Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বিয়েপাগলা বুড়ো

বাংলালাইভ

জানুয়ারি ২০, ২০২৫

Banglalive_Dhrupadi_Dinabandhu Mitra_20.1.2025_AG
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

(Dinabandhu Mitra)

স্বদেশানুরাগী শ্রীযুক্ত বাবু শারদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় প্রণয়পারাবারেষু।

প্রিয়বন্ধু শারদাপ্রসন্ন!

মদীয় দীনধাম ভবদীয় কণক নিকেতনের নিকট নিবন্ধন বাল্যকালাবধি তোমার সহিত আমার অকৃত্রিম বন্ধুতা; তুমি সহস্র কর্ম পরিহার পুরঃসর আমার পরিতোষ সাধন করিতে পরাম্মুখ নও। প্রথম দর্শনাবধি তুমি আমায় এতই ভালবাস, তোমার নিতান্ত বাসনা আমি সতত তোমার নিকট থাকি কিন্তু কাৰ্য্যগতিকে সে স্নেহগর্ভ’ বাসনার সম্পাদন অসম্ভব। যাহাকে ভালবাসা যায় তৎসম্বন্ধীয় কোন বস্তু নিকটে থাকিলে কিয়দংশে মনের তৃপ্ততা জন্মে- এই প্রত্যয়ে নির্ভর করিয়া নির্দোষ-আমোদপ্রদ মৎপ্রণীত এতৎ প্রহসনটি তোমার হস্তে ন্যস্ত করিলাম।

ইতি
দর্শনোৎসুকমনাঃ শ্রীদীনবন্ধু মিত্র (Dinabandhu Mitra)

প্রথম অঙ্ক
প্রথম গর্ভাঙ্ক

নসিরাম এবং রতা নাপতের প্রবেশ

নসি। বুড়ো ব্যাটা বিশ্বনিন্দুক।
রতা। কেশব বাবুকে সকলেই ভাল বলে, কেবল বুড়ো ব্যাটা গালাগালি দেয়। বলে কালেজে পড়ে যখন জলপানি পেয়েচে তখন ওর আর জাত কি?
নসি। মাথার উপর শকুনি উড়চে, তবু দলাদলি কত্তে ছাড়ে না। আর বৎসর বাগান বেচে দলাদলি করেছিল; স্কুলে একটি পয়সা দিতে হলে বলে আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, কোথা হতে টাকা দেব?
রতা। চক্রবর্তীরে ওর জামাইয়ের বাড়ীতে বগুনো দেইনি বলে তাদের বাড়ী খেতে গেল না, ওদের পাড়ার কাকেও যেতে দিলে না, দু’শ লোকেব ভাত পচালে।
নসি। ওর জামাইযের বাড়ী হলো ভিন্ গাঁয়, তাকে বগুনো দেবে কেন? তাকে দিতে গেলে আর এক’শ লোককে দিতে হয়।রতা। কেশব বাবুর বাপ যদি ঘোষদের রক্ষা না কত্তেন তবে ব্যাটা তাদের জাত মেরে- ছিলো।
নসি। যথার্থ কথা বলতে কি, রাজীব মুখুয্যে না মলে দেশের নিস্তার নাই। ভুবনের মামাদের এক বৎসর একঘরে করে রেখেচে। তাদের অপরাধ তো ভারি-কালী ঘোষের ছেলে ক্রিস্চান হতে গিয়ে ফিরে এসেছিল, তা কালী ঘোষের জাত না মেরে তারে সমাজভুক্ত করে রেখেচে।
রতা। কাল ব্যাটার ভারি নাকাল করিচি- দশ গণ্ডা কাগের ডিমের শাঁস ওর মাতায় ঢেলে দিইচি।
নসি। কখন?
রতা। কাল প্রাতঃস্নান করে নামাবলি- খানি গায় দিয়ে যেমন বাড়ী ঢুকবে, আমি ওদের পাঁচিলের উপর থেকে এক হাঁড়ি শাঁস ঢেলে দিয়ে পালিয়েছিলেম; ব্যাটা আবার নেয়ে মরে। কত গালাগালি দিলে কিন্তু আমায় দেখতে পাই নি।
নসি। ভুবন বড় মজা করেচে-বুড়ো ধৃতি নামাবলি রেখে স্নান কত্তেছিল, এই সময়ে পাঁটার নাড়িভুড়ি নামাবলিতে বে’ধে রেখে পালিয়েছিল। বুড়ো নামাবলি গায় দিতে গিয়ে কেদে মরে, বল্যে এ রতা নাস্তে করে গিয়েচে।
রতা। ব্যাটার আমার উপর ভারি রাগ। যে কিছু করুক আমারে দোষে, বলে নাস্তের ছেলেকে লেখাপড়া শেখালে বিপরীত ফল ঘটে। (Dinabandhu Mitra)

ভুবনমোহনের প্রবেশ

ভুব। ওহে ইনিস্পেক্টার বাবু এসেচেন, কাল আমাদের পরীক্ষা হবে।
নসি। আমাদের পুরাণো পড়া সব দেখা আছে।
ভুব। আমি বিশেষ মনোনিবেশ ক’রে পড়াগুলিন দেখবো।
রতা। দেখ ভাই, পণ্ডিত মহাশয় আমাদের জন্যে এত পরিশ্রম করেন, আমরা যদি ভাল পরীক্ষা না দিতে পারি তবে তিনি বড় দুঃখিত হবেন।
ভুব। রাজীব মুখুয্যে ইনিস্পেক্‌টার বাবুকে দেখে বড় রাগ করেচে, বল্যে এই ক্রিস্চান ব্যাটা এয়েচে।
নসি। ব্যাটা ইনিস্পেক্টার বাবুর উপর এত চলো কেন?
রতা। ইনিস্পেক্টার বাবুর সহিত এক দিন বিধবাবিবাহ উপলক্ষে তর্ক হয়েছিল, তাতে অনেক বিচারেব পর ইনিস্পেক্টার বাবু বলেছিলেন, “আপনার ষাট বৎসর বয়সে স্ত্রীবিযোগ হওয়াতে অধীর হয়ে পুনর্ধার দারপরিগ্রহের জন্য উন্মত্ত হয়েচেন, অতএব আপনার পোনের বৎসর বয়স্কা বিধবা কন্যা পুনর্ব্বার বিবাহ করিতে ইচ্ছুক কি না বিবেচনা করে দেখুন।” ব্যাটার বিচার করিবার ক্ষমতা নাই, গলাবাজিতে যা কত্তে পারে; আর মুখখানি মেচোহাটা, ইনিস্পেক্‌টার বাবুকে যা না বলবের তাই বল্যে।
নসি। আমি সেখানে থাকলে বুড়োর গলায় জয়ট্যাম্টেমি বেধে দিতেম। (Dinabandhu Mitra)

আরও পড়ুন: প্রকাশগলির ভিতর দিয়ে

রতা। ‘যদি পরমেশ্বরের কৃপায় কাল পরীক্ষা ভাল দিতে পারি, তবে বুড়োরি এক দিন আর আমারি এক দিন।
ভুবন। ইনিস্পেক্‌টার বাবুকে সন্তুষ্ট কত্তে না পারলে কোন তামাসা ভাল লাগবে না।
নসি। কলিকাতায় ছাত্রেরা পরীক্ষার পর গিবর্টের বাজি দেয়, আমরা পরীক্ষার পর রাজীব মুখুয্যের বাজি দেব।
ভুবন। সে সাপটা আছে তো?
রতা। সব আছে, পরীক্ষাটি শেষ হোক্ না।
নসি। কি সাপ?
রতা। সোলার সাপ।
নসি। তাতে কি হবে।
রতা। দুটি বাবলার কাঁটা আর একটি সোলার সাপে বুড়োর সর্বনাশ করবো-যে রতার কথা সইতে পারে না, সেই রতার চড় খাবে আরো বলবে লাগে না। লোকে জানে বাবা যে সর্পের মন্ত্র জানতেন তা মরবের সময় আমায় দিয়ে গিয়েচেন বুড়োরে সাপে কাম্ড়ালে কাজেই আমায় ডাক্বে, আমি চপেটাঘাতে নির্বিষ করবো।
গোপালের প্রবেশ
গোপা। বড় মজা হয়েচে, রাজীব মুখুয্যের খ্যাপান উঠেচে-
রতা। কি খ্যাপান?
গোপা। “পেঁচোর মা” বল্যেই ব্যাটা তাড়িয়ে কাড়াতে আসে।
নসি। কেন?
গোপা। পেঁচোর মা বুড়োর মেয়ের সঙ্গে কথা কইতেছিল, বুড়ো ঘরে ভাত খাচ্ছিল, কথায় কথায় পেঁচোর মা রামমণিকে বল্যে, তোমার বাপের চেয়ে আমার বয়স কম, বুড়ো ওমনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, ভাত- গুলিন পেঁচোর মার গায় ফেলে দিলে, আর এ’টো হাতে মাগীর পিটে চাপড় মাত্তে লাগলো, মায়েশের রথের লোক জমে গেল। বুড়ো বলতে নাগুলো “দেখ দেখি আমার বিবাহের সম্বন্ধ হচ্চে, বেটি এখন কি না বলে আমি ওর অপেক্ষা বড়, আমি যখন পাঠশালে লিখি
তখন বেটিকে ঐরূপ দেখিচি।”
নসি। কোন্ পে’চোর মা?
গোপা। রাজি ডোমের মাগ-রামুজি মরে গিয়েচে, মাগী একা আছে, কেউ নাই, কেবল একটি ধাড়ী শুকর নিয়ে থাকে।
রতা। দুজনেরি বয়স এক হবে।
গোপা। যদি কেহ বলে মুখোপাধ্যায় মহাশয় পে’চোর মার বয়স কম, বুড়ো ওমনি গালে মুখে চড়ায় ‘আর তাড়িয়ে কাড়াতে আসে; এখন অধিক বলতে হয় না; শুধু পে’চোর মা বল্যেই হয়।
নেপথ্যে। বুড়ো বামুনা বোকা বর।
পেঁচোর মারে বিয়ে কর। (Dinabandhu Mitra)

রাজীব মুখোপাধ্যায় এবং দশ জন বালকের প্রবেশ

রাজী। যম নিদ্রাগত আছেন, এত বালক মরচে তোমাদের মরণ হয় না-কি বল্লো দৌড়াতে পারি নে, তা নইলে একটি একটি ধরি আর খাই।
বালকগণ। বুড়ো বাম্না বোকা বর।
পে’চোর মারে বিয়ে কর।
বুড়ো বাম্না বোকা বর।
পে’চোর মারে বিয়ে কর।
নসি। যা সব স্কুলে যা, বেলা হয়েচে, ইনিস্পেক্টার বাবু এয়েচেন, সকালে সকালে স্কুলে যা। (Dinabandhu Mitra)

[বালকদের প্রস্থান।

আরও পড়ুন: আংরেজ বিবির অসম্পূর্ণ উপাখ্যান

মহাশয়ের অদ্য স্নানে অধিক বেলা হয়েচে, নানান কৰ্ম্মে ব্যস্ত থাকেন।
রাজী। আমাকে পাগল করেচে।
নসি। অতি অন্যায়, আপনি বিজ্ঞ, গ্রামের মস্তক, আপনার সহিত তামাসা করা অতি অনুচিত। মহাশয়ের গৃহ শূন্য হওয়াতে সকলেই দুঃখিত।
রাজী। তুমি বাবু আমার বাগানে যেও, তোমাকে পাকা আতা আর পেয়ারা পাড়তে দেব।
রতা। যে মেয়েটি স্থির হয়েচে মুখো- পাধ্যায় মহাশয়ের কাঁদ পর্য্যন্ত হবে।
রাজী। কোন্ মেয়েটি?
রতা। আজ্ঞা-ঐ পে’চোর মা।

রাজী। দূর ব্যাটা পাজী গর্ভস্রাব, যমের ভ্রম-ভাঁড় হাতে করগে, তোর লেখা পড়া কাজ কি। দেখি তোর কাকা জমিগুলো কেমন করে খায়, রাজীব এমন ঠক্ নয় এখনি নায়েবকে বলে তোর ভিটেয় ঘুঘু চরাবে। পাজী- আঁস্তাকুড়ের পাত কখন স্বর্গে যায়।
[সরোষে রাজীবের প্রস্থান]
নসি। বেশ তৈয়ের হয়েচে।
গোপা। বিয়ের নামে নেচে ওঠে-কণক বাবুর বাগানের কাছে ওর চার বিঘা ব্রহ্মত্তর জমি ছিল; রায় মহাশয় সেই জমি কয়েকখানার দ্বিগুণ মূল্য দিতে চাইলেন তবু দিলে না, রামমণি কত উপরোধ করলে কিছুতেই শুনলে না; তারপর রতা শিখায়ে দিলে, বিয়ের সম্বন্ধ করে দেব স্বীকার করুন জমি অমনি দেবে। রায় মহাশয় তাই করে জমি হস্তগত করেচেন কিন্তু তার উচিত মূল্যের অধিক দিয়াছেন।
রতা। এখন বড় মজা যাচ্ছে-ব্যাটা দু বেলা লোক পাঠিয়ে খবর নিচ্চে বিয়ের কি হলো। কণক বাবু আমায় বলেচেন একটা গোলমাল করে ব্রাহ্মণের ভ্রম ভঙ্গ করে দাওগে। আমি কি করবো কোন উদ্দেশ পাচ্চি নে।
ভুবন। বাবা যে দুঃখিত হন, তা নইলে ওর পানের ডিবের ভিতর আমি কে’চো পুরে রাখতে পারি।
রতা। তোমাদের কারো কিছু কত্তে হবে না, একা রতা ওর মাতা খাবে। (Dinabandhu Mitra)

[সকলের প্রস্থান]

দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
রাজীব মুখোপাধ্যায়ের দরজার ঘর
রাজী আসীন
রাজীব। পে’চোর মা বেটিই আমাকে বুড়ো করে তুলেচে, গ্রাম ময় রাষ্ট্র করে দিয়েচে ওর যখন বিয়ে হয় আমি তখন মল্লিকদের বাড়ী গোমস্তাগিরি কর্ম করি-কি ভয়ানক কথা ব্যক্ত করেছে, আমার কলোপ, কালাপেড়ে ধৃতি, কৌশল সব বৃথা হলো-এ কথা মনের ভিতর আন্দোলন করিলেও হানি হতে পারে। মন! প্রকৃত অবস্থা বিস্মৃত হও, বিবেচনা কর
আমি বিশ বৎসরের নবীন পুরুষ, আমি ছোলাভাজা কড়মড় করে চিবিয়ে খেতে পারি, আমি দৌড়ে বেড়াতে পারি, আমি সাঁতার দিয়ে নদী পার হতে পারি, আমি ষোড়শী প্রেয়সীকে অনায়াসে কোলে তুলে লতে পারি। বেটিকে দেখলে আমার অঙ্গ জ্বলে যায়, তা নইলে কিছু টাকা দিয়ে বেটিকে বলতে বলি পে’চো যে বার মরে সেই বার আমি হই- আবার ভারত ছাড়া বেটির নাম কচ্চি, বেটির মুখভঙ্গিমা মনে হলে হৃৎকম্প হয়। (দরোজায় আঘাত) কে-ও, ঠক্ ঠক্ করে ঘা মারে কে-ও।
নেপথ্যে। আমরা দুটি অতিথি।
রাজী। এখানে না, এখানে না, মেয়ে- মানুষের বাড়ী।
নেপথ্যে। আজ্ঞা, সন্ধ্যা হয়েচে, আমরা কোথা যাই, আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের স্থান দেন।
রাজী। কি আমার সন্ধ্যা হয়েচে গো-যা বাবু স্থানান্তরে যা, আমার বাড়ী লোক নাই, জন নাই, করে কর্মে কে। আমি বুড়ো হাড়া-(জিব কেটে স্বগত) এই জন্যে ও সকল কথা আন্দোলন কত্তে চাই নে, দেখ দেখি আপনিই “বুড়ো হাড়া” বলে ফেল্যেম।
নেপথ্যে। আমাদের কিছু চাল ডাল দেন, আমরা স্থানান্তরে পাক করে খাইগে, আমরা নিঃসম্বল, চাল ডাল দিয়ে আমাদের রক্ষা করুন, আমরা দিবসে চিড়ে খেয়ে রইচি।
রাজী। দূর হ ব্যাটারা, দূর হ এখান থেকে-অতিথি ব’লে আসেন তার পর চুরি করে সর্বস্ব লয়ে যান।
নেপথ্যে। আপনার বোধ করি কখন কিছু, চুরি হয় নি।
রাজী। হোক্ না হোক্ তোর বাবার কি, পাজী ব্যাটারা, গোচর ব্যাটারা।
নেপথ্যে। নরপ্রেত, এই সন্ধ্যার সময় ব্রাহ্মণ দুটোকে কিঞ্চিৎ অন্নদান কত্তে পাল্যে না। চল অপর কোন বাড়ী যাওয়া যাক্।
রাজী। রামমণি বড় সন্তুষ্ট হয়েচে, কণক বাবুকে জমি চারখান ছেড়ে দেওয়াতে সকলেই সন্তুষ্ট হয়েচে, এখন কণক বাবু, আমাকে সন্তুষ্ট করেন তবেই সকলের সন্তোষ, নইলে ঘর দরোজায় আগুন লাগাবো। কণক রায় তেমন লোক নয়, একটি মেয়ে স্থির করবেই, ক্ষমতা কত, মান কেমন, কণকের প্রতাপে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। (দরোজায় আঘাত) ঠক্ ঠক্ ঠক্, রাত্রিদিনই ঠক্ ঠক – (দরোজায় আঘাত) আবার ঠক্ ঠক্, কচ্চিই ঠক্ ঠক্ (দরোজায় আঘাত) কে-ও, কথা কয় না কেবল ঠক্ ঠক্ (দরোজায় আঘাত) দরো- জাটা ভেঙ্গে ফেল্যে, কে ও, রামমণিকে ডাবো না কি? গিয়েচে ব্যাটারা; রতা ব্যাটা আমার পরমশত্রু, ব্যাটারে কি করে শাসিত করি তার কিছু উপায় দেখি নে।
নেপথ্যে। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় মহা- শয় আলয়ে আছেন? ওহে বাপু তাকিয়ে ঠেসান দিয়ে আমরাও এক কালে ওরূপ অধ্যয়ন করিচি, পড়ায় এত মন দিয়েচ, আমার কথা শুনতে পাচ্চো না? (Dinabandhu Mitra)

আরও পড়ুন: শূন্যের মাঝার

রাজী। (স্বগত) এ ঘটক, আমাকে বালক বিবেচনা করেচে, আমায় কিছু দেখতে পাই নি, কেবল কাপড়ের পাড় দেখতে পেয়েচে। (প্রকাশ্যে) আপনি কার অনুসন্ধান কচ্যেন মহাশয়?
নেপথ্যে। আমি রাজীবলোচন পাধ্যায় মহাশয়ের অনুসন্ধান কচ্চি। মুখো-
রাজীব। কি জন্যে?
নেপথ্যে। দ্বার মোচন করুন, তার পরে বলচি।
রাজীব। কিজন্য এসেচেন, আর কার নিকট হতে এসেচেন, না বল্যে আমি কখনই পড়া ছেড়ে উটতে পারিনে-
“মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।”
নেপথ্যে। বাবুজী, রাজীব বাবুর সম্বন্ধের জন্যে আমাকে কণক বাবু পাটিয়েচেন, আমি ঘটক।
রাজী। “কিবা রূপ, কিবা গুণ কহিলেক ভাট। খুলিল মনের দ্বার, না লাগে কপাট।”
নেপথ্যে। নবীন পুরুষেরা স্বভাবতঃ কবিতাপ্রিয়-আমি প্রেমাবুদ, রাজীবের বিচ্ছেদ সন্তপ্ত চিত্তে প্রেমবারি বর্ষণ কত্তে
আমার আগমন।
রাজী। (স্বগত) এই সময় আমার স্বকৃত নবীন কবিতাটি কেন শুনিয়ে দিই না। (প্রকাশ্যে)
পীরিতি তুল্য কাঁটাল কোষ।
পঙ্কজ মূল ভাল কি লাগে।
বিচ্ছেদ আটা লেগেচে দোষ। চাকের মধু মিজি
কণ্টক নাগ না যদি রাগে।
মৌমাচি খোঁচা
আইল বিষ পাঁ
অঙ্কিত মৃগ সোমের অঙ্গে।
নেপথ্যে। আপনার অতি সুশ্রাব্য স্বর- আপনি কপাট উদ্ঘাটন করুন, আমি ভিতরে গিয়ে আপনার নবীন মুখচন্দ্রের অমৃত পান করে পরিতৃপ্ত হই।
রাজী। যে আজ্ঞা। (কপাট উদ্ঘাটন, ঘটকের প্রবেশ, পুনর্ব্বার দ্বার রোধ)
ঘট। আমি অধিক ক্ষণ বসতে পারবো না, আপনার দেশ বড় মন্দ, বালকেরা আমাকে বিদেশী দেখে গায় ধূলা দিয়েচে, আমি ওপাড়ায় আর যাব না।
রাজীব। মহাশয়, আপনার বাড়ী আপনার ঘর, এখানে থাকবেন, আপনার অপর স্থানে যেতে হবে না।
ঘট। রাজীব বাবুকে একবার সংবাদ দেন। রাজী। আজ্ঞা আমারই নাম রাজীবলোচন -ও রামমণি, রামমণি, ওরে কলকেডায় একটু আগুন দিয়ে যা-(তামাক সাজন) পিতা, ভ্রাতার পরলোক হওয়াতে সকল ভার আমার কোমল স্কন্ধে পড়েচে। আপনার মধ্যাহে আহার হয়েছিল কোথায়?
ঘট। কণক বাবুর বাড়ী-আমি আপনাকে মূলকাটিতে একটা কথা বলি, আপনি কাহারো তামাসা ঠাট্টায় ভুলবেন না-এ সম্বন্ধে আপনাকে অনেকে ভাংচি দেবে, আপনার আত্মীয় বন্ধু সকলেই এ সম্বন্ধে অসম্মত হবে, আর বলবে পাঁচ ব্যাটা গাঁজাখোরে পিতৃ- হীন বালকটিকে নষ্ট কচ্চে।
রাজী। আপনি আমার পরম বন্ধু, আমি কারো কথা শুনবো না, লোকে সহস্র বার নিষেধ কল্যেও ফিরবো না, আপনি যে পথে যেরূপে লয়ে যাবেন সেই পথে সেইরূপে যাবো; আমি মুরুব্বিহীন, আপনাকে আমি মুরুব্বি কল্যেম।
ঘট। আপনার কথায় আমি বড় সন্তুষ্ট হলেম-বয়স আপনার এমন অধিক কি, আপনার পিতার ধীশব্দ নাম, অতুল্য ঐশ্বর্য্য, কুলীনের চূড়ামণি, অতি শিশুকালে বিয়ে দিয়েছিলেন তাই আপনাকে দোজবরে বলতে হচ্ছে, নচেৎ এমন বয়সে কত আইবুড়ো ছেলে রয়েচে-এই যে কণক বাবুর পুত্রের বয়স ষোল বৎসর, এক্ষণে তাঁর পুত্রবধূর-পরমেশ্বর করেন না হয়-মৃত্যু হলে কি তাঁর পুত্রকে দোজবরে ব’লে ঘৃণা করবো? কন্যা-কর্তারা সকল ভার আমাকে দিয়েচেন, এক্ষণে, এ পক্ষের মতের স্থিরতা জান্তে পারলে লগ্ন নির্ণয় করে শুভকর্ম সম্পন্ন করা যায়।
রাজী। এ পক্ষের মতামত কি? মহাশয় সে পক্ষের ভার লয়েচেন, এ পক্ষের ভারও মহাশয়ের উপর-ভাষা কথায় বলে “বরের ঘরের পিসী, কনের ঘরের মাসী” আপনিও তাই।
ঘট। আমি আপনার কবিতা শন্তিতে আরো সন্তুষ্ট হইচি; আপনার শাশুড়ীর ইচ্ছে একটি সুরসিক জামাই হয়, যেমন মেয়েটি চট্টপটে, হে’য়ালির হারে কথা কয়, তেমনি একটি রসিকের হাতে পড়ে।
রাজী। মেয়েটির বয়স কত?
ঘট। এ কথা কারো কাছে প্রকাশ করবেন না, মেয়েটি তের উৎরে চোদ্ন্দয় পড়েচে-ভদ্র- লোকের ঘরে অভিভাবক না থাকা বড় ক্লেশ, তোমার শ্বশুর, টাকা গহনা সব রেখে গিয়েচেন, তবু যোটাযোট করে এমন লোক নাই ব’লে এত দিন অবিবাহিতা রয়েচে বাপু, তুমি এখন আপনার জন, তোমার কাছে ঢাক্ ঢাক্
গুড় গুড় কি, মেয়ের স্ত্রীসংস্কার হয়েচে। রাজী। ভালইত, তাতে দোষ কি, তাতে দোষ কি?
ঘট। তাওষে বয়সগুণে হয়েচে তা বোধ হয় না-চম্পক আমাদের স্বভাবতঃ হৃষ্টপুষ্ট, বিশেষ আদুরে মেয়ে, পাঁচ রকম খেতে পায়
তাইতে তের বৎসরে ও ঘটনা ঘটেচে।
রাজী। মহাশয় লজ্জিত হচ্চেন কেন, আমি এরূপই ত চাই। আমি ত আর পঞ্চম বৎসরের বালকটি নই! বিশেষ আমার সংসারে গিন্নি নাই, মেয়ে বয়স্থা হলে আমার নানারূপে মঙ্গল।
ঘট। আপনার যেমন মন তেমনি ধন মিলেচে।
রামমণির আগুন লইয়া প্রবেশ
রাম। (কলিকায় আগুন দিয়া) বাবা দুধ গরম করে আনবো?
রাজী। (মুখ খিচিয়ে) বাবা দুদ গরম করে আনবো, পাজী বেটি, আঁটকুড়ীর মেয়ে (মুখ খিচিয়া) ওঁয়ার বাবা কেলে বাবা।
রাম। বুড়ো হলে বাহাত্তরে হয়, শূলের ব্যথায় মচ্চেন, দুধ-
রাজী। তোর সাত গোষ্টির শুল হোক্- পাজী বেটি, দূর হ এখান থেকে, কড়েরাঁড়ী, আমার বাড়ী তোর আর জায়গা হবে না, তোর ভাতারের বাবা রাখে ভাল, না হয় নতুন আইন. ধরে বিয়ে কর গে।
রাম। তোমার মতিচ্ছন্ন ধরেচে, (রোদন) হা পরমেশ্বর! বিধবার কপালেও এত যন্ত্রণা লিখেছিলে, দাসীর মত খেটেও ভাল মুখে দুটো অন্ন পাইনে-বাবা আমি তোমার-
রাজী। আ মলো আবার বলতে নাগলো -ওরে বাছা তুই বাড়ীর ভিতর যা, একজন ভিন্নদেশী লোক রয়েচে, একটু, লজ্জা কত্তে হয়।
রাম। আমার তিন কাল গেচে, আমার আবার লজ্জা কি, আমার যদি গণেশ বে’চে থাক্তো ওঁর চেয়ে বড় হতো।
রাজী। বেটি পাগলের মত কি আবোল তাবোল বক্তে লাগলো, তোর কি ঘরে কাজ নেই।
রাম। ব্যথা আজ ধরি নি?
রাজী। আজো ধরি নি, কোন দিনও ধরি নি-তোর তুই বাড়ীর ভিতর যা। কালো ধরি নি, পায়ে পড়ি বাছা,
রাম। মাগো, খেতে বল্যে মাত্তে ধায়।
[প্রস্থান] (Dinabandhu Mitra)

আরও পড়ুন: নিজস্ব সংবাদদাতা

রাজী। ‘যেমন মা তেমনি মেয়ে।
ঘট।’ মেয়েটি অতি ব্যাপিকা-আপনাকে পিতা সম্বোধন কল্যে না?
রাজী। (স্বগত) এই বুঝি কপালে আগুন লাগে।
ঘট। কামিনীটি কে মহাশয়?
রাজী। আমার সতীনঝি-না, আমার সাবেক স্ত্রীর মেয়ে।
ঘট। মহাশয় আমার পরিশ্রম বিফল হলো।
রাজী। কেন বাবা, অমঙ্গল কথা বল্যে
কেন?
ঘট। উটি তো আপনার মেয়ে?
রাজী। ঘটকরাজ-
ডুবিয়ে সলিল যদি সীমন্তিনী খায়, শিবের অসাধ্য, স্বামী দেখিতে না পায়, ছেলে হয়, গুপ্ত কথা কিন্তু চাপা থাকে; কার ছেলে, কার বাপে, বাপ্ বলে ডাকে। কামিনী কুমার বটে নিশ্চয় বিচার,
স্বামীর সন্তান বলা লোকে লোকাচার। মেয়েটি আমার আমি বলিব কেমনে?
ঘট। মেয়েটির জন্ম তো আপনার বিবাহের পর।
রাজী। তারই বা নিশ্চয় কি-ব্রাহ্মণের ঘরে, মহাশয় তো জ্ঞাত আছেন, মেয়ের বয়স দশ বৎসর তখনও গর্ভধারিণীর বিবাহ হয় নি।
ঘট। তবে ব্রাহ্মণী কি এই মেয়ে কোলে করে পাক্ ফিরে ছিলেন?
রাজী। কোলে করে ফিরেচেন, কি হাত
ধরে ফিরেচেন তা কি আমার মনে আছে। সে
কি আজকের কথা তা আমি তোমায় ঠিক্ করে
বলবো, আমার বিবাহের দিন পলাসির যুদ্ধ
হয়-ঘটক বাবা, বলে ফেলেচি তার আর কি
হবে, বাবা তুমি জালে জালে, শাশুড়ী ঠাকুরুণকে এ কথা বল না, তোমারে খুশী করবো, তোমাকে বিদেয় কত্তে আমি দশ বিঘা ব্রহ্মত্তর জমি বেচবো-সাত দোহাই বাবা মনে কিছু কর না, আমি পিতৃ মাতৃ হীন ব্রাহ্মণ বালক সকল ভার তোমার উপর, তুমি ওঠ বলে উঠবো, বস্ বলে বস্কো।
ঘট। আপনি স্থির হন, আমি এমন ঘটক
নই যে ঐ মাগী আপনার মেয়ে বলে আমি বিয়ে দিতে পারবো না? ওর মা যদি আপনার মেয়ে হয় তা হলেও পিচপা নই।
রাজী। আচ্ছা, আচ্ছা,-বাবা বাঁচালে, আমি বলি তুমি বুঝি রাগ কল্যে।
ঘট। তোমার মেয়েকে আমার এক ভয় আছে।
রাজী। কি ভয়? ওরে আবার ভয় কি?
ঘট। উনি পাছে আপনার নববিবাহিতা প্রণয়িনীকে তাচ্ছিল্য করে মা না বলেন।
রাজী। অবশ্য বলবে। আমার মেয়ে আমার স্ত্রীকে মা বলবে না!
ঘট। সেটি যাচাই না করে আমি কথা স্থির কত্তে পারি না। কারণ আমাদের মেয়েটি অতিশয় অভিমানিনী, উনি যদি মা না বলেন তা হলে সে অভিমানে গলায় দড়ি দিয়ে মত্তে পারে।
রাজী। আমি এখনি যাচাই করে দিচ্চি ও রামমণি! ও রামমণি-ওরে বাছা আর এক- বার বাহিরে এস। (Dinabandhu Mitra)

