(Munshi Premchand)
Munshi Premchand
31st July 1880- 8th October 1936
ঝুপড়ির দুয়ারে বাপ-বেটা দুজন বসে আছে চুপচাপ। সামনে একটা আগুনের কুণ্ডলী নিভু নিভু জ্বলছে। ভেতরে বেটার যুবতী বউ বিধিয়া প্রসব বেদনায় উথালপাতাল আছাড় খায়। থেকে থেকে তার মুখ থেকে এমন মর্মবিদারক আর্তনাদ বের হয়ে আসে যে, উভয়ের কলিজা পানি হয়ে যায়। (Munshi Premchand)
আরও পড়ুন: মদন ঘোষের বদনে হাসি
শীতের রাত। চারদিক নৈঃশব্দ্যে ডোবা। সারা গ্রাম অন্ধকারের চাদরে ঢাকা।
— মনে হচচে বাঁচপে নাকো। দিনমানই তড়পি গেল। যা তো যা, মাধু, একটু দিকি আয়। বাপ হাসু বলল।
— মরিই গিলি জলদি মরচে না ক্যান? কী দিকি আসপো গো? ভয়-খাওয়া পাখির মতো জবাব দিল মাধু।
— তুই একটু শক্ত-মক্ত পাষাণ আচিস হে। বচ্ছর ভরি যার সাতন জীবনের সুকু-মুকু খেললি তার সাতে এমন অকরুণ করচিস?
— বললি-ই হবি? ওর ওই তড়পানি, তাতে আবার হাত-পার ছট-ফটি, ওসব আমি দিকতি পারি নাকো। (Munshi Premchand)

একে তো চামারের ঘর। তারপর আবার গাঁ জুড়ে তার বদনাম আছেই। হাসু একদিন কাজ-কাম করে তো তিন দিন করে আয়েশ। মাধুও কম না। সে এমনই কামচোর, এক ঘণ্টা খেটে-ছিটে ফের এক ঘণ্টা চুরুট টানে। এ কারণে কেউই তাকে কাজে রাখে না। ঘরে যদি একমুঠো চাল, ডাল কিংবা একফোঁটা শালুনের ঝোল থাকে তো কসম খেলেও কাজে নামবে না মাধু। দিন দু-এক অনাহারে কাটলে পরে একদিন হাসু গাছের ডাল-পাতা ভেঙে কুড়িয়ে মাধুর কাছে দেয়, আর মাধু সেগুলো নিয়ে বাজারে বেচে আসে। যে কদিন এ দিয়ে চলে সে কদিন আর রোজগার নেই। দুজন নবাবের বদন নিয়ে দিনভর এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। আবার যখন খুদ-পিপাসা হবে তখন হয়তো আবার কাঠখড়ি ভাঙে, নয়তো অনিচ্ছায় কারো দু-চার আনার মজদুরির তালাশে যায়। (Munshi Premchand)
“আজব এক জীবনধারা এদের। ঘরের মেঝেতে দু-তিনটে মাটির বাসন ছাড়া আর কোনো সম্পত্তিও এদের নেই। ছেঁড়া-ফাটা কাপড়ে লজ্জা ঢাকাই সার।”
এমন না যে, গাঁয়ে এখন কাজের দুর্ভিক্ষ যাচ্ছে। কাজবাজের কোনো অভাব নেই। কৃষাণকুলের গ্রাম। মেহনতি মানুষের জন্য পাচ-পঞ্চাশটা কাজ ছড়িয়েই থাকে। কিন্তু গাঁয়ের মানুষ এদের কাজের জন্যে তখনই পায় যখন দুজন থেকে অন্তত একজনের কাজ না করে আর কোনো উপায় থাকে না। ভাগ্যক্রমে এ দুজন যদি সাধু-সন্ন্যাসী হত তবে ‘অল্পতুষ্টি’ আর ‘খোদাভরসা’-র লাইনে এদের শুদ্ধ করতে কোনো সবকের দরকার হত না। কেন-না, এসব তাদের স্বভাব জাত ‘গুণাবলি’। (Munshi Premchand)
আজব এক জীবনধারা এদের। ঘরের মেঝেতে দু-তিনটে মাটির বাসন ছাড়া আর কোনো সম্পত্তিও এদের নেই। ছেঁড়া-ফাটা কাপড়ে লজ্জা ঢাকাই সার। পার্থিব ভাবনা থেকে বিলকুল বেফিকির। ঋণে-কর্জে একেবারে জেরবার। গালিও শোনে। মারও কম খায় না। কিন্তু মোটে লাজ নেই, গম নেই। নিঃস্বও এতখানি যে, পাওয়ার আশা বাদ দিয়েই লোকে যা কিছু কর্জ দেওয়ার দেয়। এমনি দেয়। শোধ চাইলেও পায় না। (Munshi Premchand)
কালাই মটর বা মিষ্টি আলুর ফসলের দিনে খেত থেকে আলু-মটর উগলে এনে খায়। সিদ্ধ-অসিদ্ধ খায়। খেত থেকে পেয়াঁজ উঠিয়ে, মরিচ ছিঁড়ে ভুনা করেও খায়। কখনও দিন পাঁচের জন্য পরের খেত নিড়িয়ে আখ তুলে আনে, তারপর রাতে বসে বসে চোষে। (Munshi Premchand)
