(Short Story Bagh)
ওরা বলত, জঙ্গলের সবুজ বিবরে যদি কোনওদিন দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে তোমার দেখা হয়ে যায়, চোখে চোখ রেখ না। চোখে চোখ রেখ না। চোখ নামিয়ে নিও। নইলে… দখিন রায় তোমার আত্মা দেখে ফেলবেন। তুমি আর এক পাও নড়তে পারবে না। স্থবির হয়ে টের পাবে, তোমাকে গিলে খাচ্ছেন দক্ষিণ রায়।
সংসারে মন ছিল না অনু বৌদির। সকাল সকাল কোনও মতে হেঁশেল ঠেলেই বেরিয়ে পড়ত পাড়ায়। এর ঘরের খবর আঁচলে বেঁধে এনে ফেলত ওর ঘরে। যেকোনও মৃত্যুসংবাদ তার কাছে এসে পৌঁছত সকলের আগে। মারণব্যধির হদিস রোগীর আগে জেনে যেত অনু বৌদি, তারপর রোগীর শয্যাপ্রান্তে বসে বলত, “তোমার তো ক্যান্সার হয়েছে… তুমি জানো না?” বিবাহবিচ্ছেদ এর বার্তা দম্পতির পেটের ভিতর থেকে বের করে আনত সে। খবরের কাক হয়ে অনু বৌদি পাড়ার আকাশ টহল দিত সারাদিন। আর তার উঠোনে নাওয়া, খাওয়া, পরা, পড়া ভুলে খেলে বেরাত তার দুই শিশুসন্তান। (Short Story Bagh)

বুবাই, টুবাই বেশিরভাগ সময় নিজেদের মধ্যে মারপিট করে কাটাত। খেলার সরঞ্জাম বিশেষ ছিল না তাদের, খেলার ধান্ধাও তাদের মাথায় বিশেষ পাকেনি। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও তাদের তেমন হত না। দিবারাত্র কেবল এ ওর চুল টেনে দিচ্ছে, ও তার জামা ছিঁড়ে দিল, কে বা কার মাথা ঠুকে দিল দেওয়ালে, এই সব! তবু তারা নিজেদের নামে নালিশ জানাত না। খেলাশেষে নিজেদের ক্ষতয় নিজেরাই মলম লাগাত। অন্যদের উত্যক্ত না করায় তাদের প্রতি পাড়ার মানুষদের প্রচ্ছন্ন মায়া ছিল, “আহা, মা-টা খেয়ালই রাখে না…”। তবু কী উপায়ে প্রতিবছর তারা টেনেটুনে পাশ করে যেত পরীক্ষায়। অনু বৌদি বা দেবাশিসদাকে তারা দুশ্চিন্তার সুযোগ দেয়নি। শুধু একবার বেপাড়ার ছেলেদের হাতে মার খেয়ে চোখ মুখ ফুলিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। জানা যায়নি ঝামেলাটা কী নিয়ে হয়েছিল, তবে শোনা গেছিল, টুবাইয়ের মাথাটা তারা নর্দমার জলে ঠুসে ধরেছিল আর বুবাইকে দিয়েছিল গালি– “খানকির ছেলে!” বাড়ি ফিরে তারা দেবাশিসদার হাতে ফের মার খেয়েছিল,- নব্বইয়ের দশকের বাৎসল্য অনুসারে। তার ক’দিন পর, ছাদের উপর বসে পাশের নির্মীয়মান বাদল জ্যেঠুদের বাড়ির দোতলার গায়ে, নরম সিমেন্টের উপর খোদাই করে তারা লিখেছিল, “খানকির ছেলে বুবাই টুবাই”। লেখাটা ২০১৮ সাল অবধি বাদল জ্যেঠুদের বাড়ির গায়ে দেখা যেত। তারপর বাদল জ্যেঠুর ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি রঙ করা হলে সব অতীত টতীত ধুয়ে মুছে যায়। (Short Story Bagh)
মোড়ের মাথায় দেবাশিসদার একরত্তি মুদির দোকান সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা অবধি পাড়ার নানা চাহিদা মেটাত। ধারবাকিতে অনেকের সংসার টেনেছে দেবাশিস দার দোকান।
