Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

সার্কাস, ট্রেটর ও দ্রোহকাল: পর্ব ৫

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

অক্টোবর ১৪, ২০২২

Bengali poetries
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] []

অজগরের মাথায় জ্বলে মণির মতো ভোর 

 

আজ আবার দুঃখের পাছায় লাথি মেরে বললাম:
হাসতে জানো না?
অশ্রুজলে ভাসো কেন, অতো?
বলতে পারো না আমি গাছ, বৃষ্টি আনি
মনো-অক্সাইড গায়েব করি
অম্লজান ছেড়ে দিয়ে বলি: বাঁচো।

–কেদার ভাদুড়ি  

গলি ও তস্য গলিতে ক্যারমবোর্ড ঘিরে আমরা চারজন নিস্তব্ধ, মাথার ওপর বালব, পোকাদের ভিড়। খাঁ খাঁ করছে চারপাশ, শীতের সন্ধ্যেবেলা কম্বলমুড়ি বাড়িঘর ঝিমোচ্ছে, আর স্ট্রাইকারের চোখ লাল মেডেলে স্থির। অকস্মাৎ মনযোগের ঝুঁটি আমূল নাড়িয়ে ওই সরু গলির ভেতর বিকট শব্দ ঘষটে একটা বাইক খুঁড়িয়ে চলে গেল। পোকারা বিরক্ত হয়ে উড়ে পালাল, আর তুষার বোর্ড থেকে নিমগ্ন চোখ না তুলে বলল, ‘বাইকনন্দিনী’। দেখলাম, সত্যিই আরোহীর সিটে লাল জামা পরা একটা মেয়ে, তার হর্সটেল হাওয়াতে উড়ে গেল এক ঝলক। তুষার কবিতা লিখত।

carrom
ক্যারমবোর্ড ঘিরে আমরা চারজন নিস্তব্ধ…

আমাদের পাড়ায় সমবয়সী বন্ধু যারা ছিল, যাদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম, ক্যারম, ব্যাডমিন্টন, প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত ঘরের– বাপ্পা একটা অফিসে ইলেকট্রিশিয়ান, গণেশ অটো চালায়, সৌমেন ভদ্রস্থ চাকরি জুটিয়ে কালক্রমে এইচআর হয়েছে, বিষ্ণুর হোম ডেলিভারির ব্যবসা, আর আমি ও তুষার লিখতাম। আমি গদ্য, ও কবিতা। তুষারের বাবা ছিল না, মায়ের একটা দোকান ছিল মুদিখানার, সেটা ভাল চলত। তুষারের দাদা দোকানে বসত, নিজের অটোও করেছিল একটা। কিন্তু তুষার পাকাপাকি কিছু করত না। শ্যামাপ্রসাদ কলেজ থেকে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ে তারপর কলেজস্ট্রিটে প্রুফ দেখার অনিয়মিত কাজ কিছুদিন, কখনও দু একটা টিউশন– খুব নেশা করত, ক্লেপ্টোম্যানিয়াক ছিল না, তবে পেন, টাকা এসব চুরি করত এখান ওখান থেকে, ওকে তাই আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে ভয় পেতাম। স্কুলজীবন থেকে, যত দিন যাচ্ছিল, ওর কবিতা আর চুরি দুটোই বেড়ে গিয়েছিল। আমার ভয় লাগত– এত তীব্র, রিরংসাময় ওর লেখা, যেন হাতের শিরা কেটে যাচ্ছে আর টপটপে রক্ত চুঁইয়ে যাচ্ছে পাতায়– তুষার তুই এমন লিখিস কী করে? ও উদাসীনভাবে পটভরা সিগারেটে টান দিত। ‘বাইকনন্দিনী’ জাতীয় ফ্রেজ অবহেলায় ঠোঁটের কোণায় ঝুলত ওর। অন্যেরা পাত্তা দিত না, কারণ যুগে যুগে কবিতা লেখার থেকে নিষ্কর্মা প্রস্থান যে আর কিছুতে নেই, আমরা তো জেনেইছিলাম ! কিন্তু আমার চেনাজানাদের মধ্যে তুষার প্রথম, যার কবিতা বেরিয়েছিল পর্বান্তর ও পরিচয়ের মত মান্য লিটল ম্যাগে। তখন ও ক্লাস টুয়েল্ভ মনে হয়।
– কীভাবে পাঠালি তুষার? ওরা কি তোকে চিনত?
– না তো, কেউ চিনত না…
হালকা হেসে তুষার মাথা ঝাঁকাল।
– পোস্টে পাঠিয়েছিলাম ছয় মাস আগে, জানতামও না যে বেরিয়েছে। সেদিন কল্যাণদার রাসবিহারীর দোকানে গিয়ে পাতা উলটে দেখি এই ব্যাপার।
– তাহলে খাওয়া!
– চল, জেসিবোর চাউমিন খাব আজ, একটা প্লেট ভাগাভাগি। এই শোন না, গাঁজা খাবি?
– না আমি খাই না, জানিস তো!
– না খেলে লিখবি কী করে? এরকম পুতুপুতু বেঁচে কী করবি তুই?