“শরীরজোড়া আরও একটু নির্লোদ শক্ত হয়ে উঠছে এদের। কেউ কাজে ডাকলে নবাবি ঢঙে দ্বিগুণ মজুরি হাঁকত, না করার ইচ্ছায়।”
এই রকম যাযাবর সন্ন্যাসের মতো করে জীবনের ষাট বছর কাটিয়ে দিয়েছে হাসু। মাধুও বাবার পদচিহ্ন দেখে দেখে চলছে গর্বিত সন্তানের মতো। বরং বলা ভালো, বাবার নাম-শিরোনাম আরও খানিকটা উজ্জ্বল করেই চলছে সে। (Munshi Premchand)
আজও দুজনে একসাথে আলোর কুণ্ডর সামনে বসে আলু সিদ্ধ করছে। এই আলুও কারও খেত থেকে হালাল করা হয়েছে নিশ্চিত।(Munshi Premchand)
হাসুর বিবির পরপারযাত্রা হয়েছে বহুদিন। মাধুর শাদি হয়েছে মাত্র গত বছর। মেয়েটা জাতবংশীয়ই ছিল বটে। আসার পর থেকে এই পরিবারে কিছুটা আদব-লেহাজের ভিত-বুনিয়াদ রেখেছে সে-ই। যাঁতায় ঘাস-দানা পিষে খোসা ছাড়িয়ে দিনে না হলেও সেরখানেক আটা জোগাড়-যন্তর করে ফেলত মেয়েটা। তারপর তা দিয়ে এই দুই নির্লজ্জ নিকম্মার উদর-আগুন নেভাত। কিন্তু এ আসার পর বাপ-বেটা আরও বেশি আলসে, আরামখাকি হয়ে গেছে। শরীরজোড়া আরও একটু নির্লোদ শক্ত হয়ে উঠছে এদের। কেউ কাজে ডাকলে নবাবি ঢঙে দ্বিগুণ মজুরি হাঁকত, না করার ইচ্ছায়। (Munshi Premchand)
“আসলে মাধুর আশঙ্কা হল, সে ঘর থেকে যাওয়া মাত্রই আলুর বড়ো ভাগটা সাবার করে দেবে হাসু।”
সেই মেয়েটাই আজ ভোর থেকে প্রসবযন্ত্রণায় মরতে বসেছে, আর এই দুই স্বজন সম্ভবত এই অপেক্ষায় আছে, মরুক, ও মরলেই একটু শান্তি মিলবে ওদের। (Munshi Premchand)
হাসু আলু বের করে ছিলতে ছিলতে বলল- যা না, একটু দিকি আয়, কেমনতরো রইছে।
— ওই ডাকিনীটা উহ-আহ করচে, আর কি! এ গাঁয়ে তো ওঝাজিও এক রুপি মাঁগবে। সেটি আসপেনে কুন ঘর থিকে?
আসলে মাধুর আশঙ্কা হল, সে ঘর থেকে যাওয়া মাত্রই আলুর বড়ো ভাগটা সাবার করে দেবে হাসু। বলল, কুটুরিতে যাতি আমার ডর লাগচে। (Munshi Premchand)
— ডর কীসের? আমি তো হেথায় আচি না কি?
— তালি পরে তুমি গে দেকো না?
— শোন, মাধু, আমার মেয়েমানুষ যবে মরেচিলো, আমি তিন দিন তার সিথান থেইকে একচুল নড়িনি, হুম। তাপ্পর, তোর পরিবার আমাকে দিকলি পরে কেমন শরম পাবে বল্ দিকি। কুনোদিন তো তার সুরমুকটি আমি দিকিনি। আজ গিয়ে তার খোলাপটকা শরীর দিকবো না কিরে? তার গা-গতরের কুনো বালা-ই তো অকন সিদে নেই। হামাক দিকলি পরে কুয়াইশ করে একটু হাত-পা নাড়াবে, তাও তো পারবি নানে। (Munshi Premchand)
“যে সমাজে দিনমান গতর-খাটানো মানুষের অবস্থাও এদের থেকে বিশেষ ভালো ছিলো না আদৌ, সেখানে বাস করেও এমন ভরসার কথা বলার তাকত একমাত্র এদেরই ছিল বলতে হবে।”
— ওদিকে হামি তো চিন্তা করি মরছি, বাপুজি। তেল, গুড়ও নেই হামাক ঘরে। একটি কাঁচি পর্যন্ত নেইকো। ইকখান বাচ্চা-কাচ্চা হলি পরে কী করব নে? (Munshi Premchand)
— সবই আসি পড়বেনে। ভগবান বাচ্চা দিলি পরে দিকপি, যারা ইকটু নুন-পানি, একটি পয়সা তক দেয়নি কুনোদিন, তারাও ডাকি ডাকি দু-চার আনা বাইর করি ছাড়বিনে। হামার তো চেলে হল, ঘরে কিচ্চুটি ছিল নাকি? ওমনতরো দেকিস, আজ ভি একরকম কাম চলিই যাবে নে। (Munshi Premchand)