মোড়ের মাথায় দেবাশিসদার একরত্তি মুদির দোকান সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা অবধি পাড়ার নানা চাহিদা মেটাত। ধারবাকিতে অনেকের সংসার টেনেছে দেবাশিস দার দোকান। সকাল বিকেল অনেকের আড্ডা ওই দোকানে। মুনাই ওর বাবার কোলে চেপে দোকানে এসে পৌঁছলে দেবাশিস দা ছোঁ মেরে মুনাইকে নিজের কাছে এনে বসাত আর ধরিয়ে দিত খুচরোর বাটি। মুনাই খুচরো পয়সা নিয়ে খেলত আর ফোকলা দাঁত মেলে খিলখিল হাসত। দেবাশিস দা মুনাইকে টিকলি বলে ডাকত, আর মুনাইয়ের মাকে বলত, “ডাঁসা পেয়ারা।” দুপুরের দিকে দোকান ফাঁকা হয়ে এলে শাটার অল্প নামিয়ে দেবাশিস দা পায়ে পায়ে গিয়ে পড়ত রাস্তার উল্টোদিকে মুনাইদের বাড়িতে। মুনাই তখন ভাত খেয়ে ঘুমোচ্ছে আর মুনাইয়ের মা নাইটি গায়ে কপালে তুলছে রগরগে লাল টিপ, গলায়, বুকে, তলপেটে ডলে দিচ্ছে দেবাশিসদার দোকান থেকে দেবাশিসদার সুপারিশে কেনা পাঁচ টাকা দামের সুগন্ধী আতর। কিছু পরে মুনাইয়ের মায়ের যে লাল আলতা লাগানো পা উঠবে আকাশে, সে আলতাও দেবাশিস দার দোকান থেকেই এসেছে। (Short Story Bagh)
সন্ধ্যার দিকে মুনাই যখন ধীরে ধীরে চোখ মেলে, দেবাশিস দা তখন দোকানে ফিরে শাটার তুলছে। আলতা মাখা চাঁদ তার পিছু পিছু আকাশে উঠে এসেছে।
সন্ধ্যার দিকে মুনাই যখন ধীরে ধীরে চোখ মেলে, দেবাশিস দা তখন দোকানে ফিরে শাটার তুলছে। আলতা মাখা চাঁদ তার পিছু পিছু আকাশে উঠে এসেছে। কেউ টের পায় না, অতর্কিতে, লাল সেই অন্ধকারে এসে দাঁড়িয়েছে অনু বৌদিও। তার রোদে পোড়া গা কারও নজরগোচর হয় না, তার গায়ের বুনো গন্ধ পায় কেবল কাকপক্ষীতে, তার দুটোচোখ ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে সন্ধ্যার লাল আঁধারে। (Short Story Bagh)
ওরা বনে মধু আর মোম আনতে যেত যখন, মুখোশ পরত, মাথার পিছন দিকে। যাতে দক্ষিণ রায় বিভ্রান্ত হন। পিঠপিছে কামড় বসাতে না পারেন। ওরা জানে, দখিন রায় আড়াল ভালোবাসেন। নিভৃতে তিনি শান দেন নিজের নখে আর দাঁতে। একদিন বেখেয়াল হলেই, একদিন বেসামাল হলেই, তিনি ছিনিয়ে নেবেন সবকিছু।
একদিন।

(Short Story Bagh) পাড়ার সবাই মুনাইয়ের মাকে এড়িয়ে যায়, “মহিলার চোখ ভাল না” সকলে জানে। দুয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেবাশিসদার দিকে হিংস্র হায়নার চোখে চেয়ে থাকে সে সকাল থেকে। অপেক্ষায় থাকে কখন দুপুর হবে আর সে সাবার করবে দেবাশিসদাকে। দুপুর হয়। দেবাশিসদা দোকানের শাটার অল্প নামিয়ে রেখে নিয়মিত সাবার হতে আনবাড়ি যায়। অনু বৌদি সকাল থেকে আকাশে পাখসাট দেয়, দুপুর হলেই নেমে আসে মাটিতে, মুনাইদের বাড়ি থেকে একটু দূরে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। তার দৃষ্টি মুনাইদের দুয়ারে। সে দৃষ্টিতে কোনও প্রাণ নেই, আত্মা নেই, যেন কেউ ভর করেছে অনু বৌদিকে। অন্যের চোখ মেলে অনু বৌদি দেবাশিসদাকে মুনাইদের ঘরে ঢুকে যেতে দেখে রোজ, অনু বৌদির চোখে নিজস্ব দৃষ্টি থাকে না, উত্তাপহীন চোখে সে রোজ দুপুরে দেবাশিসদাকে মুনাইদের ঘরে ঢুকে যেতে দেখে, চুপচাপ। কিছু বলে না, কিছু করে না। কেবল চুপ করে চেয়ে থাকে। অপেক্ষা করে। ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে একদিন দেবাশিসদার চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার অপেক্ষা করে সে। সন্ধ্যায় দেবাশিসদা দোকানে ফিরে এলেও সে ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকে সরে যায় না। প্রথম দিকে মুনাইয়ের মায়ের কাছে যাওয়ার সময় দেবাশিসদা এড়িয়ে যেত অনু বৌদিকে, এখন উপেক্ষা করে। না করেই বা উপায় কী? চোখে চোখ পড়ে গেলেই তো দেবাশিসদা পাথর আর অনু বৌদি ক্ষণে ক্ষণে গিলে চুষে খাবে তার হাড়, নলি, যাবতীয় রক্তমাংস। (Short Story Bagh)
পাড়ার কেউ কেউ দেবাশিসদাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কেউ কেউ অনু বৌদিকে রাস্তা থেকে বাড়িতে ডেকে এনে চা খাওয়ায়। বলার চেষ্টা করে “সকলই কুশল হবে”, কিন্তু বলে উঠতে পারে না।
পাড়ার কেউ কেউ দেবাশিসদাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কেউ কেউ অনু বৌদিকে রাস্তা থেকে বাড়িতে ডেকে এনে চা খাওয়ায়। বলার চেষ্টা করে “সকলই কুশল হবে”, কিন্তু বলে উঠতে পারে না। শুধু ফ্যানের ঠান্ডা বাতাসে অনু বৌদির ঘাম শুকিয়ে গেলে সে আবার উঠে দাঁড়ায়, চলে আসে ল্যাম্পপোস্টের নিচে। সেখানে আজকাল অজান্তেই বুনো গন্ধ ছেয়ে থাকে, যেমন ছাতিমতলায় ছাতিমের, যেমন হাসনুহেনা সুবাস ছড়ায় হাসনুহেনা গাছের নিচে, ল্যাম্পপোস্ট ঘিরে এখন তেমনই অনু বৌদির বুনো গন্ধ বাসা বেঁধেছে। দেবাশিসদা দিনকেদিন রোগা হয়ে আসছিল। মুনাইয়ের মাকে দোষ দিত সকলে, মনে মনে। মুখে কিছু বলার সাহস বা রুচি কারও ছিল না। কারণ পাড়াটা ছিল ভদ্দরলোকদের। এই সময় থেকে বুবাই-টুবাই রাতে বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিয়েছিল। তারা কোথায় রাত কাটাত তখন, আজ অবধি কেউ জানে না। সকালের দিকে তারা ফিরে আসত যখন সবাই দেখত তাদের সারা গায়ে লেগে আছে গত রাতের ছাই। দুই ভাই আপাদমস্তক ছাই মেখে বাড়ি ফিরত সকালবেলা। (Short Story Bagh)

ওরা বলত, জঙ্গলে দক্ষিণ রায়ের গায়ের গন্ধ সবার আগে পায় পাখিরা, বানরেরা, বুনো শুয়োর আর সুন্দরীগাছ। সেই গন্ধে তারা ডেকে ওঠে, সাবধান করে স্বজাতীকে। মানুষ পশুপাখির এই ভাষা চুরি করেছে। মোউলেরা মধু আনার সময়, বিপদের আঁচ পেয়ে কাছেপিঠের বাকি মৌলেদের ডাক দেয় “কু” বলে। মানুষ পশুপাখির ভাষা নকল করে, মনে করে, এভাবে বুঝি পার পাবে। ভাবে, এভাবে বুঝি পার পাওয়া যায়।
দেবাশিসদা যখন পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী, তখন আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমাদের বেডরুমের জানালা দিয়ে দেখা যেত অনু বৌদিদের ঘর। দেখতাম, অনু বৌদি হাতে থালা নিয়ে চটকে চটকে মাখছে ডাল, ভাত আর ডিমের তরকারি।
দেবাশিসদা যখন পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী, তখন আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমাদের বেডরুমের জানালা দিয়ে দেখা যেত অনু বৌদিদের ঘর। দেখতাম, অনু বৌদি হাতে থালা নিয়ে চটকে চটকে মাখছে ডাল, ভাত আর ডিমের তরকারি। দেবাশিসদার মুখ হাঁ হয়ে উঠছে, সেই হাঁ গলে ভাত ঢুকে যাচ্ছে দেবাশিসদার মুখের ভিতর যন্ত্রের মতো। চুপ করে ছোট ছেলের মতো দেবাশিসদা ভাত খাচ্ছে। অনু বৌদি আমাদের দেখে সবলা হত, “খাও, খাও খেয়ে নাও বলছি।” জানালা থেকে সরে আসতাম আমরা দুজন। জোনাকী বলতো, “দেখেছো, কী প্রেম!”
