আঁচিলে পাঁচিলে উঠে, গাছে চড়ে, মাঠ দাপিয়ে ছুটে, হাঁটু ছড়ে, থুতনি কেটে, ঘেমে নেয়ে সেই যে ক্ষণে ক্ষণে ভাব আর আড়ির বহর, তা যেন কবেই গুটি গুটি এসে জড়ো হল মশগুল আড্ডায়। চাল এবং চলন দু’ইই গেল বদলে। শুরু হল প্রচুর প্যাকেজ ভর্তি জীবন- বাঁধা কাজ আর বিস্তর দায় ও দায়িত্ব বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত। চলল, টুকটাক গল্পগুজব, আলোচনা, পরামর্শ। তবে, একে ঠিক মশগুল আড্ডা বলে মনেই হত না; মানে যেমন দেখেছি বাবা, কাকা বা দাদাদের আড্ডায়। সেই যে, এক কথার ভিড় ঠেলে, অন্য কথায় এমনি এমনি সময় কাটানো এবং তাতে ছেদ পড়লেই এর বিহনে বিস্তর ফাঁকা ফাঁকা লাগা! আমার ধারণায় তাইই তো হল আড্ডা। সঙ্গে একটু ফুরফুরে সাজগোজ, আর টুকিটাকি খাওয়া দাওয়া। সময় বার করে অনাবশ্যক মতান্তর ও সহমর্মিতার খেরোর খাতা।
ইশকুল বেলা পর্যন্ত খেলা আর সইভাবে বড় হয়ে উঠতেই সময় কেটে যায়। আসল আড্ডা শুরু হয় কলেজে গিয়ে। পাকা পাকা মেয়েদের ছড়ানো দলে, সমবয়সী ছেলেদের তখন নিতান্তই বালক মনে হয়। তাই মেয়ে ইশকুলে পড়েও আমরা যতটা না মেয়ে ছিলাম, ছেলেদের সঙ্গে মিলেমিশে বুঝতে পারলাম যে, আমরা মেয়েই বটে। আর আমাদের গপ্পো, আমাদের সাজ, আমাদের নড়াচড়া সবতেই আকর্ষণ এবং সকলের নজরও– সহপাঠী বা সিনিয়র থেকে তাবৎ মাস্টারমশাই কেউ বাদ নেই। ঠারেঠোরে, অনুমানে বা ইশারা ইঙ্গিতে পাওয়া সেই সব মণি মাণিক্য সংগ্রহের বহরে মেয়েদের আড্ডায় তখন মেলা রসদ। আর নানা অলীক বাসনার সুখ স্বাদ।
ক্লাসের আগে প্রেসিডেন্সির মাঠে, আর ক্লাস হয়ে গেলে কফি হাউস। তখনও কিন্তু মেয়েদের গায়ে দোসুতি চাদরের মতো আলগা জড়িয়ে আছে– ‘মা বকবে– বাবা বকবে’; আর আমার তো কেউ না খেয়াল করলেও, ঠাকুমা বকবেনই। ফলে ওদিকে বাড়ি ফেরার সময়ে টান পড়বে ভেবে, মাঝে মাঝেই তিনটের ক্লাসটা কাটা ছাড়া উপায় ছিল না। সে যে কী বকবকের নেশা! সবার মুখেই খই ফুটছে। তখন শরীরের বায়োলজিক্যাল রহস্য নিয়ে ইস্কুলবেলার সেই আলোচনা, একেবারেই তুচ্ছ হয়ে গেছে।
সে সব পার করে, সবে আমরা সমাজ, রাজনীতি, সিনেমা, নাটক, লিটল ম্যাগাজিন– অর্থাৎ সাঁর্ত্র – কামু – কাফকা ও ঋত্বিক ঘটকে ঢুকছি। ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’ এবং ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ দেখে এসে, সারারাত না ঘুমিয়ে বসে আছি। ভিয়েতনামের যুদ্ধে বুক বাঁধছি। মাও ছাপিয়ে চিনছি ফিদেল কাস্ত্রো এবং হো চি মিনকেও। হাতে পায়ে ছুট যত কমছে, মনের ছটফটানি ততই বাড়ছে। এই অস্থিরতার ঝড়ই তখন আমাদের আড্ডার বিষয়। সাজগোজ চাল চলনে ফুটে উঠছে, অনাড়ম্বর অথচ সপ্রতিভ এক আত্মবিশ্বাস। আত্মীয়স্বজনরা আওয়াজ দিচ্ছেন– ‘কলেজ-স্ট্রিট মার্কা আঁতেল’ বলে।