তুষার পুতুপুতু বাঁচত না। ওকে দেখে আমার বাঘের কথা মনে পড়ত। ছ’ফুটের ওপর লম্বা, চওড়ায় তেমনই, দাড়িওলা, গালে একটা কাটা দাগ, ছোটবেলায় বঁটির ওপর পড়ে গিয়েছিল। ইউনিয়নের মারামারিতে নিয়ে যেত বন্ধুরা, কিন্তু ওর ইন্টারেস্ট ছিল না। লেখা, ফুটবল খেলা, রাত্রে নেশা করে বাড়ি ফেরা, তারপর মায়ের গাল খেতে খেতে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেওয়া একচিলতে খাটে, এটুকুই বিনোদন ওর। সন্ধ্যেবেলা আমরা মাঝে মাঝে মাইতিপাড়ার মাঠে বসতাম, ও শোনাত নতুন লেখাগুলো। আগ্নেয়গিরির লাভার মতো গড়িয়ে যেত শব্দরাজি, মনে হত আগুন জ্বলে উঠেছে চরাচরে, তার আলো তুষারের বসন্তলাঞ্ছিত কপাল দগ্ধে দিচ্ছে। আমি স্তব্ধ ভাবতাম, এরকম অনর্গল বাকবিভূতি, যেন চোখ বুজলেই দিগন্ত পর্যন্ত তুষারের শব্দে ভরে উঠবে, তেমন স্ট্রাকচার তার– ‘পুরুষ থাকে সার্কাসে, আর নারীর গৃহ জোকা-য়’, এখানে ‘জোকা’ শব্দের মধ্যে যেভাবে জোকার চলে আসে এবং তা থেকে সার্কাসের অনুষঙ্গ, পুরুষ-নারী যেভাবে সংলগ্নতায় আসে, সেই ব্যাখ্যা শুনে ঝাঁকুনি খাবার স্মৃতি ভুলিনি। আমি এমন পারি না কেন, কেন এত অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মে লেখার সাহস নেই! তুষার মাঠের ওপর তখন শুয়ে পড়ত, পকেট থেকে পট বার করে বানাত কখনও বা। হঠাৎ বলত, ‘চল তোর বাড়ি যাই আজ’। আমি শঙ্কিত হতাম, তুষার বাড়ি যাওয়া মানেই কিছু না কিছু হারানো। 

কালক্রমে তুষারের একটা বই বেরল, আমরা তখন থার্ড ইয়ার। ওর চেনা বন্ধুরা মিলে ‘হারিত’ বলে একটা কাগজ করত, সেখান থেকে এক ফর্মার কবিতার বই। তুষার এক কপি আমাকে এনে দিল, বাকিগুলো নাকি নিজেই বিক্রিবাটা করেছিল। তারপরেও শুনেছি, ওর বাড়িতে ডাঁই হয়ে সেসব বই পড়ে থাকত। তাতে অবশ্য তুষারের কিছু এসে যায়নি, কারণ আমরা জানতাম এরকমই হয়। এসব বই মরে যাবার জন্যই জন্মিয়েছে। তাতে কি ওর লেখা থেমেছিল? না তো, অখ্যাত অল্পখ্যাত কাগজগুলোতে প্রায়ই বেরত, সেগুলো আমাকে দিতও– ‘তুই বুঝবি, বাকিগুলো তো আনপড়!’ তবে ওর নেশা করা বেড়ে যাচ্ছিল, সারাদিন মাঠেঘাটে শুয়ে থাকে আর গাঁজা খায়। প্রুফ দেখার কাজটাও ছেড়ে দিল। ‘ধুর, ঢপের চপ, পড়তে গেলে নিজের লেখা ভুলে যাব।’ ওর দাদা খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না ভাইয়ের বাউণ্ডুলেপনায়। পয়সা আনছে না দুটো, এদিকে কাব্যি ফাব্যির নাম করে ঘুরছে, ওদের মতো বাড়িতে এসব শৌখিনতা চলে না। একবার আমাকেও ধরেছিল– ‘তুই বল তো, এসব করে একটা টাকা কামাতে পারবে? লোকে নাকি কাগজে লিখে কামাই করে, এ তো উলটে আমার থেকে হাতখরচা নেয় রোজ ! ছাড়তে বল ওকে, একদিন কিন্তু বাবলার ডাল দিয়ে পিটাব!’

