“গো–ও!”
“এ কীরে! এটাও সেভ!”
শক্তিসংঘের সমর্থক পলাশ ওর পাশে থাকা মিজানকে বলতে না বলতেই ফের ঝেঁপে নামে বৃষ্টিটা। কিছুক্ষণ আগেও হয়ে গিয়েছে একপশলা।
মাঠের জায়গায় জায়গায় ঘাসের নীচে লুকিয়ে রয়েছে কাদা। ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই। দু’দিকের গোলবক্সে তো শুধুই কাদা, ঘাসের চিহ্নমাত্র নেই।
সত্তর মিনিট গোলশূন্য থাকার পর অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের দশ মিনিটেও কোনও দল গোল করতে পারেনি। মাঠের সকলেই মোটামুটি ধরে নিয়েছে ম্যাচটা শেষমেষ টাইব্রেকারের (Tiebreaker) দিকেই গড়াচ্ছে। এ সময় কোনও দলই আর ঝুঁকি না–নিয়ে ডিফেন্স সামলে খেলে যাচ্ছে শেষ বাঁশি বাজার অপেক্ষায়।
অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামার সময়ে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বারিক ঘোষ বলে দিয়েছিলেন, “দ্যাখ কানু, ম্যাচ টাইব্রেকারে গেলে যদি জেতাতে পারিস, তাহলে আমি কলকাতায় তোর কথা বলব। ইনফ্যাক্ট কিছুটা বলেও রেখেছি। ইস্টার্ন রেল, বিএনআর ছাড়াও পোর্ট ট্রাস্টের কোচের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। দু–একটা পেনাল্টি যদি ঠেকিয়ে দিতে পারিস তাহলে ওই সব জায়গায় চাকরির সঙ্গে ক্যালকাটা লিগও খেলতে পারবি।”
বারিকদার কথাগুলো শুনে কানুর চোখদু’টো চকচক করে উঠেছিল। ক্ষণিকের জন্য মনে পড়েছিল নিজের কেরিয়ারের কথা, পরিবারের কথা।
খেলার শুরুতে যেখানে সাধারণত লেফ্ট ব্যাকরা দাঁড়ায় সেরকম জায়গা থেকে আস্তে করে বাড়ানো সুব্রতর ব্যাকপাসটা ধরে কানু একটু এগিয়ে ডান পায়ের চেটো দিয়ে বলটা গোলবক্সের ডানদিকে কোণাকুণি ভাবে দাঁড়ানো সমীরকে দিতে গিয়ে বাঁ পা’টা পিছলে পড়ে যেতেই বুটের ডগায় লেগে বলটা সোজা চলে গেল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিপক্ষ দলের ফরোয়ার্ড ভিকির কাছে। ও গোলবক্সের ‘ডি’–এর কাছেই ঘুরঘুর করছিল অনেকক্ষণ ধরেই। গোলটা করতে কোনও অসুবিধাই হয়নি ভিকির। ম্যাচটা শেষ হতে বাকি তখন মিনিট তিনেক।
দুর্গাপঞ্চমীর শেষ বিকেল। জেলার সব থেকে প্রেস্টিজিয়াস ফুটবল টুর্নামেন্টটার ফাইনাল ম্যাচটায় প্রাইজ মানিটাও মন্দ নয়। চ্যাম্পিয়ন দল পাবে তিনলক্ষ, হারলে একধাক্কায় অনেকটা কমে পঁচাত্তর হাজার। জেলার সব এমপি, এমএলএ তো বটেই, কেন্দ্র–রাজ্যের বেশ কিছু মন্ত্রীও এই টুর্নামেন্টের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জড়িত। তাঁদের খুশি রাখতে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী এই টুর্নামেন্টে বেশ মোটা রকমের টাকা ঢালেন।
‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ গোলটার পরই শক্তিসংঘের সদস্য–সমর্থকরা ফেটে পড়ল উল্লাসে। দমাদম ফাটতে শুরু করল চকলেট বোমা। মাথায় হাত ইয়ং ফুটবল ক্লাবের সকলের। যেখানে পা’টা হড়কে ছিল সেখানেই কাদার মধ্যে মুখটা গুঁজে উপুর হয়ে পড়েছিল কানু। দলের ক্যাপ্টেন অর্জুন এসে ওর হাতটা ধরে টেনে তুলল। মাঠে উপস্থিত সকলেই বুঝে গেল ষষ্ঠীর বোধনের আগেই বিসর্জন হয়ে গেল কানুর।