যে সমাজে দিনমান গতর-খাটানো মানুষের অবস্থাও এদের থেকে বিশেষ ভালো ছিলো না আদৌ, সেখানে বাস করেও এমন ভরসার কথা বলার তাকত একমাত্র এদেরই ছিল বলতে হবে। এরা সেই খেত-খামারের মেহনতি কৃষকদের ভজিয়ে ভাজিয়ে ফায়দা হাসিল করতে পারত বলে কৃষক পরিবারের থেকেও এদের ভার-ভাবনা ছিল অনেক কম। বলতে গেলে বিলকুল চিন্তামুক্তই ছিল এরা। এ ধরনের মন-মগজ তৈরি হয়ে যাওয়াতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আমার মতে, কৃষাণকুলের তুলনায় হাসু অনেক বেশি সূক্ষ্মদর্শী ছিল হয়তো; যার ফলে মাথামোটা সাধাসিধে কৃষকগোষ্ঠীর একজন না হয়ে সে উচ্ছৃঙ্খল চিটার-বাটপারদের কাতারে ঢুকে পড়েছিল। (Munshi Premchand)
“দুজনেই আগুন থেকে আলু বের করে গরম গরম গিলতে থাকে। কাল থেকে এ অবধি কিচ্ছুটি মুখে পড়েনি। খাওয়ার মতো পায়নি কিছুই।”
তবে হ্যাঁ, তার মধ্যে অবশ্য এই যোগ্যতা ছিল না যে, একদম পায়ে পায়ে সন্ত্রাস-গুন্ডাদের আদবকেতা মেনে চলবে। অর্থাৎ এতটাই ঢিলামাশি ছিল যে, কোনো বদ-কানুনের আদতও গড়ে উঠতে পারেনি সঠিকমাত্রায়। হয়তো এ জন্যই, তার বয়েসি, একই সাথে বেড়ে উঠে যেখানে অন্য অনেকে গাঁয়ে-গঞ্জের মাতবর-সরদার হয়ে বসেছে, আর এই হাসুকে মানুষ ভ্রুকুটি করছে, ছিঁচকে চোর বলে চিহ্নিত করছে, তারপরও হাসু মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসতে পারছে। ভাবছে, তার এই গরিবি হাল যদি না হত আজ, তাহলে কী ভোগটাই না ছিল কপালে। এই জীর্ণ-দুর্দশা আছে বলেই তো তাকে কৃষকের মতো হাড়ভাঙা খাটুনি করে মরতে হয় না। তদুপরি কৃষকের মতো সাদাদিল হলে তার সরলতা আর নির্বচনতার সুযোগ নিত তার মতো অন্য মানুষ। আহ্, বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছে সে। (Munshi Premchand)

দুজনেই আগুন থেকে আলু বের করে গরম গরম গিলতে থাকে। কাল থেকে এ অবধি কিচ্ছুটি মুখে পড়েনি। খাওয়ার মতো পায়নি কিছুই। তাই বলে এটুকু সময়েরও বার নেই যে, খানিকটা জুড়াক, তারপর মুখে দেবে। বেশ ক’বারই দুজনের জিভ ঝলসে গেছে। (Munshi Premchand)
খোসা ছাড়ানোর পর আলুর শরীরটা তেমন গরম না মনে হলেও ভেতরটায় আগুন অঙ্গার হয়ে জমে থাকে। দাঁতের নীচে নামার সাথে সাথেই গলাসহ টাকরা জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু এই অঙ্গারটা মুখে রাখার থেকে ভালো হল ভেতরে পাঠিয়ে দেয়া। যেহেতু সেখানে ঠান্ডা করার বেজায় উপকরণ মজুদ আছে। অতএব দুজনেই ঢোক গেলার মতো করে আলুগুলো তাড়াতাড়ি গলার ওপারে ঠেলে দেয়। এই করতে যেয়ে তাপে-কষ্টে চোখ থেকে ছটাকখানেক পানিও বেরিয়ে গেল হাসু-মাধুর। তবু ক্ষান্তি নেই। কে কার চেয়ে আগে বেশিটুকু খেতে পারল, চলছে তার এক অসম প্রতিযোগিতা। (Munshi Premchand)
“সেই নিমনতন্নে গিয়ে হাসু যেমন ভরপেট খেতে পেয়েছে, তা তার জীবনে একটা মাইল ফলক ঘটনা বইকি। আজও তার খিদে চাগানো স্মৃতি টাটকা মাছের মতো সুগন্ধি ছড়ায়।”
এমনই নিদারুণ সময়ে কোত্থেকে হাসুর চোখে একখানি ভোজ-নিমনতন্নর স্মৃতি ভেসে আসে উড়াল পাখির মতো।
বিশ বছর আগে। সেই নিমনতন্নে গিয়ে হাসু যেমন ভরপেট খেতে পেয়েছে, তা তার জীবনে একটা মাইল ফলক ঘটনা বইকি। আজও তার খিদে চাগানো স্মৃতি টাটকা মাছের মতো সুগন্ধি ছড়ায়। সে স্বগতোক্তি করে, সেই ভোজের কাহন ভুলব না রে, মাধু। আজতক তেমন মজেদার খানা পেটপুরে খাওয়া হয়নিকো আর। (Munshi Premchand)
