প্রথম পর্বের লিংক: ক্লোমা: প্রথম পর্ব
৭
সাল ২০৫০, ১৭ জানুয়ারি
ভোর তিনটে। এনআইএ-র হেডকোয়ার্টারের হেলিপ্যাড থেকে একটু দূরে ডঃ চক্রবর্তী, ডঃ সৈয়দ, সুদীপ ও এই সিক্রেট অপারেশনের ছ’জন যোদ্ধা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ঠান্ডা হাওয়া তুচ্ছ করে ওই ছ’জনের পরনে কমান্ডো পোশাক, মুখের অভিব্যক্তি কঠিন। ডঃ চক্রবর্তী এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে। দ্যুতিকে বললেন, “মা, দু’বছর বয়স থেকে তোমাকে দেখছি। তোমার প্রচুর গুণ আছে। প্রকৃতির এক অভিনব দান তুমি। কিন্তু সে সব কিছুর আগে তোমার আত্মসম্মানবোধ আমাকে বার বার মুগ্ধ করেছে। চরৈবেতি,মা।” বাকি পাঁচজনের দিকে ঘুরে আবেগঘন কণ্ঠে বললেন “তোমরা তো আমার ব্রেন চাইল্ড, আমার সন্তানরা কখনও হারতে শেখেনি।” তারপর দেখা গেলো ওরা ছ’জন ও দুই বর্ষীয়ান ডাক্তার একসঙ্গে গোল হয়ে নিজেদের কাঁধে হাত দিয়ে একটা বৃত্ত রচনা করেছেন। ওদের সবার চোখে জল। এরপর খুব দ্রুত দ্যুতি আর শৌর্য একটা হেলিকপ্টারে চাপল, বাকি চারজন অন্যটায়।
দ্যুতি আর শৌর্য যখন হিমাচল প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম মালানা থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে ঝারিতে ল্যান্ড করল তখন সূর্যোদয় হচ্ছে। তিন ডিগ্রি তাপমাত্রায় দ্যুতি আর শৌর্য হেলিকপ্টার থেকে নীচে নেমে এল। অনুভূতি নেই। তাই এত ঠান্ডাতেও দু’জনেই স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
অপরদিকে বাকি চারজন, অর্থাৎ নিলয়, শাক্য, অঙ্গদ ও সম্পূর্ণা দু’বার হেলিকপ্টার বদলে এসে পৌঁছল ভারতের সবচেয়ে জনবহুল শহর হায়দরাবাদে। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই নিলয় বাকি তিনজনকে বলল, “বন্ধুগণ, আকাঙ্ক্ষা নাকি হেব্বি সুন্দরী! আগে ওকে একটু মেপে নেব।” সম্পূর্ণা চোখ পাকিয়ে উত্তর দিল, “লয়, দিল্লী অনেক দূর।” ওর কথায় সবাই হেসে উঠল। আর ঠিক এরপর থেকেই অপারেশন “ভারত সুরক্ষা”র কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল। আগামী ছ’দিন ওদের পাখির চোখ হবে এই অপারেশনে জয়লাভ করা।
৮
সাল ২০৫০, ১৭ই জানুয়ারি
হেলিকপ্টার থেকে নামার পরের সতেরো কিলোমিটার দ্যুতি আর শৌর্য জিপে করে গিয়ে শেষপর্যন্ত মালানা গ্রামে পৌঁছল। গ্রামের একপাশ দিয়ে মালানা নদী কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে। মালানার বাসিন্দা মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে ওখানকার স্থানীয় কানাসি ভাষায় গান গাইতে গাইতে। সুরটা শুনলে এক অনাবিল আনন্দে মন কানায় কানায় ভরে ওঠে। প্রকৃতি এখানে বছরের পর বছর ধরে একই রকম সৌন্দর্য নিয়ে রয়ে গেছে। হিমাচল প্রদেশ সরকার গত কয়েক বছরে এখানে বেশকিছু ওষুধ কোম্পানিকে কারখানা তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছে। এরকমই একটি কারখানায় ডঃ অয়নান্ত রায় তার কিছু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে লুকিয়ে রয়েছে। তারা সঠিক সময়ের অপেক্ষায়। তারপরই শুরু করবে মারণ ভাইরাসের হত্যালীলা।
