ব্রিনডংক কোথায়? কীভাবে যেতে হয়? যেতে কতক্ষণ লাগবে? কলকাতা বা দিল্লি নয়, খোদ ব্রাসেলস শহরের অন্যতম ব্যস্ত বাস-ট্রেন-ট্রাম টার্মিনাল যা ‘ব্রাসেলস সেন্ট্রাল‘ নামে পরিচিত, সেখানে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। সুমিত্র বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী তাও কাজ চালানোর মতো স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে পারেন। তিনি না থাকলে কী যে হত কে জানে!
ভাষার প্যাঁচে যাত্রা হল শুরু
ব্রাসেলস হল বেলজিয়ামের রাজধানী। এখন আবার ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন বা ইইউ-এর সদর দফতর। ইইউ-এর সংসদ থেকে শুরু করে সমস্ত শাখা-প্রশাখার প্রশাসনিক সদরও এই শহরেই। কাজেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাগরিক এখানে কর্মরত। তার উপরে প্রতিদিন নানা দেশের নানা ভাষাভাষী মানুষের নানারকমের কাজে ইইউ-এর বিভিন্ন দফতরে নিত্য যাতায়াত। তবুও স্থানীয় লোকজন মূলত ফ্লেমিশ এবং ফরাসি ভাষায় কথাবার্তা বলতে অভ্যস্ত। বেলজিয়ামের উত্তরাঞ্চলের মানুষ, যাঁরা ফ্ল্যান্ডার্স বলে পরিচিত, ফ্লেমিশ ভাষায় কথা বলেন। ভাষাটির সঙ্গে ডাচ ভাষার নৈকট্য আছে। আর দেশের দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ ওয়ালমিয়া এলাকার মানুষের কথ্য ভাষা ফরাসি। বাপ্পাদিত্য ফ্লেমিশ না ফরাসি (তবে কোনওমতেই ইংরেজিতে নয়) কোন ভাষায় কথা বলে আমাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করলেন তা বলা মুশকিল। কারণ দুটো ভাষার কোনওটাই তো আমার জানা নেই।
মিনিট বিশ-পঁচিশ অপেক্ষার পর এল ৪৬০ নম্বর বাস। বাসে উঠতে না উঠতেই টিকিটের জন্য চালক হাত বাড়িয়ে দিলেন। কার্ড দেখে কিছু একটা বললেন বটে, তবে বোঝা গেল না। ততক্ষণে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে এবং মাত্র দু’জন যাত্রী নিয়েই বাস ছেড়ে দিয়েছে। যাত্রীরাও বুঝতে পারলেন যে সিটি কার্ড যখন মান্যতা পেয়েছে ব্রিনডংক জায়গাটা ব্রাসেলসেরই কোনও এক প্রান্তে অবস্থিত। যাত্রা হল শুরু। তারিখ: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৮।

ইউরোপের অন্য অনেক শহরের মতোই ব্রাসেলসেও একবার সিটি কার্ড কিনে রাখলে বাস ট্রাম মেট্রোয় অনায়াসে যাতায়াত করা যায়। বারবার টিকিট কাটার জন্য সময় অপচয় করতে হয় না। অবশ্যই প্রতি সফরের শেষে কার্ডের জন্য জমা দেওয়া ইউরো কমতে থাকে। ফুরিয়ে গেলে আবার ইউরো ঢেলে ভরিয়ে নিলেই হল। প্রতিটি স্টপেজে বাস থামছে। একজন বা দু‘জন যাত্রী। কেউ উঠছেন। কেউ হয়তো নামছেন। সকলেই স্থানীয়। বিদেশি বলতে মাত্র দু‘জন। বাপ্পাদিত্যকে এখন বিদেশি বলা যায় কি? কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল তাঁর পকেটে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের পাসপোর্ট ছিল। অবসরের পর গিন্নির ইইউ-তে কাজের সুবাদে ব্রাসেলসের বাসিন্দা। তবে এ পথে বারবার কেন, একবারও আসেননি সে বিষয়ে নিশ্চিত। কারণ, দু‘জনের চোখেই সংশয়, বাস ঠিক রাস্তায় যাচ্ছে তো!
চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। শহরের ঔজ্জ্বল্য কখন যেন হারিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশের বাড়িগুলোয় মফসসলের ছোঁয়া লেগেছে। ইউরোপীয় স্থাপত্যের ঐতিহ্যবাহী বিশাল অট্টালিকা উধাও। এখন সব বাগানঘেরা ছোটো ছোটো দোতলা বাড়ি। স্থাপত্যশৈলী ভিন্ন, মানে চলচ্চিত্রে বা বিজ্ঞাপনে যেমন আদর্শ বাংলোর ছবি দেখানো হয়, সেরকমই আর কী! প্রতিটি বাড়িতেই একটি বা দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জনহীন পথ। সড়ক আর প্রশস্ত নয়। সংকীর্ণ রাস্তায় অত বড়ো বাস কী করে যে অনবরত ডাইনে-বামে বাঁক নিচ্ছে সে এক বিস্ময়। তবে বাস যাত্রীশূন্য নয়। প্রতি স্টপে নামা ওঠা থেমে নেই। অর্থাৎ বাস নির্ধারিত পথেই নির্দিষ্ট সময়ে চলেছে।

অবশেষে প্রায় সওয়া ঘণ্টা বাদে শহর ছেড়ে এক প্রান্তরের ধারে বাঁদিকে ঘুরে গিয়ে একটা প্রশস্ত সড়কে পৌঁছে বাস থেমে গেল। চালক ঘোষণা করলেন, ব্রিনডংক এসে গেছে। নামতেই দেখা গেল বাসস্টপে আরও দু‘ চারটে ভাষার সঙ্গে একপাশে ইংরেজিতেও লেখা আছে ‘ব্রিনডংক ফোর্ট।’ আর রাস্তাটার নাম এ ১২ মোটরওয়ে। ব্রাসেলস থেকে সোজা অ্যান্টওয়ার্প চলে গেছে। চরাচর জনশূন্য।
কোথায় গেল ব্রিনডংক ফোর্ট?
ওপারে একটা পাঁচিল দেওয়া জায়গা নজরে আসছে। দ্রুত বহমান গাড়ির স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সন্তর্পণে মোটরওয়ে পেরিয়ে পাঁচিলের কাছাকাছি পৌঁছনোর পর চোখে পড়ল, এক বিরাট দরজার একটা ছোট্ট অংশ খোলা রয়েছে, যেখান দিয়ে একবারে মাত্র একজন ভেতরে যেতে বা বাইরে আসতে পারে। মনে সংশয়, তাহলে কি গন্তব্যে পৌঁছনো গেল না! বাইরে কিছু লেখা না থাকলেও ভেতরে কিন্তু ইংরেজি সমেত আরও তিনটি ভাষায় স্থান পরিচয় দেওয়া আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বেলজিয়ামের নাগরিকদের অন্যতম সমাধিক্ষেত্র। নিয়মিত যত্নআত্তি করে গড়ে তোলা বাগানের মধ্যে সারিবদ্ধভাবে অসংখ্য সমাধি উন্মুক্ত আকাশের নিচে সাজানো। প্রতিটি সমাধিফলকে খচিত মৃতের নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ দেখে বোঝা যায়, প্রায় সকলেই ১৯৪১ অর্থাৎ বেলজিয়াম জার্মানির দখলে চলে যাওয়ার পরপরই মারা গেছিলেন। অথবা হত্যা করা হয়েছিল। পায়ে পায়ে এগোতে এগোতে এসে গেল সমাধিক্ষেত্রের অন্য এক দরজা। বাইরে বেরোতেই আবার সেই এ-১২ মোটরওয়ে। এবার কিন্তু রাস্তার ওপারে একটা পাব দেখা যাচ্ছে।

পাব দেখেই হঠাৎ যেন ক্ষুধাতৃষ্ণা চাগাড় দিয়ে উঠল। রাস্তার মতো পাব-ও জনশূন্য। দূরে কাউন্টারের পেছনে একটা টিভি চ্যানেলে ফুটবল খেলা চলছে। হঠাৎ কাউন্টারের ওপার থেকে বেরিয়ে এলেন এক হৃষ্টপুষ্ট প্রৌঢ়। পরনে বারমুডা নয় একেবারে খেলোয়াড়দের মতো শর্ট প্যান্ট এবং স্যান্ডো গেঞ্জি। পেশিবহুল চেহারার যেটুকু দেখা যাচ্ছে, সবটাই বিভিন্ন ট্যাটুতে চিত্রিত। কোলে একটি বেড়াল নিয়ে এগিয়ে এসে খুবই বিরক্তির সঙ্গে কোনওরকমে দায়সারা ভঙ্গিতে মেনুকার্ড টেবিলে বিছিয়ে দিলেন। ভাবখানা এমন, যেন খেলার মাঠ থেকে তাঁকে জোর করে তুলে আনা হয়েছে। চোখ অবিশ্যি টিভির পর্দায় আটকে আছে। বাপ্পাদিত্য বিনীত ভঙ্গিতে যা বললেন তা কানে গেল কিনা বোঝা না গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য-পানীয় পরিবেশিত হল। বাপ্পাদিত্য ব্রিনডংক ফোর্টের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করায় ভদ্রলোক জানালেন যে তার জানা নেই। হঠাৎ কী কারণে কে জানে নিজেই বললেন যে এক্ষুনি তাঁর গার্লফ্রেন্ড এসে যাবেন; তিনি ঠিক হদিশ দিতে পারবেন; সারাদিন তো পুরো তল্লাট জুড়ে ঘুরে বেড়ায়; ঠিক বলতে পারবেন। “১৯৪৮-এ আমার জন্ম ইস্তক আমি এখানেই আছি। এমন কোনও জায়গার নাম আগে কখনও শুনিনি।”
সত্যি সত্যিই খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই এক প্রবীণ পৃথুলা মহিলা পাবে প্রবেশ করলেন। পরনে বিচিত্র পোশাক। ভেতরে এসেই পাবের মালিক বা ম্যানেজার বা ওয়েটার, অর্থাৎ সেই প্রৌঢ়কে প্রায় জাপটে ধরে চুমু খেতে শুরু করলেন। ওদিকে তাকানো উচিত নয়। তার থেকে পানাহারে মনোনিবেশ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে মাত্র কয়েকমুহূর্ত। পাবের দুই অতিথির সামনে তিনি উপস্থিত। উচ্চকণ্ঠে রীতিমতো উত্তেজিত ভঙ্গিতে তিনি বোঝাতে শুরু করলেন কীভাবে ব্রিনডংক ফোর্টে যেতে হবে। কথা বুঝতে না পারলেও দ্রুততার সঙ্গে তাঁর দুই হাতের নাড়াচাড়া দেখে বোঝা গেল, যে এতক্ষণে মনে হচ্ছে গন্তব্যের নিশানা পাওয়া গেছে। বাপ্পাদিত্য স্মিতহাস্যে ইয়োরোপীয় সহবত-সৌজন্য বজায় রেখে কী যেন বললেন। এমন পরিস্থিতিতে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনই সমীচীন। দাম চুকিয়ে পাব থেকে বেরনোর সময় নজরে এল অতিথি সমাগম শুরু হয়েছে। অর্থাৎ মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে এবার পাব ব্যস্ত হয়ে উঠবে।

রাস্তায় বেরিয়ে বাপ্পাদিত্য জানালেন ওই মহিলা দু‘হাত এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফরাসি এবং ফ্লেমিশ মিশিয়ে প্ৰথমে এই জায়গার বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। ব্রাসেলস শহরের উপকণ্ঠের এই এলাকা আদতে অ্যান্টওয়র্প প্রদেশের উইলেব্রয়েক পুরসভার অন্তর্গত। প্রায় সাড়ে সাতাশ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত এই পুরসভার জনসংখ্যা ২৬ হাজারের থেকে সামান্য বেশি। তারপর তিনি নাকি বলেছেন, এ-১২ মোটরওয়ে পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে পা মেপে মেপে কত পথ চলার পর বাঁদিকে ঘুরতে হবে এবং তারও পর পাথর মোড়ানো কত মিটার হাঁটলে গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে। বাপ্পাদিত্য মন্তব্য করলেন যে সুকুমার রায় বেঁচে থাকলে খুশি হয়ে বলতেন, বিদেশ বিভুঁইয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে অন্তত একজন তাঁর কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। সবশেষে সেই প্রাণোচ্ছল পৃথুলা মহিলা নাকি একটা মনখারাপ করা বিকেলের জন্য আগাম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
সত্যি সত্যিই পা মেপে মেপে খানিকটা এগোতে না এগোতেই মোটরওয়ের ডিভাইডারের উপর ব্রিনডংক ফোর্ট লেখা একটা ছোট্ট বোর্ড নজরে আসায় দুই ভারতীয়ের মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির হাসি।
ছবি সৌজন্য: লেখক ও Wikimedia Commons
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।