(Birthday Tribute) (Chhabi Biswas)
১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এক দিন রাত্রে’ সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখে রাজ কাপুর বলেছিলেন, ভারতীয় সিনেমার (Indian Cinema) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা তিনি। তাঁর অনুপস্থিতির কারণে কিছু ছবি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। আবার, পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে দেশের ‘বেস্ট স্ক্রিন অ্যাক্টর’ শিরোপা দিয়ে বলেছিলেন, অভিনয় জগতে তিনি একটা যুগ। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে ডায়লগ বলতে ভুলে যেতেন স্বয়ং উত্তমকুমার। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চোখে তিনি ‘রাজকীয় অভিনেতা’। সিনেমার পাশাপাশি মঞ্চেও সমান সফল। আর তাই ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নাটকটির উৎসর্গপত্রে তাঁকে ‘নট সম্রাট’ নামে অভিহিত করেছিলেন মন্মথ রায়। ‘সপ্তপদী’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘জলসাঘর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র মতো ছবি বাঙালি মননে গেঁথে গিয়েছে তাঁর অভিনয়গুণেই। তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চ তথা চলচ্চিত্র জগতের অনন্য অভিনেতা ছবি বিশ্বাস (Chhabi Biswas)।
১৯০০ সালের ১৩ জুলাই উত্তর কলকাতার আহিরিটোলার বনেদি বিশ্বাস পরিবারে জন্ম তাঁর। ভাল নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। খুব অল্প বয়সে মা প্রয়াত হলেও তাঁর দেওয়া নামটাই রয়ে গেল আজীবন, ‘ছবি’! হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর প্রেসিডেন্সি কলেজ ও তারপর বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক। মদন মিত্র লেনে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বৈঠকখানায় ছিল ‘বারবেলা বৈঠক ক্লাব’। সেখানেই ছবি বিশ্বাসের অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি এবং ১৯৩৮ সালে সতু সেনের ডাকে নাট্য নিকেতন মঞ্চে পেশাদার শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ। নাট্যকার মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশেম’-ও ওই বছরেই মঞ্চস্থ হয়।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুই পুরুষ’ নাটকে নুটুবিহারীর চরিত্রে তাঁর অসামান্য অভিনয় সকলের নজর কাড়ে। ‘দেবদাস’, ‘ধাত্রীপান্না’, ‘কাশীনাথ’, ‘চাঁদ সদাগর’, ‘ডাকবাংলো’-সহ মোট ৩৯টি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। অভিনয় করেছেন মিনার্ভা, স্টার, শ্রীরঙ্গম ও সুন্দরম-এ। এরই মাঝে রুপোলি পর্দায় প্রথম অভিনয় ১৯৩৬ সালে তিনকড়ি চক্রবর্তী পরিচালিত ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে। এরপর আরো ছ’সাতটি ছবিতে কাজ করলেও কোনোটিই বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। অবশেষে সাফল্য ধরা দিল নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে ১৯৪১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রতিশ্রুতি’ ছবিটিতে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। পরের বছরই পরপর ১৩ টি ছবি মুক্তি পায় ছবি বিশ্বাসের।
১৯৫৭ সালে মুক্তি পায় রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ও বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে উচ্চ প্রশংসিত তপন সিংহ পরিচালিত ছবি ‘কাবুলিওয়ালা’। সেখানে নামভূমিকায় তাঁর অসাধারণ অভিনয়ে শুধু কলকাতাতেই নয়, সারা ভারতে হইচই পড়ে যায়। এক সাক্ষাৎকারে তপন সিংহ বলেন, ‘আমার তো মনে হয় ‘কাবুলিওয়ালা’ আমার নয়, ছবি বিশ্বাসেরই ছবি।’’ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম কাজ ‘জলসাঘর’ সিনেমায়। পরিচালকের কথায়, ‘এক দিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃশ্যকারিতা, অন্যদিকে তার পুত্রবাৎসল্য ও সংগীতপ্রিয়তা এবং সব শেষে তাঁর পতনের ট্র্যাজেডি — একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র ছবিবাবুর পক্ষেই সম্ভব ছিল।’ আবার অজয় করের কালজয়ী ছবি ‘সপ্তপদী’-তে মেজাজি রিনা ব্রাউনের মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্য যে আবহ তৈরি করে তাও বোধহয় তাঁর পক্ষেই সম্ভব।
তাঁর আরেক প্রবাদপ্রতিম চরিত্র ‘দাদাঠাকুর’, যাঁর জীবনী নিয়ে ছবি সেই শরৎচন্দ্র পণ্ডিত তখনও জীবিত। শিয়ালদহে এক হলের বাইরে ‘দাদাঠাকুর’ দেখতে বিশাল জনসমাগম, অথচ আসল দাদাঠাকুরের দিকে কারোর নজরই নেই। যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন শরৎ পণ্ডিত নিজেও।
‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘শিউলিবাড়ি’, ‘বিচারক’, ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’-সহ ২৫৬টি বাংলা এবং তিনটি হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। পাশাপাশি, পরিচালনা করেছেন ‘প্রতিকার’ এবং ‘যার যেথা ঘর’ নামে দুটি ছবি। ‘চাণক্য’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’-এর মতো বেতার নাটকেও ছবি বিশ্বাস ছিলেন সমান সপ্রতিভ! ‘প্রতিশ্রুতি’ ও ‘দিকশূল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সম্মানিত হন বিএফজেএ পুরস্কারে। ১৯৫৯ সালে ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমী’ তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান জানায়। ভূষিত হন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারেও। আবার, এই মানুষটিই ছোটো জাগুলিয়ায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য প্রায় ১০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্কটকালে সকলে যখন রাস্তায় নেমেছিল, তখন অগ্রণী ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল ছবি বিশ্বাসকে। জাগুলিয়া যাওয়ার পথেই ১৯৬২ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় অকাল প্রয়াত হন তিনি। তবু, আজও ‘দাদাঠাকুর’ থেকে ‘জলসাঘর’, ‘কাবুলিওয়ালা’ থেকে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ — বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমা জগতে অভিনয়-আভিজাত্যের অপর নাম ছবি বিশ্বাস (Chhabi Biswas)।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।