এই যে বিরাট দলে তাল তুলে ঝোড়ো আড্ডা, তা বেশ খানিক সাইজ হয়ে গেল কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসেই ক্লাস, কিন্তু বেশিরভাগ বই নিতে তো যেতেই হত ন্যাশনাল লাইব্রেরি। ফটোকপির সুবিধে নেই, তাই পাতার পর পাতা বুঝে বুঝে নোট। রিডিং রুমে পড়তে পড়তে, ক্বচিৎ কখনও ছোট দলে গুলতানি করেছি বন্ধুরা মিলে। সেটা ঠিক আড্ডা নয়।
পড়ার চাপের সঙ্গে সঙ্গে, ইতিমধ্যে আবার বেশিরভাগের জীবনেই প্রেমিকরা ঢুকে পড়ায়, দলে মেশার থেকে তখন বেশি পছন্দের হল নিভৃতি আর রাস্তায় রাস্তায় হাঁটা। সে সময়টাতে আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আঁচ অনুমান করে প্রবল শ্রমেও লেগে পড়েছি– মানে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ গোছের অবস্থা। ভবের বাজারের খোলা হাটে, কোমর বেঁধে ঢোকার প্রস্তুতি।
তবে মেয়ে কলেজে পড়াতে এসে বুঝলাম যে, অমলিন আড্ডা কাকে বলে! সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের স্টাফরুম। গৌরীদি (আইয়ুব), অমিতাদি, মৈত্রীদি, দুই বন্দনাদি, যমুনাদি, সুশীলদি (পাঞ্জাবী), সুকীর্তিদি, পূরবীদি এবং শীলাদি মিলে বিকেলের আড্ডা। সিঙ্গাড়া-মুড়ি-চা এবং সেইসঙ্গে বিকেল ফুরিয়ে আসার আঁচ। প্রিজমের মধ্যে দিয়ে আলো প্রবেশ করলে যে রকম মনোহারি দেখায়, ঠিক সেই রকম এক অনায়াস বিভা ছড়িয়ে থাকত তাঁদের আলোচনা এবং সরস মন্তব্যে।
আমার মতো চটি ফ্যাট ফ্যাট 3D/1 চড়ে কলেজে আসার সঙ্গেও অনায়াসে মিশে যেতেন, লর্ড সিনহা রোড বা থিয়েটার রোডের দামি আস্তানায় বসবাস করা, দু’কানে হিরে পরে, হালকা পায়ে হেঁটে আসা সেই সব সত্যিকারের দামি এবং অভিজাত মানুষগুলি। শিক্ষাই সেখানে একমাত্র বিবেচ্য সম্পদ। ক্লাব মেম্বারশিপ বা হিরে জহরতে ঠাসা একাধিক লকার বা বাঙালি-অবাঙালি কিছুই বিচারাধীন নয়। ফলে এক অন্যরকম আড্ডা দেওয়া শিখতে লাগলাম, তাঁদের সঙ্গে জুটে এবং আড্ডা দিতে দিতে। শিখলাম, মতান্তর যে মনান্তর নয়।
সে সব পার করে, সবে আমরা সমাজ, রাজনীতি, সিনেমা, নাটক, লিটল ম্যাগাজিন– অর্থাৎ সাঁর্ত্র – কামু – কাফকা ও ঋত্বিক ঘটকে ঢুকছি। ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’ এবং ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ দেখে এসে, সারারাত না ঘুমিয়ে বসে আছি। ভিয়েতনামের যুদ্ধে বুক বাঁধছি। মাও ছাপিয়ে চিনছি ফিদেল কাস্ত্রো এবং হো চি মিনকেও।
