পাঠকের মুখে মুখে আজ থ্রিলার, ক্রাইম, সাসপেন্স, আর অশরীরী আত্মার উত্তেজনা। জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য জানার আগ্রহ যেন চাপা পড়ে আছে দমবন্ধ করে দেওয়া যান্ত্রিক ও দ্রুতগতির আবহে। তবু কিছু প্রশ্ন বার বার ফিরে আসে। কড়ি দিয়ে কি সত্যিই সব কেনা যায়? তরুণ সমাজ হয়তো বলবেন, আলবাত কেনা যায়। কড়ি দিয়েই তো সব কেনা হচ্ছে। মন্ত্রী, আমলা থেকে সুইপার-সুপারভাইজার। কিছু ক্ষেত্রে সত্যিটা হয়তো ঠিক তাই। কিন্তু সব সময় কি সেটাই একমাত্র সত্যি? কিছু আপাত দৃশ্যের আড়ালেও তো কিছু অদৃশ্য সত্য থাকে।
নিজের জীবন দিয়ে যিনি তা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলেন, তিনি হলেন বাংলা ও হিন্দি সাহিত্যের এক অনিকেত প্রতিষ্ঠান, লেখক বিমল মিত্র। ১৮ মার্চ ১৯১১ যাঁর জন্ম।
‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাসে দীপঙ্কর সেন পেশাগত যথেষ্ট যোগ্যতা থাকার সত্ত্বেও ত্রিশ টাকার ঘুসের চাকরি ভুলতে পারেননি। গভীর অন্তর্দহনে ছেড়ে দিয়েছিলেন লোভনীয় চাকরিটি। এটা কি লেখকের আত্মদর্শন নয়? না, চোরাপথে কড়ি দিয়ে লেখক কিছু কেনেননি। সারাজীবন ছুটেছেন কিছু উত্তরের ঠিকানায়। ঘটনাক্রমে জীবনের কিছুটা পথ এসে যে উত্তরের জন্য জিজ্ঞাসাগুলো আমাদের প্রায় প্রত্যকের মনে একদিন দানা বাঁধে। কিন্তু অভ্যাস আর কালার্জিত পথের বাইরে যেতে আমরা অনেকেই পারি না। তাই ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেললেও প্রশ্নগুলো প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়। মজুত উত্তর ঘেঁটে আমরা পাশ কাটিয়ে যাই।
যিনি সেই উত্তরের অপেক্ষায় থেকে সব চেনা পথ হারিয়ে ফেলেন, তিনিই সেই সত্যের দাবিদার। প্রকৃত সাধক। রেলের উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে যিনি সেই সত্য অনুসন্ধান করেছেন আর তাঁর অগাধ অভিজ্ঞতা ও অনুভবের উপসংহার রেখে গেছেন কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টির মোহনায়। ঠিক যেন কাব্যরসিক বিনয় মজুমদার, যিনি বিশ্বপিতাকে খুঁজে পান প্রকৃতির প্রতিটি শরীরে।

প্রকৃতির সহজ একমাত্রিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যেমন কবি বিনয় মজুমদার লিখে চলেন একের পর এক সব অমোঘ কবিতা, কথার যাদুকর বিমল মিত্র জীবনের অলি গলি ঘুরে লিখে চলেন একে একে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘একক দশক শতক’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’, ‘চলো কলকাতা’, ‘পতি পরম গুরু’, ‘এই নরদেহ’, ‘এরই নাম সংসার’, ‘মালা দেওয়া নেওয়া’, ‘তোমরা দুজনে মিলে’, ‘গুলমোহর’, ‘আসামী হাজির’-সহ একশোরও বেশি কালজয়ী উপন্যাস ও পাঁচশোরও বেশি ছোটগল্প। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে তাঁর রচনা।
এত সহজ করে আর কারও কলমে ইতিহাসকে কথা বলতে দেখা যায়নি। তাঁর গল্পে যেমন ধরা পড়ে সাধারণ মানুষের কষ্ট, তেমনি ধ্বনিত হয় প্রতিবাদ। আদিবাসী জীবন নিয়ে লেখা তাঁর ‘সরস্বতীয়া’ একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এত সহজ ভাবে সামন্তবাদের অবক্ষয়ের কাহিনি কে আর লিখবেন? কে-ই বা খসে পড়া পলেস্তরার মধ্যে খুঁজে পাবেন সাহেব, বিবি, গোলামের শ্বেতহার?
