১৯৭২ সালে ৮৩ বছর বয়সে যখন তিনি (Charlie Chaplin) অস্কার নিতে ওঠেন, টানা বারো মিনিট হাততালির ঝড় বয়ে যায় অস্কার মঞ্চে। অ্যাকাডেমির ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত তা-ই দীর্ঘতম স্ট্যান্ডিং ওভেশন। প্রবাদপ্রতিম ফরাসি পরিচালক জঁ লুক গোদার (Jean-Luc Godard) তাঁর তুলনা করেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির (Leonardo da Vinci) সঙ্গে। সিনেমার ইতিহাসে কোনও একটি নাম বেছে নিতে বললে, সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) সসম্ভ্রমে স্মরণ করেন তাঁর কথা। আবার তাঁর গুনমুগ্ধ রাশিয়ার এক বিজ্ঞানী নিজের আবিষ্কৃত উপগ্রহের নাম রাখেন তাঁর নামে! তিনি আর কেউ নন, গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রতিভা স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন (Charlie Chaplin)। মাথায় ডার্বি টুপি আর হাতে ছড়ি, এভাবেই তাঁর সৃষ্ট ‘ভবঘুরে’ বা ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প’ চরিত্রটি নিয়ে বিশ্বজয় করেছেন তিনি।
তাঁর (Charlie Chaplin) ছেলেবেলা কাটে দক্ষিণ লণ্ডনের (London) এক ছোট্ট শহরে। প্রামাণ্য নথির অভাবে জন্মতারিখ নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও নিজের আত্মজীবনীতে ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল তারিখটিকেই মান্যতা দিয়েছেন তিনি। মা হানা আর বাবা চার্লস, দু’জনেই ছিলেন মঞ্চাভিনেতা। যদিও তাঁর জন্মের এক বছরের মধ্যেই বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। ছোট্ট চার্লির অভিনয় জগতে পা রাখার ঘটনাও খুবই আকস্মিক। মঞ্চে অভিনয় ও গান করতে উঠে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে দর্শকদের শান্ত করতে চার্লিকে মঞ্চে তুলে দেন ম্যানেজার। তখন তাঁর বয়স মাত্র পাঁচ! প্রথমবার আকস্মিকভাবে মঞ্চে উঠতে হলেও, ৯ বছর বয়সে মায়ের উৎসাহে এবং নিজের আগ্রহেই পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা সামলাতে ‘এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’ নামে একটি নাট্যদলে যোগ দেন চার্লি।
পরবর্তী কয়েক বছর আরও দু-একটা দলে কাজ করার পর ১৯০৮ সালে দাদা সিডনির দৌলতে ‘ফ্রেড কার্নো’ নামের নাট্যদলে কাজ জুটে যায় চার্লির (Charlie Chaplin)। এই দলের সঙ্গে দ্বিতীয় আমেরিকা সফর চলাকালীন তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের জন্য সেলুলয়েডের দুনিয়ায় পা রাখার প্রস্তাব পান তিনি। ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে যোগ দেন ‘দ্য কিস্টোন স্টুডিওস’-এ। তিনি প্রথম যে ছবিতে অভিনয় করেন তার নাম ‘মেকিং আ লিভিং’। যদিও চ্যাপলিনের (Charlie Chaplin) কথা ভাবলে প্রথমেই যে ছবিটা আমাদের মাথায় আসে, এই ছবিতে তাঁর সাজ-পোশাক তেমন ছিল না। বিখ্যাত ‘ট্র্যাম্প’ চরিত্রটির আবির্ভাব ঘটে তাঁর দ্বিতীয় ছবিতে, যার নাম ছিল ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’। কিস্টোনে পরপর দশটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্বাক ছবিতে তিনি শুধু অভিনয় (Film actor) করেন। এগারো নম্বর ছবি ‘টোয়েন্টি মিনিটস অফ লাভ’-এ চ্যাপলিন প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন চলচ্চিত্র পরিচালক (Film maker) হিসাবে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
‘এসানে’ ও ‘মিউচুয়াল ফিল্ম কর্পোরেশনে’ কাজ করার পর ১৯১৮ সালে তিনি যোগ দেন ‘দ্য ফার্স্ট ন্যাশনাল’-এ। সেখানে থাকাকালীন তৈরি করেন ‘আ ডগস লাইফ’, ‘সানিসাইড’, এবং ‘দ্য কিড’-এর মতো সিনেমা। তাঁর ভবঘুরে চরিত্র, স্ল্যাপস্টিক কমেডি ও গল্প বলার ধরন আলোড়ন ফেলে দেয় দর্শকদের মধ্যে। ১৯১৯ সালে আরেক মহারথী গ্রিফিথ ও অন্যান্যদের নিয়ে স্বাধীন ছবি তৈরির লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘ইউনাইটেড আর্টিস্টস কর্পোরেশন’। এই ব্যানারে করা তাঁর আটটি ছবির মধ্যে ‘দ্য গোল্ড রাশ’ থেকে ‘সিটি লাইটস’, ‘মডার্ন টাইমস’, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ বা ‘লাইমলাইট’-এর মতো সিনেমা আজ বিশ্ব চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। অনাবিল হাসির মোড়কে তিনি তুলে ধরেছেন সামাজিক অব্যবস্থা, অবিচার, অসঙ্গতিকে। দেখিয়েছেন পুঁজিবাদের বৈষম্য আর বঞ্চনার শুষ্ক বাস্তবতাকে। চার্লির সিনেমা জীবনের জয়গান, শ্রমিকের জয়গান, ভালোবাসার জয়গান।
মানুষের কথা বলায় ১৯৫২ সালে ‘কমিউনিস্ট’ (Communist) তকমা দিয়ে আমেরিকা তাঁর (Charlie Chaplin) উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বাকি জীবন কাটানোর জন্য চ্যাপলিন বেছে নেন সুইজারল্যান্ডকে। তিনি শুধু ভবঘুরের পোশাকের আড়ালে থাকা এক অসাধারণ অভিনেতাই নন। তাঁর অধিকাংশ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, শিল্পনির্দেশক এমনকি সংগীত পরিচালকও তিনি নিজেই। প্রায় ৭৫ বছরব্যাপী সিনেমাকীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ চ্যাপলিন ভূষিত হয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মানে। বিশ্বের প্রথম অভিনেতা হিসাবে ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান পান তিনি। ব্রিটিশ সরকারের থেকে পেয়েছেন নাইট উপাধি। অক্সফোর্ড ও ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লেটার্স’। ১৯৭২ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব তাঁকে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কারে ভূষিত করে। আমাদের ‘সুস্থ’ সমাজে ‘ট্র্যাম্প’ যেন বেমানান, বেখাপ্পা এক চরিত্র। অথচ মৃত্যুর প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়েও চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি এতটুকু। সিনেমার ইতিহাসেই নয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসে চার্লি চ্যাপলিন (Charlie Chaplin) একজন প্রকৃত মানবদরদী শিল্পী। ১৩৫-তম জন্মদিনে তাই তাঁকে আমাদের কুর্নিশ!
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।