রান্নাকে বাঙালি নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। দিদিমা, ঠাকুমার হাতের রান্না, শিল নোড়ায় বাটার আওয়াজ থেকে হালফিলের বাঙালি রেঁস্তোরা। পরিবর্তন সবক্ষেত্রেই দেখা যায়। বেলা দে, লীলা মজুমদার, প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী, পূর্ণিমা ঠাকুর প্রভৃতি রন্ধনশিল্পীর হাত ধরে সাহিত্যেও এসেছে রান্নার প্রবাহ।
সুরবেক বিশ্বাস ও বিশ্বনাথ বসু ‘শ্রীভোজনেষু ভোজবাজি’ ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে আনছেন সঠিক পদ্ধতিতে রান্না করা পদের খাবারের খবর, যেখানে মিশেল ঘটছে খাবারের ইতিহাস ও সংস্কৃতির। চ্যানেলটির প্রযোজকের ভূমিকায় রয়েছেন সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত সুরবেক বিশ্বাস–এর ‘শ্রীভোজনেষু রসেবশে রসনায়’ ও ‘শ্রীভোজনেষু চেটেপুটে’ বইটি জনপ্রিয় হয়েছে বাঙালির স্বাদের ঘরে।
বর্তমানে ‘ভাইরাল’ করার লক্ষ্যে যেভাবে বেশিরভাগ খাবারের দোকানকেই শুধু পরিমাণের কারণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উচ্চতায়। এই পরিস্থিতিতেই আরও একটি চ্যানেল! যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার যুগে গঠনগত ও স্বাদের বিষয়টি তুলে ধরা।

অবশ্য রান্নার পদ-বৈচিত্র্য অনুযায়ী বই খুঁজে পাওয়া সহজ নয়, যে কারণে মানুষ হাত ধরেছে ডিজিটাল দুনিয়ার। নানা ইউটিউব চ্যানেল থেকে শুরু করে ই-ম্যাগাজিন বেড়ে উঠেছে রান্নাকে কেন্দ্র করে। এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি রান্নার বিভিন্ন পদকে নিয়ে এসেছে একই ছাদের তলায়। যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলেছে হেঁশেলের চেহারা। ‘ভেতো’ বাঙালির খাদ্যাভাস পাল্টেছে। রান্না, মহিলাদের হাত থেকে বেরিয়ে এসে হয়ে উঠেছে পুরুষদেরও। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে সবার। দেখতে পাওয়া যায় শিশুদেরও রান্নার চ্যানেল। পুরুষরা হয়ে উঠেছেন রীতিমতো রন্ধন বিশেষজ্ঞ।
এবার আসা যাক আসল আলোচনায়, যা নিয়ে আজ লিখতে বসা। রান্না কেবল বাড়িতে আসা বাজারের ব্যাগ থেকে শুরু বললে ভুল বলা হয়। এরও এক বিস্তীর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যা শুরু হয় উপকরণের ইতিহাস বা ভৌগলিক অবস্থান থেকে।
বোরোলি মাছের স্বাদ নদী পরিবর্তনের সঙ্গে পালটে যায়। আমরা জানি কি যে, ‘ভোজ কয় কাহারে?’ বর্তমানে ফুড ব্লগিং-এর নামে যে বিরিয়ানির আলু টিপে দেখানো হয় অথবা মাংসের মাত্রাতিরিক্ত সাইজ। সেখান থেকে বাঙালির জিভের মুক্তির দায় কে নেবে?

খাওয়া মানে শুধু পেট-ভরানো নয়, খাওয়া মানে মনের তৃপ্তিও। সেখানে যদি বিরিয়ানির স্বাদের বদলে তার আলু, মাংস, শুকনো না একেবারে তেলে মাখামাখি সেগুলি পরখ করা হয় তাহলে মুশকিল। যে কোনও খাবারের সঙ্গে জুড়ে থাকে সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মিশেল। সেসব পদের সঙ্গে তার ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথাও জানা জরুরি।

এরপরেও আমরা রিলস বা ভিডিও দেখে ভিড় করি সেই দোকানে। ছুটে যাই, হুজুগে মেতে উঠি। এসবের নামে আদৌ দেখেছি কি, ভুল পদ্ধতিতে বানানো খাবার খাচ্ছি কী না! মশলার পরিমাণ ঠিক আছে কী না? কলকাতার অচেনা গলির ভিতরে যদি পাওয়া যায় ঘরোয়া পরিবেশ বা তৃপ্তির উল্লাস, তবে তো একবার যেতেই হয়; অথবা নর্থ বেঙ্গলের পদের স্বাদের সঙ্গে কোথায় মিল বা অমিল কলকাতার একই পদের। সেসব মিলিয়ে খাবারের বৈচিত্র্য। যদি খাবারের বৈচিত্র্য জানি তবে ঠিক খাবার ঠিক দোকানে খাওয়া খুব কঠিন কাজ নয়।
বিশেষত বাঙালি খাদ্যের বৈচিত্র্য ও জায়গা অনুযায়ী স্বাদের পরিবর্তনই মূল কারণ, ভুল খাবার খেয়ে ফেলার। তাই বলে এটা বলছি না খেতে গেলে শিক্ষিত হতে হবে! শুধু জানা থাকলে অনিয়ন্ত্রিত খাবার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচা যাবে।

অরিন চক্রবর্তী
অরিন চক্রবর্তী। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে বেড়ে ওঠা। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা। ছোট পত্রিকা প্রিয়, শব্দের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জীবন।