সংক্রান্তি পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। শীতও, এই শেষবেলায় ভোররাতে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে শুধু। নতুন ধান সমাদরে ঘরে তুলতে যে আয়োজন ছিল, সেই উৎসবের অংশ, উঠোনের আলপনার ছোঁয়াটুকু রয়ে গেছে, মড়াই-এর ধানের বিনুনিও একদিকে এখনও দেখা যাচ্ছে। ঘরের আনাচে কানাচে যে ধান-লক্ষ্মীর চিহ্ন, ‘বাউনি’— সবকিছুই শীতবুড়ির স্মৃতিদাগের মতো কিছু কিছু রয়ে গেছে।
তাই কুলুঙ্গি থেকে কিছুটা থেকে যাওয়া চালের গুঁড়ো, আর নারকেল দড়ি দিয়ে ঝোলানো গুড়ের হাঁড়ি পেড়ে কোনও এক শনি-রবিবারে সবাই মিলে হাত মিলিয়ে শীত-বিদায়ী কিছু পিঠে (Pithe) বানিয়ে ফেলা যেতে পারে। যা দিদা, ঠাকুমা থেকে শুরু করে মা-কাকিমা, এমনকি কাকুদের থেকেও শেখা…

পিঠে (Pithe) শুধু এপার আর ওপার বাংলাতেই নয়, অন্য নানা রাজ্যেও প্রিয় খাবার..
আজ তুলে আনলাম অসমের মাঘ বিহু বা ভোগালি বিহুর আয়োজনের অন্যতম অংশ ‘তিল পিঠে’। এই পিঠের স্বাদ একদম অনন্য। কালো তিলের সুগন্ধ, নারকেল আর গুড়ের মিশেল আর বোরা চালের নরম তুলতুলে ওপরের প্রলেপ— সব মিলিয়ে পাটিসাপটার কাছাকাছি দেখতে হলেও স্বাদে-গন্ধে পাটিসাপটার থেকে অনেকটাই আলাদা।
আরও পড়ুন: ভিনদেশি কেকের রেসিপিতে নতুন বছর জমজমাট
বিহারের সংক্রান্তিতে ঘরে ঘরে জনপ্রিয় ‘ডাল পিঠে’। নোনতা পিঠের মধ্যে এ এক আলাদা মাত্রা দেয়। সঙ্গে ধনেপাতার চাটনি আর একটু লংকা; স্বাদ ফিরিয়ে দেবে অরুচিতেও।
ওপার বাংলার ‘মুগ পাকন পিঠা’। একাধারে মুচমুচে আর পরতে পরতে মিষ্টির ছোঁয়া, আর ওপার বাংলার মানুষের নকশা করা হাতের কাজ— কেবল একটা খেয়ে থাকা যায় না মোটেই…
সঙ্গে রয়েছে এপারের ‘ভাজা মুগ ডালের পিঠে’র নোনতা ভার্সান। শীতকাল এলে অন্তত একবার মটরশুঁটির পুর দিয়ে পিঠে না করলে হয় নাকি!