দ্যুতিকে বললেন, “মা, দু’বছর বয়স থেকে তোমাকে দেখছি। তোমার প্রচুর গুণ আছে। প্রকৃতির এক অভিনব দান তুমি। কিন্তু সে সব কিছুর আগে তোমার আত্মসম্মানবোধ আমাকে বার বার মুগ্ধ করেছে। চরৈবেতি,মা।” বাকি পাঁচজনের দিকে ঘুরে আবেগঘন কণ্ঠে বললেন “তোমরা তো আমার ব্রেন চাইল্ড, আমার সন্তানরা কখনও হারতে শেখেনি।”
দ্যুতি আর শৌর্যকে ওদের বাকি চারজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই অপারেশন নির্বাহ করতে হবে। এনইএ দ্যুতিদের জানিয়ে দিয়েছিল, ১৮ জানুয়ারির মধ্যে হায়দরাবাদে ওদের চারজনের টিম কাজ শেষ করবে। অতএব দ্যুতিদেরও ওই সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে। অয়নান্ত রায় হায়দরাবাদের খবর জেনে গেলে দ্যুতিদের পক্ষে অপারেশন “ভারত সুরক্ষা” সফল করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। দ্যুতিদের হাতে সময় খুব কম। মাত্র একদিন। তারমধ্যে এরকম পাহাড়ি কুয়াশাঘেরা আবহাওয়া ওদের কাজের পক্ষে বেশ সমস্যা তৈরি করছিল।
প্রথমেই দ্যুতি শৌর্যকে ওই কোম্পানির সাফাইকর্মী হিসাবে ভেতরে যেতে বলল। শৌর্য নিজের মুখ খুব ভাল করে মাফলার দিয়ে ঢেকে নিল। তারপর সময় বুঝে কারখানার মধ্যে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই ইচ্ছে করে গেটের কাছে একটা গন্ডগোল তৈরি করল সে। সিকিউরিটি গার্ডরা ওদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে দ্যুতি সেই ফাঁকে খুব সাবধানে সিসিটিভি এড়িয়ে কোনওরকমে কারখানায় ঢুকে পড়ল। কিন্তু ওরা দু’জনেই কোনও গ্যাজেট বা অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে পারল না। সেক্ষেত্রে ডিটেকটরের সাইরেন বেজে উঠত। এইভাবে খালি হাতে আসা আর মৃত্যুকে আহ্বান করা সমান জেনেও ভারতের দুই বেপরোয়া সিক্রেট এজেন্ট এগিয়ে চলল তাদের অপারেশন সফল করতে।
৯
সাল ২০৫০, ১৮ জানুয়ারি
নিলয়, শাক্য, অঙ্গদ ও সম্পূর্ণা এই মুহূর্তে হায়দরাবাদের প্রাণকেন্দ্র ইউনিক সিটির সামনে দাঁড়িয়ে। এটি রামকো ব্রাদার্স এর বানানো একটি অত্যাধুনিক ছোট শহর। মাত্র হাজার একরের ওপর তৈরি এই শহরে আমোদ প্রমোদের জন্য কী নেই? ক্যাসিনো, ডিস্কো, বিভিন্নরকম ড্রিংকস বার, বিলাসবহুল মোটেল, শপার্স পয়েন্ট, গেম কর্নার, বিশ্বের সমস্ত বড় বড় রেস্তোরাঁর প্রায় সব আউটলেট থেকে শুরু করে এলাহি আয়োজন। এখানে দিন-রাতের পার্থক্য বোঝা যায় না। আপাতত এই ইউনিক সিটি বিশ্বের দু’নম্বর লাক্সারি সিটির তকমা পেয়েছে। এখানে সিকিউরিটি যেমন টাইট তেমনিই প্রত্যেকটি বিল্ডিং একরকম দেখতে। তাই ওদের চারজন প্রথমেই ঠিক করল সিটিতে গিয়ে আগে ওটার একটা ম্যাপ বানিয়ে নেবে, তারপর আসল অপারেশন শুরু করবে।