আর শিখলাম, বাড়ি ফেরার পথে মনে করে, কাজ সারতে সারতে ফুরফুরে মনে সংসারের দেখভাল। কারণ, ‘মেয়ে আমার আড্ডা দিয়ে ফিরলেন’- এ কথা বলার লোক তখন কমতে শুরু করেছে। তাছাড়াও সংসারের নানা দেখভাল ঠিকমতো না করলে, শেষে বিরাট এক মুশকিলে তো পড়তে হবে নিজেকেই। ‘মুড নেই’- বলে জানলার দিকে অপলক তাকিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার সেই সব বিলাসী দিন, কখন যেন মুঠো আলগা হয়ে পগারপার। আমদের বয়সও তো তখন তিরিশ ছাড়াচ্ছে।
তবে অবাধ আড্ডা হত আমাদের বিভাগের সহকর্মীদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে। নানা বয়সের হলেই বা– সারারাত আড্ডা আর টুকটাক খাওয়া। ভোরে একঘণ্টা ঘুমিয়েই আবার বেরিয়ে পড়া। এইসব নিবিড় আড্ডাই আমাকে অনেক বেশি নারী করে তুলেছিল। তখন আমাদের বিভাগে আবার অনেকেই ছাত্রী থেকে সহকর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছে। বয়সের এক ব্যাপক বিস্তৃতি। নির্বিচারে পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ।
সকলেই এক বিষয়ের শিক্ষিকা, একই কলেজে রোজ কাজ, অথচ ভাবনাচিন্তার কত কত তফাৎ। মনের গহন জঠরে যা কিছু জমা থাকে, অথচ বলা যায় না, তার একটা সহজ জানলা ছিল এইসব আড্ডা। যৌনতাবোধ, নারীত্বের সম্মান, নিজেকে রক্ষা করা এসব নিয়ে ক্রমে ভাবতে শিখেছি। ‘ভাল মেয়ে–খারাপ মেয়ের’ সাদা কালো তকমার বাইরে বেরিয়ে এসেছে উন্মুক্ত এক সত্তা। ‘bad marriage– good sex’, ‘homosexuality’, ‘hetero sexuality’, ‘marriage or live in’, ‘post menopausal syndrome’– কত অনায়াসে খোলা মনে জানতে পেরেছি। কত ভাল ভাল বই আর সিনেমারও হদিশ পেয়েছি।
হৈ হৈ তর্ক আর কোরাস হাসিতে তুফান উঠেছে। আর শিখেছি ছোট ছোট আয়োজনে নিজের মনে, নিজের জন্য একটা সাজানো ঘর গড়তে। শিখেছি এই যে- সমঝোতাও কখনও কখনও প্রতিবাদ। আসলে শিখেছি, নারীবাদী হওয়ার আগে পূর্ণবয়স্ক এবং সচেতন এক নারী হয়ে উঠতে। বুঝেছি যে সচেতনতাই আসলে এক মস্ত প্রতিবাদ, যাকে আর ‘ডেঁপোমি’ বলে তাড়ানো যাবে না। অচেনা ভুবনের আগল ক্রমে ক্রমে এভাবেই খুলেছে। সম্পর্কের ঝোড়ো হাওয়ায় বেসামাল হয়ে, আবার যে সামলে উঠেছি, তার অন্যতম কারণ এই সব খোলামেলা আড্ডা আর তর্ক বিতর্ক। সবচেয়ে বড় সম্পদ যে সিদ্ধান্ত নিতে পারা- তাও তো শিখেছি।