মেয়েপক্ষের লোকেরা সবাইকে লুচি খাইয়েছিল, সব্বাইকে। ছোটো-বড়ো সকলেই সে লুচির ভাগ পেয়েছে। সাথে ছিল খাঁটি ঘিয়ের চাটনি। রায়েতা, তিন রকমের শাকভাজি, একটা ঝোল-ঝোল রসালো তরকারি, আচার, মিঠাই। কী করে বোঝাবে যে, সেই ভোজের খাবারে কেমনতরো সোয়াদ যে হয়েছিল সেদিন। যা খুশি চাও আর যত চাও খাও, কেউ বাধা দেবে না, জিজ্ঞেসও করবে না। অতিথিরা এত এত খেয়েছে, খাইয়েছেও যে, কেউ হয়তো পানি খাবে, গ্লাসে পানি নিয়ে খাবার আগেই পাতে তার গরম ভাপ ওঠা গোল গোল কচুরি ঢেলে দিল। হয়তো সে না করছে, ভাই আর খেতে পারছি না, কিন্তু কে শোনে সে কথা! দিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। শেষে যখন সবার হাত-মুখ ধোয়া হল, তো সবাইকে একটা করে বড়ো পানও খেতে দেয়া হয়েছে। (Munshi Premchand)
“মাধু তার বাপ হাসুর কথা শুনছিল, আর জিভ বের করে মজা চাখছিল। তারপর বলল, আহ্, ইক্কন যদি কেউ আমায় সিরাম এককান ভোজ খাতি ডাকত!”
— কিন্তু আমার আবার পান খাওয়া সইত নারে, মাধু। মুণ্ডু পে চক্কর মারে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারচি না। ত্বরা করে গিয়ে ঠাকুরের কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েচিলুম। বড়ো দিল দরিয়া লোক আচে সে ঠাকুর। (Munshi Premchand)
মাধু তার বাপ হাসুর কথা শুনছিল, আর জিভ বের করে মজা চাখছিল। তারপর বলল, আহ্, ইক্কন যদি কেউ আমায় সিরাম এককান ভোজ খাতি ডাকত! (Munshi Premchand)
— ইকানে আর কে কী খাওয়াবে? ও জামানা চিলেক আলাদা। ইক্কন তো সবেরে কেষ্টগিরিতে পেয়িচে। বিয়ে-ছাদিতে কম খর্চা করো। শ্রাদ্ধে-খানাতে বেশি খর্চা করে হবি কী– ইরাম কত্তা মুসল্লি বের হয়িচে। পুচে দেকো তো, গরিবের মালামাল চুষে চুষে কোথা নিয়ে রাখপে, বাপু? পরেরটা চোষনের কালি তো কোনো খামতি দিকিনাকো । হামাক খিলানের কালিই যতো কেষ্টগিরি। (Munshi Premchand)
— তুমি কি কুড়িটা লুচি খাতি পারিচো, বাপুজি?
— কুড়িটা বলিস কী রে, তারচে বেশি খায়িচি না?
— হামি হলে পঞ্চাশ খাতি পারতাম।
— হামিও পঞ্চাশের কম খাইনি মনে কচ্চে।
— পাঠার গোশতের ঝোল চিলে। আজ তো তার আধেকটা কেউ খাতি দেবে না।
“সকালে মাধু কুটুরির মধ্যে ঢুকে গিয়ে দেখে, তার বিবি ঠান্ডি মেরে পড়ে আছে। তার মুখের ওপর মাছি ভনভনিয়ে উড়ছে।”
আলু খাওয়া হলে দুজনেই পানি খায় পেট ভরে। তারপর পরনের ধুতি বিছিয়ে সেই আগুনের সামনেই পা-দুখানা পেটের সাথে দ-এর মতো পেঁচিয়ে শুয়ে পড়ে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন, দুটি আজদাহা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে। ওদিকে বিধিয়া আহ-উহ আর্তনাদ করেই যাচ্ছে। (Munshi Premchand)
সকালে মাধু কুটুরির মধ্যে ঢুকে গিয়ে দেখে, তার বিবি ঠান্ডি মেরে পড়ে আছে। তার মুখের ওপর মাছি ভনভনিয়ে উড়ছে। ফ্যাকাশে চোখের মণি ও পুতুলিটা উলটে আছে। সারা দেহে মাটি-কাদা লেপ্টে একেবারে লুতুপুতু অবস্থা। পেটের মধ্যেই নবজাতক বাচ্চাটার জানাজা হয়ে গেছে। (Munshi Premchand)
