[১]
‘স্ট্রেঞ্জ! মানুষকে বোঝা যায় না।’’
সুব্রত বললেন – ‘‘পটকা তো মরেই গেছে। তোর আর বোঝাবুঝির কী আছে?” (Story)
–না, তা নয়। তবে অবাক হয়েছি কেন জানিস? সেবার দীপংকর এসে ওর জাহাজের চাকরিতে বউ ছেলে মেয়েকে মাসের পর মাস ছেড়ে থাকতে হয় বলে, কত দুঃখ করে গেল। অথচ তখন ও অলরেডি কলকাতার এক মহিলার সঙ্গে ইনভলভড। হি ওয়াজ লিডিং আ সিক্রেট প্যারালাল লাইফ।”
হঠাৎ খেয়াল হতে অজয় অভীক’কে হেসে বললেন– “সরি, কফি খেতে ডেকে বাজে গল্প শুরু করেছি। আসলে আমাদের এই মধ্যবয়সে একস্ট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্সের কথা শুনলে একটু অবাক লাগে। এত রেসপন্সিবিলিটি, প্রি-অকুপেশন, ছেলে-মেয়েদের মানুষ করার স্বপ্ন। এর পাশাপাশি আর একটা লুকোনো জীবন? কী জানি?
রিলেশনশিপের মধ্যে ভালোবাসা যদি না থাকে, লয়্যালিটি যদি না থাকে, সে কেমন বিবাহিত সম্পর্ক?”
অভীক ভাবছিল কথাটার উত্তর দেবে কী না। তার আগেই সুব্রত জিজ্ঞেস করলেন– “দীপংকরের এসব খবর তুই পেলি কোত্থেকে?”

–গতবার বম্বে গিয়ে পীযুষের কাছে শুনলাম। দীপংকর নিজেই ওকে বলেছিল। বেশ ক’বছর ধরে কলকাতার এক গানের আর্টিস্টের সঙ্গে ইনভলভড। যখন ছুটিতে আসত তাকে নিয়ে রিসোর্টে বেড়াতে যেত। বম্বের কোন হোটেলে হঠাৎ পীযুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে দীপংকর, সে মহিলার সঙ্গে ইন্ট্রোডিউসও করিয়ে দিয়েছিল। বোধহয় তারপরে পীযুষকে সব কথা বলেছিল। অভীক জিজ্ঞেস করল– “হাউ অ্যাাবাউট হিজ ফ্যামিলি? এত বছরে তারা কিছু জানতে পারেনি?”
ইন্দ্রাণী কফির ট্রে নিয়ে বাইরে এলেন। মিলনীর হাতে এক প্লেট পেস্ট্রি। অস্মিতা গেছে কাছাকাছি ভারতীয় দোকানে পোস্ত আর হাতে গড়া রুটি কিনতে। ইন্দ্রাণী অভীকের শেষ কথাটা শুনতে পেয়ে বললেন– “না, ফ্যামিলি তো সব শেষে জানতে পারে। জানলেও বিশ্বাস করতে চায় না।”
অজয় কফির কাপ তুলে নিয়ে বললেন– “পীযুষ যা বলল, লেটলি দীপংকরের বউ আর বড় মেয়ে বেশ অশান্তি শুরু করেছিল। অন্যদিকে সেই মিসট্রেসও নাকি ওকে বিয়ে করার জন্যে চাপ দিচ্ছিল। কে জানে? এত স্ট্রেসড-আউট হয়েই বোধ হয় মারা গেল।”
অভীক জিজ্ঞেস করল– “সেই গানের আর্টিস্টের নাম জানেন? বড় গাইয়ে নাকি?”
