(Story)
বাড়ির যে গেস্টরুমে বহুবছর আগে আমেরিকান দার্শনিক ও লেখক হেনরি ডেভিড থরো সপরিবারে এসে থাকতেন, মেয়েটি আমাদের সেখানেও নিয়ে গেল। দেখলাম চেয়ারে বসে একজন আমেরিকান পুরুষ ফোনে কথা বলছে। মেয়েটি এই ঘরের ঐতিহাসিক মূল্য–টুল্য বোঝাতে চাইলেও, লক্ষ্য করলাম পুরোনো চেস্ট– অফ– ড্রয়ারের মাথায় এ যুগের কিছু দরকারি জিনিসপত্র রাখা আছে। লোকটি আমাদের ‘হ্যালো’ বলে বেরিয়ে যাওয়ার পরে মেয়েটি হেসে বলল— “হেনরি ডেভিড থরোর স্মৃতি ঘেরা এই ঘরে এখন আমি থাকি। মিউজিয়ামের কেয়ার টেকার হিসাবে এখন এটাই আমার বাড়িঘর।” (Story)
আরও পড়ুন: স্মৃতি ভবন ও জীবন: প্রথম পর্ব
বিকেল হয়ে আসছে। পাঁচটায় মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার আগে আমরা একটা কাচের বয়ামে টিপস হিসেবে কুড়ি ডলার রেখে বেরিয়ে আসছিলাম। মেয়েটি হঠাৎ বলল— “ক্যান ইউ প্লিজ স্টে ফর আ হোয়াইল?” তারপর বাকি ট্যুরিস্টদের বিদায় জানিয়ে বাবার কাছে এসে দাঁড়াল। সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করল— “আমাকে আপনার মনে আছে স্যার? ফিলসফি অনার্সের সুজয়া। সুজয়া মিত্র।” (Story)
বাবা মাথা নাড়লেন— দেখে চেনা মনে হয়েছিল। নামটা মনে পড়ছিল না। তুমি তো পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করে কোথায় পড়াতে গিয়েছিয়ে না?

“হ্যাঁ, বাঁকুড়ায় চাকরি পেয়েছিলাম।”
“তারপর এদেশে এলে কবে?”
বাবার কথাবার্তায় দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে একটু তাড়া দিতে হল— “মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাবা। আমাদের এবার ফিরতে হবে।” (Story)
সুজয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ল— আপনারা কোথায় ফিরবেন? বস্টনে? একটু সময় থাকলে আমার ঘরে বসে কফি খেয়ে যান না? আমার ওয়ার্ক আওয়ার শেষ। কত বছর পরে ডঃ গোস্বামীর সঙ্গে দেখা হল। প্রথমে চিনতে একটু সময় লেগেছিল। মানে, এত বছর পরে ঠিক এখানে আপনাকে দেখব— “ওর কথার মাঝখানে বাবা বললেন, সে তো হতেই পারে, কিন্তু আমাদের কী আর বসার সময় হবে?” আমি সুবীরকে জিজ্ঞেস করলাম “তাহলে আধঘণ্টা পরে স্টার্ট করি? বাবার একটু কফি ব্রেক হয়ে যাবে।” (Story)

সুবীর বলল— “ঠিক আছে। আমারও একটু কফি পেলে মন্দ হয় না।”
সুজয়া “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! ভেতরে চলুন” বলতে বলতে আমাদের একটা ছোট বসার ঘরে নিয়ে গেল। বাড়ির মেইন দরজা বন্ধ করে গ্যারাজ সংলগ্ন ছোট রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। তারমানে কেয়ারটেকার হিসেবে প্রধান বাড়ির বড় কিচেনে নয়। এই ছোট্ট কিচেন কাম্ ডাইনিং রুমে ও রান্না খাওয়া সারে। তারপর এই নির্জনে এত বড় বাড়িটার গেস্ট রুমে রাত কাটায়। কোথায় কলকাতা, কোথায় বাঁকুড়া, ভাসতে ভাসতে এত দূরে চলে এসেছে? (Story)