১৭৫৭ থেকে ১৯৬২ সালের সময়কাল নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম পাঁচটি ভিন্ন কাহিনির উপন্যাস গল্পের ছলে বলে ফেলা অবশ্যপাঠ্য কলকাতার ইতিহাস। তাঁর লেখায় হিট হয়েছে বক্স অফিস। ধনী হয়েছেন প্রকাশক। কিন্তু কী জুটেছে তাঁর কপালে? শুধুই কি সম্মান? শুধুই কি রবীন্দ্র পুরস্কার? অসম্মান, প্রবঞ্চনা, খ্যাতির বিড়ম্বনা ও আর্থিক ক্ষতির আঘাতে ভরে গেছে তাঁর প্রাপ্তির ঝুলি। বিখ্যাত বিমল মিত্রের ব্র্যান্ড নেম বিকিয়ে যায় কিছু অসাধু লেখক ও প্রকাশকের হাতে। তাঁর নামেই জাল বই লিখে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান কত সাধারণ লেখক ও প্রকাশক। পাইরেটেড এডিশানে ভরে যায় বাজার।
যুগ বদলেছে। সময় বদলেছে। রঙিন হয়েছে জীবন। মানুষ কি বদলেছে? অসাধু প্রকাশকের হাতে মার খাচ্ছেন না কি লেখক লেখিকা আজও? লেখক বিমল মিত্র ঘৃণা জানাতেও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন এসব ক্ষেত্রে। এমন মানুষ তো অনন্য হবেনই, যাঁর এপিফ্যানি হয় উস্তাদ আবদুল করিম খানের রাগ ভৈরবী শুনে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ‘যমুনা কে তীর…’ গান শুনে যিনি পড়ে ফেলেন কোনও এপিক উপন্যাস। উস্তাদ ফৈয়াজ খানের, ‘ঝন ঝন ঝন ঝন পায়েল বাজে’ থেকেই যিনি শিখে ফেলেন সাহিত্যের সারবত্তা– ‘গ্রহণ ও বর্জনের সমন্বয়’। ‘একলব্যের মতো বিশুদ্ধ সঙ্গীতের কাছে যিনি তাঁর সাহিত্য জীবনের নাড়া বাঁধেন, তিনি যে দহন দানে মুগ্ধ হবেন, তা তো বলাবাহুল্যই।

‘ব্রাদারহুড’ কবিতায় যখন কবি অক্টেভিও পাজ় বলেন, তিনি একজন সাধারণ মানুষ, তখন আমাদের চোখ খুলে যায়। আর লেখক যখন নিজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিজেই প্রশ্ন তোলেন, ‘ তরুলতা অতি সহজেই তরুলতা, পশু-পাখি অতি সহজেই পশু-পাখি, কিন্তু মানুষ অনেক কষ্টে অনেক দুঃখে অনেক যন্ত্রণায় অনেক সাধনায় আর অনেক তপস্যায় তবে মানুষ। আমি কি সেই মানুষই হতে পেরেছি?” তখন চোখের পাতা বুজে আসে। ঈশ্বরকনার বিচিত্ররূপে ভরে ওঠে আকাশ। অডেনের বিখ্যাত লাইন, ‘ We must love one another or die’ তাঁর জীবনের অর্জিত সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।
উত্তমকুমার নিজে তাঁর বাড়িতে গিয়ে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ গল্প নিয়ে সিনেমা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। সূচিত্রা সেন তাঁর বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি কিন্তু পিছিয়ে এলেন। সাহিত্যে রুপোলি রঙ লাগতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। এ যুগে দাঁড়িয়ে যা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে অঘোরনাথের মতো ব্রাহ্মণ, লোক ঠকিয়ে কিংবা গাঙ্গুলিবাবুর মতো মানুষ ঘুষ নিয়ে শান্তি পান না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জীবন আর মৃত্যু এক পাড়ায় বাস করে। তাই বাড়ির পাশেই কেওড়াতলা শ্মশানের নিরন্তর হরিধ্বনি তাঁকে চঞ্চল করত না। তিনি শান্তি পেতেন। আনমনা হয়ে দরাজ গলায় গেয়ে উঠতেন শ্যামা সঙ্গীত। আর আবৃত্তি করতেন ‘ শান্তিনিকেতন।’
ইনিই কি সেই ব্যক্তি নন যাঁকে কড়ি দিয়ে কেনা যায় না? ইনিই কি সেই সন্ন্যাসী নন, যিনি তাঁর ফেরারি বিক্রি করতে পারেন অনায়াসেই?
*ছবি সৌজন্য: youtube, bimalmitra.co.in, fromreadingtable
উৎপল চক্রবর্তী ইংরেজি ভাষার শিক্ষক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও কবি। ২০১৭ সালে প্রথম দেশ পত্রিকায় ওঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। সিগনেট থেকে প্রকাশিত কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'উড়ন্ত ডলফিন' এবং শাম্ভবী থেকে প্রকাশিত প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ, 'দ্যা মার্ক'। কলকাতার নবোদয় পাব্লিকেশন থেকে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে ওঁর দশটিরও বেশি বই।
One Response
Alaap-ta sobe jome uthchilo…. bado bhalo lagchilo……….aro kichu janar jonnyo mon prostut hocchilo..shilpee jano hotaath dilen thamiye tar gaan; e-lekha ki
aar barte parena? Bhalo thakben ..dhonyobad ei lekhar jonnyo.