(Bhanu Bandyopadhyay) এক বাংলা ছবির কিছু অংশের শুটিং চলছে দিল্লিতে, রয়েছেন উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবীর মতো তারকারা। মহানায়ক তখন খ্যাতির মধ্যগগনে, তাঁকে দেখতে হোটেলের বাইরে ভিড় হওয়াই স্বাভাবিক! কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল উত্তমকুমারকে নয়, সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখার জন্য এই জনসমাগম! ‘মাসীমা মালপো খামু’, ‘নাগো মিনু আমাগো থার্মোমিটারও নাই, বার্নলও নাই’, ‘টিনের বাক্সে বারো টাকা’… এমন হাজারো সংলাপ বাঙালির মুখে মুখে ফিরত তাঁর দৌলতে! শুধু তখন কেন, এখনও তো নানা আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে এই সব সংলাপ। ভাবছেন, এ সবের স্রষ্টা হিসাবে বিখ্যাত মানুষটির নাম তো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়! ঠিকই, কিন্তু তাঁরই পোশাকি নাম সাম্যময়। এক অসাধারণ বর্ণময় জীবন কাটিয়েছেন তিনি – হতে পারতেন স্বদেশী বিপ্লবী, বামপন্থী দলের হোলটাইমার, আবার কাটাতে হতে পারত দীর্ঘ কারাবাসও। কিন্তু তর্কাতীতভাবে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা।
১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট অধুনা বাংলাদেশের বিক্রমপুরে জন্ম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Bhanu Bandyopadhyay)। মা সুনীতি দেবী ছিলেন প্রথম মহিলা স্কুল ইন্সপেকট্রেস, বাবা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নবাবী স্টেটে উঁচু পদে চাকরি করতেন। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন সাম্যময়, যদিও ভবিষ্যতে পরিচিতি পেলেন ডাকনামেই! কিন্তু ‘সাম্যময়’ থেকে ‘ভানু’ হয়ে ওঠার যাত্রাপথ সহজ ছিল না মোটেই। প্রাথমিক পড়াশোনার পাঠ শেষ করে জগন্নাথ কলেজ থেকে ইতিহাসে আইএ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন বিএ পড়তে। সেখানে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কবি জসীমউদ্দিন, মোহিতলাল মজুমদার ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো শিক্ষকদের সান্নিধ্য তাঁর কাছে ছিল আজীবনের সম্পদ। নিজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বেশিরভাগ সময় ভানু সত্যেন বসুর ক্লাসে গিয়ে পড়া শুনতেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সত্যেন’দা বলে ডাকার অধিকার একমাত্র তাঁরই ছিল।
পড়াশোনার পাশাপাশি মাত্র ১২ বছর বয়সেই জড়িয়ে পড়েন স্বদেশী আন্দোলনে। গোপনে বিপ্লবী বই, প্রচারপত্র থেকে রিভলভার পাচার – কী করেননি ভানু! বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে থাকার সময় দীনেশ গুপ্তের সূত্রে কিশোর ভানুর আলাপ হয় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহ এবং অলিন্দ যুদ্ধের আরেক যোদ্ধা বিনয় বসুর সঙ্গে। দীনেশের মৃত্যুর পর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে অনুশীলন সমিতিতে। তাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েই ১৯৪১ সাল নাগাদ পুলিশের নজরে পড়েন ভানু। কার্যত বাধ্য হয়েই বন্ধুর গাড়ির ব্যাকসিটের পাদানিতে শুয়ে চলে আসেন কলকাতায়। চাকরি নেন আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানিতে, শুরু হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
অভিনেতা হিসাবে ভানুর আত্মপ্রকাশ ১৯৪৬ সালে, পাড়ায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে চাণক্যের ভূমিকায়। ওই বছরই বিয়ে করেন বেতার শিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পরের বছর ১৯৪৭-এ মুক্তি পাওয়া ‘জাগরণ’ ছবিটির মধ্যে দিয়ে তাঁর চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ। ১৯৪৯ সালে ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ১৯৫১ সালে ‘বরযাত্রী’, ১৯৫২ সালে ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে ভানুর অভিনয় নজর কাড়ে সকলের। তবে ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিটি সম্পূর্ণ অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় ভানুকে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘আশিতে আসিও না’ – একের পর এক অভিনয় তাঁকে লোকপ্রিয় করে তোলে।
কৌতুকের পাশাপাশি অন্যধরনের চরিত্রে অভিনয়ের যে গুটিকয়েক সুযোগ তিনি পেয়েছেন, প্রতি ক্ষেত্রেই প্রমাণ দিয়েছেন নিজের শ্রেষ্ঠত্বের, এক্ষেত্রে ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘টাকা আনা পাই’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অভিনেতার নামে চলচ্চিত্র ও চরিত্রের নাম বাংলা সিনেমার ইতিহাসে বোধহয় একমাত্র তাঁর ঝুলিতেই রয়েছে — ‘ভানু পেল লটারি’ ও ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’। হিন্দিতে তাঁকে দেখা গিয়েছে সত্যেন বসুর ‘বন্দীশ’, তপন সিংহের ‘সাগিনা’ প্রভৃতি ছবিতে। লেখক ও পরিচালক সলিল সেনকে নিয়ে গড়ে তোলা ‘ক্রান্তি শিল্পী সংঘ’-র উদ্যোগে, পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ত্রাণ সংগ্রহে মঞ্চস্থ করেছেন ‘নতুন ইহুদি’ নামে নাটক।
আবার অভিনয় জীবনের মধ্য গগনে থাকাকালীনই সরব হয়েছেন শিল্পী-কলাকুশলীদের সংগঠনে। বিভিন্ন সময় একটানা আন্দোলন করেছেন অভিনেতৃ সংঘ এবং শিল্পী সংসদের হয়ে। ফলস্বরূপ, খ্যাতির শীর্ষে থেকেও দীর্ঘদিন কাজ পেতেন না ভানু, তবুও আপোষের রাস্তায় হাঁটেননি দীনেশ গুপ্তর এই শিষ্য। সিনেমা ছেড়ে মন দেন যাত্রা-জলসায়। ১৯৭৪-এ ‘মুক্তমঞ্চ’ নামে একটি যাত্রার দলও গঠন করেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই দলের সঙ্গে মাতিয়ে তুলতেন গ্রামবাংলার বিভিন্ন প্রান্ত। ১৯৮৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অচেনা মুখ’ তাঁর অভিনীত শেষ ছবি। তিনশোরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি করেছেন থিয়েটার, রেকর্ড করেছেন বহু কৌতুক নকশা। মঞ্চ, চলচ্চিত্র, শ্রুতিনাট্য — স্বরক্ষেপণই জানিয়ে দিত তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। হাস্যকৌতুক শিল্পেও নতুন এক ঘরানার জন্ম হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। আজ তাঁর জন্মদিনে বাংলা সংস্কৃতির বিশিষ্ট শিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Bhanu Bandyopadhyay) প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। অস্ত গিয়েও যে ‘ভানু’ আলো দিয়ে যাবেন চিরকাল!
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।