আস্তে করে বাড়ানো সুব্রতর ব্যাকপাসটা ধরে কানু একটু এগিয়ে ডান পায়ের চেটো দিয়ে বলটা গোলবক্সের ডানদিকে কোণাকুণি ভাবে দাঁড়ানো সমীরকে দিতে গিয়ে বাঁ পা’টা পিছলে পড়ে যেতেই বুটের ডগায় লেগে বলটা সোজা চলে গেল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিপক্ষ দলের ফরোয়ার্ড ভিকির কাছে। ও গোলবক্সের ‘ডি’–এর কাছেই ঘুরঘুর করছিল অনেকক্ষণ ধরেই।
গোলকিপার
ম্যাচের আগের দিন বিকেলে ক্লাবের এক্সিকিউটিভ মিটিংয়ে ঠিক হয়েছিল জিতলে প্রাইজ মানি থেকে দলের কুড়িজনকে দশহাজার টাকা করে ছাড়াও আরও ত্রিশহাজার টাকা পারফরমেন্সের ভিত্তিতে ভাগ করে দেওয়া হবে। দশহাজার টাকা পাবেন কোচ প্রভাকর। বাকি টাকাটা ক্লাবের ছাদ ঢালাইয়ের কাজে লাগানো হবে। হারলে সকলের জন্য ধার্য দু’হাজার টাকা, বাকিটা ক্লাবের। তবে জেতার ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিল একশো শতাংশ।
ওই ম্যাচের দিন সাতেক পর কানুর বাড়িতে গিয়ে অর্জুন দেখে বাড়ির দরজায় তালা দেওয়া। বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে কানুরা এই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথায় চলে গিয়েছে।
সেবার ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফুটবল টুর্নামেন্ট ফেডারেশন কাপ হচ্ছিল কলকাতায়। অবিশ্যি তখন শহরটার নাম ক্যালকাটা। ভারতের সব নামি দলগুলো এসেছে খেলতে। প্রথম ম্যাচ মোহনবাগান খেলবে গোয়ার একটা ক্লাব দলের বিরুদ্ধে।
প্রায় মাস আটেক পর সেদিনের ম্যাচের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল অর্জুন। প্রিয় মোহনবাগানের খেলা দেখতে আজ মোহনবাগান মাঠে এসেছে সে। আগে মাঠে নামল মোহনবাগান। কিছুক্ষণ পর বিপক্ষ দল। সেই দলের গোলকিপার (goalkeeper) বলটা নিয়ে মাঠে গড়িয়ে দিয়ে গোলপোস্টের দিকে দৌড় শুরু করতেই বার দু’য়েক চোখ কচলে অর্জুন নিজের মনে বলে ওঠে, ”আমি যা দেখছি সেটা কি ঠিক? ও কি কানু?” গ্যালারিতে একজনের হাতে থাকা রেডিয়োয় রিলে শুনতে শুনতে সে নিশ্চিত হল–– সে ঠিকই চিনেছে, ওই গোলকিপারটা ওদের কানুই।

খেলা শেষে গেটের লোকগুলোকে অনেক অনুরোধ করে স্পোর্টস ক্লাবের ড্রেসিংরুমে অর্জুন এসেছিল কানুর সঙ্গে দেখা করতে। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর চলে গিয়েছিল।
অর্জুনের সঙ্গে কথার ফাঁকে কানুর মনে পড়েছিল সেই রাতের কথা।
রাত তখন এগারোটা হবে। একচালা টালির দু’কামরা ঘরের শেষে ছোট্ট বারান্দার নড়বড়ে কাঠের দরজায় ‘টকটক’ শব্দটা শুনে দরজাটা খুলতেই বাল্বের ক্ষীণ লালচে আলোয় প্রথমে চোখে পড়ে পাশের পাড়ার হীরুদাকে। তাকে দেখে অবাক হওয়ার আগেই হীরুদা বলে, “শুয়ে পড়েছিলিস?”
“না” বলে কানু।
“তোর সঙ্গে একটা ব্যাপারে কথা বলার দরকার ছিল। এখানে একটু বসার জায়গা পেলে…।”
“এখানে এসো। একটা চৌকি আর একটা চেয়ার আছে।” কানু দেখে হীরুদা আরও দু’জনকে নিয়ে ওই ছোট্ট ভ্যাপসা গন্ধ ঘেরা বারান্দার মধ্যে এসে দিব্যি বসে পড়ল।
“এঁকে তো চিনিস বোধহয়?”

হীরুদার প্রশ্নের জবাবে কানু বলে, “সুনীল শিরোদকর। শক্তিসংঘের প্রেসিডেন্ট।”
“আর ওঁকে তোর চেনার কথা নয়। উনি থাকেন সুনীলবাবুর দেশের বাড়ির রাজ্য গোয়ায়। ওঁর নাম ফ্রান্সিস পিন্টো। ওখানকার খুব নামকরা লোক। ফুটবল ভক্ত। তোর খেলা দেখেছেন। পছন্দ হয়েছে। সুনীলবাবুর ক্লোজ ফ্রেন্ড। ওখানকার যে সব বড় কোম্পানিগুলো রয়েছে, সেই সব কোম্পানির ফুটবল ক্লাবের হর্তাকর্তাদের সঙ্গে খুব দহরম মহরম। ব্যবসার কাজে এসে এখানে সুনীলবাবুর বাড়িতে প্রায় দিন পনেরো হল রয়েছেন। কালকের ম্যাচটা নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে চান। ওঁদের ধারণা শক্তিসংঘের ট্রফি জেতার বাধা হয়ে দাঁড়াবি একমাত্র তুই।”
ড্রেসিংরুম ছেড়ে হোটেলে ফেরার বাস ধরার জন্য দলের সহ খেলোয়াড়দের ডাকাডাকিতে সম্বিত ফেরে কানুর।
সেদিন অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামার আগে বারিকদার বলা কথাগুলো শুনে কানুর চোখ দু’টো চকচক করে উঠলেও তার আগের রাতে সুনীলবাবু এবং পিন্টোস্যরের প্রস্তাব বারিকদার থেকেও অনেক অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল তার কাছে। অভাব অনটনের সংসারে ইট-বালি খসে পড়া খুপড়ি বারান্দাটায় বসে পানাজিতে টু বেডরুম, ড্রইং–ডাইনিং–কিচেন ফ্ল্যাট, সঙ্গে ভারতের অন্যতম বড় এক ক্লাবে খেলার ডাক আর ক্লাবেরই নিজস্ব কোম্পানিতে ভাল মাইনের চাকরির অফার উচ্চাকাঙ্ক্ষী কানুর কাছে ছিল অনেক বেশি লোভনীয়। এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি মাস আটেক আগে আবেগ–টাবেগকে হারিয়ে দেওয়া কানু, মানে দলের প্লেয়ার লিস্ট দেখে রেডিয়ো–টিভির কমেন্ট্রি বক্সে এখন যাকে সবাই ডাকে কানাই বসু নামে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
অলোক অধিকারী
নতুনপল্লী পশ্চিম, মিডল রোড, সোনারপুর, কলকাতা ৭০০১৫০
মোবাইল ৯৮০৪৪ ৯৩৬৮৬
ইমেল: dishalok@yahoo.com