সে সময় মোবাইল আর সোশাল মিডিয়া না থাকায়, আমরা সকলেই উন্মুখ হয়ে থাকতাম পরস্পরের সঙ্গ পাওয়ার জন্য। ফলে আড্ডাই ছিল সমালোচনা ও সমর্থন পাবার সহজ উপায়। সঙ্গে থাকত ক্রিস্প গসিপও। তার আকর্ষণই বা কম কী! পরে যখন আড্ডা এবং সেই একরাতের জমায়েত ক্রমে ফুরল, তখন দেখলাম কবে যেন আমাদের সেই অনাবশ্যক উঁকিঝুঁকি বিষয়গুলো বেমালুম লোপাট। তার জায়গায় কিছু মামুলি গপ্পো, উন্নতি-অবনতি আর সমস্যার ঊর্ণজাল। যে যার ছোট্ট অস্তিত্ব টেঁকাতে বদহজমের ঢেঁকুর তুলছে। আর চটজলদি সমাধানে মোবাইলভর্তি নানা অ্যাপ– সুইগি, উবের, ওলা, আরবান ক্ল্যাপ, প্র্যাক্টো ইত্যাদি প্রভৃতি।
আরও পড়ুন: আলপনা ঘোষের কলাম ‘দিনের পরে দিন’- সংবাদজগতের উত্তমকুমার
চল্লিশ পার করে শুরু হল সহকর্মীদের বদলে ছোট ছোট নানা দলে বেড়ানো। সেখানে অবশ্য আড্ডা নয়, অনেক রাত পর্যন্ত একটু গপ্পোগাছা, ব্যক্তিগত সমস্যা আর বিচিত্র সব ব্যাধির খরচসাপেক্ষ চিকিৎসার ডাকখোঁজ। এরকমই জমায়েতে কখনও লেখিকাদের সঙ্গে, কখনও অন্য কোনও এনজিওদের সঙ্গে। সে সবে আলোচনা গপ্পো বিস্তর হয়েছে, কিন্তু আড্ডা হয়নি। বঞ্চনা প্রতিবাদের বিরুদ্ধে অনেক সম্মিলিত সিদ্ধান্তও হয়েছে, কিন্তু তা আর অনাবিল আড্ডার আরাম দেয়নি। ফলে অনাবশ্যক আড্ডার ঠেকও ক্রমেই হারিয়েছে।
ভরসা জাগে, আমার মেয়ের আড্ডা দেওয়ার বহর দেখে। ‘ব্যস্ত’, ‘বিরক্ত’ এবং ‘অসুস্থ’– মোটামুটি এই তিন অবস্থায় সে নিত্য বিরাজমান থাকলেও তাল তুলে আড্ডা দেওয়ায় তার কিন্তু বিরাম নেই। অতি দ্রুততায় কর্তব্য কর্ম সেরে, ‘দরকার আছে’- বলে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গিয়ে কোনও ঠেকে গুছিয়ে বসবে। অল্প সময়ের জন্য কলকাতায় থাকলেও– একদিকে যেমন কৌস্তুভী, রেশমি, সাহানা, অন্যদিকে তেমনি ঠিক একইমাপে- দোলন, তিস্তা, পারমিতা, রোশনি। আর ঠেক মানে কাছে দূরে মিশিয়ে, নিজেদের বাড়ি, গড়ের মাঠ, বিভিন্ন ক্যাফে, শান্তিনিকেতন, রণথম্ভোর, বেনারস বা গোয়া। তখন ওদের দেখে মনে হবে সব যেন ভিক্টোরিয়ায় ঘোড়ার গাড়িতে চেপেছে। চল্লিশ পার করা এইসব জাঁদরেল কর্মিষ্ঠাদের জীবন-ব্রতই নাকি আড্ডা।
এ লেখা লিখতে গিয়ে, কী মনে হল, মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, আড্ডাটা আসলে কী রে! বললাম, সবার সঙ্গে কেন রে আড্ডা জমে না? সে বলল, যারা আড্ডা দেয় একমাত্র তারাই জানে। ডেফিনিশন নেই। আর বলল যে, নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েও যেখানে সম্পর্কের মধ্যে কোনও হিংসে বা রাগ কাজ করে না, সেখানেই আড্ডা জমে। বুঝলাম যে, অল্প পরিচয়ে কারও সঙ্গে একদিন লম্বা সময় গপ্পো করাটাও আড্ডা নয়। এর একটা ধারাবাহিকতা থাকবেই; দিনের পর দিন বছরের পর বছর জুড়ে থাকার একটা টানটান এবং আকর্ষণীয় অনুভূতি। আর তাতেই যাবতীয় সমস্যা, আমোদ, বিরোধ সবই একটা সরস প্রাণ পায়।