ইউনিক সিটিতে এনইএ-র অন্য সিক্রেট এজেন্ট আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রয়োজনীয় ফরম্যালিটি শেষ করে ওদের সিটির মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে দিয়ে সে বিদায় নিল। বাকি কাজ এবার ওরাই করবে। সিটির মধ্যে একটা বিল্ডিং থেকে অন্যটায় যাওয়ার জন্য ‘ওয়্যার ওয়ে’র ব্যবস্থা আছে। এটা অনেকটা রোপওয়ের মতো। প্রতিটা ঘরের ব্যালকনি থেকে তারের মাধ্যমে অন্য বিল্ডিয়ের যোগাযোগ আছে, এটা দেখে অঙ্গদ মাথা নাড়তে নাড়তে ভাঙা বাংলায় বলে উঠল, “আচ্ছা, ইটা আমাদের উড়ন খাটোলার মতো আছে।” শাক্য আবার বরাবরই গম্ভীর। সে উত্তর দিল “আমাদের যেটা আছে সেটা হলো “ইনসার্ট অ্যান্ড রান।” অঙ্গদ বললো “ইকই হল, ভাইয়া।”
আরও পড়ুন: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের কলমে: একানড়ে পর্ব ১০
এরপর ওরা দুটো ঘর দু’দিনের জন্য ভাড়া নিল। তবে সতর্কতার জন্য একই বিল্ডিংয়ে নিল না। সম্পূর্ণা একটা ঘর, আর বাকি তিনজন আর একটায়। শাক্য প্রথমেই নিজেদের ঘরে ঢুকে বাথরুমে গিয়ে মাল্টিপল ডিভাইসে নিজের মাথার একটি চুল ছিঁড়ে ওর মধ্যে নির্দিষ্ট ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে দিল। যন্ত্রটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তীব্র সবুজ আলো বিকিরণ করতে শুরু করল, সেন্সর সিসিটিভির ফ্রিকোয়েন্সি ডিটেক্ট করছে। তার মানে ওদের ঘরে লুকনো ক্যামেরা লাগানো আছে এখানেই কোথাও। শাক্য বুঝতে পারল, এই সিটির সব ঘরেই নজরদারী করার জন্য লুকনো ক্যামেরা লাগানো আছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ও ইশারায় বাকিদের জানিয়ে দিল। ওরা বুঝতে পারল, এখানে প্রতি পদক্ষেপ ওদের বুঝে ফেলতে হবে।
ওইদিন বিকেলে সম্পূর্ণা ইউনিক সিটির সবচেয়ে বিলাসবহুল ক্যাসিনোতে প্রবেশ করল। সম্পূর্ণার গায়ের রং গমের মতো। চোখ মুখ, শরীরের অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন কেউ পাথর কেটে বানিয়েছে। ওর কালো একঢাল লম্বা চুল চেহারায় এক অদ্ভুত মাদকতার সৃষ্টি করেছে। ওর শরীরের নিখুঁত স্ট্যাটিসটিক্স যে কোনও বয়সের পুরুষের মনে ঢেউ তুলে দিতে পারে। ক্যাসিনোর অনেকেরই লোলুপ দৃষ্টি তখন সম্পূর্ণার শরীরে ইতিউতি ঘুরছে। তবে ওর এসব এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। ও খুঁজছে একজন বিশেষ নারীকে, মিস্ আকাঙ্ক্ষাকে। একটু পরেই অপরূপ সুন্দরী আকাঙ্ক্ষা ক্যাসিনোয় এসে পৌঁছল। ক্যাসিনোর সব উজ্জ্বল আলো মুহূর্তের মধ্যে যেন আকাঙ্ক্ষার রূপের সামনে ম্লান হয়ে গেল। একঝলক দেখলে মনে হয় যেন, এ সৌন্দর্য বুঝি পার্থিব নয়। চোখ ঝলসে দেওয়া রূপ নিয়ে মিস্ আকাঙ্ক্ষা ক্যাসিনোর এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘুরতে লাগল।
১০
সাল ২০৫০, ১৮ জানুয়ারি
