পঞ্চাশের দশক, দিল্লি।
নর্থ দিল্লির সিভিল লাইন্সের কাছে ২৬ ,আলিপুর রোডের সেই বিখ্যাত বাড়ি। সেখানেই ঝড়ের বেগে ঢুকল গাড়িটা। মুহূর্তে প্রধান ফটক ও বাগান পেরিয়ে মুখ্য প্রবেশপথের মুখে সশব্দে ব্রেক কষে দাঁড়াল কালো রঙের অস্টিন হ্যাম্পশায়ার।
গাড়ির পিছনের আসন থেকে দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামলেন গোলগাল, দীর্ঘাকৃতি কোর্টপ্যান্টটাই পড়া মানুষটি। মোটা চশমার আড়ালে ঝলসে উঠলো একজোড়া চোখ। শশব্যস্ত পায়ে দ্রুতবেগে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হাঁক পাড়লেন – “সারু! সারু! কোথায় তুমি?”
সবিতা আম্বেদকর রান্নাঘর থেকেই শুনেছিলেন গাড়ির শব্দ। একটু আগেই দু’জন রোগী দেখে বাবুর্চিখানায় এসেছেন। গাড়ির আওয়াজ শুনেই বুঝেছিলেন তাঁর ‘কর্তা’ ফিরেছেন। সচরাচর এই সময়ে তিনি ফেরেন না। পার্লামেন্ট বা লাইব্রেরিতে থাকেন। নয়তো পার্টি অফিসে। কিন্তু আজ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাড়ি ফিরেছেন৷ আর ফিরে এসেই এমন হাঁকডাক। না জানি আবার কী বাধিয়ে বসেছেন। তাড়াতাড়ি বসার ঘরের দিকে এগোলেন সবিতা। ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই মুখোমুখি। স্ত্রীকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসেন মানুষটি। একগাল শিশুসুলভ হাসি দিয়ে বলেন, “দেখ! দেখ, কী পেয়েছি!” এই বলে সটান মার্বেলের টেবিলের উপর তুলে ধরলেন ছোট্টখাট্টো কালো রঙের ‘ভায়োলিন কেস’। অবাক চোখে ‘সারু’ দেখেন ভিতরে ঝকঝক করছে একটি বেহালা। যেমন সুন্দর রঙ, তেমনি গঠন। দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো।
মনে মনে তারিফ করলেও মুখে কিছু বলেন না সবিতা। স্বামীকে তিনি হাড়েহাড়ে চেনেন। বহুমুখী প্রতিভাশালী মানুষ তিনি। আবার একটু খামখেয়ালীও বটে। কখন কী করে বসেন বোঝার উপায় নেই৷ প্রশ্ন করেন:
– এটা আবার কে দিল?
– আরে, কে আবার দেবে! এইমাত্র কিনলাম কনট প্লেস থেকে৷ উত্তেজনা ঝরে পড়ে মানুষটির গলায়।
– তাই বুঝি! তা আপনি এসব বাজাতে পারেন বলে তো জানতাম না!
– পারি না তো কী হয়েছে! শিখব! জানো, কতদিনের শখ আমার? অফিসে আসতে যেতে কনট প্লেসের দোকানটা (মার্কুইজ এণ্ড কম্পানি) দেখতাম। আজ কিনেই ফেললাম।

স্বামীর এমন ছেলেমানুষি দেখে হেসে ফেলেন সবিতা। বলেন:
– বেহালা বাজানো তো খুব শক্ত! বম্বে’তে ‘শাঠে বন্ধু’দের বাজনা শুনেছি। চমৎকার বাজান তাঁরা। আপনি কী এই বয়সে পারবেন?