রামমণির প্রবেশ

রাম। আমায় আবার ডাকুচো কেন? যে গাল দিয়েছ, তাতে কি মন ওটে নি?
রাজী। না মা তোমাকে কি আমি গাল দিতে পারি! তোমার জন্যে সংসারে মাথা দিয়ে রইচি-তবে একটা কথা বলছিলাম কি-আমি যদি আবার বিয়ে করি তোমার যে নূতন মা হবে, তাকে তুমি মা বলে ডাকবে কি না?
বাম। তোমার বিয়েও যেমন হবে, আমিও তেমনি মা বলে ডাকবো। বুড়ো হয়ে বাহাত্তরে হয়েছেন-রাতদিন বিয়ে বিয়ে করে মর্চ্চেন।
রাজী। কি কথায় কি জবাব। ভাল মুখে একটা কথা বল্লেম, উনি আমার গায় এক হাতা আগুন ফেলে দিলেন। এখন স্পষ্ট করে বল, আমি যারে বিয়ে করবো তুমি তাকে মা বলবে কি না?
রাম। আমি আঁশবটি দিয়ে তার নাক কেটে দিব, আর তারে পেত্নী বলে ডাকবো।
রাজী। তোর ভাল চিহ্ন নয়, আমাকে রাগাচ্চিস, আপনার মরবার পথ কচ্ছিস্। আমার স্ত্রীকে মা ববি কি না বল্?
রাম। বলবো না। কখনো বলবো না! তোমার যা খুশি তাই করো।
রাজী। বলব নে-
রাম। না।
রাজী। বল নে-
রাম। না।
রাজী। তোর বাপ যে সে বলবে! বেরো বেটি এখান থেকে-মাকে মা বলবেন না। হাজার বার বলল। তুই তো তুই, তোর বাপ যে সে বলবে। (Dinabandhu Mitra)

[রামমণির বেগে প্রস্থান।

ঘট। এ তো ভারি সর্বনাশ দেখচি।
রাজী। না বাবা-এতে ভয় পেয়ো না। ব্রাহ্মণী বাড়ী আসুক আমি যেমন করে পারি মা বলিয়ে দেব।
ঘটা। তোমার মেয়েকে আমার আর এক ভয় আছে।
রাজী। আর কি ভয়?
ঘট। উনি যে ব্যাপিকা উনি অনেক ভাংচি দেবেন; উনি বলবেন মিছে সম্বন্ধ, মিছে বিয়ে, বাজারের বেশ্যা ধরে কন্যে সাজিয়ে দেবে।
রাজী। আমি কোনো কথা শুনবো না।
ঘট। বৃদ্ধ লোককে লয়ে লোকে এমন কৌতুকবিয়ে দিয়ে থাকে এবং পাঁচটা দৃষ্টান্তও দেওয়া যেতে পারে-আমার ভাবনা হচ্চে পাছে আপনি আপনার তনযার বাক্পটুতায় আমাকে সেইরূপ বিবাহের ঘটক বিবেচনা করেন-কেবল কণক বাবুর অনুরোধে আমার এ কৰ্ম্মে প্রবৃত্ত হওয়া।
রাজী। ঘটক মহাশয়, আমি কচি খোকা নই যে কারো পরামর্শে ভুলবো, বিশেষ স্ত্রী- লোকের কথায় আমি কখন কান দিই না, আপনার কোন চিন্তা নাই, আপনি ‘যদি রতা বেটাকে কন্যা বলে সম্প্রদান করেন আমি তাও গ্রহণ করবো- পাজী ব্যাটা, নচ্ছার ব্যাটা, ছোট লোকের ছেলের কখন লেখা পড়া হয়?
ঘট। বিয়ে না করেন নাই করবেন, গালাগালি দেন কেন? (গাত্রোত্থান)
রাজী। ঘটক মহাশয় তোমারে না, তোমারে
না, আমার মাথা খাও ঘটক বাবা (পদদ্বয় ধারণপূর্বক) তুমি রাগ কর না, আমি রতা নাপ্তেকে বলিচি।

ঘট। তবু ভাল (উপবেশন) নাম ধরে গাল দিলে ভ্রম হতে পাত্তো না।
রাজী। রতা নাপ্তে পাজী, রতা নাপ্তে ছোট লোক; ঘটকরাজ অতি ভদ্র, ঘটক মহা- শয় অতি সজ্জন, ঘটক বাবা বড় লোক।
ঘট। রতা বড় নষ্ট বটে?
রাজী। ব্যাটার নাম কল্যে আমার গা জলে, আমি যদি ব্যাটাকে দৌড়ে ধত্তে পাত্তেম তবে এত দিন কীচক বধ কত্তেম, ব্যাটা আমার পরম শত্রু।
ঘট। গ্রামের ভিতর আর কেউ আপনার মন্দ কচ্চে?
রাজী। আর এক মাগী-ঘটকরাজ আমারে মাপ কত্তে হবে, আমি তার নাম কত্তে পাবো না।
ঘট। আমাকে আপনার অবিশ্বাস কি?
রাজী। বাবা আমাকে এইটি মাপ কত্তে হবে।
ঘট। ভদ্রেেলাকের মেয়ে?
রাজী। মহাভারত, মহাভারত – ডোম, বুড়ো, কালো পেত্নী।
ঘট। আপনি সম্বন্ধের কথা কারো কাছে ব্যক্ত করবেন না, বউ ঘরে এনে তবে সম্বন্ধের কথা প্রকাশ; আপনি এক শত টাকা স্থির করে রাখবেন।
রাজী। আমার দুই শত টাকা মজুত আছে।
ঘট। আপনার বাড়ীতে কোন উদ্যোগ কত্তে হবে না, আপনি শনিবারে সন্ধ্যার পর আমার সঙ্গে যাবেন, রবিবারের প্রাতে গৃহিণী লয়ে গৃহে প্রবেশ করবেন। কন্যাকর্তারা মেয়ে নিয়ে দক্ষিণপাড়ায় রতন মজুমদারের বাগানে থাকবেন, কণক বাবু ঐ বাগান তাঁদের জন্য ভাড়া করেচেন।
রাজী। গোলমালের প্রয়োজন কি, সকল কাজ চুপি চুপি ভাল, আমার পায় পায় শত্রু।
ঘট। আমি আজ যাই।
রাজী। আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।
ঘট। বলুন না?-সকল বিষয়ের মীমাংসা করে যাওয়া উচিত।
রাজী। এমন কিছু নয়-মেয়েটির বর্ণটি কেমন?
ঘট। তরুণ তপন আভা বরণের ভাতি, কাঁচাসোনা চাঁপা ফুল খেয়েচেন নাতি!
হেরে আভা, মনোলোভা, যোগীর মন টলে, খেসারির ডাল যেন বাঁধা মলমলে। নাসিকার শোভা হেরে চঞ্চল নয়ন, ঈষৎ অরুণ লাজে হয়েছে বরণ, সরমে হেলিয়ে দোঁহে করিতে বিহিত কানাকানি কানে কানে কানের সহিত।
অধরে ধরে না সুধা সতত সরস, ভিজেছে শিশিরে যেন নব তামরস।
গোলাপি বরণ পীন পয়োধরদ্বয়- বিকচ কদম্ব শোভা যাতে পরাজয়- বিরাজে বক্ষের মাঝে নিজ গরিমায়, স্থানাভাবে ঠেকাঠেকি সদা গায় গায়; তাতে কিন্তু উরজের অঙ্গ না বিদরে, কমলে কমলে লেগে কবে দাগ ধরে? (Dinabandhu Mitra)

গঠিত বিমল কুচ কোমলতা সারে, নরম নিরেট তাই দেখ একেবারে। চিকণ বসনে কুচ রেখেচে ঢাকিয়ে, কাম যেন তাঁবু গেড়ে আছে বার দিয়ে।
রাজী। “কুচ হতে উচ্চ কেশরী মধ্যখান” -না হয় নি-
“কুচ হতে কত উচ্চ মেরু চূড়া ধরে, কাঁদে রে কলঙ্কিচাঁদ মৃগ লয়ে কোলে”-
না মহাশয়, ভুলে গিয়েচি-তা এরূপ হয়ে থাকে, কালেজের জলপানিওয়ালারাও ঘটকের কাছে চমকে যায়।
ঘট। “কুচ হতে কত উচ্চ মেরু চূড়া ধরে। শিহরে কদম্ব ডরে দাড়িম্ব বিদরে।”
রাজী। আপনি শাশুড়ীর কাছে সেরে-সুরে নেবেন, বলবেন এ কবিতাটি আমি বলিচি। ঘট। শিকারী বিড়ালের গোঁপ দেখলে
চেনা যায়-আপনি সে রসিক তা আমি এক “মৌমাচি খোঁচাতেই” জানতে পেরেচি।
রাজী। “চাকের মধু মিষ্ট কি হইত, মৌমাছি খোঁচা না যদি রইত।”
ঘটক মহাশয় ইটি আমার আপনার রচন।
ঘট। বলেন কি?
রাজী। আজ্ঞা হাঁ।
ঘট। আপনি চম্পকলতার যোগ্য তরু,
রাজযোটক হয়েচে।
রাজী। আপনি রাত্রে অন্ন আহার করে থাকেন?
ঘট। আজ্ঞা, আমার দক্ষিণপাড়ায় যাওনের প্রয়োজন আছে, আমি কণক বাবুর ওখানে আহার করবো-কোন কথা প্রকাশ না হয়, কণক বাবু এর ভিতরে আছেন কেউ না জানতে পারে। (Dinabandhu Mitra)

(প্রস্থান)

রাজী। আমার পরম সৌভাগ্য-আমার রাবণের পুরী ধু ধু কচ্চে, কামিনীর আগমনে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, (তাকিয়ার উপর চিত হইয়া চক্ষু মুদিত করিয়া) আহা! কি অপ- রূপ রূপ, – সোনার বর্ণ, মোটাসোটা- দ্বিতীয়ে বিয়ে হয়েচে-(নিদ্রা।)
নেপথ্যে। এই বেলা ফুটিয়ে দে, আমি সাপ ফেলবো এখন। (রাজীবের অঙ্গুলির গলিতে জানলা হইতে কাঁটা ফুটাইয়া দেওন।)
রাজী। বাবা রে গিচি-(অঙ্গে সোলার সাপ পতন) খেয়ে ফেলেচে-(নেপথ্যে সাপ টানিয়া লওন) এত বড় সাপ কখন দেখি নি (চিত হইয়া ভূমিতে পতন) একেবারে খেয়ে ফেলেচে, করিয়েচে বিয়ে, ও রামমণি, ও রামমণি, ও রামমণি, ওরে আবাগের বেটি, ঝট্ করে আয়, জলে মলাম মা রে-কেউটে সাপে কামড়েচে, একেবারে মরিচি, শিগগির আয়, আমার গা অবশ হয়েচে, আমার কপালে সুখ নাই, আমি এক দিন তার মুখ দেখে মরতেম সেও যে ছিল ভাল-

রামমণির প্রবেশ।

আঙ্গুলের গলিতে কেউটে সাপে কামড়েচে। রাম। ও মা তাই তো রক্ত পড়চে যে, ও মা আমি কোথায় যাবো, ও মা বাবা বই আর যে আমার কেউ নাই-
রাজী। লোক ডাক্ জ্বলে মলেম, আহা! সর্পাঘাতে মরণ হলো। (দরজায় আঘাত)
রাম। ওগো তোমরা এস গো-(ম্বার উন্মোচন) আমার বাবার কাটি ঘা হয়েচে।
দুই জন প্রতিবাসীর প্রবেশ। প্রথম। তাই তো, খুব দাঁত বসেচে- দ্বিতীয়। সাপ দেখেছিলেন?
রাজী। অজগর কেউটে-আমার হাতে কাম্ড়ালে আমি দেখতে পেলেম, তার পর হা করে গলা কাম্ড়াতে এল, লাফিয়ে এসে নিচেয় পড়লেম।
প্রথম। রামমণি, দৌড়ে তোদের কুয়ার দড়াগাছটা আন্। (Dinabandhu Mitra)

(রামমণির প্রস্থান।)

(দ্বিতীয়ের প্রতি) তুমি দৌড়ে রতা- নাপুতেকে ডেকে আন, তার বাপ মরণকালে তার সাপের মন্ত্র রতাকে দিয়ে গিয়েচে, সে মন্ত্র অব্যর্থ-সন্ধান।
(দ্বিতীয়ের প্রস্থান।)
রামমণির দড়া লয়ে পুনঃ প্রবেশ।
রাম। ওগো নাপ্তেদের ছেলেকে ডাক গো, সে বড় মন্ত্র জানে গো-
প্রথম। দড়াগাছটা দাও। (দড়া দিয়া হস্ত বন্ধন)।
রাম। (রাজীবের হস্তে চিমটে কেটে)
লাগে?
রাজী। আবার কাটো দেখি, (পুনর্ব্বার চিমটি কাটন) কোই কিছুই লাগে না।
রাম। তবেই সর্বনাশ হয়েছে, আমার পোড়া কপাল পুড়েচে।
রাজী। আর কেউ মন্ত্র জানে না?
প্রথম। রতার বাপের মন্ত্র সাক্ষাৎ ধল্ব-
স্তরি, সে মন্ত্র মরূব্বের সময় আর কারো দ্যায় নি, কেবল রতাকে দিয়ে গিয়েচে।
রাজী। এমন সাপ আমি কখন দেখি নি- আমার দৌহিত্রকে আন্তে পাঠাও, আমার গা চুলচে, আমার বোধ হচ্চে বিষ মাতায় উঠেছে -আহা! কেবল প্রেমের অঙ্কুর হয়েছিল; রামমণি তোরে বলবো না ভেবেছিলাম, আমার সম্বন্ধের স্থিরতা হয়েছিল, রবিবারে বউ ঘরে আসে; আহা! মরি কি আক্ষেপ, লক্ষনী -এমন ঘরে আসবেন কেন?
রাম। আবার কে বুঝি টাকাগুলো ফাঁকি দিয়ে নেবে-
রাজী। মা! যে নিতো তা আমি জানি- অন্তিম কালে তোমার সঙ্গে কলহ করবো না, তুমি একটু গঙ্গাজল এনে আমার মুখে দাও, আমার চক বুজে আচে-
রাম। বাবা! তোমারে যে কত মন্দ বলিচি, বাবা! তোমারে ছেড়ে থাকবো কেমন করে- (Dinabandhu Mitra)