কাল সারারাত দ্যুতি আর শৌর্য কারখানার মধ্যে একটা টয়লেটে লুকিয়ে ছিল। এখানে চারিদিকে সিসিটিভির নজরদারি। ওদের এরমধ্যেই ডঃ অয়নান্ত রায়কে খুঁজে বের করতে হবে। কারখানার বেসমেন্টে একটা গোপন ফ্লোর আছে। দ্যুতিদের ওখানেই পৌঁছতে হবে। পরেরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ওরা সেই গোপন ফ্লোরের দিকে নেমে গেল। তারপর দু’জনে দু’দিকে চলে গেল।
ফ্লোরের একদম শেষ প্রান্তে জমাটবাঁধা অন্ধকারের মধ্যে দ্যুতি দেখতে পেল, একটা বন্ধ দরজার সামনে বন্দুক হাতে একজন বসে। ও বুঝতে পারল শয়তানটা তবে এই ঘরেই লুকিয়ে। বিড়াল পায়ে এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে। ঠিক তখনই দরজা খুলে ডঃ অয়নান্ত রায় বেরিয়ে এলেন। হাতে উদ্যত পিস্তল। মুখ বেঁকিয়ে উত্তেজিতভাবে চেঁচিয়ে বলছেন, “আয়, ডঃ চক্রবর্তীর সাঙ্গোপাঙ্গ, অ্যাঁ! নিজের ক্ষমতা নেই। তাই তোদের পাঠিয়েছে। শেষ করে দেব আমি, সামান্য কিছু ভাইরাস, আর তোদের সাধের দেশ বুঝবে বায়োটেরোরিজ়ম কাকে বলে।”
ওইদিন বিকেলে সম্পূর্ণা ইউনিক সিটির সবচেয়ে বিলাসবহুল ক্যাসিনোতে প্রবেশ করল। সম্পূর্ণার গায়ের রং গমের মতো। চোখ মুখ, শরীরের অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন কেউ পাথর কেটে বানিয়েছে। ওর কালো একঢাল লম্বা চুল চেহারায় এক অদ্ভুত মাদকতার সৃষ্টি করেছে। ওর শরীরের নিখুঁত স্ট্যাটিসটিক্স যে কোনও বয়সের পুরুষের মনে ঢেউ তুলে দিতে পারে।
রাগে দ্যুতি ফেটে পড়তে চাইল। কিন্তু কাজে তা করল না। অসম্ভব ক্ষিপ্রগতিতে বাঘিনীর মতো তিনটে ভল্ট দিয়ে প্রথমে সিকিউরিটিকে ধরাশায়ী করল। এরমধ্যেই ডঃ অয়নান্তের বন্দুকের গুলি এসে লেগেছে দ্যুতির কাঁধে, সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে দ্যুতি ঝাঁপিয়ে পড়ল ডঃ অয়নান্তের ওপর। নিজের পকেটের ভেতর থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে শয়তানটার মুখে গুঁজে দিল। পরবর্তী তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে ডঃ অয়নান্ত সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। ওদিকে ওপরের ফ্লোরের ক্রমবর্ধমান বুটের শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, কারখানার সমস্ত সিকিউরিটি গার্ড ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। সময় খুব অল্প। দ্যুতি একটু দূরে তাকাতেই দেখল শৌর্য ওর দিকে দৌড়ে আসছে। আর ঠিক তখনই পাহাড়ের গভীর নৈঃশব্দ চিরে ওদের কানে এল অনেকগুলো পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ।
কাঁধ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণের জন্য দ্যুতি সংজ্ঞা হারাতে লাগল। ওর চোখে চকিতেই প্রিয়জনদের ছবি একে একে ভেসে আসতে লাগল। বাবা, মা, ওর ছোট ভাই, ডঃ চক্রবর্তীর ছবি। আরও একজনের আবছা ছবি দ্যুতির চোখে ভেসে উঠল। সে হলো শুভায়ন। দ্যুতি মুচকি হাসল, তারপর পুরোপুরি জ্ঞান হারাল।
১১
সাল ২০৫০, ১৮ই জানুয়ারি
