(Jahar Roy)
কখনও তিনি হাল্লা রাজার ষড়যন্ত্রী মন্ত্রীমশাই! কখনও আবার হাড়ভাঙা গ্রামের প্রেসিডেন্ট হয়ে বলছেন, ‘বলেছিলাম না! শিল্ড আমি গ্রামের বাইরে যেতে দেব না!’। ‘সাড়ে চুয়াত্তরে’ সেই তিনিই গান জুড়ে দিলেন ‘একবার নেমে আয়, নেমে আয় ও বাপ কেদার আমার’। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, জহর রায়ের কথাই হচ্ছে! অভিনয়ের নেশায় পকেটে মাত্র ৫০ টাকা নিয়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। পেট চালাতে, এক সময় কী-ই না করেছেন! কিছুদিন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর চাকরি। পাটনায় দর্জির দোকান। প্রেসে প্রুফ রিডার। ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি। ঝুলিতে ছিল সব ধরণের অভিজ্ঞতাই। কালক্রমে হয়ে উঠলেন বাংলা সিনেমার উজ্জ্বল মণিমুক্তোদের মধ্যে অন্যতম। (Jahar Roy)
১৯১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলার বরিশালে তাঁর জন্ম। বাবা সতু রায় ছিলেন নির্বাক যুগের অভিনেতা। ১৯৩৮ সালে, পাটনার বি.এন কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন জহর রায়। সেখানেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। প্রথম শখের থিয়েটারে অভিনয়ও। এরপর শুরু করেন স্নাতক স্তরের পড়াশোনা, কিন্তু শেষ করেননি। কিছুটা অভিনয়ের নেশায়, কিছুটা সংসারের চাপে। ততদিনে তিনি গুরু মেনেছেন চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিনকে । স্কুলবেলা ফুরোনোর আগেই দেখে ফেলেছেন ‘দ্য কিড’, ‘গোল্ড রাশ’, ‘সিটি লাইটস’-এর মতো ছবি। ‘পাগলের মতো চ্যাপলিনের ছবি দেখতাম। এক-একটা ছবি আট বার, দশ বার করে। তাঁর অভিনয়ের প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি মুভমেন্ট গুলে গুলে খেতাম’, পরে বলেছেন জহর রায়। (Jahar Roy)
ভিডিও: ভানু’র আলো: জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
একদিন সব ছেড়েছুড়ে চলে এলেন কলকাতায়। একমাত্র পরিচিত বলতে পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, জহরের ‘কালাচাঁদদা’। তাঁর ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ এসে গেল কিছুদিনের মধ্যেই। তবে সম্ভবত সুশীল মজুমদারের ‘সাহারা’ ছবিতে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান জহর রায়। কিন্তু, প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘পূর্বরাগ’, ১৯৪৭ সালে। পরের বছর, মুক্তি পায় বিমল রায়ের ‘অঞ্জনগড়’। একে একে, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর মতো কালজয়ী সব ছবি! আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সত্যজিৎ রায় ‘পরশপাথর’-এ ছোট রোল দিয়েছিলেন, পরেশ দত্তের চাকর ভজহরি। দশ বছর পরে হাল্লার মন্ত্রী। ঋত্বিক ঘটকও তাই। প্রথমে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে কনস্টেবলের রোল, সাত বছর পর ‘সুবর্ণ-রেখা’র ফাউন্ড্রি ওয়ার্কশপের ফোরম্যান মুখুজ্জে এবং ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’য় গেঁয়ো মাতালের চরিত্র। (Jahar Roy)
তরুণ মজুমদারের সঙ্গে কাজ করেছেন ‘পলাতক’, ‘একটুকু বাসা’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘ঠগিনী’ ছবিতে।তরুণ মজুমদার বলেন, ‘ওঁর গায়ে কমেডিয়ানের তকমা জুড়ে দেওয়া অনুচিত।’ এর প্রমাণ জহর নিজেই দিয়েছেন ‘বাঘিনী’-র মতো ছবিতে বা উৎপল দত্তের আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক ছবি ‘ঘুম ভাঙার গান’-এ। শুধু তাই নয়, আরও এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারী তিনি, এবং সঙ্গে অবশ্যই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সরাসরি তাঁদের নামেই ছবি হয়েছে, ‘এ জহর সে জহর নয়’ আর ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’। বাংলা ছাড়াও ওড়িয়া আর হিন্দিতে কথা বলতে পারতেন অনর্গল। তবুও বোম্বে যাননি পরিবারকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে। জীবনে একটিমাত্র হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন, বিমল রায়ের ‘পহেলা আদমি’। (Jahar Roy)
ভিডিও: হাইলি সন্তোষজনক – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
সিনেমার পাশাপাশি নাটকের ক্ষেত্রেও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত। প্রায় দুই দশক জুড়ে তিনি ছিলেন ‘রঙমহল’ মঞ্চের প্রধান আকর্ষণ। রঙমহল যখন বন্ধ হতে বসেছে, তখন শিল্পীদের নিয়ে নামেন প্রতিবাদে। পরে সকলকে নিয়ে রঙমহল কার্যত তিনিই চালিয়েছেন। তাঁর পরিচালনায় নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’, বহু রাত অভিনীত হয়। করেছেন ‘সুবর্ণগোলক’, ‘আমি মন্ত্রী হলাম’-এর মতো নাটক। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও মঞ্চে উঠেছেন। এছাড়া, কৌতুক-নকশা পরিবেশনেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে কখনও বৃদ্ধ, কখনও বৃদ্ধা, কখনও রকবাজ, কখনও প্রেমিক, কখনও প্রেমিকা, সঙ্গে মুখে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, গান, নাচ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭- দীর্ঘ তিন দশকে জহর অভিনীত ছবির সংখ্যা প্রায় তিনশো। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল থেকে শুরু করে তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার- প্রায় সব খ্যাতিমান পরিচালকের ছবিতেই তিনি অভিনয় করেছেন। (Jahar Roy)
‘মানময়ী গার্লস স্কুল’‚ ‘ছদ্মবেশী’‚ ‘শহর থেকে দূরে’‚ ‘পথের দাবী’‚ ‘চিরকুমার সভা’‚ ‘নায়িকা সংবাদ’‚ ‘নিশিপদ্ম’‚ ‘ধন্যি মেয়ে’‚ ‘মর্জিনা আবদুল্লা’‚ ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর মতো ছবিতে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয় আজও বুঁদ করে রাখে দর্শকদের। তাঁর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিনের সতীর্থ ভানু বলেছিলেন, ‘অন্য দেশ হলে জহরের ‘স্যার’ উপাধি পাওয়া উচিত ছিল।’ আজ তাঁর জন্মদিনের এই অবসরই হতে পারে অভিনেতা, নাট্যকার তথা শিল্পী জহর রায়ের জীবন ও কাজের দিকে নতুন করে ফিরে দেখার সঠিক সময়। একশো পেরিয়ে আজও একাই একশো জহর রায়। বাংলার রুপোলি দুনিয়ার রসরাজ। (Jahar Roy)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।