মাধু ভয়ে আঁতকে ওঠে। দৌড়ে আসে হাসুর কাছে। তারপর দুজনেই একসঙ্গে হায় হায় রবে কোরাস-কান্না জুড়ে দেয়। দুই হাতে মাটি মেখে বুক চাপড়ানোর কাজটাও চালায় সমান তালে। (Munshi Premchand)
এই আহাজারি শুনে প্রতিবেশীদের ছুটে আসতে দেরি হয় না। পুরোনো রসম অনুযায়ী শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে যায় তারা। (Munshi Premchand)
কিন্তু বেশি কান্নাকাটি করার সুযোগ কই! মেলা কাজ বাকি পড়ে আছে। কাফনের জোগাড়-যন্তর এবং কাঠ-পাট-লাকড়ির ব্যবস্থাও করতে হবে। এমন দুর্দিনেও এদের ঘরে একসিকি পয়সা দেখা পাওয়া চিলের বাসায় আস্ত-খণ্ড বাঁশ পাওয়ার মতোই দুষ্কর, দুর্লভ। (Munshi Premchand)
অগত্যা নিরুপায় হয়ে বাপ-বেটা কাঁদতে কাঁদতে গ্রামের জমিদারের দুয়ারে ধর্ণা দেয়, যা দেখে মনে হতে পারে পূর্বপরিকল্পনারই অংশ মতো। জমিদার মশায়, যদিও এদের দুজনের চেহারা অব্দি দেখতে ঘেন্না করতেন, এমনকি চুরির অপরাধে, কথা দিয়েও কাজ না করার গুনেগার দিতে নিজের হাতে এদের দুইটাকে উত্তম-মধ্যমও দিয়েছেন কয়েকবার, কান্না দেখে তিনিও জিজ্ঞেস না করে পারলেন না, কি হে হাসু, কাঁদচিস ক্যান রে? মনে হচ্চে, কাঁদতে কাঁদতে চেহারাখানাই বিগড়ি ফালিচো, দিকি তো চিনাই যাচ্চি নাকো। কী, আবার কোনটা ফলিয়েচো? এই গাঁয়ে আর থাকপি না, সেই সিদ্ধান্ত পাকা করিচিস নাকি? (Munshi Premchand)
“জমিদার সাহেব দিলদরিয়া মানুষ বটে। কিন্তু তিনি বিলক্ষণ জানেন, হাসু-মাধুর প্রতি দয়া করা আর কালো কম্বলে রং করা একই কথা। মনে চাচ্ছিলো বলে দেন যে, যা, দূর হ, ইকান থিক।”
হাসু মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে জল থৈ থৈ চোখে বলল, সরকারজি, বড়ো বিপদে পড়ে এয়েচি। মাধুর পরিবার ও রাতে গত হই গিয়ে। দিনমান তড়পে তড়পে গেল সরকার। দুপুর-রাত তক তার সিথানে পড়েচিলুম হাম দুটি প্রাণী, সরকার। অষুধ-পথ্যি যেটুকু পায়িচি, সব করেচি। কিন্তু ও হামাক সব ফেলে মনে বড়ো দাগা দিয়ে চলি গিয়ে। মালিক, ইক্কন হামাক একটা রুটি দেওনের কেউ নেইকো আর। বড়ো নিঃস্ব হয়ে গিয়ে হামি। ঘর উজাড় হয়ে গিয়ে। হামি তো আপনার গোলাম, ইক্কন আপনি বিনি বিধিয়াক মাটি দেওনের আর কে আচে…। হামাক সব তো অষুধ-পথ্যিতে খুইয়ে দিয়। আজ মালিক আপনি কিচু দিলি পরে ওর সমাধিত্ ছাই উড়বে, সরকার। আপনি বিনি আর কার দুয়ারে যাব, মালিক…? (Munshi Premchand)
জমিদার সাহেব দিলদরিয়া মানুষ বটে। কিন্তু তিনি বিলক্ষণ জানেন, হাসু-মাধুর প্রতি দয়া করা আর কালো কম্বলে রং করা একই কথা। মনে চাচ্ছিলো বলে দেন যে, যা, দূর হ, ইকান থিক। লাশ ওই ঘরের মেঝেতেই পুঁতে রেখে দে। এমনিতে তো শ’বার ডাকলি পরেও পাত্তা পাওয়া যায় না। এখন যেই না গরজ পড়িচে, অমনি এসে খোশামোদি-তোষামোদির বাণ ছুটিয়ে দিচ্চিস। ছালা, হারামখোর, বদমাশ কাহাঁকা। (Munshi Premchand)
কিন্তু গোস্বা কিংবা প্রতিশোধ নেওয়ার সময় এটা নয়। ইচ্ছায় না অনিচ্ছায় কে জানে, দুই রুপির একটা নোট ধরে ছুঁড়ে মারলেন জমিদার। এইটুকুই। সান্ত্বনার একটা শব্দও মুখ থেকে বের করলেন না তিনি। এমনকি একবার সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। মনে হয়, মাথার বোঝা ঝেরে ফেলে স্বস্তি পেয়েছেন খানিক, ব্যাস। (Munshi Premchand)
“দুপুরবেলা হাসু আর মাধু কাফনের কাপড় আনতে বাজারে রওয়ানা হয়। আর আশপাশের লোকেরা বাঁশঝাড়ে যায় বাঁশ কাটতে।”
জমিদার সাহেব যেহেতু দুই রুপি দিয়েছেন, তাই গাঁয়ের বেনিয়া মহাজনেরও প্রত্যখ্যান করার সাহস হল না। হাসু আবার জমিদারের নামে ঢেঁড়া পেটাতে বেশ ওস্তাদ। সুতরাং কেউ এক আনা-দুই আনা আবার কেউ চার আনা বিলিয়ে দিল হেসেখেলে। ঘণ্টা পার না হতেই হাসুর হাতে প্রায় পাঁচ রুপি পরিমাণ পয়সা জমে গেছে। এছাড়াও কেউ দিয়েছে ডাল-শস্য, কেউ-বা চাল। কেউ জোগাড় করে দেয় লাকড়ি। দুপুরবেলা হাসু আর মাধু কাফনের কাপড় আনতে বাজারে রওয়ানা হয়। আর আশপাশের লোকেরা বাঁশঝাড়ে যায় বাঁশ কাটতে। এদিকে গ্রামের পাতলাদিল মহিলারা এসে বসে লাশ দেখার পুণ্য হাসিল করছে আর তার দুর্ভাগ্যের কথা স্মরে স্মরে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরিয়ে বিদায় নিচ্ছে । (Munshi Premchand)
বাজারে পৌঁছে হাসু বলল, দাহ করার কাঠ-খড়ির জোগাড় তো হই গিয়ে, কী বলিস মাধু?
মাধু বলল, হ্যাঁ, লাকড়ি তো অনেক জমচে দিকি এলুম, এখন কাফন লাকপে। তো সস্তা একজোড়া নিলেই হবি।
— হাঁ, তাছাড়া আর কি! লাশ দাহখাঁটে চড়তি চড়তি রাত হয়ে যাবেখন। রাতে কাফন দিকপিই-বা কে, আর পরখ করবিই-বা কে।
— কেমন রেওয়াজ হয়িচে সমাজে, দেকো বাপু, যে আচ্ছা-খাচ্ছা জিন্দা থাকতি ছেঁড়াফাঁটা কাপড় পরতি পারেনি, মরলে তারও নয়া কাপড় চাই। (Munshi Premchand)
— কীই-বা করার আচে বল, এই পাঁচটা রুপি যদি আগে পেতিস, তবে তো সত্য খানিক অষুধ-পথ্যির জোগাড় হয়ি যেত।
দু’জনেই একে অপরের মনের মর্মকথা বুঝতে পারছিল ঠিক ঠিক। বাজারে দু’জনেই এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে।
“হাসু বলল, কাফন পরিয়ে কী লাভ হবি নে? শিষবেলা তো পুড়ে ছাইপাসই হয়ে যাবেখন। তোর বিবির পাতে কিছুমাত্র থাকপিনে।”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দুই বাপ-বেটা ঘটনাচক্রে অথবা হয়তো ইচ্ছাচক্রেই এক শুঁড়িখানার দরজায় এসে ঠেকে। এবং যেন নিয়তি ঘুরপাকেই ভেতরে ঢুকে পড়ে। খানিকক্ষণ উভয়ে হতভম্ব অবস্থায় দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে। সম্বিত ফিরতেই হাসু এক বোতল মদের অর্ডার করে বসল এবং তারপর দুজনেই চেয়ারে বসে টেবিলে কনুই রেখে পুরোদস্তুর পানে নিমজ্জিত হয়ে গেল। কয়েক পেগ পান করার পর দু’জনকেই নেশায় পেয়ে বসে বেশ করে। (Munshi Premchand)
হাসু বলল, কাফন পরিয়ে কী লাভ হবি নে? শিষবেলা তো পুড়ে ছাইপাসই হয়ে যাবেখন। তোর বিবির পাতে কিছুমাত্র থাকপিনে। (Munshi Premchand)
মাধু আকাশ পানে তাকিয়ে বলল, যেন নিজের নিষ্কলুষতার কথা ফেরেশতাদের শুনিয়ে দিচ্ছিল, দুনিয়ার কী এক রীতিরে বাপ, ইকানের মানুষ ক্যান যে মন্দিরে হাজার রুপি দান-দক্ষিণা করচে? কে দিকপে যে, পরলোকে পায় কি না পায়? (Munshi Premchand)
“এমন অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে বলে, বেচারি বড়ো ভালো চিল বাপ। মরেও দেক কত খাইয়ে গিয়েচে।”
— ধনীদের কোচে ধন আসে আর তারা সব ফু মেরে উড়িয়ে দেয়। আর হামাক কোচে উড়ানোর কীই-বা আছে?
— কিন্তু বাপুজি, মানুষকে কী কবে নে, যদি জানতি চায়, কাফন কনে।
হাসু হেসে বলল, কব যে, কোমর থেকে ফসকে পড়ি গিয়ে। খুপ খুঁজেচি। পাইনিকো।
মাধু হাসে। এমন অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে বলে, বেচারি বড়ো ভালো চিল বাপ। মরেও দেক কত খাইয়ে গিয়েচে। (Munshi Premchand)
আধ বোতলের বেশি সাবাড় হয়ে গেছে ততক্ষণে। হাসু তাই সের দুই লুচি অর্ডার করে। সাথে নেয় গোশতের তরকারি, কলিজা ভুনা আর তেলে ভাজা মাছ। শুঁড়িখানার সাথেই রেস্টুরেন্টের দোকান ছিল। মাধু দুই পাতিল ভরে সব নিয়ে আসে। দেড় রুপির বেশি খরচ হয়ে গেছে এতেই। সবমিলে আর মাত্র সামান্য পয়সা বেঁচে আছে। দু’জনে এমন ভাবে গোগ্রাসে গিলছে সব, যেন বনের মধ্যে ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে বহুদিন পরে শিকার মিলেছে। না কোনো কৈফিয়তের ভয় আছে তাদের, না ছিল দুর্নামের আশঙ্কা। মানবিক দুর্বলতার এইসব মঞ্জিল তারা অনেক আগেই পার করে এসেছে। তবু হাসু একটু দার্শনিক মেজাজে বলল, পরলোকে আমাদের প্রশ্ন করা হলে তখন কী জবাব দেব? (Munshi Premchand)
“যদি সেদিন আমাদের ধরে বিধিয়া জিজ্ঞেস করে, আমায় তোমরা কাফন দিলি না ক্যান? তখন কী কব?”
— প্রশ্ন তো অবশ্যই হবি রে। হা ভগবান, তুই সব জান্তা। তুই ওঁকে বৈকুণ্ঠে ঠাঁই দিস। হামি দুটি প্রাণী অন্তর থিকে ওঁর জন্যে প্রার্থনা করচি। আজ ভোজন খাচ্ছি, কোনোদিন এমনটি খাতি পাইনিকো। সব তো ওঁর জন্যেই পাচ্চি। (Munshi Premchand)
একমুহূর্ত পরে মাধুর মনে একটু সংশয় ভর করল। বলল, বাপুজি, হামিও তো কোনোদিন উকানে যাতি হবেখন। তখন?
হাসু এমন শিশুসুলভ প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। মাধুর দিকে কেবল ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে একবার তাকায়। যদি সেদিন আমাদের ধরে বিধিয়া জিজ্ঞেস করে, আমায় তোমরা কাফন দিলি না ক্যান? তখন কী কব? (Munshi Premchand)
— কব তোর মুণ্ডুটা।
— পুচবে তো ঠিকই ।
— হাঁদারাম, তুই কী করে জানলি যে, ও কাফন পাবি না? হামাক বেকুফ মনে করচিস? হামি ষাট বচ্চার দুনিয়াতে বসে শুধু কি ঘাস কাটিচি? মনে রাখিস, তোর বউ কাফন তো পাবিই, এর চায়ে আরও ভালো কাফন পাবি। (Munshi Premchand)
“আঁধার যত বাড়ছে, তারার ঝলমলানির সাথে সাথে শুঁড়িখানার জৌলুসও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেউ গান গাচ্ছে, কেউ মাতলামি করছে, আবার কেউ তার বন্ধুর গলায় হেলে লুটিয়ে পড়ছে।”
মাধু বাপের কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলল, কে দিচ্চে কাফন? পয়সা তো তুমি সব উজার করি দিয়ে?
হাসু ধমকে উঠে বলল, আমি কচ্চি যে, এর চায়ে ভালো কাফন পাবি, তুই ওটা মানতি পারচিস না ক্যান?
— কে দিচ্চে, ওটা কলিই তো হয়?
— ওরাই দিচ্চে, যারা এবার দিয়ে। হাঁ, তবে সেই পয়সা হামাক হাতে আসপি না বটে। তবে যদি কোনোমতে আসতি পারে, তেইলে হাম ফের মদটদ খাইয়ে সব ফিনিশ করে দেবোখব। কাফনের জন্যে তালি পরে ফের পয়সা তুলতি হবিনে। (Munshi Premchand)
আঁধার যত বাড়ছে, তারার ঝলমলানির সাথে সাথে শুঁড়িখানার জৌলুসও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেউ গান গাচ্ছে, কেউ মাতলামি করছে, আবার কেউ তার বন্ধুর গলায় হেলে লুটিয়ে পড়ছে। আবার কেউ হয়তো তার প্রেয়সীর মুখে লোকমা তুলে দিচ্ছে। শুঁড়িখানার আবহে মাদকতা, বাতাসে নেশার গন্ধ। কেউ কেউ আসতে না আসতেই মাতাল হয়ে যায়। এখানে মানুষ আসেই নিজেকে ভুলে থাকার আস্বাদ নিতে। মদ্যপানের চেয়েও বেশি আনন্দ পায় মানুষ এখানকার উচ্ছল উন্মাতাল পরিবেশের গুণে। হতাশার বেদনাই এখানে টেনে নিয়ে আসে আর কিছুক্ষণের জন্য সে ভুলে যায়, সে কি জিন্দা না মুর্দা। নাকি বেঁচে আছে কবরের গুহায়। (Munshi Premchand)
“হাসু হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। নেশায় টালমাটাল হয়ে বলে, হাঁরে বেটা, ও তো অবশ্যি বৈকুণ্ঠে যাবি।”
এই দুই বাপবেটাও আনন্দ উল্লাস চরমভাবে উপভোগ করছে। এমনকি উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে বারবার। মানুষের নজর কাড়তেও সক্ষম হয়েছে তারা। সবাই ভাবছে, কী ভাগ্যবান তারা! পুরো বোতল নিয়ে বসেছে। (Munshi Premchand)
খাবার-দাবার শেষ হলে মাধু অবশিষ্ট লুচি আর প্লেটে জমে থাকা তেল উঠিয়ে এক ভিখিরিকে দান করে দেয়। ভিখিরিটা বহুক্ষণ যাবৎ বুভুক্ষের মতো তাদের দিকে তাকিয়েছিল। মদ্যপানের এই আনন্দ, নেশা আর উত্তেজনা জীবনে এই প্রথম তারা অনুভব করেছে। হাসু ভিখিরিকে বলল, যা, সব নিয়ে যা। বেশি করে আশীর্বাদ দিস। যার কামাই করা এই পয়সা, সে তো বেঁচে নেইকো। তাতে কি, তোর আশীর্বাদ ওঁর কাছে পৌঁছে যাবি ঠিক। খুপ কেঁদে কেঁদে তার তরে প্রার্থনা করিস। একদম নির্ভেজাল কাজের মজুরি নিয়ে কামাই করা পয়সা। বুঝেচিস।(Munshi Premchand)
মাধু আবার আকাশপানে চেয়ে বলল, ওঁ ঠিক বৈকুণ্ঠে যাবে গা। হতি পারে ও বৈকুণ্ঠের রানি হবি।
হাসু হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। নেশায় টালমাটাল হয়ে বলে, হাঁরে বেটা, ও তো অবশ্যি বৈকুণ্ঠে যাবি। ও না গেলি পরে যাবে কি এই মোটা মোটা ভুঁড়িরা, এরা তো গরিবকে দু’হাতে লুটেপুটে খায়, আর আপন বাপের পাপমোচনের জন্যে গঙ্গায় সাঁতার কাটে, মন্দিরে জল চড়ায়? (Munshi Premchand)
“মাধু বলল, কিন্তু, বাপুজি, বেচারি জীবনভর দুঃখেই ভুগি গিয়ে। মরলও বড়ো দুঃখ-কষ্ট সতি না পেরে।”
বিশ্বাসের এই খোশ রংও ছিল নেশার এক অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য। এর কারণেই দুঃখ হাওয়া হয়ে যায়।
মাধু বলল, কিন্তু, বাপুজি, বেচারি জীবনভর দুঃখেই ভুগি গিয়ে। মরলও বড়ো দুঃখ-কষ্ট সতি না পেরে। মাধু চোখে হাত রেখে কাঁন্না জুড়ে দিল।
হাসু সান্ত্বনার স্বরে বলল, কেন কাঁদচিস খামোকা। দুনিয়ার মায়াজাল থাকি ও মুক্ত হয়ে গিয়ে, বেশ। বড়ো জঞ্জাল ছে বাঁচে গিয়ে। ও তো বড়ো ভাগ্যবান, এত তাড়াতাড়ি মায়ার মোহ বন্ধন ছাড়ি চলে যাতি পারিচে। (Munshi Premchand)
এবার দুজনে সেখানে দাঁড়িয়ে গান গাইতে শুরু করে— দু চোখের মণিতে যা দেখা যায়, সবই হল ভেলকি।
শুঁড়িখানা জুড়ে চলছে আনন্দ, উল্লাস, বেহায়াপনা আর বেলেল্লপনার হুল্লোড়। এই দুই বাপবেটাও সেই হুল্লোড়ে গাইতে থাকে মনে যা আসে সেই গান। একসময় দুজনেই উঠে নাচতে শুরু করে। হেলে দুলে, টালমাটাল হয়ে। এদিকে-সেদিকে ঢুলে ঢলে বেসামাল হয়ে। বোতলের সবটুকু মদ গলায় ঢেলে দিয়ে পরিশেষে মাতলামির চূড়ায় উঠে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না নিজেদের। সেখানেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায়। মরেই গেছে হয়তো। (Munshi Premchand)
কাফনের কাপড় এবার আর একটায় সামাল দিতে পারবে না গাঁয়ের মানুষ। তিনটেই জোগাতে হবে।
(বানান অপরিবর্তিত)
মুন্সি প্রেমচাঁদ আধুনিক হিন্দি এবং উর্দু ভাষার অন্যতম সফল লেখক। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য সাহিত্যিক এবং বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগামী লেখক।