ইন্দ্রাণী বললেন– “না, না। আমরা তো নামও শুনিনি। কিন্ত সে নাকি এমন গাইয়ে, দীপংকরকে সারা রাত গান শোনাত।” অজয় বললেন– “পিয়ালী না মহুয়া। ঠিক মনে পড়ছে না।”
অস্মিতার গলার আওয়াজ পেয়ে অভীক বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। ইন্দ্রাণী বললেন– “আগে কফিটা শেষ করো। সঙ্গে একটা পেস্ট্রি খাও।” “অস্মিতা, তোমার কফিও এখানে দিয়েছি।” অস্মিতা বললেন– “আর বসব না ইন্দ্রাণীদি। বাচ্চারা টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছে। আমার কফি পেপার কাপ-এ নিয়ে নিচ্ছি। গাড়ি তো অভীক চালাবে। ঠিক আছে, দুটো পেস্ট্রিও নিয়ে যাচ্ছি।”
–অস্মিতা রান্নাঘর থেকে পেপার কাপ এনে কফি ঢালতে ঢালতে খুব হাসছিল।
অভীক ও হাসল– “আর তোমার কী কী নেওয়া বাকি থাকল? লাউ, কুমড়ো নেওয়ার নাম করে ঢুকেছিলে।”
অভীকদের সঙ্গে সুব্রত, মীনাক্ষী ও ড্রাইভ ওয়েতে গিয়ে নিজেদের গাড়িতে উঠলেন। ওমি, শমির ঘুম পেয়ে গেছে। অস্মিতা বলল– “বেশ রাত হয়ে গেল। কাল সকালে আবার ওমির সকার প্র্যাকটিস। তুমি উঠতে পারবে, না আমি নিয়ে যাব?”
অভীক অন্যমনস্কের মতো বলল– “আমাকে ডেকে দিও। আমি নিয়ে যাব।”
বাড়ি পৌঁছোতে রাত দশটা বাজল। ওমি, শমিকে ঘুমোতে পাঠিয়ে অস্মিতা স্নান সেরে নিল। অভীক ততক্ষণে অন্য বাথরুমটায় ঢুকেছে। শাওয়ারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
অস্মিতা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিল কাল সকাল থেকে কী কী করার আছে। ওমির সকার প্র্যাকটিস, ক্যারাটে লেসন, শমির নাচের স্কুল, সন্ধ্যেবেলায় চুমকিদের বাড়ি গেট-টুগেদার। এখনও গিফট প্যাক করা হয়নি।
অভীক স্নান সেরে এসে বলল– “তুমি শুয়ে পড়ো। আমি একটু নিউজ শুনে আসি।”
অস্মিতা হাই তুলল– “অনেক রাত হল। কাল আবার সকালে ওঠা। তোমার টায়ার্ড লাগছে না?”
“বেশি দেরি করব না। জাস্ট এগারটার নিউজটা শুনে আসছি। কাল আটটায় ডেকে দিও।”
অস্মিতার ক্লান্ত লাগছিল। সারাদিন ছুটোছুটি করে পায়ে ব্যথা করছে। টাগ-অফ-ওয়ারের সময় যা পড়া পড়েছে।
কোত্থেকে যে একটা পচা দড়ি এনেছিল! পা’টা মচকেছে কী না কে জানে? অভীক ঘরে এসে দেখল অস্মিতা তখনও জেগে। বেড-সাইড ল্যাম্প জ্বেলে পায়ের অ্যাঙ্কেল পরীক্ষা করছে।
“কী হল? পায়ে লেগেছে নাকি? সারাদিনে বোধহয় কোনও রেস বাদ দাওনি?”
অস্মিতা কাতর হল– বেশ ব্যথা করছে। দেখো তো একটু ফুলেছে না?”
অভীক ওর পায়ে হাত রাখল– “একটু ফুলেছে মনে হচ্ছে। বেন-গে লাগিয়ে দিচ্ছি। সঙ্গে দুটো অ্যাডভিন খাও।
অস্মিতার পায়ে ওষুধ লাগিয়ে, পেইন কিলার দেওয়ার খানিকক্ষণ পরেও ওর ঘুম আসছিল না। অভীককে বলল– “তুমি ঘুমোও না। উঃ কাল আবার সকাল থেকে পর্ব শুরু হবে। বাচ্চাদের এক্সট্রা কারিক্যুলার অ্যাকটিভিস করাতে গিয়ে উইক-এন্ডেও বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে পারি না। অভীক ওর পিঠে হাত রাখল— “বকবক বন্ধ করে ঘুমোতে চেষ্টা করো। উইক্-ডে তে আমরা রাত পর্যন্ত মুভি দেখি না? পরদিন ভোরে উঠে অফিস যাই। ওমিকে সকারে নিয়ে যাওয়া কি বিগ ডিল? এই বয়সে না পারলে আর কবে পারব?”
সে রাতে অস্মিতা ঘুমিয়ে পড়ার পরেও অভীক কতক্ষণ জেগে রইল। অজয়দার শেষ কথাটা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। নামটা পিয়ালী না মহুয়া ওঁর মনে পড়ছিল না।
অস্মিতা কিছু শোনেনি। তাহলে বাড়ি ফিরে জিজ্ঞেস করতো ওমি, শমির সামনে এসব কথা হয় না। অস্মিতা চায় না এখন ওদের কাছে অপুর কথা বলা হোক। ওর মনে হয়, কলকাতায় ওদের একজন স্টেপ ব্রাদার আছে শুনলে ওমি, শমি মনে খুব কষ্ট পাবে। হয়তো বাবার ওপর রাগ হবে, অভিমান হবে। লুকিয়ে রাখার কিছু নেই। তবু আরও কিছুদিন যাক।

অভীক বোঝে ওদের চারজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাঝে অপুর জন্যে কোথাও এতটুকু জায়গা নেই। অথচ মহুয়ার সঙ্গে অভীকের কয়েকটা বছরের তিক্ততার স্মৃতি, অপুকে ফিরিয়ে আনার জন্যে কোর্টে কাস্টডি ফাইট, সবই তো অস্মিতা জানে। অভীক এতবছর ধরে অপুর জন্যে চাইল্ড-সাপোর্টের টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছে, অস্মিতা সে নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। কলকাতায় গিয়ে অভীক যখন অপুর সঙ্গে দেখা করে, অস্মিতা ওঁর খবর নেয়। তবু নিজে থেকে কখনও অপুকে দেখতে চায় না। অভীক ওকে সঙ্গে যাওয়ার কথা বললে, অস্মিতা বোঝাতে চেষ্টা করে, আমি ওমি, শমির কাছে মিথ্যে কথা বলে বেরোতে পারবো না। তুমি ছেলের সঙ্গে নিজের মতো করে সময় কাটাও। সে তোমাকে সারাবছর দেখতে পায় না। মনের ইচ্ছে, অনিচ্ছের কথা বলতে পারে না। আই থিঙ্ক্ হি নিডস্ ইয়োর ইমোশন্যাল সাপোর্ট অ্যান্ড সাম্ প্রাইভেসি। মাঝে মাঝে অভীকের সন্দেহ হয়, অস্মিতা মন থেকে কথাগুলো বলে তো? নাকি এখনও নিজেকে একজন টিন-এজার ছেলের স্টেপ মাদার বলে ভাবতে পারে না। কিন্তু আজ অজয়দার কাছে ঘটনাটা শোনার পর থেকে মন এত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। অপুর জন্যে এবার ডিসিশন নেওয়া দরকার। কলকাতায় দাদাকে ফোন করে দেখতে হবে। কিন্তু অস্মিতাকে আগে না জানিয়ে অভীক কিছু করতে চায় না। ও সেরকম জেদি, স্বার্থপর নয়। আজ হোক, কাল হোক, একদিন যে অভীক ছেলেকে এদেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে, অস্মিতা তা ভালোভাবেই জানে। আজ আর ওর বাধা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। শুধু ওকে একটু সময় দেওয়া দরকার। ওমি, শমিকে বোঝানোর দায় তো একা অস্মিতার নয়। অভীক কি নিজেই ওদের বলবে? ছয় আর আট বছরের দুটো ছেলে মেয়েকে কতটুকু বলা যায়? ওদের ছোট্ট জীবনে ড্যাড মানে এক অখণ্ড অধিকার। ওরা কি অপুর কথা শুনতে চাইবে? বিশ্বাস করতে পারবে? বাবার ওপরে ও কি বিশ্বাস হারাবে? ওমি, শমীর সেই বিস্মিত ব্যথাহত মুখ, ভাবতেই নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল।
ভোরের আলোয় ঘরের অস্পষ্ট অন্ধকার কেটে যেতে অভীক নীচে নেমে এল। টিভি খুললে কিছু দেখার নেই। টেবিলে ম্যাগাজিন, গতকালের না পড়া খবরের কাগজ পড়ে আছে। অভীক ছুঁয়ে দেখল না। এত অশান্ত মন নিয়ে কোনও কিছু ঠিক মতো চিন্তা করতে পারছিল না। ইচ্ছে হচ্ছিল তাড়াতাড়ি সকাল হোক। সবাই ওকে ঘিরে বসুক। ছেলেমেয়েকে ও নিজেই জানাবে।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে অস্মিতা নেমে এসে বলল– “এত সকালে উঠে পড়লে?”