Man-writing
আমি ও তুষার লিখতাম… আমি গদ্য, ও কবিতা।

সেসবের দরকার পড়েনি, তুষার মার খেয়ে রক্তাক্ত হল পাড়ার লোকের কাছেই। প্রতিবেশী বাড়ি থেকে রুপোর গয়না চুরি গিয়েছিল, যেখানে তুষার ঢুকেছিল কিছুক্ষণ আগে। ওর স্বভাবের কথা সবাই জানত, এসব বেচে নেশা করে। চুলের মুঠি ধরে মারছিল বলাইদা, চেঁচাচ্ছিল– ‘তুই নাকি কবতে লিকিস! তোর কবতে, তোর কবতের চোদ্দগুষ্টির ইয়ে মারি! শালা চোরের বাচ্চা! কোন সাওসে তুই আমার মেয়েটার মল চুরি করলি বল!’ দূরে তুষারের মা দাঁড়িয়ে কাঁদছেন, ভিড় জমে গেছে। তুষারের মাথা নিচু, উসকো চুল, ঠোঁটের কোণা ফেটে রক্ত বেরচ্ছে। আমরা গিয়ে ছাড়ালাম। বলাইদা পুলিশ ডাকতে চাইছিল, মাতব্বরেরা মিলে বাধা দেয়। ওর মা দাদাকে সবাই জানে চেনে, পুলিশ এলে সম্মান বাড়বে না। এরপর যেমন গল্পে হয়, তুষার মুখ ঢেকে গুম হয়ে বসে থাকল, তারপর রাত্রিবেলা নিজের বইগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিল, অথবা নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মাথার কাছে খোলা বই রেখে ইঁদুর মারার বিষ খেল হয়তো বা… নাহ, তেমন অতিনাটকীয়তা আমাদের ম্যাড়ম্যাড়ে কলকাতায় মঞ্চস্থ হয় না। তুষারকে ছাড়িয়ে আনার পর মাঠে বসে মিচকি হেসে বলেছিল, ‘মালটা পকেটেই ছিল, মারধোর না করে সার্চ করলেই পেয়ে যেত। ফালতু এত কিছু, এখনই গিয়ে বিক্রি করে আসব, আর তো পাবে না!’ 

আর নাটকীয় নয় বলেই, আমাদের সময়ের এই রঙহীন গল্প শেষ হয় না। লুপ্ত হয় না স্মৃতিস্রোত, বাকভঙ্গিমা, লেখালেখি আমাদের। আমাদের বেজন্মা আড্ডা, কেরিয়ার, মার্কস, সফল প্রেম, জয়েন্টের র‍্যাংক এই সব কিছুকে পোষা টেরিয়ারের মতো কখনও পায়ে পায়ে আদর আর কখনও দুদ্দুর তাড়া করে বেঁচে থাকে ঢাকুরিয়া লেক, চায়ের দোকান, গলফগ্রিন কবরখানার মালি, নির্জন বাসরুট, আধবুড়ো অটো, বিজয়গড়ের মাথা নুইয়ে জ্ব্যালজেলে টিকে থাকা হোমিওপ্যাথির দোকান, বন্ধ আর্চ কম্পানির ঘোলাটে চোখ, হারিয়ে যাওয়া বুড়ো ও সন্ধ্যের পাগল। এদের নিয়ে যেহেতু তুষাররা কবিতা লিখে যায়, সেটাও অনিঃশেষ থাকে। সিকান্দারের হেরো সাইকেল টায়ার ফেঁসে অবহেলায় পড়ে থাকে আড্ডাখানার পাশে,  আমরা গড়িয়ে যাই নিজের মাফিক। কলকাতা হাই স্পিডে ছুটে চলে আমাদের নিয়ে। আমরা তারুণ্য থেকে মাঝবয়েসের  দিকে হাঁটি, এবং শুকিয়ে যায় মানুষের সাজানো বাগান। 

তুষাররা চাকরি খোঁজে না। চেহারা ভাঙে, কপালের সামনে থেকে অনেকটা চুল উঠে বুড়োটে লাগে। তিনটে চারটে পাঁচটা বই বেরয় তাদের, কেউ পড়ে না, রিভিউ হয় না কোথাও, জোর করে চেনা পরিচিতদের গছানোর পর সবাই দেখে পালায়– ওই আসছে রে বই কেনাতে! বাকি বই খাটের নীচে অন্ধকারে ডাঁই হয়ে থাকে, তবু আগের মতোই আনন্দিত তুষার ফ্যা ফ্যা ঘোরে, কবিতাসভাগুলোতে ডাক পেলে তার মুখ দীনা খুশিতে উজ্জ্বল হয়, ভদ্রেশ্বর থেকে ব্যারাকপুর– সবার সঙ্গে হইহই লোকাল ট্রেনে উঠে পড়ে, সম্মেলনের শেষে চলে যায় স্থানীয় মদের ঠেকে। কেউ মনে রাখে না ফিরল কিনা, খাবারের প্যাকেট পেল কিনা, তবু তুষার খুশি। চুরির দোষ কাটে না যদিও, বুড়ি মা বিলাপ করেন– ‘ছেলেটা বে থা কল্লনি, রোজগার কল্লনি, হতচ্ছেড়া থাকল সারাটা জীবন।’ কিন্তু তুষারের জীবনে কার্নিভালের রাত ফুরয় না। আমাদের লেখালেখির গল্পগুলো মরে যেতে যেতেও প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। আজকাল দেখা হলে দাঁত বার করে তুষার বলে, ‘কী রে সেফটিবালক, শুনলাম তোরও বই বেরচ্ছে? বিপন্নতাহীন নিশ্চিন্ত জীবনে কী চ্যাটের লেখা লিখবি? চল আজ তোর বাড়ি যাই!’   (চলবে)

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৮ অক্টোবর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Picsart

Author Sakyajit Bhattacharya

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Picture of শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
Picture of শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস