(Short Story)
বাগানের কাঠের চেয়ারে বসে খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে বাবা বললেন— “বসন্ত এসে গেছে।”
বাবা মাঝে মাঝে এমন করে কথা বলেন। কখনও কবিতার এক লাইন। কখনও গানের কথা, উপনিষদের শ্লোক। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরিজি, উর্দু শায়ের, সময় বুঝে যখন যেমন তাঁর মনে আসে। আমরা ভাইবোনেরা, নাম দিয়েছি “কোটেশন মাস্টার”। বাবা হেসে বলেন— কলেজে মাস্টারি করতে করতে এসব হয়েছে! (Short Story)
আরও পড়ুন: লক্ষ্মীবারে পক্ষী ভোজন
এই যে এপ্রিলের শেষে গাছে গাছে অজস্র পাতা এসেছে, গোলাপি ফুলের ভারে চেরি গাছ নুয়ে পড়ছে, মাটি থেকে নীল টিউলিপ মাথা তুলেছে, বাবা যেন সে খবর জানালেন। (Short Story)
মা চলে যাওয়ার পরে বাবা এই প্রথম আমাদের কাছে এলেন। রিটায়ার্ড জীবনে কাজের চাপ, সংসারের দায়িত্ব কিছু ছিল না। পড়াশোনা, মাঝেমধ্যে লেখালেখি, এই নিয়েই থাকেন। আমার বোন সুতপা, শিকাগো থেকে কোলকাতায় গিয়েছিল। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরেছে। এখন বাবা আছেন আমাদের কানেটিকাটের বাড়িতে। (Short Story)

“নিউইয়র্ক টাইমস্”-এর পাতা খুলে রেখে বাবা জিজ্ঞেস করলেন— “ডেরেল ওয়াল্কটের একটা/ দুটো বই এনে দিতে পারবি? আজ ওঁর সম্পর্কে অবিচ্যুয়ারি কলমে বেশ ডি-টেল লিখেছে। ক্যারিবিয়ানের কবিদের লেখা বেশি কিছু তো পড়িনি।” (Short Story)
কাল ইভিনিং নিউজ-এ খবরটা দেখলাম। উনি নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পারে ওঁর দুটো কবিতার বই এনে পড়েছিলাম। ক্যারিবিয়ান ক্রজে সেন্ট লুসিয়া ঘুরেও এসেছি। ঐ দ্বীপের সঙ্গে যেন ডেরেক ওয়ালকটের নাম জড়িয়ে রয়েছে। দেখি, ড্যানিয়েলকে বলে লাইব্রেরী থেকে “ওমেরস” আর “দ্য সী ইজ হিস্ট্রী” আনিয়ে দেব। বস্টন থেকে ঘুরে আসি আগে, তারপর। (Short Story)
একদিনে চারদিনের দুর্গাপুজো সারা হচ্ছে দেখে বাবা বললেন— “তোদের ক্লাবের নাম দে ‘সারাংশ’। আমি আর কি চণ্ডিপাঠ করব? সিডিতে বীরেন ভদ্র চালিয়ে দে।”
কিন্তু সেই বসন্তে আর ম্যাসাচুসেট্স্ যাওয়া হল না। জুন মাসে সবাই মিলে শিকাগোয় গেলাম। সুতপার ছেলে হাইস্কুল শেষ করে নর্থ-ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাচ্ছে। ওর হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন পার্টির জন্যে যাওয়া। বাবার ইচ্ছে ওর কলেজ ক্যাম্পাস দেখে আসেন। বাবার বন্ধুর ছেলে দ্যুতিমানও কয়েক দিনের জন্য ওঁকে ইন্ডিয়ানায় নিয়ে গেল। আমরা ওয়েস্টপোর্টে ফিরে এলাম। (Short Story)
সুতপাদের কাছে প্রায় অর্ধেক সামার কাটিয়ে বাবা ফিরে এলেন যখন, আমারও তখন স্কুল খোলার সময় হয়ে আসছে। তারপর দুর্গাপুজো এল। এদিকে বাঙালি কম। ছোট ক্লাবের ছোট পুজো। একদিনে চারদিনের দুর্গাপুজো সারা হচ্ছে দেখে বাবা বললেন— “তোদের ক্লাবের নাম দে ‘সারাংশ’। আমি আর কি চণ্ডিপাঠ করব? সিডিতে বীরেন ভদ্র চালিয়ে দে।”

ড্যানিয়েল আমাদের প্রতিবেশী। ওর স্বামী স্টিভ এখানকার হাসপাতালে আমার স্বামী সুবীরের মতোই অ্যাটেন্ডিং ফিজিশিয়ান। আমাদের দুই মেয়ে তৃষা, তৃণা ওদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। এখন সবাই দূরের কলেজে। তৃষা তো কলেজ পাশ করে স্যানফ্রান্সিকোয় চাকরি করছে। দু’জনেই ছুটিতে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করে গেছে। (Short Story)
“শীতের আগেই বাবাকে নিয়ে ম্যাসাচুসেট্স্ বেড়াতে গেলাম। বস্টন শহর, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ঘুরে দেখার পর বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন— এখান থেকে কনকর্ড জায়গাটা কি খুব দূর?”