রতা নাপতে, নসিরাম, ভুবনমোহন এবং
প্রতিবাসীর প্রবেশ।

রাজী। বাবা রতন, তুমি শাপভ্রষ্টে নাপিতের ঘরে জন্ম লয়েচ, তোমার গুণ শুনে সকলেই সুখ্যাতি করে, তোমার কল্যাণে আমার বৃদ্ধ শরীর অপমৃত্যু হইতে রক্ষা কর।
রতা। (দংশন অবলোকন করিয়া) জাত সাপের দাঁত-
রেতে কাটে জাত সাপ
রাখতে নারে ওঝার বাপ৷
তবে বন্ধনটা সময়-মত হয়েচে ইতে কিছু ভরসা হচ্চে-একগাছ মুড়ো খ্যাঁঙরা আনুন। (Dinabandhu Mitra)

(রামমণির প্রস্থান)

আপনার গা কি ঝিম্ ঝিম্ করে আসচে?
রাজী। খুব ঝিম্ ঝিম্ কচ্চে, আমি যেন মদ খেইচি।
রতা। যম বুঝি ছাড়েন না।
মুড়ো ঝাঁটা হস্তে রামমণির পুনঃপ্রবেশ।
ও এখন রাখ, দেখি চপেটাঘাতে কি কত্তে পারি। (আপনার হস্তে ফঃ দিয়া রাজীবের পৃষ্ঠে তিন চপেটাঘাত) কেমন মহাশয় লাগে।
রাজী। রতন লাগে বুঝি-বড় লাগে না। রতা। তবে সংখ্যা বৃদ্ধি কত্তে হলো (সাত চপেটাঘাত।)
রাজী। লাগে যেন।

রতা। ঠিক্ করে বলো-যেন বিষ থাক্তে লাগে বলে সর্বনাশ কর না।
রাজী। আমার ঠিক্ মনে হয় না, আবার মারো।
রতা। আমার হাত যে জলে গেল- (প্রতিবাসীর প্রতি) মহাশয় মাত্তে পারেন, আমি আপনার হস্ত মন্ত্রপূত করে দিচ্চি।
প্রথম। না বাপু আমি পারবো না-এই
ভুবনকে বলো।
রত্য। ভুবন তোমার হাত দাও তো। (ভুবনের হস্তে ফ দেওন) মার।
ভুবন। (স্বগত) আমাদের ভাত পচিয়েচ, আমাদের একঘরে করেচ-(প্রকাশে) ক চড় মাত্তে হবে?
রতা। তিন চড়।
ভুবন। (গণনা করে চপেটাঘাত) এক- দুই-তিন-চার-পাঁ-
প্রথম। আর কেন।
রতা। হোক্ তবে সাতটা হোক্।
ভুবন। এই পাঁচ-এই ছয়-এই সাত।
রতা। কেমন মহাশয় লাগচে? (Dinabandhu Mitra)

রাজী। চপেটাঘাতে পিট ফুলে উঠেচে ও তার উপরে মাচ্চে, আমি কিছুই বোধ কত্তে পাচ্চি নে।
রতা। মূল মন্ত্র ভিন্ন বিষ যায় না-
(মন্ত্র পাঠ)

এলো চুলে বেনেবউ আল্তা দিয়ে পায়। নোলোক নাকে, কলসী কাঁকে, জল আন্তে যায়।
আঁচোল বয়ে, উঠলো গিযে, হলুদে সেপো ব্যাং।
ঘুমের ঘোরে, কামড়ে ধরে, তার একটা ঠ্যাং। তাইতে সতী, গর্ভবতী, পতি নাইকো ঘরে। হায় যুবতী, মৌনবতী, বাক্য নাহি সরে॥ দৈবযোগে, অনুরাগে, সাপের ওঝা যায়।
হে’সে হে’সে, কেশে কেশে, তার পানেতে চায়।
কুলের নারী, বলতে নারি, পেটে দিলে হাত।
ওঝার কোলে, বিলের জলে, কল্যে গর্ভপাত ৷৷ হাত পা হলো বেঙ্গের মত মানুষের মত গা। গলা হলো হাড়গিলের মত, শুয়োরের মত হাঁ ৷৷
মা পালালো, বাপ্ পালালো, রইলো কচি খোকা।
কমচিয়ে চিবিয়ে খেলে দশটা শুয়োপোকা ৷৷ ঘোড়া কেন্নো পুড়িয়ে খেলে
কে’চো দিয়ে তাতে।
আঙ্গুলে ধল্লে কেউটে দুটো গরো ধল্লে দাঁতে ॥
উড়ে এল গরুড় পাকি আকাশের
এক ঠোকরে নিয়ে গেল শুয়োরমুখো ছেলে।। আঙ্গুলগুলো রইল পড়ে খগপতির বরে।
কাজ ফেলে।
চে’চে ছলে মুড়ো ঝাঁটা ওঝার বাপে করে। ঝাঁটার চোটে, আগুন উঠে, কেউটের ভাঙ্গে
ঘাড়। হাড়ির ঝি, পে’চোর মার আজ্ঞা, শিগগির ছাড় ।।
(তিন ঘা ঝাঁটা প্রহার) গা কি ঢুলুচে?
রাজী। বাবা রতন, তুমি ও বেটির নামটা ব’লো না।
রাম। মন্ত্রে আছে তা কি করবে-তুমি আবার মন্ত্র পড়ো।
রাজী এবার ও নামটা মনে মনে বলো। রাম। রোগীতে মন্ত্র না শুনলে কি মন্ত্র ফলে?
রতা। চুপ কর গো- (রাজীবের মুখের কাছে ঝাঁটা নাড়িয়া পুনর্ব্বার মন্ত্র পাঠানন্তর তিন ঘা ঝাঁটা প্রহার করিয়া) কিরূপ বোধ হয়?
রাজী। আমার বাপু গা ঘুরুচে, বিষে ঘুচে কি ঝাঁটায় ঘুচে তা আমি বলতে পারি নে-শেষের ঝাঁটাগুনো বড় লেগেচে।
রতা। আর ভয় নাই- (একটি ঝাঁটার কাটি ভাঙ্গিয়া আঙ্গুলের ঘা মুখে ফুটাইয়া দেওন)
রাজী। বাবা রে মরিচি, জজ্বালাটা একটু থেমেছিল, আবার জ্বালিয়ে দিলে, বড় জ্বালা কচ্চে, মলেম।
রতা। বাঁচলেম-এখন দশ কলসী কুয়ার জল দিয়ে নাইয়ে আনো।
[রাজীব, রামমণি ও প্রতিবাসীদিগের প্রস্থান। ভুবন। আমি ভাই ব্যাটাকে খুব মেরেচি।
রতা। সে বোতলটা কই?
নসি। এই যে।
রতা। (বোতল গ্রহণ করিয়া) ব্যাটাকে এই আরকটি খাইয়ে যাব।
ভুবন। কিসের আরক?
রতা। এতে ভাঁটপাতার রস আছে, শিউলিপাতার রস আছে, বুড়ো গোরুর চোনা আছে, ভ্যান্ডার তেল আছে, প্যাঁজ রসুনের রস আছে, কুইনাইন আছে, লবণ আছে; এর নাম “নরামৃত”।
নরামৃত কল্যে পান।
সশরীরে স্বর্গে যান।
নরামৃতের সহস্র গুণ-
ব্যাস পেটে বাঁজা বউ নরামৃত খায়।
সাত ছেলে, পায় কোলে, পতি পড়ে পায়।
ভুবন। হরে শাড়ির দোকান থেকে একটু মদ দিলে হ’ত।
রতা। আমি সে মত করেছিলেম, নসি বল্যে বুড়োর ধর্ম নষ্ট হবে।
নসি।
চুপ্ কর, আচে।
রাজীব এবং প্রতিবাসীদ্বয়ের প্রবেশ
রতা। হস্তের বন্ধন খুলে দেন, আমি নরামৃত খাওয়াই।
দ্বিতীয়। (হস্তের বন্ধন খুলিয়া) তোমার বাপের সেই আরক বটে?
রতা। আজ্ঞা হ্যাঁ- (রাজীবের গালে আরক ঢালিয়া দেওন)
রাজী। ও রামমণি-ওয়াঃ কি খাওয়ালে- ও রামমণি, ওরে জল নিয়ে আয়, গন্ধ দেখ, ওয়াঃ ওয়াঃ মলেম; ও রামমণি ওরে নেবুর পাতা নিয়ে আয়-ওয়াঃ।
প্রথম। ও বড় মাতব্বর ঔষধি, উটি উদরে ধারণ করে রাখুন।
রাজী। ও মা গেলেম, আমার সাপের কামড় যে ভাল ছিল-ওয়াঃ-আমার মরা যে ভাল ছিল-গন্ধে মরে গেলেম, নাড়ী উঠলো- ওয়াঃ ওয়াঃ।
রতা। নির্ব্যাধি হয়েচেন, ঔষধ বেশ ধরেচে।
রামমণির প্রবেশ
বাড়ীর ভিতর লয়ে যাও-রাত্রিতে কিছু আহার দেবে না, দুই তিন বার দাস্ত হলেই মঙ্গল, বিষ একেবারে অন্তর্ধান করবে।
[রামমণি, রাজীবের এক দিকে, অপর
সকলের অপর দিকে প্রস্থান। (Dinabandhu Mitra)

তৃতীয় গর্ভাঙ্ক

রাজীব মুখোপাধ্যায়ের রসুই-ঘরের রোয়াক
রামমণি ও গৌরমণির প্রবেশ
রাম। টাকায় না হয় কি? টাকা নিয়ে মেয়ে
মেচোবাজারে বেচতে পারে, বুড়ো বরকে দিতে পারে না?
গৌর। আমার বোধ হয়, ও পাড়ার ছোঁড়ারা, মিছেমিছি সম্বন্ধ করেচে; মেয়ে টেয়ে সব মিথ্যে।
রাম। আমি গয়লাবউকে কণক বাবুর
কাছে পাঠিয়েছিলেম, তিনি বল্যেন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ মুন্নি করবে, তাইতে একটি মেয়ে স্থির করে দিইচি, আমার এই জন্যে বিশ্বাস হচ্ছে,
তা নইলে কি আমি বিশ্বাস করি।
গৌর। মেয়েটির না কি বয়েস হয়েচে?
রাম। যত বয়েস হক, বাবার সঙ্গে কখনই সাজবে না-তার বুঝি মা নেই, তা থাকলে কি এমন বুড়ো বরকে বিয়ে দেয়। একাদশীর জ্বলন্ত আগুনে কাঁচা মেয়ে ফেলে।
গৌর। আহা! দিদি! মা বাপ যদি একাদশীর জালা বুঝতেন তা হলে এত দিন বিধবা বিয়ে চলতো।
রাম। গৌর, বিধবা বিয়ে চলিত হ’লে
তুই বিয়ে করিস্?
গৌর। আমার এই নবীন বয়স, পূর্ণ যৌবন, কত আশা কত বাসনা মনের ভিতর উদয় হচ্ছে, তা গুণে সংখ্যা করা যায় না-কখন ইচ্ছা হয় জীবনাধিক প্রাণপতির সঙ্গে উপবেশন করে প্রণয়গর্ভ কথোপকথনে কাল যাপন করি; কখন ইচ্ছা হয়, পতির প্রীতি- জনক বসন ভূষণে বিভূষিত হয়ে স্বামীর কাছে বসে তাঁকে ভাত খাওয়াই; কখন ইচ্ছা হয়, একবয়সী প্রতিবাসিনীদের সঙ্গে ঘাটে গিয়ে নিজ নিজ প্রাণকান্তের কৌতুকথা বলতে বলতে স্নান করি; কখন ইচ্ছা হয় আনন্দময় কচি খোকা কোলে ক’রে স্তন পান করাই; আর ছেলের মাতায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুম পাড়াই; কখন ইচ্ছা হয় পুত্রকে পাকিতে বসায়ে জিজ্ঞাসা করি ‘বাবা তুমি কোথা যাচ্চো,’ আর পুত্র বলেন “মা আমি তোমার দাসী আনুতে যাচ্চি,” কখন ইচ্ছা হয় মায়াময়ী মেয়ের সাধে পাড়ার মেয়েদের নিমন্ত্রণ করে কোমরে আঁচল জড়ায়ে পরমানন্দে পরমান্ন পরিবেশন করি। দিদি! ভাল খেতে, ভাল পত্তে, ভাল ক’রে সংসারধর্ম কত্তে কার না বিয়েপাগলা বুড়ো সাধ যায়? (Dinabandhu Mitra)

রাম। আহা! পরমেশ্বর অনাথিনী করে- চেন কি করবে দিদি বলো।
গৌর। দিদি! বালিকা বিধবাদের কত যাতনা-একাদশীর উপবাসে আমাদের অঙ্গ জলে যায়, পেটের ভিতর পাঁজার আগুন জ্বলতে থাকে, জর বিকারে এমন পিপাসা হয় না। একখান থাল নিয়ে পেটে দিই, তাতে কি জ্বালা নিবারণ হয়! দ্বাদশীর দিন সকালে গলা কাটের মত শুকিয়ে থাকে, যেমন জল ঢেলে দিই তেমনি গলা চিরে যায়, তার জন্যে আবার কদিন ক্লেশ পেতে হয়। আমি যখন সধবা ছিলেম, তখন তিন বার ভাত খেতেম, এখন একবার বই খেতে নাই; রেতে খিদেয় যদি মরি তবু আর খেতে পাব না। দেখ দিদি এ সব পরমেশ্বর করেন নি, মানুষে করেচে, তিনি যদি কত্তেন তবে আমাদের ক্ষুধা পিপাসা, আশা, বাসনা স্বামীর সঙ্গে ভস্ম হয়ে যেতো।
রাম। গৌর! তুই প্রথম প্রথম কোন কথা বলতিস্ নে, এখন তোর এত ক্লেশ বোধ হচ্যে কেন বল দেখি?
গৌর। দিদি, প্রথম প্রথম প্রাণপতির শোকে এনি ব্যাকুল হয়েছিলেম আর কোন ক্লেশ ক্লেশ বোধ হ’ত না; দিদি বিধবা হওয়ার মত সর্বনাশ তো আর নাই, তাতেই তো আগে সমরণে যাওয়া পদ্ধতি ছিল, প্রত্যহ একটু, একটু করে মরার চাইতে একেবারে মরা ভাল।
রাম। আহা! যিনি সমরণের পদ্যি উঠিয়ে দিলেন, তিনি যদি বিধবা বিয়ে চালিয়ে যেতেন তা হ’লে বিধবাদের এত যন্ত্রণা হ’ত না।
গৌর। যে দিন পতি মলেন সে দিন মনে করেছিলেম, আমি প্রাণকান্তবিরহে এক দিনও বাঁচবো না, আর প্রতিজ্ঞা কল্লেম অনাহারেই মরবো-কিন্তু সময়ে শোকে মাটি পড়ে, এখন আর আমার সে ভাব নাই-আমি কি নিষ্ঠুর, যে পতি আমাকে প্রাণাপেক্ষাও ভাল বাসতেন, আমি সেই পতিকে একেবারে বিস্মৃত হইচি। দিদি, আমার প্রাণপতি আমাকে অতিশয় ভাল বাসুস্তেন, আমিও তাঁর মুখ এক দণ্ড না দেখলে বাঁচতেম না-দিদি, বিধবা বিয়ে
চলিত হলেও আমি আর বুঝি বিয়ে কত্তে পারবো না।
রাম। অনেক মেয়ে দ্বিতীয়ে বিয়ে না হতে বিধবা হয়েচে, তারা স্বামী কখন দেখি নি, তাদের বিয়ে দিলে দোষ কি?
গৌর। ছোট মেয়েটিই কি, আর বড় মেয়েটিই কি, বিধবা বিয়েতে দোষ নাই। বিধবা বিয়ে চলে গেলে কেউ বিয়ে করবে কেউ করবে না, এখন পুরুষদের মধ্যেও তো অমনি আছে, মাগ্‌ ম’লে কেউ বিয়ে করে, কেউ বিয়ে করে না, কিন্তু তা বলে তো এমন কিছু নিয়ম নাই যে এত বয়সে দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে হবে, এত বয়সে দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে হবে না।. সকল দেশে বিধবা বিয়ের রীীও আছে, আমা দের শাস্ত্রে বিধবার বিয়ে দেওয়ার মত আছে, সে কালে কত বিধবা বিয়ে হয়েচে, রামায়ণে শোনো নি বালি রাজা ম’লে তারার বিয়ে হয়েছিল, রাবণের রাণী মন্দোদরী বিধবা হয়ে বিয়ে করেছিল-সবলোক মূর্খ, কেবল আমার বাবা আর কলকাতার বলদ পঞ্চানন পণ্ডিত। (Dinabandhu Mitra)