নিলয়, শাক্য আর অঙ্গদকে প্ল্যান বলাই ছিল। শাক্য আর অঙ্গদ ক্যাসিনোর পরের বিল্ডিংয়ে টপ ফ্লোরের একটা গেম কর্নারে অপেক্ষা করছিল। নিলয় এবার সেই ক্যাসিনোয় ঢুকল, তারপর সম্পূর্ণাকে একটু দূরে দাঁড়াতে বলে মিস আকাঙ্ক্ষার সামনে গিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে মুচকি হেসে বললো, “অয়নান্ত রায়।” মুহূর্তেই আকাঙ্ক্ষার মুখের বিগলিত হাসি মিলিয়ে গেল। সরু চোখের ইশারায় ওকে সঙ্গে আসতে বলল। নিলয় আর সম্পূর্ণা নিঃশব্দে আকাঙ্ক্ষাকে অনুসরণ করল। একটু হেঁটে ক্যাসিনোর পেছনে একটা দশ বাই দশের ঘরে এসে পৌঁছল ওরা। ঘরটা দারুণ সাজানো। দেওয়াল জুড়ে প্রচুর কাচ লাগানো। তাতে জোরালো আলো পড়লে যে কারও চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বাধ্য। ঘরে সেইজন্যই বোধহয় খুব হালকা আলো জ্বলছে।
মিস আকাঙ্ক্ষা ওদের বললেন “অয়ন তো দু’জন ছেলে পাঠাবে বলেছিল। তোমরা তো…” ওঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিলয় ওর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে চোখ মটকে বলল “কেন মিস্? আমাদের পছন্দ হচ্ছে না,আপনার?” তারপরই আকাঙ্ক্ষা কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে দ্রুত ওর হাতে থাকা একটা গ্যাজেটের বোতাম টিপতে গেল। ঠিক তখনই সম্পূর্ণা বিদ্যুৎগতিতে লাফ দিয়ে আকাঙ্ক্ষার হাত থেকে টান মেরে গ্যাজেটটা ফেলে দিল। আর তখনই নিলয় বলল, “আরে ওয়াহ! ক্যাট ফাইট যে!”
আরও পড়ুন: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের কলমে: একানড়ে পর্ব ১২
পরের চার সেকেন্ডের মধ্যে সম্পূর্ণা সুনিপুণ দক্ষতায় আকাঙ্ক্ষাকে পুরো মাটিতে শুইয়ে ফেলল। শেষে নিলয় এগিয়ে এসে আকাঙ্ক্ষার হাতে পরে থাকা ব্রেসলেটটা এক টানে খুলে নিল। কিন্তু সম্পূর্ণা সেদিকে তাকাতেই চোখের পলকে আকাঙ্ক্ষা ঘরের সব উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে দিল। ঘরের দেওয়ালে অজস্র আয়না। চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওদের। আর পুরো ঘর জুড়ে শুধু আকাঙক্ষার প্রতিবিম্ব। চারিদিকে। তারমধ্যে ওরা আসল আকাঙ্ক্ষাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। ওদিকে সময়ও কমে আসছে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই ওরা দৌড়ে ক্যাসিনোর মেন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। দৌড়তে দৌড়তে নিলয়ের কানে এল আকাঙ্ক্ষা চিৎকার করে ইংরেজিতে বলছে, “ক্যাচ দেম নাউ।”
সম্পূর্ণা ক্যাসিনোর লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে ইনসার্ট অ্যান্ড রান যন্ত্রটা বের করল। ক্যাসিনোর দেওয়ালে ওর বন্দুক দিয়ে ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে হুকের মতো একটা বস্তু দেওয়ালে গেঁথে গেল। ওই বন্দুকটা দিয়ে পরের বিল্ডিংয়ের দেওয়ালেও ফায়ার করল সে। দুটো বিল্ডিংয়ের মধ্যে সুতোর মতো একটা তার আটকে গেল। ততক্ষণে ক্যাসিনোর সিকিউরিটি অ্যালার্ম বেজে উঠেছে। প্রচুর সিকিউরিটি রোবট এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। এরমধ্যে