ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মের সখ্য সেই কবে থেকেই
যখন পাহাড়ের মৌন আর নোনা বাতাসের মাঝে
অযুত ম্লান বিকেলে ঝরে পড়া হলুদ জবার দীর্ঘশ্বাস জমা ছিল,
আর একট আসমান জমিন ফারাক তুলোর বিছানায়, খড়ের গাদায়
অচেনা অজানা ক্ষুধার্ত রাত, ঘোড়ার আস্তাবলে প্রবল শীতে
জড়িয়ে ছিল একটা একাকী বাছুরের নরম ওম!
ভোর হলে ওদের পায়ের তলা দিয়ে
কাকভিজে চুপিসারে বেরিয়ে আসত অজস্র
সব উপকথা আর আখ্যান।
দুঃখী রাজকন্যার খোলস ছেড়ে
সবেমাত্র বেরিয়েছে যে সাদা পাতা
তার গা বেয়ে উঠে আসত এক অদ্ভুত সুর,
ঠিক যেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ
অথবা নতুন কোনও ট্রেন
তার উদ্ধত গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ত এক সুরের জগতে,
যে সুর শুধু বলে, ‘পড়ো পড়ো পড়ো।
সুরটি হারিও না। জীবন বড় সুন্দর। লা দলচে ভিতা।’
একাকী পরিত্যক্ত ট্রেনটার স্পর্শে প্রতিটা রাতে
সে হয়ে উঠত উন্মত্ত এক দরবেশ!
দীন দুনিয়ায় যে দরবেশের কোনও স্থায়ী ঘর নেই,
কেবল এক অস্থায়ী স্বপ্নে জয় করতে চায় পৃথিবীর যাবতীয় অসুখ!
যে অসুখের স্পর্শ লেগে রয়েছে শ্যেন নদীর পারে
একা বসে থাকা বিষণ্ণ কবি পল সিল্যানের চোখে,
নুড়ি পাথরের খাঁজে চেনা ফুল খুঁজে পেলে,
হয়ত কবি মুলতুবি রাখতেন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত?
রাত যত গভীর হয়, দরবেশের আত্মাও চেপে বসে প্ল্যাটফর্মের কংক্রিটে
ভারী উজ্জ্বল দুটো চোখ উপহার দেয় পরিত্যক্ত সেই লম্বা মতো ট্রেনটার ইঞ্জিনে,
সে চোখ দেখতে থাকে, বুলভার ম্যাক্সিম গোর্কি ধরে পায়চারী করছেন রবীন্দ্রনাথ
মাঝে মাঝে সাইরেন বাজাতে বাজাতে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলে যাচ্ছে
আহা কী রাত!
প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেনের মধুর বন্ধন…
যাকে ভাঙতে চেয়েও সাড়ে তিনবছর ধরে একভাবে দাঁড়িয়ে ছিল একটা নিঃসঙ্গ ট্রেন
আসলে নিঃসঙ্গতা বড় জটিল, সমস্ত ট্রেন জুড়ে গতিপথের স্মৃতি,
সুন্দরের আবাহন, সফলতার স্বপ্ন
স্বপ্ন দেখানোর মতোই স্বপ্ন ভাঙার অপূর্ব আস্বাদ!
রেলপথ জুড়ে ছড়ানো ছোটো কয়েকটা নুড়িপাথর ভাঙতে ভাঙতে
একদিন নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ট্রেনটা
ভোর হওয়ার আগেই।
কে যেন ছুটছে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে,
ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটাকে ধরে ফেলার কী আকুল প্রচেষ্টা!
যতক্ষণ না পৃথিবী একটু একটু করে জেগে উঠছে
সে ছুটে চলেছে অবিরাম
হাত বাড়িয়ে ডাকছে ক্রমাগত
জীবন, প্রাণ মায়া ভালবাসা সকলকে হাতের ইশারায় ডাকছে
ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে ছুটন্ত সেই ট্রেন
আর কুয়াশার মুখ মুছে জেগে ওঠা পৃথিবীর আলোয়
ঘুম ভেঙে প্ল্যাটফর্ম, বিদ্রূপভরে নিজেকেই বলছে,
‘লা দলচে ভিতা লা দলচে ভিতা,
জীবন সুন্দর জীবন সুন্দর!’
রিমি দিল্লিনিবাসী, অর্থনীতির শিক্ষক। খবরের কাগজে ফ্রিলান্স সাংবাদিকতা ছাড়াও লেখেন গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। তাঁর প্রকাশিত বই দুটি। ‘মিথ্যে ছিল না সবটা নামে কবিতা সংকলন ও দময়ন্তীর জার্নাল নামে গল্প সংকলন। ভালবাসেন এরোপ্লেনের ডানায় ভেসে থাকা মেঘ আর সেই উথালপাতাল ঢেউ ও চাপচাপ কুয়াশায় খুঁজে পাওয়া নতুন কোনও ক্যানভাস।