আমি কিছু বলতাম না। (Short Story Bagh)

একদিন চোখে পড়ল মুনাইয়ের মা বাজার করছে। দরদাম করে সবজি কিনছে। বচসা করছে সবজি বিক্রেতার সহিত। তার সব চুল সাদা। তার বুক ঝুলে গেছে। তবু সে আমায় লক্ষ্য করে বহুযুগ আগের হিংস্র হায়নার দৃষ্টি মেলে অনাবিল হেসে উঠল। রোমহর্ষ হল আমার আপাদমস্তক। বাজারের ব্যাগ নিয়ে তড়িঘড়ি ঘরে ফিরলাম। জানালার কাছে গিয়ে দেবাশিসদার ভাত খাওয়ার দৃশ্য দেখে যেন স্বস্তি হল। দৃশ্যটা এতদিনে চিরন্তন হয়ে উঠেছে। অনু বৌদির চোখও এখন প্রাণময়, সবুজ শ্যামল নালার মতো সেখান দিয়ে মৃদু দৃষ্টি যায় বয়ে। (Short Story Bagh)
সেদিন রাতে জোনাকীকে মুনাইয়ের মা আর দেবাশিসদার সম্পর্কের কথা না চাইতেও বলে ফেললাম। জোনাকী টুবাইকে চিনত, একই টিউশনে বাংলা পড়তে যাওয়ার দরুন। সে আমায় টুবাইদের কথা জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, “আমরা জানি না। ওরা দুজনেই বোধহয় আরবে এখন।”
এর কিছুদিন পর থেকে ঘরের ভিতর কেমন বুনো একটা গন্ধ পাওয়া গেল। অনেক খুঁজেও সেই গন্ধের উৎস শনাক্ত করতে পারলাম না।
এর কিছুদিন পর থেকে ঘরের ভিতর কেমন বুনো একটা গন্ধ পাওয়া গেল। অনেক খুঁজেও সেই গন্ধের উৎস শনাক্ত করতে পারলাম না। একদিন অফিস থেকে ফিরে জোনাকীর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, শুষ্ক, শূন্য দৃষ্টিতে সে আমার দিকে চেয়ে আছে। ইচ্ছে হল, চোখ নামিয়ে নিই। ইচ্ছে হল, পালিয়ে যাই অন্য কোনওখানে। ইচ্ছে হল, জোনাকীর দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলি, “আমি কোথাও যাচ্ছি না, তুমি ফিরে এসো!”
যে এখন জোনাকীকে ভর করেছে, সে আমার গায়ে মুনাইয়ের মায়েদের গন্ধ পেয়ে গেছে অনেক আগে। আমিই টের পাইনি। আমি চোখে চোখ রেখে ফেলেছি। (Short Story Bagh)
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
অলোকপর্ণার জন্ম ১৯৯০ সালে, কলকাতায়। উত্তর ২৪ পরগণার নববারাকপুরে স্কুলজীবন ও বেড়ে ওঠা। কলকাতা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে কখনো ব্যাঙ্গালোর কখনো কলকাতায় বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। লেখালেখির সূত্রপাত কৈশোরে হলেও, ২০১০ থেকে তা শখ নয়,- আসক্তিতে পরিণত হয়েছে।
এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত বই- ঝিঁঝিরা (২০১৫), হাওয়াশহরের উপকথা (২০১৮), দাস্তানগো (২০১৯), রণ বিশ্বাস কারো নাম নয় (২০১৯), যাহা বলিব সত্য বলিব (২০২২), সবুজ অন্ধ করেছে (২০২৩)।