২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এখনও আমাদের বার বার প্রশ্ন করতে হচ্ছে যে নারী দিবস পালন করা উচিত কিনা, নারী দিবসের আলাদা করে কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি না— অথচ, এত দিনে এ সব প্রশ্ন অবান্তর হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রে মানুষ যত এগিয়েছে— বৌদ্ধিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে, সেই ধারা মানলে এত দিনে সমানাধিকার স্থাপিত হওয়া খুব উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কারণ মানুষ মস্তিষ্ক দিয়ে কেবল যুক্তির পরম্পরা ভাবে না, সে ক্ষমতাও ভাবে, সে অনুভূতি ভাবে, সে যুক্তিহীনতার চর্চা করে এবং সামাজিকতার নিয়ম মেনে জীবন চালনার চেষ্টা করে। মনুষ্যমস্তিষ্ক কি আর সাধে জটিল?
এই সব জটিলতা থেকেই অসাম্যের সৃষ্টি। যে অসাম্য কেবল নারীদের ক্ষেত্রে নয় আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনও বহাল তবিয়তে বিরাজমান। কিন্তু আজ যেহেতু নারী দিবস, তাই নারীদের কথাই বরং বলি।
যদি সমানাধিকার মেনে নিতে হয় এবং বৃহত্তর সমাজের অঙ্গ হিসেবে নারীকে ধরতে হয়, যদি তার ক্ষমতাকে কমিয়ে দেখার প্রবণতা ত্যাগ করে একটি সাম্যের সমাজের কথা ধরা হয়, তা হলে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে সংরক্ষণ কিংবা নির্দিষ্ট দিবস পালন থেকে নিস্তার দেওয়া উচিত। অনেকের মতে আলাদা করে দিবস পালন করে দেওয়ার মধ্যেও নারীকে একটি গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করার একটা ধারণা আছে। যে ধারণা মূল স্রোতে থেকেও মূল স্রোতের অধিকার এবং সম্মান থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। নারীকে কতকগুলি নির্দিষ্ট ভূমিকায় দেখতেই প্রবণতা জোগায়। এবং এই দিবস পালন করার মধ্যে নারীর অধিকারকে মেনে নেওয়ার চেয়ে তাকে অধিকার দান করার মহত্ত্বে মেতে ওঠে সমাজ। যা নারীর পক্ষে অবমাননাকর। মানুষ হিসেবে জন্মেছে বলেই যে অধিকার নারীর প্রাপ্য, তা সমাজ তাকে দান করলে মনুষ্য সত্তাকেই যে প্রকারান্তরে অপমান করা হয়, সে কথা বুঝে নেওয়াই ভাল।এবং সেই অপমানকে সম্মানের অধিকারে পরিবর্তন করতে নারীকে ক্রমাগত লড়াই করতে হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।
এক দল নারী রয়েছেন যাঁরা এই সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিকার স্থাপন কিংবা একটি দিনকে লড়াইয়ের দিন হিসেবে চিহ্ণিত করাকে গৌরবের মনে করেন না। না-ই করতে পারেন, তাঁদের যুক্তিও গ্রাহ্য। তাঁরা নৈতিকতা এবং সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে কথাগুলি বিশ্বাস করেন।
কিন্তু বাস্তবে নারীর যে অবস্থান, এমনকী প্রথম বিশ্বের নারীদেরও, তাতে নারীর অধিকার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য, নারীকে মস্তিষ্কের ভাবনায়, সমাজের নিয়ম বদলে সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অবশ্যই এই দিনটির প্রয়োজন। নারীর সমস্যার তালিকা করতে গেলে পাতা ফুরিয়ে যাবে, যুক্তির ভান্ডার ফুরিয়ে যাবে, কেবল সংখ্যার ঠাঁই অসীম অবধি বলে গুনতি করা যাবে। অর্থনৈতিক অবস্থান দিয়ে যদি বিচার করা যায়, তা হলে দেখা যাবে, যে নারী অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন, চিন্তায় স্বাধীন, সমাজে তাঁর এক রকম সমস্যা আর যে নারী অর্থনৈতিক অবস্থানে নিচের দিকে, সামাজিক অবস্থানে নিচের দিকে, তার সমস্যা অন্য রকম। সুতরাং কেবল বাস্তবিক সমস্যাকে মান্যতা দিলে নারীকে একাসনে বসাতে এখনও ঢের সময় বাকি। আর তাই নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা আছে। শুধু এটুকু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে নারী সমাজে এখনও সমান স্থান পায়নি, তার অধিকারের লড়াই শেষ হয়নি।
যুক্তির লড়াই দু-দিকেই থাকবে, তা কখনই শেষ হবে না, আবার দিবস পালন করার বা না-পালন করার স্বাধীনতাও শেষ হবে না। এই স্বাধীনতাটাকে সম্মান করাই নারীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।