– গান্ধী যদি শেষ বয়স পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন, আমি সামান্য বেহালা শিখতে পারব না? হেসে ওঠেন তিনি।
– এক কাপ চা দাও দেখি! বলে ভায়োলিন কেস হাতে হনহন করে এগিয়ে যান তাঁর স্টাডি কাম লাইব্রেরির দিকে।
স্বামীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন সবিতা। এই মানুষটিকে যত দেখেন, ততই অবাক হন তিনি। এত অসুস্থতা, এত ব্যস্ততা, এত কাজ অথচ তার মাঝেই বই, আঁকা, সঙ্গীতচর্চায় মজে থাকতে ভালবাসেন। তাঁর অতলস্পর্শী পাণ্ডিত্য ও দার্শনিক প্রজ্ঞার কথা সারা দেশের মানুষ জানে। অথচ তাঁর এই ছোট ছোট কথা, এই আন্তরিকতা, ‘ডেডিকেশন’ সত্যিই বিরল। ভাবতে ভাবতে শ্রদ্ধায় যেন নুইয়ে পড়েন সবিতা। মৃদু হেসে এগিয়ে যান রান্নাঘরের দিকে। স্বামীর জন্য চিনি ছাড়া চা, নাস্তা বানাতে।
অবিশ্বাস্য বহুমুখী প্রতিভা
সবিতা জানেন, তাঁর স্বামী কোনও সাধারণ মানুষ নন। তিনি ডাঃ বাবাসাহেব ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী। ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতা। জীবন্দ কিংবদন্তী। বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬) এক অবিশ্বাস্য প্রতিভা, যার তল পাওয়া দুষ্কর। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘ম্যান অফ মেনি পার্টস’ বা নীরদ সি চৌধুরীর ভাষায় ‘স্কলার এক্সট্রাঅর্ডিনারী’, বাবাসাহেব ছিলেন ঠিক তা-ই। ৬৫ বছরের জীবনে এমন কোনও বিষয় বা আঙ্গিক নেই, যা তিনি ছুঁয়ে দেখেননি। যে বিষয় হাতে নিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন৷

একদিকে তিনি রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক, জুরি সদস্য, সমাজসেবী, অন্যদিকে দলিত অন্ত্যজ ও নিম্নবর্গের অধিকার আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ, সুলেখক, প্রাবন্ধিক, বৌদ্ধশাস্ত্রজ্ঞ, নারী শিক্ষা ও জাগরণের হোতা, ভোজনরসিক, সুবক্তা, আইনজ্ঞ, নির্ভেজাল বইপোকা…এ তালিকা সহজে ফুরোবার নয়৷ তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় হল, তিনি ভারতীয় সংবিধানের জনক। স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য এক সেনানী, যিনি বন্দুকের চেয়েও বই ও কলমের শক্তিতে বিশ্বাস রাখতেন বেশি। তাঁর আঁকা অসংখ্য ছবি তাঁর নিবিড় শিল্পীমনের পরিচায়ক।
কিন্তু মজার বিষয়, আদ্যোপান্ত মজলিশি স্বভাবের মানুষটির একটি বিশেষ পরিচয় আজও বহুজনের অজানা। সেটি হল শাস্ত্রীয় ও লোকসঙ্গীতের প্রতি আকণ্ঠ অনুরাগ৷ খুব কম মানুষই জানেন যে বাবাসাহেব একজন সুগায়ক ছিলেন। ছিলেন তালবাদ্যে পারঙ্গম। চমৎকার ‘ডফলি’ বাজাতেন ও শেষ জীবনে নিষ্ঠাভরে শিখেছেন বেহালা। প্রৌঢ়ত্বে এসে সেই নিভৃত সঙ্গীতসাধনা তাঁকে দিয়েছিল অপার শান্তির সন্ধান।
আরও পড়ুন: দেবজ্যোতির কলমে: বিপ্রতীপে বাবাসাহেব
বিশিষ্ট আম্বেদকর-অনুরাগী, মরাঠি লেখক এবং জীবনীকার ভগবনরাও চন্দেও খড়মোরে ১২ খণ্ডে লিখেছিলেন বাবাসাহেবের পূর্ণাঙ্গ জীবনী। তা থেকে জানা যায়, বাবাসাহেব তাঁর শৈশব থেকেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মেধাবী পড়ুয়া হওয়ার পাশাপাশি খেলাধূলায় ছিল তাঁর উৎসাহ। এর মধ্যে ক্রিকেট ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। ক্লাস এইট থেকে টেন পর্যন্ত বম্বের এলফিনস্টোন হাইস্কুলে পড়ার সময় স্কুল ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ভাল ব্যাটসম্যান ছিলেন। আর এই সময় থেকেই সঙ্গীতের প্রতি একটু একটু করে অনুরক্ত হতে শুরু করেন ভীমরাও। অবশ্য এর পিছনে ছিল তাঁর বাবার বিশেষ অবদান।
শৈশব থেকে শুরু
রামজি মালোজি সকপাল ও ভীমাবাঈ-এর সবচেয়ে ছোটছেলে ভীমরাও। সকপাল ছিলেন কবীরপন্থী। বাড়িতে প্রায়ই বসত ভজন-কীর্তনের আসর৷ সে আসরে বাবার সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন ছোট্ট ভীমও। মায়ের নামেই তাঁর নামকরণ। মা ভীমাবাঈ নিজেও ছিলেন সুগায়িকা। ভজন-কীর্তনে বরাবর উপস্থিত থাকতেন ভীমরাও। চমৎকার গান গাইতে পারতেন। ‘কবীরের দোঁহা’ ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। এরই পাশাপাশি কীর্তনিয়াদের সঙ্গে মিশতে মিশতে এই সময়ে, তিনি ‘ডফলি’ বাজানো শেখেন। রামজির উৎসাহে কবীরপন্থীদের সঙ্গে ‘ডফলি’ বাজিয়ে সঙ্গত করতেন তিনি। তাঁর ‘ডফলি’ বাজানো শুনতে ভিড় করতেন বহু মানুষ। তিনি বলতেন, “আমার দশটি আঙুল দু’টি কাজের জন্য প্রদত্ত। সমাজের অনগ্রসর ও দলিতবর্গের মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই ও ডফলি বাজানো।” বাবাসাহেবের নিজস্ব ‘মাহার’ (দলিত) সম্প্রদায়ের মানুষেরাও তাদের গান বাজনার আসরে ডেকে নিতেন তাঁকে।

বাবাসাহেবের আর এক জীবনীকার, বিখ্যাত মারাঠি পণ্ডিত নানকচন্দ রত্তু জানিয়েছেন, উচ্চশিক্ষার সময় বেশ কিছুদিন সময় সঙ্গীত থেকে দূরে সরে যান আম্বেদকর। এর আগেই রীতিমেনে রমাবাঈয়ের সঙ্গে তাঁর ‘বাল্যবিবাহ’ সম্পন্ন হয়, ১৯০৬ সালে। এরপর বিলেত যাত্রা, লণ্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ শেষে দেশে ফিরে আসা ও সক্রিয় রাজনীতি ও সমাজসেবায় যোগদান। এই সময়ে গানবাজনার জগৎ থেকে সাময়িক অবসরই নেন আম্বেদকর। দেশ ও দশের হিতার্থে কোথায় যেন হারিয়ে যায় ভীমরাওয়ের সঙ্গীতবীক্ষা। অবশ্য এই সুদীর্ঘ যতিচিহ্ন শেষমেশ সরে যায় পঞ্চাশের দশকে। বাবাসাহেবের জীবনে পুনরায় ফিরে আসে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চার নয়া দিগন্ত। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Swarajya, Alamy, Drambedkarbooks.com
পেশায় সাংবাদিক প্রসেনজিতের জন্ম ১৯৮১-তে। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলো, প্রসেনজিতের গবেষণার বিষয় রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও সঙ্গীততত্ত্ব। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। অবসরে ভালোবাসেন সরোদ বাজাতে, পুরনো চিঠি ও বই পড়তে।