তিল পিঠে
উপকরণ- বেশি স্টার্চ আছে এমন চাল -২ কাপ
( আসামে বোরা সাউল ব্যবহার হয়, এখানে বিন্নি ধান কিংবা নতুন গোবিন্দভোগ ব্যবহার করা যেতে পারে)
১৫০ গ্রাম খেজুর গুড়ের পাটালি ভেঙে গুঁড়ো করে রাখা
১০০ গ্রাম কালো তিল ঝেড়ে বেছে রাখা
আধ কাপ নারকেল কোরা
১ চা চামচ করে মৌরি আর এলাচ গুঁড়ো করে রাখা
কালো তিল, সুন্দর গন্ধ বেরোনো পর্যন্ত ৫-৬ মিনিট ভেজে, তুলে হালকা করে গুঁড়ো করতে হবে, হামানদিস্তা কিম্বা মিক্সারে। খুব মিহি হবে না। এতে নারকেল, গুড়, এলাচ, মৌরি মিশিয়ে তৈরি হবে পুর।
এবারে রেডিমেড চালগুঁড়ো পেলে ভালো। নইলে দু’কাপ চালকে চার কাপ জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে ঘণ্টা চারেক, তারপর একদম ভালো করে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। সেই চাল মিক্সারে গুঁড়ো করে আরও ঘণ্টা তিন-চার হালকা ভিজে কাপড় চাপা দিয়ে রাখতে হবে। সব রেডি হলে, একটা লোহার তাওয়া গরম করে, তাতে হাতে করে এক মুঠো চালগুঁড়ো নিয়ে গোল করে পাতলা লেয়ার করে দিতে হবে। স্টিকি রাইসের গুঁড়ো ৫/৬ সেকেন্ড আঁচে থাকলেই রেডি। একটা কাপড়ে করে হালকা হাতে চেপে চেপে দিয়ে, একটা ধার দিয়ে তিলের পুর দিয়ে রোল করে নিলেই রেডি অসাধারণ স্বাদের তিল পিঠে।
গুঁড়ো চাল দিয়ে অসুবিধে হলে চালগুঁড়ো গুলে নিয়ে পাটিসাপটার মতো করেও এ পিঠে করে নেওয়া যায়।

ডাল পিঠে
উপকরণ-
১ কাপ চাল গুঁড়ো
১ চা চামচ তেল
এক চিমটে নুন
চালগুঁড়ো মাখার জন্যে গরম জল
পুরের জন্যে-
ছোলার ডাল ৩/৪ কাপ, তিন চার ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা
লংকা ২/৩ টে
রসুন ৩ কোয়া
আদা ১ ইঞ্চি
নুন গোলমরিচ স্বাদমতো
ধনেপাতা মিহি কুচি
ছোলার ডাল মিক্সারে বেটে নিয়ে, একটা প্যানে তেল গরম করে তাতে জিরে ফোড়ন দিয়ে একে একে রসুন কুচি, আদা কুচি, ভিজিয়ে রাখা ডাল বাটা, নু্ন, গোলমরিচ দিয়ে একদম শুকনো করে নিতে হবে। শেষে দিতে হবে ধনেপাতা কুচি।
ওদিকে চাল গুঁড়োতে গরম জল আর নুন আর অল্প তেল মিশিয়ে সেটা আঁচে বসাতে হবে। মিডিয়াম আঁচে ক্রমাগত নাড়তে হবে যাতে মণ্ড না পাকিয়ে যায়। মিশ্রণটা পাত্রের গায়ে লেগে লেগে যাবে। এ অবস্থায় চালগুঁড়ো সেদ্ধ হয়ে এলে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। ঠান্ডা হলে খুব ভালো করে ঠেসে নিতে হবে। এরপর ছোট ছোট লেচি কেটে, তাতে ডালের পুর ভরে ইচ্ছেমতো আকার দিয়ে তৈরি হবে পিঠে। সেই পিঠে ফুটন্ত জলের ওপরে স্টিমারে ভাপা হবে মিনিট কুড়ি মতন। পরিবেশন করতে হবে যে কোনো চাটনি দিয়ে। ধনেপাতা বা টমেটো-তেঁতুলের চাটনি দিয়ে দারুণ লাগে এই পিঠে।