রাম। বাবা বাহাত্তরে হয়েচেন, ওঁর কিছু জ্ঞান আছে, উনি সে দিন স্কুলের পণ্ডিতের সঙ্গে বিচার কত্তে কত্তে বল্যেন বিধবারা বরঞ্চ উপপতি কত্তে পারে তবু আবার বিয়ে কত্তে পারে না-আমার তিন কাল গেচে এক কাল আছে আমার ভাবনা ভাবি নে-বাবা যদি আপনার বিয়ের উযাগ না ক’রে তোর বিয়ের উফ্যুগ কত্তেন তা হলে লোকেও নিন্দে করতো না। আর তোর পাঁচটা ছেলে পিলে হতো সুখে সংসারধর্ম করতে পাত্তিস্, হাড়িনীর হালে থাকৃতে হ’ত না।
গৌর। সতীত্বের মহিমা যে জানে, সে সধবাই হক্ আর বিধবাই হক্ প্রাণপণে সতীত্ব রক্ষা করে, আর যে সতীত্বের মহিমা জানে না সে পতি থাকলেও কুপথে যায়, পতি না থাকলেও কুপথে যায়। বাবা ভাবেন কেবল উপপতি নিবারণের জন্যে বিধবা বিয়ের আন্দোলন হচ্যে।
সুশীলের প্রবেশ
সুশী। ছোট মাসি। এই পুস্তকখানি বাসতেন, আমিও তার মুখ এক দণ্ড না দেখলে বাঁচতেম না-দিদি, বিধবা বিয়ে

সুশী। ছোট মাসি। এই পুস্তকখানি
আপনার জন্যে এনেচি।
গৌরমণির হস্তে পুস্তক দান
রাম। সুশীল আজ কি যাবে?
সুশী। আমি কি থাকতে পারি, কাল আমাদের কালেজ খুলবে।
গৌর। তোমাদের ইংরাজি পড়া হয় না।
সুশী। হয় বই কি-এখন সংস্কৃত কালেজে ইংরাজিও পড়া হয়, সংস্কৃতও পড়া হয়।
গৌর। মেঝদিদিকে বলো, বাবা কারো কথা শুনবেন না, বিয়ে করবেন।
সুশী। তোমরা যেমন পাগল তাই বিয়ের কথা বিশ্বাস কচ্চো-আমি আর একদিন থাকূলে কোন্ ছোড়া ঘটক সেজেচে ধরে দিতে পাত্তেম।
রাম। না বাবা মিছে নষ, আমি দেখিচি ঘটক ভিনদেশী; এ গাঁর কেউ না।
সুশী। বেশ তো বিয়ে করেন তোমাদেরই ভাল, তোমরা তিন বৎসর মাতৃহীন হয়েচ আবার মা পাবে।
গৌর। তুমি যাকে বিয়ে করে আত্বে সেই আমাদের মা হবে, বাবা যাকে বিয়ে করে আনবেন সে ছোট লোকের মেয়ে, সে কি আমাদের স্থল দেবে, না আমাদের স্নেহ করবে!
সুশী। তোমরা নিশ্চিন্ত থাক, ঠাকুরদাদার কখনই বিয়ে হবে না-
পেঁচোর মার প্রবেশ
এই তোমাদের মা এয়েচে-কেমন পে’চোর মা তুই মাসিমাদের মা হতে এইচিস্ না?
পেঁচো। মোর তো ইচ্ছে; বুড়ো যে মোরে দেল্লি কেড়ে খাতি আসে।
গৌর। ও মা পোড়ারমুখো মাগী বলে কি!
রাম। পাগলের কথায় তুই আবার কথা কচ্চিস্।
সুশী। ও পে’চোর মা, তুই বুড়ো বামুনকে বিয়ে করবি?
পেঁচো। মুই তো আজি আচি, বুড়ো যে
আজি হয় না।
গৌর। মাগী বুঝি পাগল হয়েচে-হ্যাঁলা
পেঁচোর মা তুই যে ডুনি, বামনের ছেলেরে বিয়ে করবি কেমন করে? (Dinabandhu Mitra)

পেঁচো। ডুনি বানিতি তপাত টা কি?
তোমরাও প্যাট্ জ্বলে উলি খাতি চাও, মোরাও প্যাট্ জ্বলে উলি খাতি চাই; তোমরাও গালাগালি দিলি আগ্‌ কর, মোরাও গালাগালি দিলি আগ্‌ করি; তোমার বাবা মরিলেও বুকি বাঁশ, মুই মলিও বুকি বাঁশ; তাঁনারও দাঁত পড়েচে, মোরও দাঁত পড়েচে, তবে মুই কোম্ হলাম কিসি?
রাম। আ বিটি পাগুলি, বামুনের মর্য্যাদা জান না-বাবার গলায় একগাছ দড়ি আছে দেখ নি?
পেঁচো। দড়ি থালি কি মোরে বিয়ে কত্তি পারে না? তিতে ডোমের এ’ড়ে শোডার্ গলায় যে দড়ি আছে, মোর ধাড়ী শোল্ডার্ গলায় যে দড়ি নেই, মোর ধাড়ীডের তো ছানা হতি লেগেচে।
গৌর। চুপ্ কর্ আবাগের বেটি- সুশীলকে ভাত দাও দিদি।
সুশী। ঠাকুরদাদা আসুন, একত্রে খাব। রাম। বাবাকে বিয়ে কত্তে তোর যে বড় ইচ্ছে হলো?
পেঁচো। ঠাকুরবরের বরে বুড়ো বামন যদি মোর বব হয়, মুই ন কড়ার সিন্নি দেব।
রাম। বাবা তোরে কিছু বলেচে না কি?
পেঁচো। বুড়ো কি মোরে দেতি পারে? -মুই স্বপোন দেখিচি, আর নাপিৎগার ছেলে মোরে বলেচে।
গৌর। কি স্বপোন দেখেচিস্?
পেচো। দ্যাল সাক্কি-মোরে য্যান বুড়ো বামন বে কচ্চে, মুই য্যান ওনার কোলে ছেলে দিচ্চি।
রাম। এ মাগী বাবার চেয়ে ক্ষেপে উঠেচে।
পেঁচো। স্বপনের কথা অ্যাটা দুটো সত্যি হয়, মুই ভাক্তি ভাতি যাতি নেগেচি, মোরে ফতা নাপ্তে ডালে।
সুশী। ফতা কি?
পেঁচো। মুই ও নামডা ধত্তি পারি নে, মোর মিনসের নামে বাদে। (Dinabandhu Mitra)

গৌর। মর মাগী হাবি-তার নাম হলো রামজি এর নাম হলো য়তা।
পে’চো। মা ঠাকুরোণ ভেবে দ্যাকো, অতা বলতে গেলি তানার নাম আসে।
সুশী। আচ্ছা আসে আসে, ফতা কি বলেচে বল।
পেঁচো। ফতা বল্যে, পেঁচোর মা তোর কপাল ফিরেচে, নগোদ্ন্দিপির ভাজ্জি বস্তা দিয়েচে তোর সাথে বামনের বিয়ে হবে।

রাম। নবদ্বীপের পণ্ডিতরা ঘাস খায়, এমনি ব্যবস্থা দিতে গিয়েচে।
পে’চো। ট্যাকা পালি তানারা গোরু খাতি বস্তা দিতি পারে, মোর বের বস্তা তো তুচু কথা।
গৌর। আচ্ছা বাছা তুই এখন যা, বাবার আসব্বের সময় হয়েচে আবার তোরে দেখে গালে মুখে চড়িয়ে মরবেন।
পে’চো। স্বপোন যদি ফলে।
ঝোবো তানার গলে।
হাতে দেব বুলি।
মোম দেব চুলি৷
ভাত খাব থালা থালা।
তেল মাকুবো জালা জালা।
নটের মুকি দিয়ে ছাই।
আতি দিনি শুয়োর খাই।
রাম। মাগী একেবারে উন্মাদ হয়েচে।
সুশী। হ্যাঁ রে পে’চোর মা শুকরের মাংস কেমন লাগে?
পেচো। ঝুনো নেকোল খ্যায়েচো?
সুশী। খেইচি।
পে’চো। তবিই খ্যায়েচো।
গৌর। দূর আবাগের বেটি।
পে’চো। মাঠাক্রোণ আগ কর ক্যানো, শুয়োরের মাংসো কলি না পেত্যয় যাবা ঠিক্ নেক্কোলের মতো খাতি।
রাম। পে’চোর মা তুই যা, নইলে আবার বাবার কাছে মার খাবি। (Dinabandhu Mitra)

পে’চো। মুই অ্যাট্টা শুয়োরের ট্যাং ঝলসা পোড়া করিচি, তেল নুন আবানে খাতি পাচ্চি নে, মোরে এটুটু তেল নুন দাও মুই যাই। [তৈল লবণ গ্রহণান্তর পে’চোর মার প্রস্থান।
রাম। আমার ব্রতটা পচে গেল তবু বাবা দুটি টাকা দিতে পারলেন না, শুচি ঘটক মিন্সেকে সাড়ে বারো গণ্ডা টাকা দিয়েচেন।
সুশী। বিয়ে যত হবে তা ভগবান জানেন, টাকাগুলিন কেবল অনর্থক অপব্যয় হচ্ছে।

রাজীবের প্রবেশ

রাজী। (আসনে উপবেশন করিয়া) তুমি কি এখানে দুদিন থাকতে পার না; আজো তো নাতবউ হয় নি যে কান ম’লে দেবে!
রাম। গৌর, তুই পান তৈয়ের কর গে আমি ভাত আনি।

[রামমণি ও গৌরমণির প্রস্থান]

রাজী। তোমার জলপানি কোন্ মাস হতে পাবে?সুশী। গত মাস হতে পাব।
রাজী। ক টাকা করে দেবে?
সুশী। আট টাকা।
রাজী। উপরি কি আছে?
সুশী। যারা সত্যের মাহাত্ম্য জানে, তারা
উপর কাকে বলে জানে না।
রাজী। অপর লোকের কাছে এইরূপ বলতে হয় কিন্তু আমার কাছে গোপন করার আবশ্যক কি?
সুশী। আপনি বিবেচনা করেন আমি মিথ্যা কথা বলে থাকি।
রাজী। দোষ কি, তোমাদের এ কালে কেমন এক রকম হয়েচে, মিথ্যা কথা কবে না, ভালতেও না, মন্দতেও না-যখন দাঁও প্যাঁচের দ্বারা অর্থ লাভ হয় তখন মিথ্যা বলতে দোষ নাই। আমি তো আর সিদকাটি গড়িয়ে চুরি কত্তে বলি নে। কলমের জোরে কিম্বা মোড় দিয়ে যে টাকা নিতে পারে সে তো বাহাদুর।
সুশী। আপনি যেরূপ বিবেচনা করুন, আমার কোনরূপ প্রতারণা অথবা মিথ্যায় মন যায় না। যবনের অন্ন খেতে আপনার যেরূপ ঘৃণা হয, আমার মিথ্যা প্রবঞ্চনায় সেইরূপ ঘৃণা হয়।
রাজী। তোমার বাপ অতি মুর্খ তাই তোমারে কালেজে পড়তে দিয়েচে কালেজে
পড়ে কেবল কথার কাপ্তেন হয়, টাকার পন্থা দেখে না-সৎপরামর্শ দিতে গেলেম একটা কদুত্তর করে বলে।
সুশী। আপনি অন্যায় বলেন তা আমি কি করবো-জলপানি আট টাকা পাই তাতে আবার উরি পাবো কি?
রাজী। আরে আমি মল্লিকদের বাড়ী পাঁচ টাকা মাইনেতে পঞ্চাশ টাকা উপার্জন করিচি। যদি কেবল পাঁচ টাকায় নির্ভর করতেম তা হলে বাড়ীও কত্তে পাত্তেম না, বাগানও কত্তে পাত্তেম না, পুকুরও কত্তে পাত্তেম না-একবার আমারে চুন কিন্তে পাঠিয়েছিল আমি দরের উপর কিছু রাখলেম আর বালি মিস্য়ে কিছু পেলেম-এরূপ সকলেই করে থাকে, তুমিও উরি পেয়ে থাকো, পাছে বুড়ো কিছু চায় তাই বলুচো না, বটে?
সুশী। হ্যাঁ উপরি পেয়ে থাকি।
রাজী। কত?
সুশী। রবিবার আর গ্রীষ্মের অবসর।
রাজী। সে আবার কি?
সুশী। এ সময় কালেজে যেতে হয় না কিন্তু জলপানি পাই।
রামমণির ভাত লইয়া প্রবেশ
রাজী। দাও ভাত দাও-ওদের সঙ্গে আমাদের আলাপ করাই অনুচিত।
রাম। (ভাত দিয়া) বেদনাটা সেরেচে?
রাজী। না আজো টন টন কচ্চে।
সুশী। পায় কি হয়েচে।
রাম। পাড়ার ছোড়ারা খেপিয়েছিল, তাদের তাড়া করে গিয়েছিলেন, খানায় পড়ে পাটা ভেঙ্গে গিয়েচে।
রাজী। করে রাখিস্। বিকাল বেলা একটু চুন হলুদ
রাম। রাখবো। আহা বুড়ো শরীর বড় লাগন লেগেচে-তা বাবা তুমি রাগ কর কেন, পে’চোর মা হলো ডোম, পে’চোর মারে তুমি বিয়ে কত্তে গেলে কেন?
রাজী। তুইও গোল্লাই গিইচিস্, তুইও লাগুলি, তুইও খ্যাপাতে আরম্ভ করলি-খা বিটি ভাত খা। (দুই হস্ত দ্বারা রামমণির
অঙ্গে অন্ন ছড়াইয়া দেওন) খা আবাগের বিটি, ভাতও খা, আমারেও খা-

[বেগে প্রস্থান]

সুশী। এমন পাগল হয়েচেন।
রাম। এমন পোড়া কপাল করেছিলেম-
ঘর দোর সব সগুড়ি হয়ে গেল।
সুশী। যাই আমি তাঁকে শান্ত করে আনি।
রাম। যাও-আমি না নাইলে হেন্সেলে যেতে পারবো না।

দ্বিতীয় অঙ্ক প্রথম গর্ভাঙ্ক বাগানের আটচালা

ভুবন, নসিরাম এবং কেশবের প্রবেশ
কেশব। ঘটকটা পেলে কোথায়?
ভুব। ও ইনিস্পেক্টার বাবুর কাছে এসেচে; উমেদার, স্কুলের পণ্ডিতি প্রার্থনা করে।
কেশ। ও যেরূপ বুদ্ধিমান্ সর্বাগ্রে ওকে কর্ম দেওয়া উচিত।
রতা নাপ্তে এবং লোক চতুষ্টয়ের প্রবেশ রতা। বর আস্বের সময় হয়েচে আমরা সাজি গে।
ভুব। এ’দের বাড়ী কোথায়?
রতা। সে কথা কাল বলবো-ইনি হবেন কনের কাকা, ইনি হবেন কনের মেসো, ইনি হবেন কনের দাদা, ইনি হবেন পুরোহিত।
কেশ। আমি ভাই ঠাকুঝি সাজবো, তা নইলে ব্যাটার সঙ্গে কথা কওয়া যাবে না।
রতা। আচ্ছা তুমি হবে বড় ঠাকুঝি, ভুবন হবে কনের বিয়ান, নসিরাম হবেন শালাজ। আমি ত ছাই ফ্যালুতে ভাঙ্গা কুলো আছি, বুড়ো ব্যাটার মাগ সাজবো।
কেশ। আমাদের অধিক খরচ হবে না, বড় জোর দশ টাকা, আমরা একটা চাঁদা করে দেব। বুড়ো যে টাকা দিয়েচে তা ওর মেয়ে দুটিকে দেব, তাদের ভাল করে খেতেও দেয় না।

রতা। গিল্টিকরা গহনায় যা খরচ হয়েচে আর খরচ’ কি। এস আমরা যাই (লোক চতুষ্টয়ের প্রতি) আপনাদিগের যেরূপ বলে দিইচি সেইরূপ করবেন।
[লোক চতুষ্টয় ব্যতীত সকলের প্রস্থান। কাকা। রতা নাপ্তে ভারি নকুলে।
মেসো। বুড়ো ব্যাটা যেমন নষ্ট তেমনি বিয়ের জোগাড় হয়েচে।
দাদা। বেশ বাসরঘর সাজিয়েছে।
ঘটক এবং বরবেশে রাজীবের প্রবেশ গদির উপর রাজীবের উপবেশন
কাকা। এই কি বর, কি সর্বনাশ, ঘটক মহাশয় সব কত্তে পারেন-সোনার চম্পক এই মড়ার হাড়ে অর্পণ করবো, আমি ত পারবো না।
ঘট। মহাশয় পাঁচ দিক্ বিবেচনা করুন-

কাকা। রাখো তোমার পাঁচ দিক্, দশ দিক্ হলেও মড়িপোড়ার ছোঁড়া মাজুরে মেয়ে দিতে পারবো না-দাদারি যেন পরলোক হয়েচে, আমি ত জীবিত আছি, চম্পক আমার দাদার কত সাধের মেয়ে, শ্মশানঘাটের শুকনা বাঁশে সেই মেয়ে সম্প্রদান করবো? বলেন কি? এমন সর্বনাশ করেচেন, এই জন্যে আপনাকে বন্ধু বলতেন-আরে টাকা! খেয়ে আমাদের এই সর্বনাশ কল্যেন। দাদা টাকা
দাদা। খুড়া মহাশয় এখন উতলা হওনের সময় নয়।
রাজী। বাবা তুমিই এর বিচার কর।
ঘট। ইনি তোমার শালা, তোমার শ্বশুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র।
রাজী। তবে ত আমার পরম বন্ধু-দাদা তুমি আমার মেগের ভাই, মাতার মাদুরি, কপালের তিলক, আমি তোমার খড়মের বোলো, তোমার ইংরাজি জুতার ফিতে, দাদা আমার হয়ে তুমি দুটো বলো তা নইলে আমি ঘাটে এসে দেউলে হই, আমার গোয়ালপাড়ার সরষের নৌকা হাটখোলার নিচেয় ডোবে।
কাকা। আহা মেয়ে ত না যেন সিংহ- বাহিনী-দুঃসময় পেয়ে ঘটক মহাশয় কাল- সর্প হলেন।
দাদা। যখন কথা দেওয়া হয়েচে বিবাহ দিতে হবে।
রাজী। মরদ্‌দকি বাৎ হাতীকি দাঁৎ।
কাকা। তা হলো ভাল তোমরা যেমন বিধবা বিবাহের সহায়তা করে থাক তেমনি ত্বরায় বিধবা বিবাহ দিতে পারবে।
দাদা। মুখোপাধ্যায় মহাশয় এমন কি বৃদ্ধ হয়েচেন যে সহসা মৃত্যুর গ্রাসে প্রবেশ করবেন। যদি মরেন চম্পকের পুনর্ব্বার বিবাহ দেওয়া যাবে, তাতে মুখোপাধ্যায় মহাশয় অসম্মত নন।
রাজী। তা তো
দেওয়া অতি কর্ত্তব্য, কে আছে, কেবল কতকগুলো খোশামুদে ব বকেয়া, বার্ষিকখেগো বিদ্যাভূষণ বিপক্ষতা কচ্চে।
কাকা। বাবাজির দেচি যে বিধবা বিবাহে বিলক্ষণ মত। শালা ভগিনীপতিতে মিল্কে ভাল।
রাজী। নব্য তন্ত্রের সকলেরি মত আছে।
কাকা। তোমাদের যেরূপ মত হয় কর, আমি আর বাড়ী ফিরে যাব না, আমি তীর্থ পর্যাটন করবো।
দাদা। যখন সম্বন্ধের স্থিরতা হয় তখন আপনি অমত করেন নি, এখন এরূপ করা কেবল ধাষ্টমো প্রকাশ।
রাজী। “ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন।”
ঘট। ছোটবাবু কিঞ্চিৎ বয়স অধিক হয়েচে বলে এমন উতলা হচ্ছেন কেন, বরের আর আর অনেক গুণ আছে। বিষয় দেখুন, বিদ্যা দেখুন, রূপ দেখুন, রসিকতা দেখুন। বন্ধুর মেয়ে বলে আমারো স্নেহ আছে আমি অপাত্রে অর্পণ কচ্চি নে।
পুরো। ছোটবাবুর সকলি অন্যায়। বাক্- দান হয়েচে, গাত্রে হরিদ্রা দেওয়া হয়েচে, নান্দীমুখ হয়েচে, বরপাত্র সভায় উপস্থিত, এখন উনি অমঙ্গলজনক বিবাদ উপস্থিত করে শুভ কর্মের বিলম্ব কচ্চেন-করুন লক্ষ কথা ব্যতীত বিবাহ হয় না।

মেসো। পুরোহিত মহাশয়ের অনুমতি হয়েচে, ছোটবাবু আর বিলম্বের আবশ্যকতা নাই, হৃষ্টচিত্তে কন্যা সম্প্রদান কর।
কাকা। আচ্ছা, কখান দাঁত হয়েচে দেখা আবশ্যক, বাবাজি দাঁত দেখাও দেখি।
রাজী। আমি বড় বাঁশি বাজাতেম তাই অল্প বয়সে গুটিকতক দাঁত পড়ে গিয়েচে। (দাঁত বাহির করিয়া দর্শায়ন)
কাকা। সকলেরি মত হচ্চে আমার অমত করা উচিত নয়, আমি বাবাজিকে অন্যায় বুড়ো বলে ঘৃণা করেচি।
রাজী। আপনি খুড়শ্বশুর, পিতৃতুল্য, ‘ছেলেপিলেকে এইরূপ তাড়না কত্তে হয়। মা ছেলেকে কত মন্দ বলে, তখনি আবার সেই ছেলে কোলে লয়ে স্তন পান করায়।
কাকা। জামাই বাবুর কথাতে অঙ্গ শীতল হয়ে যায়।
রাজী। আপনি শ্বশুর নচেৎ আদিরসের কবিতা শুনায়ে দিতেম।
ঘট। এখন কোন কথা বলবেন না, লোকে বলবে বরটা ঠোঁটকাটা। বাসরঘরে আমার মান রক্ষা করেন তবে আপনাকে বাসরবিজয়ী বর বলবো। মাগীগুলো বড় ঠ্যাঁঠা, কান মোড়া দেয়, কিল মারে, নাক কামড়ায়, বসে। কোলে
রাজী। এ ত সুখের বিষয়।
দাদা। এখন রহস্যের সময় নয়, লগ্ন ভ্রষ্ট হয়, বৈকুণ্ঠ নাপিতকে ডাকুন পাত্র লয়ে যাক্।

বৈকুণ্ঠের প্রবেশ

ঘট। বৈকুণ্ঠ আর বিলম্ব ক’র না, পাত্র
কোলে করে লও।
বৈকু। আপনি যে বুড়ো বর এনেচেন এ কি
কোলে করা যায়।
কাকা। আমাদিগের বংশের রীতি আছে সভা হতে বর নাপিতের কোলে যায়, হে’টে যাওয়া পদ্ধতি নাই।
রাজী। পরামাণিকের পো, আমি আল্ল্গা দিয়ে কোলে উটবো, দেখ নিতে পারবে এখন, কিছু পাওয়ার পিত্তেশ রাখত?
বৈকু। পাওয়ার পিত্তেশ রাখি, কোমরিকেও ভয় করি।
দাদা। একটা সামান্য কর্ম্মের জন্য শুভ কৰ্ম্ম বন্ধ থাকবে? বৈকুণ্ঠ চেষ্টা করে দেখ বুড় মানুষ অধিক ভারি নয়।
বৈকু। মহাশয় পুরাণো চাল দমে ভারি। এক একখানি হাড় এক একখানি লোহার গরাদে। এ বোঝা নিয়ে কি মাজা ভেঙ্গে ফেলবো।
কাকা। উপায়?

রাজী। আমি লাফ দিয়ে লাফ দিয়ে যাই।
পুরো। প্রচলিত আচারানুসারে মৃত্তিকায় পদস্পর্শ হওয়া অবৈধ, উল্লম্ফ দ্বারা গমন করিলে মৃত্তিকা স্পর্শ হবে।
রাজী। ঘটকরাজ, এক্ষণকার উপায়? এ কথা কেন আগে বলো নাই, আমি একজন বলবান্ নাপিত আস্তেম, না হয় এর জন্যে এক বিঘা ব্রহ্মত্তর জমি যেতো।
ঘট। সামান্য বিষয় লয়ে আপনারা গোল কচ্যেন কেন। নাপিত মুখের দিক্ ধরুক, আমরা দুই জন পায়ের দিকে ধরি, বিবাহের স্থানে লয়ে যাই।
রাজী। এ কথা ভাল, এ কথা ভাল- (চিত হইয়া শয়ন করিয়া) ধর, ধর।
বৈকু। আজ্ঞা হাঁ এরূপ হতে পারে (বৈকুণ্ঠ মস্তকের দিকে, ঘটক এবং দাদা পায়ের দিকে ধরিয়া উঠায়ন) গুরু মহাশয়, তোমার পড়ো উড়ে যায়, বাঁশবাগানে বিয়েবাড়ী বেগুনপোড়া খায়।

[সকলের প্রস্থান]

দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

বাগানের আটচালার অপর এক কাম্রা
বাসর ঘর
রতা নাপ্তে কনের বেশে আসীন, কেশব এবং ভূবনের নারীবেশে প্রবেশ
‘ভুব। রতন এই বেলা ভাল করে বসু, ব্যাটা আসচে।
কেশ। যে ছোঁড়া জুটিয়েচিস্ গোল করে ফ্যালবে, এখন।
রতা। না হে ওরা সব খুব চতুর, এত ক্ষণ দেখলে ত কেমন উলু দিলে শাক বাজালে।
কেশ। ও ছোঁড়া কে, যে বুড়োর মাথায় এক কলসী গোবর-গোলা ঢেলে দিলে?
রতা। ও ছোঁড়া আমাদের স্কুলে পড়ে, ওকে একদিন বুড়ো ব্যাটা মার খাইয়েছিল তাইতে ওর রাগ ছিল, গোবরগোলা মাথায় ঢেলে দিয়েচে।
ভুব। আমি ব্যাটার গা ধুয়ে দিইচি-ব্যাটা রাগ করি নি, বলে বিয়ের দিন এমন আমোদ করে থাকে।
নেপথ্যে। এই ঘরে বাসর হয়েচে।
কেশ। রতন! ঘোমটা দাও হে।
(রাজীবের বরবেশে এবং নসিরাম আর পাঁচ জন বালকের নারীবেশে প্রবেশ)
নসি। বসো ভাই কনের কাছে বসো।
রাজী। (উপবেশনানন্তর) আমার মনে বড় ক্লেশ হয়েছে-শাশুড়ী ঠাকুরুণ, উনি স্ত্রীর মা, আমারো মা, আমাকে দেখে মরা কান্না কাঁদলেন।
কেশ। মার ভাই এইটি কোলের মেয়ে, তাইতে একটু কাঁদলেন। তা ভাই তুমিই ত ঝুতে পার, সকলেরি ইচ্ছে মেয়ে অল্পবয়সী বরে পড়ে। সে কথায় আর কাজ কি, তুমি এখন মার পেটের সন্তানের চাইতেও আপন। তিনি বলচেন উনি বে’চে থাকুন। আমার চম্পক পাঁচ দিন মাচ ভাত খাক্।
নসি। একবার দাঁড়াও ত ভাই জোঁকা দিই তোমার কত দূর পর্যন্ত হয়। (রতা এবং রাজীবের একত্রে দণ্ডায়ন)
কেশ। দিব্বি মানিয়েচে, বসো। (উভয়ের উপবেশন)
রাজী। আমার শরীর পবিত্র হলো, চিত্ত প্রফুল্ল হলো, আমার সার্থক জন্ম, এমন নারীরত্ব লাভ কল্যেম। আমি পাঁজি দেখে- ছিলেম, এই মাসে মেষের স্ত্রীলাভ, তা ফল্লো।
ভুব। ও মাসে কি গো, তুমি কি ভ্যাড়া, বিয়ান ভ্যাড়া বিয়ে কল্যে না কি?
রাজী। আমি ভ্যাড়া ছিলেম না তোমরা বানালে।
কেশ। ঘটক যা বলেছিল সত্যি রে, খুব রসিক।
ভুব। বাসরঘর রসের বৃন্দাবন, যার মনে যা লাগে তিনি তা কর।
নসি। ষোলো শ গোপিনী একা মাধব।
রাজী। “কাল বলে কাল মাধব গ্যাছে।
সে কালের আর কদিন আছে।”
প্রথম বালক। বা রসিক, কানমলা খাও
দেখি। (সজোরে কান মলন)
রাজী। উঃ বাবা। (সজোরে কান মলন)
লাগে মা- (সজোরে কান মলন) মলেম গিচি – (সজোরে কান মলন) মেরে ফেলে- (নাক মলন) দম আটকালো, হাঁপিয়েচি মা, ও রামমণি।
সকলে। ও মা এ কি।
ভুব। রামমণি কে গো? কানমলা খেয়ে এত চে’চানি, ছি, ছি, ছি, এমন বর, এই তোমার রসিকতা।
রাজী। কান দিয়ে যে রস গড়িয়ে পড়ে, না চেঁচিয়ে করি কি।
ভুব। কামিনী কোমল কর কিবা কানমলা,
নলিনীর মূল কিবা নবনীর দলা।
রাজী। আমি কৌতুক করে চে’চিয়েচি।
ভুব। বটে, তবে তোমাকে নবনী খাওয়াই। (কান মলন)
রাজী। উঃ উঃ বেস রূপসি। (কান মলন) মলুন, বেশ, সুন্দরীর হাত কি কোমল!
ভুব। না, রসিক বটে।
কেশ। একটি গান কর দেখি।
রাজী। তোমরা মেয়েমানুষ, বাইনাচ কর আমি শুনি।
দ্বিতীয় বালক। নাচ শোনে না দেখে?
রাজী। নাচ শোনাও যায়, দেখাও যায়। তুমি নাচো আমি চক্ বুজে তোমার মলের ঠন ঠুন শব্দ শুনি।
ভুব। আগে তুমি একটি গাও তার পর আমি নাচবো।
কেশ। সে কি ভাই, আমোদ আহমাদ না কল্যে মা কি ভাববেন; তুমিই যেন দোজবরে,
তাঁর চাঁপা ত দোজবরে নয়; গান কর, নাচো, তামাসা ঠাট্টা কর, রসের কথা কও।
রাজী। শাশুড়ী ঠাকুরুণ গান বুঝি বড় ভাল বাসেন? আচ্ছা বেশ গাচ্চি। (চিন্তা করিয়া) আমি ভাই গান ভাল জানি না, কবিতা বলি।
ভুব। কবিতা বিয়ানের সঙ্গে ব’লো, আমরা তোমায় একদিন পেইচি, একটি গান শুনে মজে থাকি।
রাজী। আমার ব্রাহ্মণী কি তোমার বিয়ান?
ভুব। ওগো হ্যাঁ গো, বিয়ানের বিয়ে না হতে জামাই হয়েছে। তোমার ক্লেশ পেতে হবে না, তৈরি ঘর।
রাজী। বিয়ানের কথাগুলিন বড় মিষ্টি, যেন নলেন গুড়। বিয়ানের নামটি কি?
কেশ। তোমার বিয়ানের নাম চন্দ্রমুখী।
রাজী। হ্যাঁ বিয়ান, চন্দ্রমুখী? তোমার নাম
ভুব। আমার কি চন্দ্রমুখ আছে, তা আমার নাম চন্দ্রমুখী হবে?
রাজী। বিয়ান, ব্রাহ্মণীর সঙ্গে আমার বাড়ী চলো, তিন জনে বউ বউ খেলা করবো। ডুব। খোঁড়া ভাতার বুড়ো ব্যাই,
কোন দিকে সুখ নাই।
নসি। দুঃখের কথা বলবো কি, ওর ভাতার ওকে খুব ভাল বাসে, বয়স অল্প কিন্তু খোঁড়া।
রাজী। তবে হরেদরে বিয়ানের একটি পুরো ভাতার হবে। আমার পা নেবেন, ব্যায়ের বয়স নেবেন, তা হলেই পাতরে পাঁচ কিল।
কেশ। তোরা বাজে কতায় রাত কাটালি গাও না ভাই, গীতের কথা ভুলে গেলে।
রাজী। আমি একটা ন্যাড়া নেড়ীর গান
গাই-
মন মজ রে হরিপদে,
মিছে মায়া, কেবল ছায়া, ভুল না মন আমোদ মদে।
কেউ কারো নয় এই ভুবনে, হরিচরণ তরি বিপদে।
নসি। আহা! কি মধুর গান, আমার ইচ্ছে করে এখনি কুঞ্জবনে গিয়ে রাধিকা রাজা হই।
রাজী। অনেক রাত্রি হয়েচে আমার ঘুম আচে।
তৃতীয় বালক। বাসরঘরে ঘুমুলে মাগ- ভাতারে বনে না।
নসি। না ভাই, তোমায় আমরা ঘুমুতে দেব না। আমরা কি তোমার যুগ্যি নই? আমি কত ব’লে কয়ে মিন্সেরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এলেম, আমি আজ সমস্ত রাত জাগবো।
রাজী। আমার রাত জাগলে পেটে ব্যথা ধরে।
ভুব। ওলো না লো, ব্যাই একবার বিয়ানের সঙ্গে রঙ্গ ভগ্ন কুরুবেন, তাই আমাদের ছলে বিদায় দিচে483 59/483 ..
কেশ। ভালই ত, চল আমরা যাই, চাঁপা ত আর ছেলেমানুষটি নয়।
ভুব। বিয়ান নবীন যুবতী, ষাট বছরের একটি ভাতার না হয়ে কুড়ি বৎসরের তিনটি হলে বিয়ানের মনের মত হতো।
কেশ। (রাজীবের নিকট গিয়া) তা ভাই তুমি এখন চাঁপাকে নিয়ে আমোদ কর, আমরা যাই, দেখ ভাই ছেলেমানুষ শান্ত করে রেখ-
নসি। ঠাকুঝি যে মুখের কাছে মুখ নিয়ে যাচ্চিস্, দেখিস্ যেন কাড়ে ন্যায় না।
ভুব। কামড়ালে ক্ষেতি কি? বোনাই- ভাতারী ত গাল নয়, শালী পোনের আনা মাগ।
কেশ। তুই যেমন ব্যাইভাতারী তাই ও কথা বলুচিস্-আয় লো আমরা যাই।
[রাজীব এবং রতা নাপ্তে ব্যতীত]
সকলের প্রস্থান; দ্বার রোধ। রাজী। সুন্দরি, সুন্দরি, তুমি আমার অন্ধের নড়ী, আমার ভাঙ্গা ঘরের চাঁদের আলো, আমার শুকনো তরুর কচি পাতা; তুমি আমার এক ঘড়া টাকা, তুমি আমার গঙ্গামণ্ডল। তোমার গোলামকে একবার মুখখান দেখাও, আমার স্বর্গলাভ হক্।

রতা। (অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া)
ক্ষণকাল ক্ষম নাথ অধীনী তোমার, গাঁটা দিয়ে দেখে সবে দম্পতি বিহার।
এখনি যাইবে ওরা নিজ নিজ ঘরে, রাসলীলা কর পরে বিয়ের বাসরে।
রাজী। আমি দেখে আসি কেহ আছে কি না, (চারি দিকে অবলোকন) প্রাণকান্তা! জনপ্রাণী এখানে নাই।
রতা। ভাল ভাল প্রাণনাথ আমি একবার, দেখি উ’কি মারে কি না পাশে জানালার।
চারি দিকে অবলোকন এবং উভয়ের উপবেশন রাজী। কাছে এস, আমি একবার তোমার হাতখানি ধরি।
রতা। কাছে কিম্বা দূরে থাকি উভয় সমান, যত দিন নাহি পাই অন্তরেতে স্থান।
রাজী। প্রেয়সি! আমি বিচ্ছেদ আগুনে দগ্ধ হতেছিলাম, তুমি আমার দগ্ধ অঙ্গ মুখের অমৃত দিয়ে শীতল করলে। আমি যে জ্বালা পেয়েচি তা আমিই জানি, রামমণিও জানে না, গৌরমণিও জানে না-এরা তোমার সতীন ঝি, তোমাকে খুব যত্ন করবে, তা নইলে তোমার ঘর তোমার দোর তুমি তাদের তাড়িয়ে দেবে।
রতা। শুনিয়াছি তারা নাকি কাণ্টা অতিশয়, পরম পবিত্র বাপে কটু কথা কয়।
যোড় হাতে তব দাসী এই ভিক্ষা চায়, পরবশ তারা যেন না করে আমায়।
রাজী। তুমি যে আমার বুকপোরা ধন, আমি কারো ছাতে দেব? কাল পাল্কি হতে আপনি তুলে নিয়ে যাব, রামমণিকে আপনি মুখ দেখাব, তার পর ঘরে গিয়েই দে দোর। আমার যা আছে সব তোমার (কোমর হইতে চাবি খুলিয়া) এই নাও চাবি তোমার কাছে থাক। (চাবি দান)
রতা। পিতা পরলোক গেলে জননীর সনে, হা বাবা হা বাবা বলে কাঁদি দুই জনে।
বাবার বিয়োগ শোক ভুলিলাম আজ, মিলেচে গুণের পতি নব যুবরাজ।
রাজী। বিধুমুখি! তুমি আমায় আনন্দ- সাগরে সাঁতার শেখাবে-আহা আহা কি মধুর
বচন! প্রেয়সি! আমায় বুড়ো বলে ঘৃণা করো না।
রতা। প্রবীণ কি দীন হয় কিবা কদাকার, ভকতিভাজন ভর্তা অবশ্য ভার্য্যার।
রাজী। সুন্দরি, আমাকে তোমার ভড়ি হয়?
রতা। দেবতা সমান পতি সাধনের ধন, হৃদয়মন্দিরে রাখি করিয়ে যতন।
নানা আরাধনা করি মন করি এক, সরল বচন জলে করি অভিষেক। বিলেপন করি অঙ্গে আদর চন্দন, হেম উপবীত দিই সুখ আলিঙ্গন। রসের হে’য়ালি ছলে বলি শিব ধ্যান,
কপোল কমল করি দেব অঙ্গে দান। অবলা সরলা বালা আমি অভাজন,. দিবানিশি থাকে যেন পতিপদে মন। (Dinabandhu Mitra)

(রাজীবের চরণ ধারণ)

রাজী। সোনার চাঁদ তুমি আমার স্বর্গে তুল্যে, আমি আর বাড়ী যাব না, এইখানে পড়ে থাকবো। বিধূবদনি একটা ছড়া বলো।
রতা। মাথার উপর ধরি পতির বচন, বলিব ললিত ছড়া শুন হে মদন। কণক কিশোরী, পিরিতের পরি, রসের লহরী, বসে আলো করি, নিকুঞ্জ বন,
মন উচাটন, মুদিত নয়ন, ভাবে মনে মন, কোথায় সে ধন, বংশীবদন।
কুলের অবলা, অবলা সরলা, বিরহে বিকলা, সতত চপলা,
বাঁচিতে নারি,
বিনে প্রাণ হরি, হার হলো হরি, কুসুম কেশরি, আহা মরি মার, মরে গো নারী।
রমণীর মন, কি জানি কেমন, এত অষতন, তবু তো রতন, পুরুষে ভাবে,
কি করি উপায়, অরি পায় পায়, পথে যদু রায়, পড়ে প্রেম দায়, মজেচে ভাবে।
বৃন্দে বলে রাই, লাজে মরে যাই,
এসেচে কানাই, দোহাই দোহাই,
কথা কস্ নে, রাই বলে সখি, সে মানে হবে কি,
পিপাসী চাতকি, নীরদ নিরখি,
বাধা দিস্ নে।
কামিনীর মান, সফরির প্রাণ,
মানে অপমান, বিধাতা বিধান,
আন গোবিন্দে,
করি আলিঙ্গন, মদনমোহন,
স্মর হুতাশন, করি নিবারণ,
যাও গো বুন্দে।
নূপুরের ধ্বনি, শুনি ওঠে ধনী,
দীনে পায় মণি, পদ্মে দিনমণি,
ধরিল করে,
সহজ মিলন, সুখ সন্তরণ,
সুবোধ সুজন, ললনা কখন,
মান না করে।

রাজী। আহা মরি এমন মধুর বচন কখন শুনি নি, সুন্দরীর মুখ যেন অমৃতের ছড়া দিচ্চে। আহা! প্রেয়সি বিচ্ছেদজ্বালা এমনি বটে, পুরুষেরা বিচ্ছেদ-বাঁটুল খেয়ে ঘুরে মাটিতে পড়ে, হনুমান যেমন ভরতের বাঁটুল খেয়ে গন্ধমাদন মাথায় করে ঘুরে পড়েছিল। মেয়ে পুরুষের সমান জজ্বালা, চে’চামেচি করে, মেয়েরা গুমুরে মরে। পুরুষে
রতা। অনঙ্গ অঙ্গনা অঙ্গ বিনা পরশনে,
প্রহারে প্রসূন বাণ বিরহিণী মনে;
কামিনী বিরহ বাণী আনে না অধরে,
বিরলে বিকল মন মনসিজ শরে,
লাবণ্য বিষণ্ণ নয় বিদরে অন্তর,
কীটক কুলায় যথা রসাল ভিতর।
রাজী। আহা আহা এমন মেয়ে ত কখন দেখি নি, আমার কপালে এত সুখ ছিল, এত দিন পরে জালেম, বুড়ো বিটি আমার মঙ্গলের জন্যে মরেচে, “বক্তার মাগ মরে, কম- বক্তার ঘোড়া মরে।” প্রেয়সি! তুমি আমার গালে একবার হাত দাও।
রতা। বয়সে বালিকা বটে কাজে খাট নই, প্রাণপতি গাল দুটি করে করি লই। (রাজীবের কপোল ধারণ)

রাজী। আহা, আহা, মরি, মরি, কার মুখ দেখেছিলেম-আজ সকালে রতা শালার মুখ দেখেছিলাম-পাজী ব্যাটার মুখ দেখে এমন রত্নলাভ কল্যেম-সুন্দরি আমি একবার তোমার গা দেখবো।
রতা। আমি তব কেনা দাসী পদ আভরণ,
মম কলেবর নাথ তব নিজ ধন,
যাহা ইচ্ছা কর কান্ত বাধা নাহি তায়,
দেখ, কিন্তু দাসী যেন লাজ নাহি পায়,
স্বামীর সোহাগে যদি হইয়ে অবশ,
দেখাই বিয়ের রেতে উদর কলস,
কৌতুক রঙ্গিণী রসময়ী রামাগণ,
বেহায়া বলিবে মোরে ঠারিয়ে নয়ন,
সবে না সরল মনে কৌতুক কঙ্কর,
আজি কান্ত শান্ত হও দেখে বাম কর, (বাম হস্ত দর্শায়ন)
রাজী। আহা কি দেখলেম, মরে যাই, রূপের বালাই লয়ে-
তড়িত তাড়িত বর্ণে তড়াগজ মুখ,
উল্টা কড়া সম যোড়া কুচ যোড়ে বুক,
সুশ্রাব্য অমৃত বাক্যে জুড়াইল কর্ণ,
অদ্যাবধি ঋণগ্রস্ত আমি অধমর্ণ।
তোমার গ্রথিত ছড়া রহস্যের কুয়া,
আমি বুড় মুঢ় কবি করি হয়া হয়া,
ভূত্যের বার্ধক্যে যদি না কর ধিক্কার,
স্বকৃত মসৃন পদ্য করিব ন্যক্কার।
রতা। কবিতা কানাই তুমি রসের গামলা, ছলনা কর না মোরে দেখিয়ে অবলা। বলো বলো নিজ পদ্য এক তার তান, শুনিয়ে মোহিত হোক্ মহিলার প্রাণ।
রাজী। পীরিতি তুল্য কাঁটাল কোষ।
বিচ্ছেদ আটা লেগেচে দোষ।
পঙ্কজ মূল ভাল কি লাগে।
কণ্টক নাগ না যদি রাগে।
চাকের মধু মিষ্টি’ কি হৈত।
মৌমাচি খোঁচা না যদি রৈত।
আইল বিষ পীযূষ সঙ্গে।
অঙ্কিত মৃগ সোমের অঙ্গে।।
রতা। কবিতার কোমলতা ভাবের ভঙ্গিমা, কি বলিব কত ভাল নাহি পরিসীমা। খাটিল ঘটক বাণী ভাগ্যে অধীনীর, বুড় বর বটে কিন্তু দুধ মরে ক্ষীর।