ড্যানিয়েল লাইব্রেরিতে পার্ট টাইম কাজ করে। আমার কথা মতো বাবার জন্যে ডেরেক ওয়ালকটের কয়েকটা কবিতার বই এনে দিয়েছিল। সকাল, বিকেল একটু হাটতে বেরোনো। বাকি সময়টা বইপত্র পড়েই বাবার কেটে যায়। এক সময় শুনতে পাই ডেরেক ওয়ালকটের “লাভ আফটার লাভ” কবিতার বই থেকে পড়ছেন—
“দ্য টাইম উইল কাম
হোয়েন, উইশ ইলেশন
ইউ উইল গ্রীট ইয়োরসেলফ আরাইভিং
অ্যাট ইয়োর ওন ডোর ইন ইয়োর ওন মিরর্।” (Short Story)
আরও পড়ুন: দাঙ্গা বিষয়ক গল্পের উপসংহার
বাবাকে রসিকতা করে বলি— এ তো, ব্যর্থ প্রেমের কবিতা। বাবা উত্তর দেন— জীবন যেরকম! শেষ পর্যন্ত সেই তো নিজের কাছে ফিরে আসা। (Short Story)
শীতের আগেই বাবাকে নিয়ে ম্যাসাচুসেট্স্ বেড়াতে গেলাম। বস্টন শহর, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ঘুরে দেখার পর বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন— এখান থেকে কনকর্ড জায়গাটা কি খুব দূর? (Short Story)

বাবা ছিলেন ফিলসফির প্রফেসর। কন্কর্ড সম্পর্কের কারণটা বুঝেছিলাম। আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক র্যালফ ওয়াল্ডো এমারসন কনকর্ডে থাকতেন। তাঁর বাড়িটা এখন মিউসজয়াম। বাবার সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। আমরা হোটেলে এক রাত বিশ্রাম নিয়ে পরদিন সকালে কনকর্ডে এমারসানের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। (Short Story)
তখন টুরিস্টদের তেমন ভিড় ছিল না। বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা প্রথমে গিয়েছিলাম ওয়ালডেন-এ। বাবা হেনরি ডেভিড থরোর “ওয়ালডেন” বই এর “পণ্ড ইন্ উইন্টার” থেকে একটি অংশ বলতে শুরু করেছিলেন। থরো এখানে থাকতেন। বাড়ির কাছেই পুকুর। ওয়ালডেন পন্ড। এখনও তাঁর বাড়ি, সেই পুকুর সবই রয়েছে। (Short Story)
ওয়ালডেন পণ্ড দেখে ফেরার সময় বাবা বললেন— “এই যে ওয়ালডেনের জল আর গঙ্গার জলের মিশে যাওয়ার তুলনা, এর মধ্যে দিয়েই হেন্রি ডেভিড থরোর ভিশনকে উপলব্ধি করা যায়।”
দেড়শো বছরেরও বেশি আগে শীতকালে জমাট বাঁধা পুকুর থেকে বরফ ভেঙে দেশ-বিদেশে চালান দেওয়া হত। আমাদের দেশেও চালান যেত। ওয়ালডেন পণ্ড থেকে শ্রমিকদের বরফ ভাঙা দেখে থরো লিখেছিলেন— দেখে দেখে ভাবি মাদ্রাস্, বম্বে আর ক্যালকাটার তাপদগ্ধ মানুষেরা এই একই উৎস থেকে জলপান করছে। প্রতিদিন সকালে আমি আমার মনন ও চিন্তাকে ভগবদ্গীতার পরমাশ্চর্য সৃষ্টিতত্ত্বমূলক দর্শনে অবগাহন করাই। তারপর এক সময় বই রেখে দিয়ে জলের জন্য কুয়োর ধারে যাই। কল্পনায় দেখি ওয়ালডেনের শুদ্ধ জল গঙ্গার পবিত্র জলের সঙ্গে মিশে গেছে। (Short Story)
ওয়ালডেন পণ্ড দেখে ফেরার সময় বাবা বললেন— “এই যে ওয়ালডেনের জল আর গঙ্গার জলের মিশে যাওয়ার তুলনা, এর মধ্যে দিয়েই হেন্রি ডেভিড থরোর ভিশনকে উপলব্ধি করা যায়।” (Short Story)

ক্রমশ বেলা বাড়ছিল। গাছপালায় ঘেরা গ্রামাঞ্চলের মতো পরিবেশে এমারসনের বহু পুরোনো কালের দোতলা বাড়িটি দূর থেকে চোখে পড়ল। বাগানে হেমন্তের ঝরাপাতা পায়ে পায়ে মাড়িয়ে বাবা বাড়িটায় ঢুকলেন। আমরা দরজা পার হয়ে ভেতরের বারান্দায় যেতে একটি মেয়ের গলা শুনতে পেলাম— “এমারসন লিভড্ হিয়ার ফ্রম এইটিন থার্টি ফাইভ আনাটিল হিজ ডেথ্। দ্যাট ওয়াজ এইটিন এইট্টি টু।” (Short Story)
“বাবাকে যেন অন্যমনস্ক দেখলাম। দোতলায় উঠে মেয়েটি আমাদের নিয়ে এমারসনের শোবার ঘর, তাঁর ছেলেমেয়েদের খেলার ঘর, বইপত্রে ঠাসা পড়ার ঘর, সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল।”
মেয়েটি তাহলে ট্যুর গাইড। এখন অক্টোবরের প্রথমে ভাঙা সিজনে অল্প কয়েকজন ট্যুরিস্ট পেয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছে। আমরা কাছে যেতে তার কথা থেমে গেল। বাবার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল “হ্যালো!” তারপর ট্যুরিস্টদের বলল— এসো, দোতলায় যাওয়া যাক। সে আমাদেরও সঙ্গে যাওয়ার জন্যে ডাকল। কাঠের লম্বা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে ভাবছিলাম মেয়েটি বোধহয় বাঙালি। আজ পর্যন্ত এদেশে কোনও বাঙালি মেয়েকে ট্যুর গাইড্ এর কাজে দেখিনি। (Short Story)
তাও আবার বস্টন থেকে চব্বিশ/পঁচিশ মাইল দূরে কনকরডের মিউজিয়ামে কাজ করছে। কী জানি, হয়তো ছাত্রী টাত্রি হবে। কিন্তু এখন তো সামার এর ছুটি নয় যে, সামার জব নিয়েছে। কাছাকাছি সব ইউনিভার্সিটিতেই ফল সেমেস্টার শুরু হয়ে গেছে। তাছাড়া মেয়েটির বয়সও অত কম মনে হয় না। হয়তো ছোট মিউজিয়ামে কিউরেটরের চাকরি নিয়েছে। ট্যুর দেওয়াও ওরই দায়িত্ব। (Short Story)
বাবাকে যেন অন্যমনস্ক দেখলাম। দোতলায় উঠে মেয়েটি আমাদের নিয়ে এমারসনের শোবার ঘর, তাঁর ছেলেমেয়েদের খেলার ঘর, বইপত্রে ঠাসা পড়ার ঘর, সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল। বইগুলো দেখতে দেখতে বাবা বললেন— “এমারসনের ফিলোসফি অফ্ ইন্ডিভিজুয়ালিজম, ফ্রিডম অ্যান্ড সেলফ রিলায়েন্স্”— বাবার মৃদুস্বর ছাপিয়ে মেয়েটির কথা কানে এল— “হি ওয়াজ দ্য ফার্স্ট পার্সন, অর ওয়ান অফ দ্য ফাস্ট পিপল্ টু স্টার্ট থিংকিং আউট সাইড দ্য বক্স, উইথ হিজ হোল ট্র্যান্সেডেন্ট্যালিজম অ্যান্ড, লাইক গড অ্যান্ড নেচার অ্যান্ড অল দ্যাট…” (Short Story)
দেখলাম বাবা ওর দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন, ওর দার্শনিক কথাবার্তার জন্যে? নাকি বিস্ময়ের অন্য কোনও কারণ ঘটেছে? মেয়েটিই বা প্রথমে ওরকম অবাক ভাব দেখিয়েছিল কেন? ও কি বাবাকে আগে কখনও দেখেছে? তাহলে তো চেনার কথা। কিন্তু ব্যবহারে কিছুই বুঝতে দিল না। (Short Story)
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।