এটা ঠিক তাই গজালি বা গুজগুজ ফুসফুস নয়। আবার দাদারা যে ছুটির দিন বা অন্যদিন সন্ধেবেলা পাড়ার মোড়ের দিকে হাঁটা দিয়ে বলত, ‘যাই একটু গেঁজিয়ে আসি’– আড্ডা ঠিক সেই গ্যাঁজানোও নয়। আবার বাঁকাভাবে বলা ‘আড্ডাবাজি’ও কিন্তু যথার্থ আড্ডা নয়। আড্ডা হল বুদ্ধি বিবেচনায় শান দেওয়ার এক অব্যর্থ নিদান। আড্ডা নিজেই এক চলমান সংস্কৃতি।
তবে মজা হল, সোশাল মিডিয়ার দৌলতে ইশকুল বন্ধুদের আবার নিজেদের চৌহদ্দিতে ফিরে পাওয়ায়। পড়ন্ত বেলায় ষাট ছুঁই ছুঁই সময়ে হৈ হৈ করে জুটে এল ইশকুল বন্ধুরা। ফেসবুক আর স্মার্টফোনের দৌলতে। যাদের স্মার্টফোন নেই তাদের জোর করে কেনানো হল। এবার সেই সদলবলে পুরী বা মধুপুর যাওয়ার মতো, কমবেশি তিরিশ জনের দল নিয়ে মাসে একবার করে, একবার এর বাড়ি তো, অন্যবার তার বাড়ি যাওয়া ছাড়াও বিয়ের নেমন্তন্ন বা উপহার কিনতে যাওয়াও।
সে সময় মোবাইল আর সোশাল মিডিয়া না থাকায়, আমরা সকলেই উন্মুখ হয়ে থাকতাম পরস্পরের সঙ্গ পাওয়ার জন্য। ফলে আড্ডাই ছিল সমালোচনা ও সমর্থন পাবার সহজ উপায়। সঙ্গে থাকত ক্রিস্প গসিপও। তার আকর্ষণই বা কম কী!
কী যে ভরপুর আনন্দ শুরু হল বলবার নয়। কত বদলে গেছি সবাই, কিন্তু ইশকুল বেলাটা তো আর বদলে যায় না! শোক, দুঃখ, বন্ধুবিয়োগ, অসুস্থতা, সবই ঘটছে। কিন্তু বন্ধুরাই তো বন্ধুদের সামলাচ্ছে। দিল্লির জয়শ্রী দিন গুনছে, কবে আবার এসে বাগবাজারের ফুচকা খাওয়া হবে; কানপুরে থাকা সুক্রিয়া আর অমরাবতীও সেই একই তাল ঠুকেই চলেছে। আর কলকাতার আমরা কখনও ইশকুলে সরস্বতী পুজোর দিনে, কখনও বিকেলে বাগবাজারের মায়ের ঘাট। আড্ডা আর শেষ হতে চায় না।
শ্রাবন্তীর বাড়ি প্রথম আড্ডার দিনে সকলে মিলে একসঙ্গে আমরা যে গাছ পুঁতেছিলাম, এই ক’বছরে বেড়ে উঠে সেই হাসনুহানা এখন ফুল ঝরায়। আমরা মোমবাতি জ্বেলে, গান করে, আড্ডার শুভেচ্ছায় ভরেছি নিজেদের। সংসারের তবিলদারির বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দেখছি, কারও কিছু খোওয়া যায়নি। আর আমাদের এই দল জুটিয়ে আড্ডা তো পরিচিত মহলেও কম সাড়া ফেলেনি! লকডাউন হতেই মেয়ে, নাতি, ড্রাইভার, সহকর্মীরা ‘হায় – হায়’ করে বলতে লাগল, আপনাদের আড্ডার কী হবে? কী করে দেখা করবেন! আমাদের অবশ্য সে সবে তোয়াক্কা নেই। হোয়াটস্যাপ গ্রুপেই চলছে একের পর এক জম্পেশ আয়োজনে আড্ডা। শুভ জন্মদিন, শুভ বিজয়া, রবীন্দ্রজয়ন্তী, দোল- এ রকম কয়েকটা দিন জুটে গেলে তো কথাই নেই।
এর বাইরেও আছে বিশাল এক হট্টমালার দেশ। তবে আপাতত চলছে আমাদের ভ্যাক্সিন পর্বের আড্ডা। যেমন দিল্লি থেকে একজন লিখল, ‘এদিকে বিরাট সমস্যা। কাল সকাল দশটায় ভ্যাক্সিন নেব, অথচ আমার স্লিভলেস ব্লাউজ নেই। শাশুড়ি বলছেন একটা হাতা আপাতত কেটে নাও, পরে আবার জুড়ে নেওয়া যাবে; দেওর বলছে, দাদার স্যান্ডো গেঞ্জি তো আছে; বর বলছে, চল কিনে নাও; শাশুড়ি রেগে বলছেন, সুদুমুদু পয়সা নষ্ট; আমার প্রাণের বন্ধুরা, তোরা কি হেল্প করতে পারবি?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে যা এল–
*হাতকাটা নাইটির ওপর শাড়ি পর;
*ব্রা পরে আঁচল টেনে বেরিয়ে যা;
*শাশুড়িকে ভূতের ভয় দেখা।
আমি লিখলাম, ‘তোর প্রেরণায় চল, ভ্যাকসিন ব্লাউজের নতুন ডিজাইন চালু করি। অফ শোল্ডার ভ্যাক্সিন টপ/ব্লাউজ় উইথ ম্যাচিং মাস্ক।
আর একজন জানাল, ‘আমারও কোন হাতকাটা ব্লাউজ় নেই। তাই আমি রুবিয়ার একটা হাতা ঢুলঢুলে ব্লাউজ পরে গিয়েছিলাম, যাতে হাতাটা একটু গুটিয়ে ওপরে তোলা যায়। কিন্তু গিয়ে দেখলাম ওখানে মহিলারাই ভ্যাকসিন দিচ্ছে, কাঁধ থেকে মেয়েদের ব্লাউজের হাতাটা একটু টেনে নামিয়ে। তবে দিল্লিতে কী ব্যবস্থা তা জানি না।’ এইরকম দু’এক পিস পড়েই বোঝা যায় যে মেয়েদের কথা বলাবলি এবং আড্ডার কী মহিমা!
আরও পড়ুন মন্দার মুখোপাধ্যায়ের কলাম ‘আইঢাই’- সর-পর
তবে এর মানে মোটেই এই নয় যে, ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা আমরা উপভোগ করি না; খুবই আনন্দের হয় সেই ‘কো –এড’ আড্ডা। আমাদের বেশ কিছু সরাসরি বন্ধু আছে যাদের গায়ে পুং গন্ধ চড়া হলেও তা কখনও চড়াও হয়ে আক্রমণাত্মক নয়। বন্ধুর বরেরা তো চমৎকার সব মানুষ। দাদা এবং ভাইয়ের বন্ধুরাও তো এখন বন্ধু। তবে ওই আর কী! মেয়েদের দেখলেই মনে হয় এরাই চা দেবে, সিঙ্গাড়া সাজাবে আর আমরা পুং দল বসে বসে পা দোলাব।
মধ্যবয়সী একজন মেয়ে যত স্বাবলম্বী, তুলনায় একজন মাঝবয়সী পুরুষ, বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া, অনেক বেশি পরিবার নির্ভর। ‘কই গো! কোথায় গেলে?’ এই আঁচলচাপা ভাব কাটিয়ে আড্ডা দেবার মনটা চাপা পড়ে যায়। সেই সব তরুণ তুর্কিরা , নিজেদের চাকরি বা ব্যবসায়িক সাফল্যের ফলভারে নুয়ে, বেশি উৎসাহ পায় চালু রাজনীতি, অর্থনীতি, আর অবক্ষয়ের কথা বলতে। ‘বউ বকবে’র নিরাপদ বর্মটা অনাবশ্যক এঁটে রাখে। তুলনায় মেয়েরা একটা বয়েসের পর, অনেক সহজে বলতে পারে, ‘তুমি চুপ কর তো!’
আমাদের ছোটবেলায় আড্ডাবাজ হওয়া বা আড্ডাবাজি করাটা বেশ খারাপ অর্থেই বলা হত। মনে পড়ছিল, হাতিবাগানে শাশুড়িরই পেটিকোট কিনতে এসে ফুচকা, আলুকাবলি খেতে একটু দেরি হয়ে যাওয়ায়, ঢোকার মুখে সদর দরজা থেকেই শুনছি যে কাকে যেন বলছেন, ‘দেখ, আড্ডা দিতে দাঁড়িয়ে পড়েছেন কোথাও!’
বাচাল এবং অপোগণ্ড অলসরাই যে শুধু আড্ডা দেয় এমনটাও ভাবা হত। আবার একইসঙ্গে বলা হত যে বাঙালির সিগনেচার হল আড্ডা। হিন্দি শিখতে গিয়ে যখন জানলাম যে , ‘ঘুসঘুস আড্ডা’ হল রেল জংশন– তখন এর বাঙালিত্ব নিয়ে সন্দেহ জেগেছিল। এবং আড্ডা নিয়ে সংসারে যে রকম ঠাসাঠাসি ছিল, তা দেখে ভাবতাম যে, এটা বোধহয় নিত্য পুংলিঙ্গ শব্দ। আর মেয়ে পুরুষে মিলে আড্ডা হলে তো সেই সব মেয়েদের বেজাত বদনামে সাতদিনের ফাঁসি।
এর মানে মোটেই এই নয় যে, ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা আমরা উপভোগ করি না; খুবই আনন্দের হয় সেই ‘কো –এড’ আড্ডা। আমাদের বেশ কিছু সরাসরি বন্ধু আছে যাদের গায়ে পুং গন্ধ চড়া হলেও তা কখনও চড়াও হয়ে আক্রমণাত্মক নয়। বন্ধুর বরেরা তো চমৎকার সব মানুষ।
আমাদের যৌবন-উন্মেষে যৌথতা যে শুধু সংসারে ছিল তাই নয়, ছিল এক সার্বিক মনোভূমির যাপনেও। মতামতের সংগঠিত প্রকাশ তাই অনেক বাধা পার করতেও সাহায্য করেছে, এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরেও। আজকের সমস্যা কিন্তু নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব এবং পরস্পরকে কাছে না পাওয়া; এবং একই সঙ্গে রাজনীতির উগ্র আক্রমণ। সমাজ এবং মানুষ– এই সরাসরি সম্পর্ককে যদি আবার ফলবান করে তুলতে হয়, তো আড্ডাই হল এক অব্যর্থ টোটকা, মানসিক পুনর্বাসনের সহজ পথ।
এখন আবার হালে দেখি যে, আড্ডা কথাটা বেশ ব্র্যান্ডেড হয়ে উঠেছে। নিখুঁত ব্যবসার ছকে সাজানো জমায়েতকেও আড্ডার আদর দেওয়া হচ্ছে, যা আসলে পেশাদারি ‘মজলিস’। সেই ‘সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে, বেড়ে ব্যাটাকে ধরে’র মতো। সে যা হোক তা হোক; যে যা পারে করুকগে আর বলুকগে। আমারা যারা দল জুটিয়ে মেয়ে-আড্ডার স্বাদ পেয়ে গেছি, তা আর সহজে ছাড়ছি না। আড্ডাই আড্ডাকে বাঁচিয়ে রাখুক– আর আমরা নিয়মিত জড়ো হই, নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে এক আড্ডার সংকল্পে। কারণ আড্ডায় না লাগে চাল, না কোনও পেশাদারিত্ব। চলনটুকুই থাকলেই হল। আড্ডাই হল শুয়ে বসে গড়িয়ে ঘেমে– সেই সক্ষম ‘চরৈবেতি’।
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।