সুবীর বাবার কথায় সায় দিল, “ঠিকই তো লোকজনের ব্যাপারে আপনার কৌতুহল কম। তার ওপর সকাল থেকে থরো আর এমারসনের তীর্থস্থানে ঘুরছেন। আসলে নীপাই এখন একটা স্টোরি লাইন খোঁজার চেষ্টা করছে।”
বাবার মনেও বোধহয় এসব প্রশ্ন জেগেছে। সুজয়া ঘরে আসার আগে বাবাকে নিচু গলায় সতর্ক করলাম, “তুমি ওকে বেশি পার্সোনাল কথা জিজ্ঞেস করো না।”
বাবা যেন বিরক্ত হলেন “পুরোনো ছাত্রীকে পড়াশোনার কথা ছাড়া কীই বা জিজ্ঞেস করব?” (Story)
সুবীর বাবার কথায় সায় দিল, “ঠিকই তো লোকজনের ব্যাপারে আপনার কৌতুহল কম। তার ওপর সকাল থেকে থরো আর এমারসনের তীর্থস্থানে ঘুরছেন। আসলে নীপাই এখন একটা স্টোরি লাইন খোঁজার চেষ্টা করছে।”
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু সিকিউরিটির ব্যবস্থা কি? তুমি একা মেয়ে, এই নির্জন পাড়ায় থাকো। রাতে ভয় টয় নেই তো?”
আমি সুবীরকে কিছু বলার আগেই সুজয়া কফির ট্রে নিয়ে ঘরে এল। টেবিলের উপর ট্রে রাখতে রাখতে বলল “সরি, ক্র্যাকার আর বাদাম ছাড়া কিছু দিতে পারলাম না।” (Story)
বাবা বললেন “দুপুরের লাঞ্চ এখনও হজম হয়নি, এখন কফি ছাড়া কিছু নয়।”
আমার ওয়ার্নিং শুনে বাবা সুজয়াকে যে ঠিক কী জিজ্ঞেস করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কফির মগ হাতে নিয়ে বললেন, “তুমি কি এদেশে ডক্টরেট করেছ? কোন ইউনিভার্সিটিতে?” (Story)
আরও পড়ুন: লক্ষ্মীবারে পক্ষী ভোজন
সুজয়া মাথা নাড়ল, “পি এইছ ডি করতে আসিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর দাদা স্পনসর করে নিয়ে এসেছিলেন। হিউষ্টনে ট্র্যাভেল এজেন্সিতে চাকরি করতাম। তারপর ঘুরতে ঘুরতে বস্টনে। পী-বডি মিউজিয়ামে পার্টটাইম কাজ পেয়েছিলাম। কিছুদিন করেছি। কিউরেটরের চাকরির জন্যে যা কোয়ালিফিকেশন দরকার, সে সব তো আমার নেই। মাঝে কয়েকটা কোর্স নিয়েছেলাম। কমপ্লিট করতে পারিনি।”
আমি বললাম, “এ কাজটা নিশ্চয়ই ভাল লাগছে? নয়তো শহর ছেড়ে এখানে থাকবেন কেন?”
সুজয়া হাসল, “ইন এ ওয়ে, ইউ আর রাইট। কেয়ার টেকার হিসেবে কাজের চাপ তো খুব নেই, শুধু ক্লিনিং-এর কাজটা সন্ধ্যের পরে শুরু করতে হয়। আমিই দারোয়ান, ক্লিনিং লেডি, সব কিছু। তাও একজনের হেল্প পাই।” (Story)

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু সিকিউরিটির ব্যবস্থা কি? তুমি একা মেয়ে, এই নির্জন পাড়ায় থাকো। রাতে ভয় টয় নেই তো?”
দরজা দিয়ে সেই আমেরিকান লোকটি ঘরে এল। আমাদের দেখে একটু হেসে সুবীরের দিকে হাত করে বলল, “হাই, আয় অ্যাম শন।”
সুজয়া পরিচয় করাল, “হি ইজ্ দ্য ল্যান্ড স্কেপার অফ্ দিস প্রপার্টি, অ্যান্ড মাই ফ্রেন্ড। শন্, মিট মাই কলেজ প্রফেসর ডঃ গোস্ওয়ামি আন্ড হিজ্ ফ্যামিলি।”
সুবীরের সঙ্গে আলাপ করার পর শন্ বাবার কাছে এগিয়ে এসে হাত বাড়াল। বাবা ইতঃস্তত ভাবে ‘হাউ আর ইউ’ বলে চুপ করে গেলেন। (Story)
“সুজয়া যেন শনের শেষ কথাটায় একটু অস্বস্তি বোধ করল। ‘বন্ধু আর কমপ্যানিয়ন’ শব্দ দুটোর পার্থক্য বাবা কী বুঝলেন জানি না।”
কফি নিয়ে বসে শন্ জিজ্ঞেস করল ‘আমরা কোথা থেকে এসেছি। সুজয়ার সঙ্গে এদেশে আগে কখনও দেখা হয়েছিল কী না, এই সব মামুলি প্রশ্ন। বাবার বোধহয় ওর উচ্চারণ বুঝতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। আমরাই কথাবার্তা বলছিলাম। শন্ কথায় কথায় জানাল এই মিউজিয়াম সংলগ্ন জমি, বাগান দেখাশোনার জন্য কন্ট্র্যাক্ট পেয়ে এসেছে। ল্যান্ড স্কেপিং ওদের পারিবারিক ব্যাবসা। কাছাকাছি আরও কয়েকটা পুরোনো বাড়ির বাগান দেখাশোনার কাজও করছে। শীতকালে বরফ পরিস্কার করার কন্ট্র্যাক্ট নেয়। দু’একজন লোক নিয়ে সারা বছর এই ব্যবসা চালায়। (Story)

সুবীর জিজ্ঞেস করল, “তোমরা বোধহয় নিউ ইংল্যান্ডের এই অঞ্চলেরই লোক?”
শন্ উত্তর দিল, “হ্যাঁ, প্রায় কয়েক জেনারেশান ধরে কাছাকাছি শহর গুলোতেই আত্মীয় স্বজনরা রয়েছে। আমি উইক্ এন্ডে কুইন্সি শহরে বাবা, মা’র কাছে ঘুরে আসি। সারা সপ্তাহ এবাড়িতে সুজির সঙ্গে থাকি, অ্যাজ হার কম্প্যানিয়ন।” (Story)
সুজয়া যেন শনের শেষ কথাটায় একটু অস্বস্তি বোধ করল। ‘বন্ধু আর কমপ্যানিয়ন’ শব্দ দুটোর পার্থক্য বাবা কী বুঝলেন জানি না। আমরা আর কথা না বাড়িয়ে এখান থেকে ফেরার জন্যে উঠে পড়লাম। এক ঘণ্টার আলাপে কে আর সুজয়ার জীবন যাপন নিয়ে মাথা ঘামায়? (Story)
চলে আসার সময় সুজয়া বলল, “অদ্ভুতভাবে আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি যে প্রথমে স্যারকে ঠিক চিনতে পারিনি তা নয়। কিন্তু ট্যুরের মাঝখানে লোকজনের সামনে ব্রেক নিতে পারিনি। মিউজিয়াম বন্ধ করার সময় হয়ে যাচ্ছিল” (Story)
বললাম, “এটা আপনার প্রফেশন। আমরা কিছু মনে করিনি। তা ও তো একটু বসলাম। কফি খাওয়া হল।” সুজয়া আন্তরিক ভাবেই বলল। এই ছোট্ট মিউজিয়াম দেখতে কেউ তো দ্বিতীয়বার আসে না। তাই আবার আসবেন, সে কথাটাও বলতে পারছি না। তাছাড়া চাকরিটাও কতদিন থাকবে জানি না। (Story)
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।