(Haradhan Bandyopadhyay)
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে সকল শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতা এসেছেন তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে তিনি অন্যতম। একদিকে সত্যজিৎ রায়ের ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবির বিমল গুপ্ত, বা ‘সোনার কেল্লা’-য় তোপসের বাবা, অন্যদিকে ‘সীমাবদ্ধ’-তে তালুকদার। এছাড়া ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘কোরাস’, ‘অপরিচিত’, ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’-র মতো একের পর এক অসাধারণ ছবিতে তাঁর অসামান্য অভিনয় আজও ভোলার নয়। ঠিক ধরেছেন, কথা হচ্ছে বাংলা ছবির অবিসংবাদী চরিত্রাভিনেতা হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। ১৯৫০ থেকে ’৮০, বাংলা ছবির যে অফুরান ঐশ্বর্য, তার তালিকা নিয়ে বসলে অনেকের পাশাপাশি হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও উঠে আসবে। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর জীবন ও কাজের দিকে আমাদের ফিরে দেখা।
১৯২৬ সালে আজকের দিনে অধুনা বাংলাদেশের দর্শনায় জন্ম হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন কুষ্টিয়ায়। স্কুলের পাট শেষ করার আগেই জড়িয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ক্লাস নাইনে পড়াকালীন সক্রিয়ভাবে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে জড়িয়ে জেলও খেটেছেন। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক, কিন্তু তিনি তো তা হতে চান না! শেষমেশ, একদিন সব ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ ও স্বাধীনতার আন্দোলনে কলকাতা তখন উত্তাল। কাজ পেলেন কাশীপুর ‘গান অ্যান্ড শেল’ ফ্যাক্টরিতে। এরপর বাটা কোম্পানিতে জুতো পরিস্কারের কাজ এবং আরও কিছু ছোটোখাটো চাকরির পর যোগ দেন একটি জীবনবিমা কোম্পানিতে। তবে তাঁর চাকরিজীবনের থেকে তাঁর অভিনয় জীবন অনেক বেশি বিস্তৃত। প্রায় ৬৫ বছর ধরে দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। একদিকে মঞ্চে অহীন্দ্র চৌধুরী, উৎপল দত্ত, ছবি বিশ্বাসের মতো দিকপালদের সঙ্গে, অন্যদিকে চুটিয়ে সিনেমায়। (Haradhan Bandyopadhyay)
যদিও হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় জগতে পদার্পণ কিন্তু বেতার নাটক দিয়ে, কাজ করেছেন বেতার ঘোষক হিসাবেও। এই সূত্রেই নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরীর পরিচালনায় ‘আবুল হাসান’ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে গেলেন। এরপর, ১৯৪৮-এ অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘দেবদূত’ দিয়ে চলচ্চিত্রে ওঁর আত্মপ্রকাশ। একই বছর মুক্তি পেল ‘উমার প্রেম’, পরের বছর ‘আশাবরী’। কিন্তু কোনও ছবিই বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখল না। হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়যাত্রা শুরু ‘বরযাত্রী’ ছবি থেকে। এরপর একের পর এক ছবিতে ডাক আসতে লাগল। (Haradhan Bandyopadhyay)
ভিডিও: অনন্য অরুন্ধতী: জন্মশতবর্ষে ফিরে দেখা (১৯২৪-১৯৯০)
আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে, সঙ্গে সমান তালে চলতে থাকল মঞ্চাভিনয় ও বেতার নাটক। উৎপল দত্ত পরিচালিত ‘মেঘ’ ছবিতে হারাধনের অভিনয় নজর কাড়ল সত্যজিৎ রায়ের। কয়েক বছর পর সত্যজিতের ‘মহানগর’ ছবিতে দেখা গেল তাঁকে। মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করলেন ‘আকাশকুসুম’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘কোরাস’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে। একে একে, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘চৌরঙ্গী’, সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘শাখা প্রশাখা’, অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়ের ‘পদিপিসির বর্মীবাক্স’, প্রভৃতি ছবিতে অব্যাহত থাকল হারাধনের জয়যাত্রা। (Haradhan Bandyopadhyay)
কাজ করেছেন, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, যাত্রিক, অগ্রদূত, অগ্রগামী, সলিল সেন, রাজেন তরফদারের মতো উল্লেখযোগ্য পরিচালকদের সঙ্গে। সন্দীপ রায় পরিচালিত শেষ দু’টি ফেলুদার ছবিতে তিনি ছিলেন ‘সিধু জ্যাঠা’। তাঁর শেষ অভিনয় অনুরাগ বসু পরিচালিত ‘বরফি’ ছবিতে, ২০১২ সালে। পাশাপাশি, মঞ্চেও অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন। একদিকে উৎপল দত্তের ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’-এর সঙ্গে ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘সাংবাদিক’ নাটকে, অন্যদিকে সারকারিনা, রঙমহল, মিনার্ভা, বিশ্বরূপার মতো পেশাদার মঞ্চে অহীন্দ্র চৌধুরী, অমর ঘোষ, প্রভাত সিংহ, সমর মুখোপাধ্যায় প্রমুখের নির্দেশনায় ‘আবুল হাসান’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘চরিত্রহীন’, ‘দেবদাস’, ‘তুষার যুগ আসছে’, ‘সম্রাট ও সুন্দরী’ ইত্যাদি নাটকে তাঁর অনবদ্য অভিনয়! (Haradhan Bandyopadhyay)
দূরদর্শনে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছেন বিভিন্ন নাটক ও সিরিয়ালে। ২০০৫-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্রান্তিকাল’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ সহকারী অভিনেতা হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। আজীবন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১-য় পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ সম্মান। তবে, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি অবশ্যই তাঁর অভিনীত স্মরণীয় চরিত্ররা, যাঁরা বাংলা ছবির আপাত-মলিন একমাত্রিকতার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমাদের সামাজিক বিন্যাসের জটিলতাকেই উদ্ভাসিত করেছে। তাই শতবর্ষ ছুঁতে চলা সদাহাস্য হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য! (Haradhan Bandyopadhyay)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।