একটা রোবটের গুলি এসে লাগল নিলয়ের হাতে। নিলয় ক্রমাগত হিটার গান ফায়ার করে রোবটের বডিগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছে। এবার সম্পূর্ণা নিলয়কে ডাকতেই ওরা ওদের কোমরের অ্যাংকর দিয়ে ওই তার বেয়ে ঝুলে পড়ল। তারপর জ়িপলাইনের মতো ঝুলে নিমেষে পৌঁছে গেল অন্য বিল্ডিংয়ে। সেখানে ইতিমধ্যেই শাক্য আর অঙ্গদ এসে পৌঁছেছে। ওদের চারজনকে তখন ঘিরে ধরেছে প্রায় পঞ্চাশটা রোবট। আর ঠিক তখনই আকাশের বুক চিরে একটা হেলিকপ্টার দ্রুতবেগে ওদের দিকে এগিয়ে এল।
১২
সাল ২০৫০, ১৮ জানুয়ারি
হেলিকপ্টারে উঠেই অঙ্গদ নিলয়ের হাতের গুলি লাগা জায়গাটার চিকিৎসায় মন দিল। নিলয় তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অঙ্গদকে আশ্বস্ত করে বলল, “মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা!” সম্পূর্ণা ওদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই শাক্য বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে নিজের মধ্যমায় পরা আংটিটার দিকে তাকিয়ে বলল “টাইমলি, সিগন্যাল কমিউনিকেটর মারফত হেল্প চেয়েছিলাম। ওরাই হেলিকপ্টার পাঠাল।” সম্পূর্ণা আক্ষেপের সুরে বলল “ইশ… মিস আকাঙ্ক্ষা নাকের নীচ দিয়ে পালিয়ে গেল।”
নিলয় তখনই গুলি লাগা হাত নিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠল “সুন্দরীদের মারতে কষ্ট লাগে না? সখি তোমার মন নাই?” সম্পূর্ণার হঠাৎ কী মনে পড়তে নিলয়কে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো “চুড়িটা কই?” নিলয় হাত নেড়ে গেয়ে উঠলো “চুড়ি নেহি ইয়ে মেরা দিল হ্যায়” এবং সবাই দেখল নিলয় নিজের হাতে মিস্ আকাঙ্ক্ষার ব্রেসলেটটা পরে রয়েছে। ততক্ষণে ওদের চারজনের চোখমুখের উচ্ছ্বল আনন্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে ওরা সফল।
১২
সাল ২০৫০, ২০ জানুয়ারি
দ্যুতি হিমাচল প্রদেশের এক হসপিটালের বেডে শুয়ে রয়েছে। ওর অবস্থা স্থিতিশীল। ডাক্তার বলেছেন কিছুদিনের মধ্যেই ওকে ছেড়ে দেবেন। যদিও ও নিজে শরীরে কোনও ব্যথাবেদনা অনুভব করছে না।
ডঃ চক্রবর্তী নিজে এসেছিলেন দ্যুতির সঙ্গে দেখা করতে। উনিই বললেন, মিস আকাঙ্ক্ষার হাতের ব্রেসলেটের মধ্যে একটা কনটেনারে লুকনো ছিলো ওই মারণ ভাইরাস। ওরা হায়দরাবাদের মতো বিপুল জনবহুল শহর বেছে নিয়েছিল, কারণ ওদের লক্ষ্য ছিল সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষকে আক্রান্ত করা। আর ডঃ অয়নান্তর পাশের ঘরে তিনটে লোককে আটকে রেখে জোর করে কনটেনার সমেত ওই ভাইরাস ওদের গিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
পরিকল্পনা ছিল সময় সুযোগ বুঝে ওদের পেট থেকে ওই কনটেইনার-ভর্তি ভাইরাস বার করবে। কিন্তু ওই তিনজন শৌর্যকে সব কথা বলার পর এনইএ ওদের পেট থেকে কনটেনারগুলো উদ্ধার করে। কিন্তু এরমধ্যে একজনের পেটে কনটেইনার কোনওভাবে লিক হয়ে যাওয়ায় শরীরে ভাইরাসের বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ফলে তাকে আর বাঁচানো যায়নি। ডঃ অয়নান্ত ঘটনাস্থলেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
