চরিত্র
অতুলানন্দ মহারাজ – বয়স ৪০-৪২, গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী
মৃণাল – বয়স ৩৫-৩৭, অতুলানন্দের সেক্রেটারি
শাশ্বতী – বয়স ৪০, প্রেস রিপোর্টার
বৃদ্ধ – বয়স ৭৫
বৃদ্ধা – বয়স ৭২-৭৩
এফবিআই – ৪০-৫৫, এফবিআই অফিসার
ভক্ত ১, ২, ৩
স্থান – উত্তর আমেরিকায় স্বামী অতুলানন্দের আশ্রম
কাল – বর্তমান
(স্বামী অতুলানন্দ মহারাজ বক্তৃতা দিচ্ছেন। সামনে বসে কিছু ভক্ত শ্রোতা অধীর আগ্রহে তার কথা শুনছেন।)
অতুল: আপনারা জানতে চেয়েছেন ঈশ্বর কী? বা ঈশ্বর কে? না না, এটা কোনওও অস্বাভাবিক বা অনৈতিক প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা আমাদের সবার মনেই কোনওও না কোনও সময় উঁকি দিয়েছে বা দেয়। বিশ্বাসী মানুষের মনেও দেয়, অবিশ্বাসীর মনেও দেয়। প্রশ্নটা উঁকি দেয়, আর আমরা তাকে চাপা দিয়ে দিই। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি না। যদিও উত্তরটা খুবই সহজ। আমাদের খুব কাছেই সেই উত্তর। তইত্তিরীয় উপনিষদে সুন্দর করে ঈশ্বর কী তা বলা হয়েছে – সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্মঃ ! অর্থাৎ যে অনন্ত সত্য আমরা আমাদের চেতনা বা জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করি, তাহাই ব্রহ্ম – তাহাই ঈশ্বর। সৎ কী? সৎ অর্থে বাস্তব – বস্তু। যে বস্তু আমরা দেখি, স্পর্শ করি, আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করি। উপলব্ধি করি বলেই বস্তু আছে, উপলব্ধি না করলে নেই। সৎ চিত অনন্তম – আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ – অর্থাৎ আমি আছি বলেই পান্না আছে, পান্না সবুজ হয়েছে। আমি আছি বলেই এই বস্তু জগত রয়েছে – আমি আছি বলেই এই গ্রহ তারা – এই পৃথিবী আছে। আমি না থাকলে কিছুই নেই। আমি আছি বলেই তুমি আছ। আমি আছি বলেই ঈশ্বর আছে। আমি ও ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন। সো-অহম – আমিই সে। সুতরাং, আমি যদি আমাকে দয়া করতে না পারি, তাহলে আর কে আমায় দয়া করবে? করুণা করবে?
ভক্ত ২: কিন্তু মহারাজ, আমি কি করে আমাকে দয়া করব? কি করে আমাকে করুণা করব, ক্ষমা করব?
অতুল: এই হল আসল প্রশ্ন। আমি কে? এই আলোচনা শুরু করার আগে আপনাদের একটা গল্প বলি। পুরাকালে জনক নামে এক রাজা ছিলেন। আপনারা অনেকেই জনক রাজার নাম শুনেছেন। এক রাতে, মহারাজ জনক তার শয়ন কক্ষে নিদ্রা যাচ্ছিলেন। হঠাত্ রক্ষীর প্রবল চিৎকারে শুনে উনি লাফিয়ে উঠলেন। রক্ষী দুয়ারে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে জানাল, ”মহারাজ, শত্রু সৈন্য নগর আক্রমণ করেছে। আপনি নগর রক্ষা করুন।” মহারাজ তৎক্ষণাৎ উঠে, রণসাজে সেজে, নগর রক্ষা করতে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, শত্রু পক্ষের এই অতর্কিত আক্রমণ মহারাজ জনকের সৈন্যদল প্রতিরোধ করতে বিফল হল। মহারাজ জনক বন্দী হলেন। বন্দী মহারাজকে শত্রু পক্ষের রাজার সামনে বেঁধে আনা হল। শত্রু পক্ষের রাজা বললেন, মহারাজ জনক আমি আপনাকে প্রাণে মারব না। কিন্তু এই রাজ্য থেকে আপনি চিরদিনের জন্য নির্বাসিত হলেন। রক্ষীদের বললেন, তোরা মহারাজকে রাজ্যের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আয়। রক্ষীরা জনক রাজাকে রাজ্যের বাইরে ছেড়ে দিয়ে এল। রণক্লান্ত, রক্তাত্ত রাজা হেঁটে চললেন – সারা দিন সারা রাত হাঁটলেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত মহারাজ দেখলেন পথের ধারে এক বণিক দরিদ্র নারায়ণসেবা করছেন। হাজার হাজার গরিব ভিখিরিদের খিচুড়ি বিতরণ করছেন। ক্ষুধার্ত মহারাজ সেই খিচুরির জন্য দরিদ্র ভিখারিদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে দাঁড়ালেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, মহারাজ যখন খিচুড়ি বিতরকের সামনে এসে পৌঁছলেন তখন সব খাবার শেষ। বণিক বললেন, আমি দুঃখিত সব খিচুড়ি নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু হতাশ এবং ক্ষুধার্ত রাজাকে দেখে তার করুণা হল। বললেন, হাঁড়ির নীচে একটু মাড় পড়ে রয়েছে, যদি চাও দিতে পারি। অগত্যা মহারাজ হাত পেতে শাল পাতার ঠোঙায় সেই মাড় নিলেন। কিন্তু মহারাজ যখন সবে খেতে বসেছেন, অমনি একটি চিল এসে ছোঁ মেরে ঠোঙাটা ছিনিয়ে নিতে গেল। মহারাজও ছাড়তে নারাজ। এই টানাটানিতে ঠোঙার সবটুকু মাড় ধুলোয় গড়িয়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল।
