Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

‘বৃক্ষ অনুবাদক’ সম্পর্কে

Brikkho Anubadak cover Goodreads
বৃক্ষ অনুবাদক প্রচ্ছদ
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

গ্রন্থ- বৃক্ষ অনুবাদক
শ্রীজাত
আনন্দ পাবলিশার্স
মূল্য: ২৫০ টাকা

যখনই কোনও একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ ওঠে, তখনই তা সকলের কাছে সমান ভাবে গৃহীত হবে কিনা, সে প্রসঙ্গও উঠে আসে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য, অনেক সময়ই নতুন কোনও বিষয় সমাজের কাছে সে সময়েই গৃহীত হয় না। পাঠকদের কাছেও না। কারণ, পাঠককে সেই শিল্পকে গ্রহণ করার জন্যেও সমানভাবে দীক্ষিত হতে হয়, প্রস্তুত হতে হয়। এর মানে এটা নয় মোটেই, সেই শিল্প মহাকালের কাছে পরীক্ষিত হয়ে গেল, বা প্রকৃতই তা নতুন! নতুনকে নতুন হয়ে ওঠার পথেও মনে হয় অনেকখানি রাস্তা অতিক্রম করতে হয়। এ হল নতুনের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব। একজন প্রকৃত শিল্পী বা প্রকৃত শিল্পকে সৃজনের নিরভিসন্ধি নিয়ে রাখা শিল্পীর কাছে এই প্রস্তুতিপর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার প্রথম পদক্ষেপ হল, চেনা অভিজ্ঞতার পরিধি থেকে লেখাকে বের করে আনা এবং পরিচিত, গতানুগতিক ও চলতি টেক্সট- আর লিখনের ছাঁচ থেকে আগে লেখাকেই বের করে আনা। ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ঝুঁকি একজন লেখককে নিতে হয়, অন্তত যিনি, নতুন একধরনের অভিজ্ঞতা তৈরি করতে চাইছেন।

উপন্যাসের শিল্প যে আবহমানতাকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বব্যাপীই নিজেকে বারবার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে, তা উপন্যাস নামক মাধ্যমকেই নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে আমাদের সাহায্য করেছে। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের ইতিহাসে বিভূতি, মানিক, তারাশঙ্কর, সতীনাথ, কমলকুমার, সন্দীপন, সমরেশ বসু, নবারুণ, অরূপরতন, কৃষ্ণগোপাল, অভিজিত সেন, অমিয়ভূষণ, আশাপূর্ণা, মহাশ্বেতা সেই পথেই রচনা করেছেন এমন সব কিংবদন্তি লেখা, যে তার পর অন্য কোনও উপন্যাস বিষয়ে লিখতে সত্যিই অনেক ভাবতে হয়। কারণ এঁরা হলেন সেই শৃঙ্গ, যে পথে আর হাঁটা যাবে না। যদি হাঁটতেই হয়, তবে অন্য পথে হাঁটা ভালো। ‘আম’ আর সম্ভব নয়। ‘আমড়া’ হলেও তা নতুন হবে। কিন্তু ‘নতুন’ হবে। ‘অন্যরকম’ হবে। যা পড়তে গেলে কিছুতেই মনে হবে না আগের ক্লাসিকগুলির সঙ্গে তুলনার কথা। যা নতুন। মহাকালজয়ী হবে কিনা, তা ভাবার দায় তার নেই।

