১.
অল্পবয়সে প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হয়ে গেলে, মানুষ যে-কালে মদ্যপান, বেশ্যাবাড়ি আর নানা রকম উদ্ভট আমোদ-প্রমোদেই নিজেদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত, এক মুহূর্তও কালবিলম্ব করত না, সেখানে দাঁড়িয়ে আজও এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন বাগবাজারের ভুবনমোহন নিয়োগী। চালচলনে যদিও র্যালা ছিল তাঁর। শোনা যায়, ভুবন কখনও-সখনও নাকি নিজের চুরুট জ্বালাতেন দশ টাকার নোট পুড়িয়ে। বাড়ির চাকরদের কিনে দিতেন সাটিনের জামা। এ ছাড়া কারওর পৈতেই হোক, বাপ-পিতেমহর শ্রাদ্ধই হোক, কিংবা কন্যার বিবাহের আর্থিক অসঙ্গতি– তিনি একাই সমস্ত ভার বহন করতেন দিনের পর দিন। তাঁর কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে খালি হাতে কেউ কখনও ফেরেনি। অথচ এই ভুবনকেই জীবনের শেষ কয়েক বছর বস্ত্রাভাবে কাটাতে হয়েছে গেরুয়া পরে। দিনে একবেলা ভাল করে খাবারও জোটেনি। এর-তার কাছে ভিক্ষা চেয়ে, খালি পায়ে বাগবাজারের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে একা-একা। ভুবন ভালবেসেছিলেন থিয়েটারকে, আর্থিক ভাবে তার উন্নতিকল্পে চেষ্টা করেছিলেন যত দূর অবধি করা যায়… কিন্তু এই থিয়েটারই তাঁকে সর্বস্বান্ত করে এক দিন। বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর মতো।
২.
বাগবাজারে এখন যেখানে অন্নপূর্ণা ঘাট, একটা সময়ে তার অদূরেই ছিল রসিক নিয়োগীর ঘাট। এই রসিক নিয়োগী ছিলেন ভুবনের পিতামহ। ১৮৭২ সালে অমৃতলাল বসু, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি, ধর্ম্মদাস সুররা যখন ‘নীলদর্পণ’ নাটকটির রিহার্সাল করার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তখন অমৃতলালের এক কথায় ভুবন তাঁদের সেই ঘাটসংলগ্ন বাসভবনের দোতলার বিরাট হলঘরটা ছেড়ে দেন। সঙ্গে দিয়েছিলেন একটা হারমোনিয়ম এবং খানসামা নবীনের ওপর তদারকির ভার। নবীন সন্ধ্যা হওয়ার আগে এসে সেজ জ্বেলে দেওয়ার পাশাপাশি তামাক ও আগুনের ব্যবস্থা করে রেখে যেত। অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফিরা তখন ভেসে বেড়াচ্ছেন। সামান্য টাকার চাকরি করেন এক-একজন, তবু থিয়েটার অন্তপ্রাণ! গড়ের মাঠের লুইস থিয়েটার তাঁদের অনুপ্রেরণা জোগাত। এর-ওর বাড়ির উঠোনের বাঁধা স্টেজে অভিনয়ের অবসরে তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন, এক দিন তাঁদেরও একটা স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ হবে! কিন্তু তখন কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, প্রথম স্থায়ী নাট্যশালার টাকা জোগাবেন স্বয়ং ভুবনমোহন নিয়োগীই!
৩.
১৮৭৩ সালে যখন ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ তৈরি হয়, শুরুর দিকে তাদের অতটা রমরমা ছিল না। অভিনয় হত ঠিকই, জমত না। এমনকী মাইকেলের নাটকও ফ্লপ। হঠাৎই এক দিন ‘মোহান্তের এই কি কাজ’ নামে একটি নাটক ভাগ্যের চাকা দিল ঘুরিয়ে। হু হু করে টিকিট বিকোতে আরম্ভ করল। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল বেঙ্গলের নাম। রাতের পর রাত লোকে টিকিট না পেয়ে ফিরে যেতে লাগল।
ধর্ম্মদাস সুর, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসুর সঙ্গে এক দিন ভুবনও গেছিলেন এই নাটক দেখতে। কিন্তু লোকের এত ভিড়, তা টপকে টিকিট কেনা সম্ভব হয়নি। টিকিটের কারণে ফিরে যেতে হবে, ভুবন নিয়োগীকে? ধর্ম্মদাস সুরকে নিয়ে গ্রীনরুমে যেতে গেলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বচসা হয় তাঁদের। অপমানিত হন ভুবন। আর তার পরেই সিদ্ধান্ত নেন, যত টাকা লাগে লাগুক, থিয়েটার তাঁকে তৈরি করতে হবেই!
৪.
৬ নং, বিডন স্ট্রিটে (বর্তমানে যেখানে ‘মিনার্ভা থিয়েটার’) মহেন্দ্রনাথ দাসের জমি লিজ নেওয়া হল। লুইস থিয়েটারের অনুকরণে গড়ে উঠল ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’। স্টেজ ম্যানেজার নিযুক্ত হলেন ধর্ম্মদাস সুর। ১৮৭৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর অমৃতলাল বসুর ‘কাম্যকানন’ অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে উদ্বোধন হল গ্রেট ন্যাশনালের। ভুবনমোহন এই রঙ্গমঞ্চ তৈরি করতে, খরচ করেছিলেন বিস্তর!
থিয়েটারের ভালো হবে, এই আশায় শুরুর থেকে কখনওই কার্পণ্য করেননি তিনি। শুধু স্টেজ তৈরি করতেই সেকালে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৩,০০০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু ভাগ্য? অভিনয়ের প্রথম রাত্রেই আগুন লেগে যায় গ্রেট ন্যাশনালে। মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় অভিনয়। বিস্তর ক্ষতিপূরণ যায় ভুবনের। তবু ভয়ে কিংবা হতাশায় পিছিয়ে আসেননি তিনি! মাস তিনেকের মাথায় আবার সব আগের মতো। এত বড় ঘটনার ছাপটুকু যেন সেখানে নেই…
৫.
ভুবন তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির এক অংশ মাত্র পেয়েছিলেন। তখন তাঁর মা জীবিত। জমিদারি কিংবা কলকাতার বিষয়ের আয় সরাসরি তাঁর কাছেই আসত। ভুবন কোনও দিনই এসব নিয়ে মাথা ঘামাননি। থিয়েটারের কারণে যখন তাঁর এককালীন প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সে বাধ্য হয়ে ধার পর্যন্ত নেয়। থিয়েটার তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে হবেই! তাঁর মা, ছেলের এই অদ্ভুত প্রেম দেখে বিরক্ত হয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান। আর ঠিক এইখান থেকেই ভুবনের অবস্থা আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করে। থিয়েটার থেকে যত দিন টাকা উঠছিল, তত দিন কখনও তিনি বুঝতেই পারেননি, একটা করুণ সময় মাছির মতো ভনভন করতে করতে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। বুঝতেই পারেননি কখনও, তাঁর প্রিয়জনেরা একে একে তাঁর পাশ থেকে সরে যাবে এক দিন। সরল ভুবন মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকেছিলেন। তাঁর থেকে থিয়েটার লিজ নিয়ে হাতবদল করতে করতে এক দিন তাঁর ওপরেই বিপুল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকারী হয়েও নিজের থিয়েটারে নিজে ঢুকতে পেতেন না একটা সময়ে। নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় টাকা চেয়ে ব্ল্যাকমেল করে দলের একাংশ সঙ্গে নিয়ে চলে যান দল ফাঁকা করে। সদ্য ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন’-এর সতর্কতা তো ছিলই! কিন্তু ভুবন, সেই পুরনো স্বপ্নের জালে আবার ঢুকে পড়েন। তখন কোথায় অমৃতলাল বসু! কোথায় গিরিশচন্দ্র ঘোষ! ১৮৭৭ সালে ‘সরোজিনী’ নাটকে বিজয় সিংহের ভূমিকায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং ভুবনমোহন নিয়োগী!
৬.
নিজের অপটু অভিনয় দিয়েও ভুবন তাঁর থিয়েটারকে শেষপর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। অন্য মঞ্চে তত দিনে আলো জ্বলে উঠেছিল। ভুবন এর পর যতদিন বেঁচেছিলেন, একমাত্র সঙ্গী ছিল দারিদ্র। হয়তো আশা করতেন, থিয়েটার এক দিন আবার তাঁকে ডাকবে কোনও-না-কোনও কাজে। আবার সমস্ত অসচ্ছলতা একটু একটু করে দূর হয়ে যাবে। কিন্তু মৃত্যুর আগে অবধি তাঁর কাছে আর কোনও ডাক আসেনি। অমৃতলাল বসুরা শেষ জীবনে থিয়েটার থেকে তাঁকে সামান্য টাকার মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। এইটুকুই। ১৯২৭ সালের ২৫শে বৈশাখ যখন তাঁর মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। মৃত্যুর ১৯/২০ দিন হয়ে যাওয়ার পরেও কোনও সংবাদপত্রে ভুবন সম্পর্কিত একটা প্রতিবেদনও নাকি দেখা যায়নি! রঙ্গমঞ্চের ঝলমলে আলোয় ভুবন তত দিনে সম্পূর্ণই বিস্মৃত। কিন্তু আজ এত দিন পর এসে ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়, যে-সময়ে থিয়েটারকে ভালোবেসে ভুবনমোহন নিয়োগী অতগুলো টাকা খরচ করেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৭ কি ১৮ বছর..
জন্ম ১লা জুলাই, ১৯৯৬। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতোকত্তর পড়ছেন। নেশা আড্ডা মারা, রাস্তায় এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো আর লিটল ম্যাগাজিন ঘাঁটা। 'দশমিক' নামে একটা ছোট কাগজ সমপাদনা করেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'খইয়ের ভিতরে ওড়ে শোক'।