মহারাজ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে হাহাকার করতে লাগলেন, আর ধুলোতে গড়াতে লাগলেন। কিন্তু তার মধ্যেই শুনতে পারলেন কে ডাকছে “মহারাজ, মহারাজ। উঠুন মহারাজ”। মহারাজ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন। দেখলেন তিনি তার শয়নকক্ষেই, দুগ্ধফেননিভ শয্যায় বসে রয়েছেন, পাশে তার রক্ষী উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ এতক্ষণ যা দেখছিলেন তা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। মহারাজ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। স্বপ্ন কখনও এত জীবন্ত হতে পারে? উনি ফ্যাল ফ্যাল করে রক্ষীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, উহা সত্য নাকি ইহা সত্য? মহারানী ছুটে এলেন। মহারাজ তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, উহা সত্য নাকি ইহা সত্য? মহারাজ রাজসভায় গেলেন। কিন্তু যেই সামনে আসছেন, মহারাজ তাকেই জিজ্ঞাসা করছেন – উহা সত্য নাকি ইহা সত্য? রাজ কাজ সব বন্ধ হবার জোগাড়। মহারাজ জনকের মুখে কেবল একটাই কথা – উহা সত্য নাকি ইহা সত্য। রাজ্যের নাগরিকগণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। সেই সময়ে নগর ভ্রমণে এসেছিলেন মহাজ্ঞানী মহামুনি অষ্টাবক্র। সব শুনে তিনি রাজসভায় এসে মহারাজকে সম্ভাষণ করে বললেন – জয়স্তু মহারাজ। মহারাজ বললেন – উহা সত্য নাকি ইহা সত্য? অষ্টাবক্র মুনি ত্রিকালজ্ঞ। মহারাজের মনের কথা সব তিনি জানেন। তিনি বললেন, মহারাজ, আপনি উহা যা দেখেছিলেন, অনুভব করেছিলেন – সেই যুদ্ধ, সেই লাঞ্ছনা, সেই ক্লান্তি, সেই ক্ষুধা, সেই হতাশা – তা কি এখন অনুভব করছেন? মহারাজ বললেন, না করছি না। মুনি জিজ্ঞসা করলেন, আর এখন আপনি আপনার রাজসভায়, আপনার সমহিমায়, আপনার মন্ত্রী আমাত্য রক্ষীদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে, আপনার ধন দৌলৎ, আপনার মহারানী, আপনার পুত্রগণের সান্নিধ্য সুখ অনুভব করছেন। কিন্তু সেই সময় এই সব ছিল কি? মহারাজ বললেন, না ছিল না। কিন্তু মহারাজ ওই সময়, ওই পরাজয়, ওই গ্লানি, ওই যন্ত্রণা তো আপনিই অনুভব করেছিলেন, তাই নয় কি? মহারাজ বললেন, হ্যাঁ আমিই করেছিলাম। আর এখন এই বৈভব, এই সুখ, এই সাম্রাজ্য এসবও তো আপনিই অনুভব করছেন? মহারাজ বললেন, হ্যাঁ ঠিক, আমিই অনুভব করছি। অষ্টাবক্র বললেন, তাহলে মহারাজ, উহাও সত্য নয়, ইহাও সত্য নয়। কেবল আপনিই সত্য। (থেমে) কথাটার তাৎপর্য বুঝতে পারছেন। আমিই একমাত্র সত্য – আর কিছু নয়। মানুষ চারটি অবস্থায় বাস করে – জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, এবং তুরীয়। জাগ্রত, যেমন এই আমরা জেগে আছি। একে অপরকে দেখছি, শুনছি। স্বপ্ন, যখন আমরা নিদ্রামগ্ন হয়ে স্বপ্ন দেখি আর জনক রাজার মতো তাকেই সত্য বলে মনে করি। সুষুপ্তি সেই অবস্থা যখন আমরা সম্পূর্ণ অচেতন জগতে চলে যাই – আমার অস্তিত্ব থাকে কিন্তু কোনও স্থান কাল বোধ থাকে না। কিন্তু এই তিন অবস্থাতেই আমি থাকি। সেই আমিকে যে অবস্থায় আমরা বুঝতে পারি, তাহাই হল তুরীয়! ধ্যান যোগে সেই চেতনা আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়। আসুন আমরা ধ্যান করি।
অতুলানন্দ ধ্যানে বসেন। এক ভদ্রলোক মৃণাল বাবু প্রবেশ করেন। মৃণাল অতুলানন্দ মহারাজের পাশে এসে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ওনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।)
ছবি সৌজন্যে Pixabay
চলবে
সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।