মুগ পাকন পিঠা
উপকরণ-
মুগ ডাল- ১ কাপ
চাল গুঁড়ো- ২ কাপ
নারকেল কোরা- ১/৪ কাপ ( অপশনাল)
গুড়ের রসের জন্যে-
গুড় ১.৫ কাপ
জল ১/৪ কাপ
প্যানে গুড় নিয়ে অল্প আঁচে তাতে জল মিশিয়ে ফুটিয়ে রেডি করে রাখতে হবে রস। গুড়ের বদলে চিনির রসও ব্যবহার হয়।
মুগ ডাল শুকনো প্যানে ভালো করে ভেজে নিতে হবে, যতক্ষণ না হালকা সুগন্ধ বেরোচ্ছে ভাজা ডালের। ঠান্ডা করে, ভাজা মুগ ডাল ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর ডালে অল্প নুন আর তিন কাপ জল দিয়ে আঁচে বসাতে হবে। জল ফুটতে থাকলে আঁচ কমিয়ে ডাল সেদ্ধ করে নিতে হবে। সেদ্ধ ডালকে ঠান্ডা করে পেস্ট করে নিয়ে আবার সেটা যাবে উনুনে। এই অবস্থায় এতে যাবে নারকেল কোরা আর চাল গুঁড়ো। ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে ৫ থেকে ৬ মিনিট। এই মিশ্রণটি একদম আটা মাখার মতো হবে। বেশি শক্ত হলে একটা ডিম ফেটিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে, আর বেশি নরম হলে চাল গুঁড়ো মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর খুব ভালো করে ঠাসতে হবে।
এবারে ডাল মিশ্রণটি থেকে লেচি কেটে, বেলে নিয়ে টুথপিক, কৌটোর ঢাকা ইত্যাদি দিয়ে পছন্দমতো ডিজাইন করতে হবে। এই ডিজাইনগুলো যত সূক্ষ্ম হবে, তত বেশি পরতে পরতে তেল ঢুকে মুচমুচে ভাজা হয়ে স্বাদ বাড়বে। মিডিয়াম আঁচে লাল ভাজা হলে আগে থেকে বানিয়ে রাখা চিনি বা গুড়ের রসে ডুবিয়ে কয়েক সেকেন্ড রেখে তুলে রাখতে হবে। ব্যাস, অসাধারণ স্বর্গীয় স্বাদের মুগ পাকন পিঠে রেডি।

মুগ ডালের নোনতা ভাজা পিঠে
উপকরণ-
মুগ ডাল- ১ কাপ
চাল গুঁড়ো- ২ কাপ
নুন গোলমরিচ স্বাদ মতো
১ চা চামচ চিনি
জিরে ভাজার গুঁড়ো ১ চা চামচ
পুরের জন্যে
১/২ কাপ মটর শুঁটি
জিরে গুঁড়ো আর ধনে গুঁড়ো দুটোই ১ চা চামচ
আদা- ১/২ চা চামচ বাটা
নুন মিষ্টি স্বাদ মতো
লংকা দুটো
কালো জিরে ১/২ চা চামচ আর এক চিমটে হিং ফোড়নের জন্যে
মুগ ডাল ভেজে, ধুয়ে সেদ্ধ করে পেস্ট করে রাখতে হবে আগের রেসিপির মতো। তাতে চাল গুঁড়ো দিয়ে মিশিয়ে রাখতে হবে। তাতে বাকি মশলা দিয়ে খুব ভালো করে ঠেসে নিতে হবে মোলায়েম করে।
পুরের জন্যে একটা প্যানে এক চামচ তেল গরম করে, কালো জিরে, হিং ফোড়ন দিয়ে, আদা দিয়ে কষে, মটরশুঁটি বাটা দিতে হবে। নুন, মিষ্টি, ঝাল সব দিয়ে একদম শুকনো করে রাখতে হবে পুর। মুগ ডাল চালের মিশ্রণ থেকে লেচি কেটে, হাতে চেপে বড় করে তাতে পুর ভরে ইচ্ছেমতো আকার দিয়ে রাখতে হবে। পাত্রে তেল গরম করে, আঁচ কমিয়ে তাতে ভাজতে হবে পিঠে। গরম গরম এই পিঠে পরিবেশন হলে কেউ একটা খেয়ে থামতে পারবে না একদম।
রইলো চার রকমের পিঠে। বছর বছর ধানের মড়াই ভরে উঠুক পাকা সোনালি শস্যে, হাসি থাকুক চাষির মুখে আর অভাব দূরে থাকুক গৃহস্থের ঘর থেকে। আবার এস শীত ফিরে…
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Facebook
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।