রাজী। সুন্দরি, আমার ঘুম গিয়েচে, রাত আমার দিন বোধ হচ্যে-প্রেয়সি! তুমি এক বার আমার কাছে এস, তোমারে গোটা কত কথা জিজ্ঞাসা করি।
রতা। কথার সময় নয় রসময় আজ,
এখনি আসিবে তব শ্যালকী শ্যালাজ। রাজী। কারো আস্তে দেব না, তুমি উতলা হও কেন, এস, এস, এস না-এই এস (অঞ্চল ধরিয়া টানন)।
রতা। রসরাজ কি কাজ সলাজ মরি!
মম অঞ্চল ছাড় দু পায় ধরি।
ক্ষম জীবন যৌবন হীন বলে, ভ্রমরা কি বসে কলিকা কমলে; নব পীন পয়োধর পাব যবে,
রস সাগর নাগর শান্ত হবে।
রহ মানস রঞ্জন ধৈর্য্য ধরে, সুখ নূতন নূতন লাভ পরে।
(যাইতে অগ্রসর)
রাজী। সুন্দরি, এখন রাত অধিক হয় নি -তুমি ঘর হতে গেলে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মবো, আমি তোমায় ছেড়ে দেব না, যদি যাও আমি তোমার জেলের হাঁড়ি হয়ে সঙ্গে যাব, ব’স যেও না (হস্ত ধরিয়া টানন)। (Dinabandhu Mitra)

রতা। হাতেতে বেদনা বড় ছাড় না ছাড় না, বিবাহ বাসরে নহে বিহিত তাড়না।
নিশি অবসান প্রাণ গেল শশধর; দম্পতি অরাতি রবি গগন উপর। যাই যাই বেলা হলো হাত ছাড় বন্ধু, দিনে কি কামিনী কান্তে দিতে পারে মধু? রাজী। প্রেয়সি! বুড়ো বামুনের কথা রাখ, যেও না, প্রেয়সি, তোমার পরকালে ভাল হবে- তুমি আমার প্রাণের প্রাণ, আমারে আর পাগল ক’র না। আমি রত্নবেদি হই, তুমি জয় জগন্নাথ হয়ে চড়ে ব’স।
(রতানাপুপ্তের পদম্বয় ধরিয়া শয়ন)
রতা। অকল্যাণ অকস্মাৎ হেরে হাঁসি পায়, বাপের বয়সি পতি পড়িলেন পায়। (জানালার নিকটে নসিরামের আগমন)
নসি। এ কি ভাই ঠাকুরজামাই, ক্ষিদে পেলে কি দুই হাতে খেতে হয়? কিলিয়ে
কাঁঠাল পাকালে মিষ্টি লাগে না।।
[নসিয়ামের ‘প্রস্থান]
রতা। ছি ছি ভাই, কি বালাই, লাজে মরে যাই, বিয়ের কনের কাজ দেখিল সবাই।
(কিয়দুর গমন)
রাজী। বান্ধন আমার চল্যে! আমারে মেরে চল্যে, ব্রহ্মহত্যা হলো-যেও না সুন্দরি, যেও না।
রতা। রাত পুইয়েচে, কাক কোকিল ডাক্‌চে। (Dinabandhu Mitra)

[রতানাপুত্রের প্রস্থান]

রাজী। বিটি জানালা দিয়ে কথা কয়ে আমার মাতায় বজ্রাঘাত কল্যে, বিটি রাত- ব্যাড়ানী। বিটি আক্তা ভাতারের মাগ, তা নইলে সে ব্যাটা রেতে সেবাকে দে?
কণক বাবুর প্রসাদাৎ বউ ঘরে তুলে কণক বা মারা,
আতা পাঠিয়ে দেব। কণক বাবু অনুগ্রহ ৭। কল্যে কি এ বুড়ো বয়সে অমন মেয়ে জুটতো? যদি মা দুর্গা থাকেন তবে তুই বুড়োরে যেমন সুখী কল্যি, এমনি সুখী তুই চিরদিন থাকি।
নসিরাম এবং ভুবনের প্রবেশ
ভুব। কি ব্যাই, বিয়ানের সঙ্গে আমোদ হলো কেমন?
নসি। ঠাকুরজামাই ভাবুক্চো কি? আজ তো সুখের সূত্রপাত, স্বর্গের সিড়ির প্রথম ধাপ, এতেই এই, না জানি চাঁপার বয়সকালে কি হবে।
রাজী। আমারে কিছু ব’ল না; আমি মরিচি, কি বেচে আছি তা আমি বলতে পারি নে-আমার স্বর্ণলতাকে এইখানে নিয়ে এস, আমি ছোঁব না কেবল দেখবো, আমার কাছে বসে থাকলে আমার প্রাণ বড় ঠান্ডা থাকে-তোমার পায় পড়ি এক বার নিয়ে এস।
নসি। সে এখন ঠাকুণের কাছে ব’সে রয়েচে, তাকে আব্বের যো নাই-আমরা এইচি এতে কি তোমার মন ওটে না?
ভুব। বড় সুখের বিষয় বিয়ানের সঙ্গে তোমার এমন মন মজেচে।
নসি। ঠাকুরজামাই, ভাই, ছেলেমানুষ, কত লোকে কত কথা বলবে তুমি ভাই খুব যত্ব
কান্না আরম্ভ করলেন, ওঁর ভাতার এখনি মলো।

নসি। ঠাকুরজামাই, ভাই, ছেলেমানুষ, কত লোকে কত কথা বলবে, তুমি ভাই খুব যত্ন কর-চাঁপা বড় অভিমানী, বড় কথা সইতে পারে না, তোমার মেয়েদের ব’লে দিও মন্দ কথা না বলে।
রাজী। আর মেয়ে! তারা কি আছে, মনে মনে তাদের গাঁ ছাড়া করিচি। দেখবো যদি ব্রাহ্মণী তাদের উপর রাজী হন তবেই তাদের মঙ্গল, নইলে তাদের হাতে টুনি দিইচি।
ভুব। বিয়ান সতীনের নাম সইতে পারে না, তোমার মেয়েরা বিয়ানের সতীনঝি, তারা যেন বেয়ানকে ছোঁয় না, তা হলে বিয়ান জলে ডুবে মরবে-
সতীনের ঘা সওয়া যায়, সতীন কাঁটা চিবিয়ে খায়।
রাজী। তোমরা কিছু ভেব না, আমি কাহাকেও ছঃতে দেব না, চুপি চুপি নিয়ে যাব, দশ দিন পরে গাঁয় প্রকাশ করবো।

নসি। এস, বাসি বিয়ে করসে, ঘোর থাক্তে থাক্তে বরকনে বিদেয় কত্তে হবে। (Dinabandhu Mitra)

[প্রস্থান]

তৃতীয় গর্ভাঙ্ক

রাজীব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ীর উঠান রামমণি ও গৌরমণির প্রবেশ
রাম। ভগবতী এমন দয়া করবেন, বাবার বিয়ে মিছে বিয়ে হবে।
গৌর। যথার্থ বিয়ে হয় চারা কি, তিনি আমাদের মা হবেন না আমরাই তাঁর মা হবো, মেয়ের মত যত্ন করবো, খাওয়াব, মাখাব, তাতে কি হবে, যুবতীর যে পরমসুখ তা তো দিতে পারবো না, স্বামীর সুখ কখনই হবে না, বাবা তো বেচে মরা। (Dinabandhu Mitra)

রাজীবের প্রবেশ

রাজী। ও মা রামমণি, ও মা, তোমার মা এনিচি বরণ করে নাও।
রাম। সত্যি সত্যি আমাদের কপালে আগুন লেগেচে, পোড়া কপাল পুড়েছে, বুড়ো বাপের বিয়ে হয়েচে!
রাজী। আবাগের বেটি আমাকে চিরদিন জালালে, আমি ভালমুখে ডাকূলেম উনি
কান্না আরম্ভ করলেন, ওঁর ভাতার এখনি মলো।
রাম। কই আনো দেখি-আর বাপ হয়ে অমন কথাগুলো বলো না-কনে কোথায়?
রাজী। বন্ধু বাবার কাছে।
গৌর। বন্ধু বাবা কে?
রাজী। ঘটককে তোমাদের মা বন্ধু বাবা বলেন, আমিও বন্ধু বাবা বলি, তিনি আমার শ্বশুরের বন্ধু-বন্ধু বাবা! বন্ধু বাবা! নিয়ে এস।
কনের হাত ধ’রে ঘটকের প্রবেশ গৌর। দেখি মেয়েটির মুখ কেমন।
ঘটক। জামাই বাবু, ছাঁতে দিবেন না।
রাম। (ঘটকের প্রতি) আঁটকুড়ির ব্যাটা, সর্বনেশে, আমার মত তোর মেগের হাত হক্ -কোথা থেকে এসে বুড়ো বয়সে বাবার বিয়ে দিলে-তুই যেমন সর্বনাশ কল্লি এমনি সর্ব্বনাশ তোর হবে-
ঘট। বাছা মিছি মিছি গাল দাও কেন, বউয়ের মুখ দেখ, সব দুঃখ যাবে, পুত্রশোক নিবারণ হবে।
[হাস্যবদনে ঘটকের প্রস্থান]
রাজী। তুই বিটি ধর্মের ষাঁড়, এত ঝড়া কত্তে পারিস, তোর বাবার বন্ধু বাবা, গুরুলোক, প্রণাম না করে গাল দিলি, আ পাড়া কুদুলি-ঘরের দোর খুলে দে, আমি ব্রাহ্মণীকে ঘরে তুলি।
গৌর। আচ্ছা আমরা ছাঁতে চাই নে তুমিই একবার মুখটো দেখাও।
পাঁচ জন শিশু এবং গ্রামস্থ কতিপয় লোকের প্রবেশ
শিশুগণ। বুড়ো বাম্না বোকা বর, পে’চোর মারে বিয়ে কর। বুড়ো বাম্না বোকা বর, পে’চোর মারে বিয়ে কর।
রাজী। দূর ব্যাটারা পাপিষ্ঠ গর্ভস্রাব, কেমন পে’চোর মা এই দ্যাখ্ (কনের অবগুণ্ঠন মোচন)।
গৌর। ও মাএ যে সত্যি পে’চোর মা, ও মা কি ঘৃণা, কোথায় যাব-মাগীর গায় গহনা দেখ, যেন সোনারবেনেদের বউ-
রাজী। (দীর্ঘ নিশ্বাস) হ্যাঁ, আমার স্বর্ণলতা বাড়ী এসে পে’চোর মা হলো-আমি স্বপন দেখলেম, আমায় ছলনা কল্যে-আহা! আহা! কেন এমন স্বর্গ মিথ্যা হলো-ও লক্ষক্ষ্মীছাড়া বিটি পে’চোর মা তুই কেন কনে হলি-সে যে আমার ডোইরে কলাগাছে জল- ভরা মেয়ে-মরে যাই, মরে যাই, মরে যাই, (ভূমিতে পতন) কণক রায় নির্বংশ হক, কণক রায়ের সর্ব্বনাশ হক-
পে’চোর মা। কান্তি নেগুলে ক্যান, তোমার ছ্যালে কোলে কর। (কাপড়ের ভিতর হইতে অলঙ্কারে ভূষিত শুকরের ছানা রাজীবের গাত্রে ফেলন)।
রাজী। আঁটকুড়ীর মেয়ে, পেতনি, শুয়োর খাগি, শুয়োরের বাচ্ছা আমার গায় দিলি ক্যান? শুয়োরের বাচ্ছা ঐ রামী রাঁড়ীর গায় দে।
[শুকরের ছানা রামমণির গাত্রে ফেলিয়া রাজীবের প্রস্থান]
রাম। কি পোড়া কপাল, কি ঘৃণা, শুয়োরের ছানা গায় দিলে-অমন বাপের মুখে আগুন, চিলুতে গিয়ে শোও-খুব হয়েচে, আমি তো তাই বলি, কণক বাবু বুদ্ধিমান, তিনি কি বুড়ো বরের বিয়ে দেন।
পে’চোর মা। (শুয়োরের বাচ্ছা কোলে লয়ে) বাবার কোলে গিইলে বাবা, বাবার কোলে গিইলে বাবা-কোলে নেলে না, আগ করে ফেলে দিয়েচে, দিদির গায় উটেলে। (Dinabandhu Mitra)

গৌর। পে’চোর মা তোর বিয়ে হলো কোথায়।
পে’চোর। মোর স্বপোন কি মিত্যে। তোমার বাবা মোর হাত ধরে আলে।
রাম। তোকে নিয়ে গিয়েছিল কে?
পে’চোর। নরলোকে পরির মেয়েদের
চিন্তি পারে?
গৌর। পরির মেয়ে কোথা পেলি?
পে’চোর। ঝুজকো ব্যালাডায় আত আছে কি নেই, মুই শোরের ছানাডা নিয়ে শুয়ে অইচি, দুটো পরির মেয়ে বল্যে পে’চোর মা তোর স্বপোন ফলেচে, আজ তোর বিয়ে হবে, মুই এই ছানাডারে বড় ভালোবাসি, এডারে
সাতে করে গ্যালাম, কত মেয়ে কতি পারি নে, মোরে গয়না পরালে, এডারে গয়না পরালে, পালকিতে তুলে দেলে, বলে দেলে কতা কস্ নে, মুখ দেখানো হলি কতা কস্।
রাম। বাবার গায়ে শুয়োরের বাচ্ছা দিলি ক্যান?
পে’চোর। তানারা বলে দিয়েলো, শোরের ছানা কোলে দিলি তোরে খুব ভালো বাবে, ভাতার বশ করা কত ওষুধ জানি, শোরের ছানা গায় দেওয়া নতুন শেকলাম। (Dinabandhu Mitra)

রতানাপুত্রের প্রবেশ

ইনিতি মোরে পরতম বলেলো মোর কপাল ফিরেচে।
রতা। (রামমণির প্রতি) ওগো বাছা তোমাকে তোমার বাপ একটি পয়সা দেয় না যে ব্রত নিয়ম কর, এই পঞ্চাশটি টাকা তোমরা দুই বনে নাও, আর চাবিটি তোমার বাবাকে দিও, তিনি কাল রেতে আহহ্লাদে চাবি দিয়ে ফেলেছিলেন।
রাম। গৌর টাকা রাখ আমি দৌড়ে একটা ডুব দিযে আসি, শুয়োরের ছানা ছাঁইচি।

[প্রস্থান]
পে’চোর। ভাই ছায়ে নাতি চায়! ও মা মুই কনে যাব।
গৌর। দাও আমার কাছে টাকা চাবি দাও -আহা, বুড়ো মানুষকে কেউ তো মারি ধরি নি।
রতা। মারবে কে?
গৌর। বেশ হয়েছে, মিছে বিয়ে হলো আমরা টাকা পেলুম।
[প্রস্থান]

পে’চোর। বড় মেয়ে গেল, ছোট মেয়ে গেল, মোরে ঘরে তোলে কেডা, মোর বামুন ভাতার কনে গেল?
প্রথম শিশু। দূর বিটি ডুনি।
পে’চোর। বুড়োর বেতে বামনি হইচি, মুই অ্যাকন ডুনি বামনি।
রতা। ওলো ডুনি বানি, আমার সঙ্গে আয়, তোর হারাধন খুজে দিইগে।
[সকলের প্রস্থান]
সমাপ্ত

বানান অপরিবর্তিত

Banglalive.com Logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Picture of বাংলালাইভ

বাংলালাইভ

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।
Picture of বাংলালাইভ

বাংলালাইভ

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com