তিনি (Ustad Amir Khan) ছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের (Indian Classical Music) সুর-তাপস! ঋষির মতো শান্ত চিত্তে এসে বসতেন মেহফিলে, তারপর চোখ বন্ধ করে মগ্ন হতেন স্বর-সাধনায়। আলাপ-বিস্তার-তারানার কারুকাজের মুহূর্তেও তাঁর সৌম্য-সমাহিত মুখমণ্ডলে বিকৃতির সামান্যতম আভাসও দেখা যেত না। পণ্ডিত রবিশঙ্কর স্মরণ করেন, “গান গাইতে বসে লোকটার কোনও লম্ফঝম্প নেই, হাত-নাড়া মুখ-ভেঙচানো নেই, শ্রোতার সঙ্গে চোখ মিলিয়ে তারিফ নেওয়ার চেষ্টা নেই। চোখ বন্ধ করে যেন পুজো করছেন, এইরকম একটা ধ্যানগম্ভীর ভাব…।” আবার তিনিই, কোনও এক বর্ষায় কলকাতার পাঁচটি আসরে মেঘ রাগ পরিবেশন করেছিলেন পাঁচটি ভিন্ন উপায়ে। সেতারিয়া মণিলাল নাগের কথায়, ‘তাঁর কল্পনাশক্তি কোন পর্যায়ের ছিল, ভেবে দেখো — পাঁচটা আসরে একই রাগ নিয়ে তিনি পাঁচটা আলাদা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। অমন রাগবিস্তারের শক্তি, ওই প্রকার দখল কখনও দেখিনি।’ তিনি উস্তাদ আমির খাঁ (Ustad Amir Khan), যাঁর সুরের মায়াজালে নিবিষ্ট শ্রোতা মাত্রেই মগ্ন হয়েছেন যুগে যুগে।
আমির খাঁ-র (Ustad Amir Khan) জন্ম ১৯১২ সালের ১৫ আগস্ট মহারাষ্ট্রের আকোলে শহরে, যদিও বড় হয়ে ওঠেন ইন্দোরে। পরিবারে সংগীতের রেওয়াজ ছিল ছেলেবেলা থেকেই। তাঁর এক পূর্বপুরুষ ছিলেন খোদ মুঘল দরবারের সভাগায়ক। আর বাবা শাহমির খাঁ সারেঙ্গী বাজাতেন। বালক আমিরের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হাতেখড়িও বাবার কাছেই, সারেঙ্গী শেখার মধ্য দিয়ে। সেকালের বিভিন্ন ঘরানার বিখ্যাত সব কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীদের আনাগোনা ছিল তাঁদের ঘরোয়া সঙ্গীতের আসরে। ফলে, অল্পবয়সেই বিভিন্ন ঘরানার গায়কীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন আমির খাঁ-সাহেব। যদিও তিনি যন্ত্রসংগীত থেকে কণ্ঠসংগীতের দিকেই বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু কোনও প্রতিষ্ঠিত ঘরানায় টানা তালিম মেলেনি তাঁর, মাথার ওপর ছিল না কোনও উস্তাদের আশীর্বাদও। ১৯৩৭ সালে বাবা শাহমির খাঁ মারা গেলে ভাগ্যের অন্বেষণে প্রথমে তিনি পাড়ি জমালেন বোম্বাই এবং পরে কলকাতায়। সেই কলকাতা, যে শহর একদিন তাঁকে মাথায় করে রাখবে।
আমির খাঁ যখন কলকাতায় গাওয়া শুরু করলেন, সবাই তখন মজে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ-র সংগীতের জাদুতে। তিনি আসরে নিজের পছন্দের চেয়ে শ্রোতার পছন্দের ওপরই নির্ভর করতেন বেশি। শ্রোতারা তাঁর কাছে পাঞ্জাবি হরকৎ প্রত্যাশা করে, দুর্দান্ত তান আশা করে — কখনও নিরাশ করেননি বড়ে গুলাম। পাশাপাশি শ্রোতার মন ভোলাতে তাঁর ঠুংরি ছিল অসম্ভব কার্যকরী। ফলে খাঁ সাহেবের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথ সহজ ছিল না। সেই লড়াই নিজের জন্য আরও কঠিন করে দিয়েছিলেন স্বয়ং আমির খাঁ-ই। বড়ে গোলামের সঙ্গে লড়াইয়ে নামার আগে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যে ঠুংরি গেয়ে বড়ে গোলাম শ্রোতাদের মাত করে দেন, সেই ঠুংরি তিনি গাইবেনই না কোনও আসরে। প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন তিনি। কখনও কোনও আসরে ঠুংরি, দাদরা গাননি।
অন্যদিকে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে কীভাবে অতিক্রম করতে হয়, তারও মোক্ষম উদাহরণ তিনি। ফ্যারিঞ্জাইটিসের জন্য তারসপ্তকের রেখাবের ওপর গলা উঠত না, চড়ায় উঠতে পারতেন না, আওয়াজ চাপতে হত। কিন্তু সেই লিমিটেড রেঞ্জেই রাগে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতেন। বিশিষ্ট সেতারিয়া পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে খণ্ডমেরুর যে রেওয়াজ, তা আমির খানের থেকে ভালো কেউই করেননি।’ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কনসার্ট সাধারণত তিনটি লয়ে বাঁধা হয়, ‘বিলম্বিত’ বা ‘অতিবিলম্বিত’ লয়ে শুরু হয়ে ‘মধ্যলয়’ পেরিয়ে ‘দ্রুতলয়’-এ শেষ। আমির খাঁ ক্রমটা উল্টে দেন, এবং নিজস্ব কারুকাজ মিলিয়ে যে স্বকীয় গায়নরীতি গড়ে তোলেন তা সৃষ্টি করে এক নতুন ঘরানার, তাঁর জন্মস্থানের নামে ঘরানার নাম হয়, ‘ইন্দোর ঘরানা’।
তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে প্লেব্যাকের মধ্যে দিয়ে ছায়াছবির জগতে তাঁর প্রবেশ, কাজ করেছেন আরও বেশ কিছু ছবিতে। ১৯৭১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে, পেয়েছেন সংগীত নাটক আকাদেমি এবং রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও। ১৯৭৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বুকেই ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় অকাল প্রয়াণ ঘটে তাঁর। কিন্তু, তিনি কি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন? মৃত্যুর দিনকয়েক আগে এক সকালে তিনি রেওয়াজ করছেন, সহকারী গোবিন্দ বসু উপস্থিত। এক গান্ধারে অকল্পনীয় সুর লাগল তাঁর। খাঁ সাহেব গাওয়া থামিয়ে দিলেন। তার পর আস্তে আস্তে বললেন, ‘ঔর জাদা দিন নহি, গোবিন্দ। ইয়ে গান্ধার জিসে লগ যাতা হ্যায়, ও ইনসান জাদা দিন রহেতা নহি!’ শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্যগগনে তিনি ছিলেন সুরসম্রাটের মতো। তাঁর জন্মদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য!
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।