে আমরা সরাসরি ফিরে আসব প্রয়াত শ্রী শিবকুমার খান্নার স্মরণে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘নমঃ শিবায়’ নিয়ে। আপনারা দেখতে থাকুন।
[পুনম ‘ফোনো’ শেষ করে। মহেশ আসে]
মহেশ:- চল, আজকের মতো কাজ শেষ। চল এবার অন্তত একটু জলওয়ায় গিয়ে বসি। দুটো পেগ খাই। আমি খাওয়াব তোকে। আজ অন্তত না করিস না প্লিজ।
পুনম:- রাম নাম সত হ্যায়। চ, তোর এতদিনকার সখ, আমার সঙ্গে ডেট করবি। আমার চ্যানেল আজকে যা ব্রেক দিয়েছে, তোদের সবাইকে দশগোল মেরে দিয়েছি। মন পুরো খুশ্ হয়ে আছে। চ, আজ তোর সব গোপন ইচ্ছে পূরণ করে দেব।
মহেশ:- (চোখ নাচায়) বলছিস। গ্রেট। চ তবে।
[দুজন বেরিয়ে যায়। পাটাতনের ওপর আলো জ্বলে। যেন টিভির সম্প্রচার শুরু হল। অ্যাংকর কথা বলছে। দুপাশ থেকে ইন্দীবর, জাফর, গঙ্গাধররাও কথা বলেন। কিন্তু তা শোনা যায় না। ধীরে ধীরে পর্দা নামে।]
সমাপ্ত
জন্ম ১৯৬৯, ২৫ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর। পূর্বতন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। পরবর্তীতে সিটি কলেজে অধ্যাপনা। নাটককার, পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্রাভিনেতা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গীতিকার সম্পাদক। 'কালিন্দী ব্রাত্যজন' নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার ও 'ব্রাত্যজন নাট্যপত্রের' প্রধান সম্পাদক। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মন্ত্রী। পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি। উল্লেখ্য সত্যেন মিত্র পুরস্কার, শ্যামল সেন স্মৃতি পুরস্কার, দিশারী পুরস্কার, রমাপ্রসাদ বণিক স্মৃতি পুরস্কার, খালেদ চৌধুরী স্মারক সম্মান, অন্য থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ নাট্য নির্মাণ সম্মান। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন গজেন্দ্র কুমার মিত্র-সুমথনাথ ঘোষ স্মৃতি সম্মান। তাঁর সম্পাদনায় 'গিরিশ কথা' ও 'শিশির কথা' দু'টি বই তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, প: ব: সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছেন এবিপি আনন্দ 'সেরা বাঙালি ২০১৯' সম্মান। পেয়েছেন বাংলার নাট্যশিল্প জগতের সর্বোচ্চ সম্মান 'দীনবন্ধু মিত্র পুরস্কার'।