অভীক এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল– “পায়ের ব্যথা কমেছে?”
অস্মিতা মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চা করতে চলে গেল। ফিরে এসে দেখল অভীক একভাবে সোফায় শুয়ে আছে। টিভিতে সকালের খবর, আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারের ওঠা নামার খবর, কিছুই দেখছে না। টেবিলে চা রেখে অস্মিতা পাশে বসল– “তোমার কি শরীর খারাপ? নাকি আবার ঘুমের প্রবলেম হচ্ছে?”
অভীক উঠে বসল– “নাঃ শরীর ঠিক আছে।”
“মন ভালো নেই বোধহয়?”
অভীক চমকে উঠল– “কী করে বুঝলে?”
“জানি না। কাল থেকেই তোমাকে একটু ডিস্টার্বড মনে হচ্ছিল। কী হয়েছে বল তো?”
“কাল কেন জিজ্ঞেস করলে না?”
“পায়ের ব্যথার জ্বালায় ভুলে গিয়েছিলাম। এনি ওয়ে, তুমি কি কোনও কারণে বেশি চিন্তা করছ? অফিসের প্রবলেম?”
অভীক মাথা নাড়ল– “সে সবকিছু নয়। অস্মিতা এবার মনে হয় আমাদের একটা ডিসিশন নিতে হবে। আর দেরি করা যাবে না।”
অস্মিতা জানতে চাইল– “কীসের ডিসিশন?”
“ওমি, শমীকে এবার অপুর কথা বলে দেওয়া দরকার। এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা ঠিক নয়।”
অস্মিতার মুখ বিবর্ণ দেখাল– “এখনই বলে দেবে? বাচ্চাদুটোর কী রিয়্যাকশন হবে ভাবতে পারছ? দে উইল বি ডেভ্যাসটেটেড।”
“জানি। আমার নিজেরও কি কষ্ট হচ্ছে না? তবু সত্যি কথা জানিয়ে দেওয়া ভাল। পরে জানলে আরও হার্ট হবে। আমরা দিনের পর দিন ওদের মিথ্যে বলেছি। হয়তো সেই কারণে আমাদের আর বিশ্বাস করতে চাইবে না। রেস্পেক্ট করবে না। অস্মিতা, যা বলছি বোঝার চেষ্টা করো। এমন তো নয়, ওরা স্কুলে কোনও ডিভোর্সড পেরেন্টদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে মেশে না। কারোর স্টেপ সিবলিং থাকে, তাও হয়তো জানে। আমি ওদের অপুর কথা বোঝাতে পারব!”

অভীকের কথার মধ্যে যুক্তি ছিল। অস্মিতা বুঝতে পারছিল মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। শুধু বলল– “কয়েকদিন সময় দাও। আমি ওদের স্কুল সাইকোলজিস্টের সঙ্গে দেখা করি। আমি জানি ওদের কাউনসেলিং এর দরকার হবে। শুধু আমরা দুজনে হ্যান্ডল করতে পারব না অভীক! তোমাকে ওরা অন্য কারোর সঙ্গে শেয়ার করার কথা ভাবতেও পারে না। ফ্যামিলিতে যে এরকম হতে পারে, সেটা কমপ্যাশনেটলি বোঝানোর জন্যেও কাউনসেলারের হেল্প দরকার।”
অস্মিতা কাঁদছিল। অভীক ওকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করল– “ওরা কত ছোট অস্মি! অপুর কি সেই বয়স আছে যে ওদের সঙ্গে বাবার আদর ভালোবাসা নিয়ে ঝগড়া করবে? ওকে তো ছোটবেলায় কাছেই পেলাম না। নতুন করে আর কিই বা আশা করবে?”
“তুমি কি ওকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছ? ওর মা আসতে দেবে?”
ওমি, শমীর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অভীকের গলার স্বর নিচু হল– “পরে সব বলছি। এমন একটা সিচুয়েশন হয়েছে, ওকে আর দেশে ফেলে রাখতে চাই না।”
ওমি “হাই ড্যাড” বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। শমী বাবার গা ঘেঁষে সোফায় বসতে আসছিল। হঠাৎ অস্মিতাকে দেখে কাছে এল– “ হোয়াট হ্যাপন্ড মাম? ডিড ইউ ক্রাই? ইজ ইয়োর অ্যাংকল স্টিল হার্টিং?”
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্মিতা কোনও উত্তর খুঁজে পেল না। কলকাতায় ক’দিন একটানা অসহ্য গুমোটের পর শুক্রবার বিকেল থেকে প্রবল বৃষ্টি নেমেছে। জলকাদা যানজটে শহর বিপর্যস্ত। হোস্টেল থেকে বাড়ি আসার পথে অপু বাস থেকে নেমে রীতিমতো ভিজে গেল।
মহুয়া নামল আরও পরে। ছাতা খুলে ছেলেকে ডাকতে ডাকতে অপু প্রায় দৌড়ে দৌড়ে মিমিদের গাড়ি বারান্দার নিচে পৌঁছে গেছে। মহুয়া ছাতা মাথায় দিয়ে জোরে জোরে হাঁটছে। দমকা হাওয়ায় ছাতা প্রায় উলটে যাওয়ার অবস্থা। কাছাকাছি এসে বলল – “ঠিক সময় বুঝে নামল। ফেরার পথে একটা ট্যাক্সিও পেলাম না।”
অপু তখন দোতলার গাড়ি বারান্দার পাশের জানলা থেকে মিমির গলা শুনছিল– “আজ হঠাৎ চলে এলি?” মহুয়াকে দেখতে পেয়ে মিমি জানলা থেকে সরে গেল। ছেলের হাতে ছাতা ধরিয়ে মহুয়া ব্যাগ থেকে ফ্ল্যাটের চাবি বের করে ভেতরে ঢুকল। অপু ভেজা ছাতা ছোট বারান্দায় রেখে চুপচাপ জুতো খুলল। মা যে কেন আজ হোস্টেলে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে, স্পেশ্যাল পারমিশন করিয়ে পরীক্ষার মুখে ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে, অপু অনেকটাই অনুমান করতে পারছে। গত কয়েক মাস ধরে মার মন মেজাজ ভাল নেই। আংকল মারা গেছে বলে এত কষ্ট? অপু তো সেই দিনগুলোর কথা ভাবতেও চায় না।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে বৃষ্টি ধরে এল। মহুয়া খিচুড়ি ডিমভাজা তৈরি করে ছেলেকে নিয়ে খেতে বসল। বাড়ি ফিরে পর্যন্ত দুজনের মধ্যে বিশেষ কথা হয়নি। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত বুঝে অপু মিমিকে ফোন করেছিল। জানিয়ে দিয়েছে কাল কোথায় ওরা দেখা করবে। মিমিদের বাড়ির লোকজন মহুয়াদের পছন্দ করে না। বড় হওয়ার পরে কারণটাও ওরা বুঝেছিল। অপু হোস্টেলে চলে যাওয়ার পরে দেখাশোনা কমে গেছে। ফোনে কথা হয়। ছোটবেলা থেকে ওর অনেক নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ মুহূর্তের সঙ্গী মিমিকে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার কথাগুলো বলা যায়। এবার একবার দেখা হওয়া দরকার। অপু বুঝতে পারছে মা বাবার মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে।
অলংকরণ – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।