আরও পড়ুন: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের কলমে: একানড়ে পর্ব ১৫
দ্যুতি ডঃ চক্রবর্তীকে হতাশ স্বরে বলে, “কেন বলুন তো এমন করে মানুষ? কেন এত ঘৃণা, লোভ?” ডঃ চক্রবর্তী নিজের চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে নার্সিংহোমের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে উদাস গলায় বলে ওঠেন, “মা,আজ পর্যন্ত ভালবাসা দিয়ে কোনও যুদ্ধ জয় করা যায়নি। ঘৃণা খুব তাড়াতাড়ি সংক্রামিত হয়,ভালবাসায় সংক্রমণের হার খুব কম।” তারপর ওরা দু’জনেই চুপ করে বসে থাকে, সময় কেটে যায় নিজস্ব ছন্দে। দ্যুতি বুঝতে পারে জীবনকে কখনও একটা ডায়মেনশনে মাপা যায় না।
দ্যুতি এখন টেলিভিশনের সামনে বসে রয়েছে। সামনে খোলা একটা নিউজ় চ্যানেল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১০৩তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন। দ্যুতি ওর আইসিইউ-এর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনের কাচের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল, দেখল একঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। সূর্যের নরম আলো ওদের ছুঁয়ে দিচ্ছে, অপূর্ব লাগছে দেখতে। ঠিক যেমনটা ও সেদিন লখনউ শহরে সন্ধ্যার আকাশে দেখেছিল। তবে আজ ও জানে, ও একা নয়, গোটা দেশ ওই পাখিগুলোর মতোই স্বাধীন আর নিরাপদ।
পৃথিবীর একমাত্র “বায়োনিক চাইল্ড” (Bionic child) ইংল্যান্ডের অলিভিয়া ফ্রান্সওয়র্থ-এর জীবনের বিস্ময়কর ক্রোমোজ়োমের বিরল পরিবর্তনের ঘটনা নিয়ে গল্পটি লেখা হয়েছে।
আনন্দবাজার পত্রিকা ১৮ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখের সংস্করণে এই বিরল ঘটনা ছাপা হয়েছিল।
অনুভা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি চাকরি করেন। লেখালেখি প্যাশন। সানন্দা ব্লগ, শুকতারা, এখন ডুয়ার্স, অপার বাংলা, প্রসাদ-সহ প্রচুর পত্রপত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজ়িন, ওয়েবজিন ও সংবাদপত্রে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেয়েছেন ছোটদের জন্য লিখে। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২০-তে, অমিয়া ভৌমিক স্বর্ণকলম পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১-এর বিচারক ও সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য।
3 Responses
কয়েকটা জায়গার পরিপূর্ণ নিপুণতা এই গল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে লেখার ক্ষেত্রে আর একটু সময় দিলে আরও ভালো হতে পারত বলেই আমার বিশ্বাস।
ভালোই লাগল। চরৈবতি।
Khub bhalo laglo. Ekta ghatana koto bhabe dana mele ei golpo tar proman.