কারণ সে তার মাথার মধ্যে, মনের মধ্যে, দেখার মধ্যে যে সমস্ত রহস্য, সেগুলির সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া করে ফেলতে চাইছে। একটা প্রতিধ্বনিকে যদি কেউ আঁকতে চায়, তুমি জীবনানন্দকে আবিষ্কার করলে কীভাবে, তাহলে তার সেই আঁকার মধ্যে ফুটে ওঠে অজস্র সময়ের চিত্রপট। আসলে তো আমরা আলাদাভাবে নেই কোথাও। আমাদের থাকার মধ্যে বাজনা বাজাচ্ছেন পণ্ডিত রবিশংকর, আঁকছেন পাবলো পিকাসো, হয়ত পাশেই একটা গলন্ত ঘড়ির ছবি আর শূন্যে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবি আঁকছেন সালভাদর দালি। আমাদের থাকার মধ্যেই কবিতা লিখছেন জীবনানন্দ দাশ। আমাদের থাকার মধ্যেই লোরকা মারা যাচ্ছেন। আবার আমাদের থাকার মধ্যেই যমস্ত বেদনাকে লিখে রাখছেন সিলভিয়া প্লাথ। ‘বৃক্ষ’ যা আসলে এই অজস্র পাতা, শাখাপ্রশাখাকে নিয়ে থাকে। যার আসলে কোনও দেশ নেই। আকাশের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে তার এই সংযোগের মধ্যে থাকে হাজার হাজার বছরের মানুষের চেতনার ইতিহাস, অবচেতনার ক্যানভাস। আমরা আসলে তার অনুবাদক মাত্র। সম্যক, সিলভিয়া, ক্যারোল, এরিয়েল সবাই মিলেমিশে যাচ্ছে। যেন পড়ছি কিছু পাঠের, কিছু দেখার প্রতিক্রিয়া। কীভাবে একজন লেখক ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিছু কবিতার মধ্যে, কিছু পেইন্টিং-এর মধ্যে, আর কীভাবেই বা নিজের নিজের ভিতরে থাকা ভ্যান গঘ, পিকাসো, দালি, সেজান, মাতিসের পাশাপাশি সিলভিয়া, জীবনানন্দ এক হয়ে পরস্পর কথা বলছেন। ‘উপন্যাস’ বা ‘লেখা’ তবে কি নতুন ভাবে এই নিজের অবচেতনে থাকা টেক্সটগুলির সঙ্গে আলাপচারিতা?

কিছুটা দক্ষিণ আমেরিকীয় ফিল্মগুলির মতো আবহের দৃশ্যাবলি দেখি। এই উপন্যাসে এই দৃশ্য একধরনের অবচেতনের পাঠপ্রতিক্রিয়ার প্রতীকী অর্কেস্ট্রেশন তৈরি করেছে। আর তার মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে কথন। গল্প আসলে লেখক বলেননি। কারণ গল্পের কোনও অস্তিত্ব নেই।
লেখাটি মহৎ না, কালজয়ী না, (অন্তত স্বাভাবিক ভাবেই আমার পক্ষে এ বিষয়ে কিছু বলাই অনুচিত, কারণ এ বিষয়ে জানি না), লেখাটি নতুন। লেখাটি অবশ্যই নতুন। এই লেখা, লেখককে আরও বড় কোনও লেখার জন্য প্রস্তুত করছে। আরও নতুন কোনও লেখার জন্য তো বটেই। যদি সিরিয়াল-সাহিত্যের ঝড় সব উড়িয়ে নিয়ে না যায়। কিন্তু সে সম্ভাবনা শ্রীজাতর ক্ষেত্রে কম। কারণ, তিনি, তাঁর উপন্যাসগুলিতে আশ্চর্যরকম ভাবে এক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে চলেছেন। এই প্রেক্ষাপটের একটা ধারাবাহিকতার দিক আছে, যা লেখককে ক্রমশ এবং ক্রমশই আরও অনেকটা ঝুঁকি নেওয়ার দিকে নিয়ে যাবে আশা করা যায়। কারণ যে ধরনের বৃত্তান্তের লিখনভঙ্গিমার দিকে তিনি তাঁর এই উপন্যাসকে নিয়ে গেছেন, তার মধ্যে বৃত্তান্তের চলনকেই অস্বীকার করা আছে। তথাকথিত বৃত্তান্ত বা ন্যারেটিভের চলন এই লেখায় স্বীকৃত হচ্ছে না বলেই, এই লেখা বারবার আমাদের ধাক্কা দিচ্ছে। নতুন করে পাঠের অভিজ্ঞতার কাছে হাজির করাচ্ছে আমাদের। যেখানে কবিতা, দর্শন এবং ব্যক্তি মানুষের কুহকী বেদনার কাছে গিয়ে আমরা নীরব হয়ে যেতে পারছি। নিশ্চিত ভাবেই এই উপন্যাস সকলের জন্য নয়। অনেকেই, যাঁরা উপন্যাস থেকে ইচ্ছেপূরণের গল্প বা সময়যাপনের গল্প খোঁজেন এবং যাঁরা চান সেই সব গল্প হবে ভি আই পি রোডের মতো মসৃণ, তাঁদের জন্য তো একপ্রকার ধাক্কা বটেই। কারণ তথাকথিত আখ্যানের ঘেরাটোপ ছেড়ে ও আখ্যানের আবহের ঘেরাটোপ ছেড়ে এই উপন্যাস বেরিয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, শ্রীজাত, তাঁর দীর্ঘদিনের ইউরোপীয় নিউ ওয়েভ সিনেমার সঙ্গে যাপনের ফলস্বরূপ, নিউ ওয়েভ সিনেমার সিনেমাটিক ভাষাকে আত্মীকরণ করে নিয়েছেন তাঁর গদ্যরীতির মধ্যে। এর ফলে সিনেমাটিক ভাষার নির্মিতি (মাইমেসিস) পাওয়া যায় তাঁর এই উপন্যাসের বৃত্তান্তের মধ্যে। দুই মাধ্যমের মধ্যে এই যে ভাষার মিথষ্ক্রিয়াটি ঘটল তাঁর কলমে, তা বাংলার মেনস্ট্রিম উপন্যাসে অকল্পনীয়, যদিও বাংলার উপন্যাসের প্রকৃত ধারার কথা আলোচনা করলে, মেনস্ট্রিম উপন্যাস বলতে যেটিকে বোঝাচ্ছি, তা কতটা মেনস্ট্রিম, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ নির্দ্বিধায় অমিয়ভূষণ মজুমদার বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বা সুবিমল মিশ্র বা অরূপরতন বসু বা কৃষ্ণগোপাল মল্লিক তথাকথিত মেনস্ট্রিম উপন্যাসের ধারার মধ্যে না পড়েই বাংলার মূল ধারার লেখক। বলা যেতে পারে, আধুনিক বাংলা উপন্যাসের ভিতটাই এদের উপর। তাঁদের লেখার মধ্যে এই নতুন ধারার আত্মপ্রকাশ এবং বিস্তৃতি হয়েছিল অনেক আগেই। শ্রীজাতর সাহস এবং সততার জায়গাটি এখানেই, বৃক্ষ অনুবাদক উপন্যাসে তিনি একপ্রকার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যেভাবে উপন্যাস লিখিত হয়, তার বিরুদ্ধে। অনেকটা এ কারণেও শ্রীজাতর বৃক্ষ অনুবাদক উপন্যাসটি হয়তো বহু পাঠকের কাছে বিস্ময়ের বিষয়, আবার কারো কারো কাছে বিরক্তির বিষয়ও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাতে উপন্যাসের কিছু এসে যায় না। কারণ, পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে শিল্প তার নিজস্ব নিয়মেই এগিয়ে যাবে। তার জন্য পাঠককেই দীক্ষিত হতে হবে। আর পাঠক পরে দীক্ষিত হন, লেখক নিজ নিয়মে সৃষ্টি করে, পাঠককে দীক্ষিত হতে প্ররোচনা দেন মাত্র।

Author Hindol Bhattacharjee

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।

Picture of হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।
Picture of হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।

2 Responses

  1. “গদ্য লিখেছেন কবিতার মতো” বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ কে।
    এত কাব্যগুণ সমৃদ্ধ লেখা একজন কবিই পারেন।
    সত্যিই শ্রীজাত-র উপন্যাসটি পড়ে মনে হয়েছিল হয়তো প্রস্তুতি নিচ্ছেন আরও বড় কিছু লেখার জন্য।
    এক অন্য মাত্রার ভালো লাগা ছুঁয়ে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস