বলছিলেন শ্রী আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সাহিত্যিক। ১৮ মার্চ, শনিবার, কলকাতার বেঙ্গল ক্লাবে ক্যান্টো কবিতা উৎসব আয়োজিত একটি আলোচনায় উঠে এল, ছিন্নমূল হওয়ার যন্ত্রণার কথা। ‘দ্য ইনহেরিটেন্স অফ লস: ডিপ্রভিনসিয়ালাইজিং বেঙ্গলস পার্টিশন’ শীর্ষক এই মনোজ্ঞ আলোচনাটিতে আলাপনের সঙ্গী ছিলেন ক্যান্টো কবিতা উৎসবের ডিরেক্টর, বিশিষ্ট লেখক, প্রাবন্ধিক এবং অনুষ্ঠানের অন্যতম সঞ্চালক অভীক চন্দ। ছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিনা ফেরেরা এবং আ্যলিসন জেমস। যে আলোচনায় ফিরে ফিরে এলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। ১৯৪৭ সাল— র্যাডক্লিফ লাইনের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বাংলা ও পাঞ্জাব। বাস্তুহারা হলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাতে জন্ম দিয়েছিল কবিতার নতুন স্বরের, ঠিক যেমনভাবে হলোকস্ট প্রভাব ফেলেছিল তৎকালীন ইউরোপীয় সাহিত্যে। কিন্তু হলোকস্টের নির্দিষ্ট একজন খলনায়ক বা চরিত্র থাকলেও এই উপমহাদেশের ‘দেশভাগ’ আসলে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন।

গত ১৫ মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল ‘ক্যান্টো কবিতা উৎসব’ (Canto Poetry Festival), যা বহুভাষিক, বহুসাংস্কৃতিক এবং ‘ভ্রাম্যমাণ’। চারদিন-ব্যাপী এই উৎসবের প্রথম পর্বটি হয়েছিল নয়া দিল্লির ‘ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো সেন্টার’-এ। একই ছাদের নীচে জড়ো হবেন বিশ্বের খ্যাতনামা কবি, অনুবাদক, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপকরা। জড়ো হবেন দেশের কবিতাপ্রেমী মানুষ, সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীরা। চলবে কবিতা পাঠ ও কবিতাকেন্দ্রিক আলোচনা— এমন ভাবনাই জন্ম দিয়েছিল এই অভিনব উৎসবের। বলা বাহুল্য, বাংলা তথা ভারতে এমন আয়োজন বিরল।
প্রথম দু’দিন ১৫ এবং ১৬ তারিখ, শিকাগো পর্বের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন পুলিৎজারপ্রাপ্ত কবি বিজয় শেষাদ্রি, ম্যান বুকার ও টিএস এলিয়ট পুরস্কারজয়ী জর্জ সির্টেস, কবি জিৎ থায়িলের মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা। ‘কোলার হাউজিং এস্টেট’-এর কালজয়ী কবি সির্টেসের রচনাকে বিশেষভাবে উদযাপন করল ক্যান্টো। স্মৃতির সরণি বেয়ে লিংকন সেন্টারের জ্যাজ কনসার্টে পৌঁছে গিয়েছিলেন কবি বিজয় শেষাদ্রি। পাশ্চাত্যের জ্যাজ সঙ্গীত কীভাবে মিশে গেছে তাঁর কবিতায়—সে কথা উঠে এসেছিল কথোপকথনে। কবির প্রতিবাদী সত্তা, অনুবাদের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন কবি সচ্চিদানন্দন।
আরও পড়ুন: একটা চড়ুই স্মৃতির ভিতর ‘এক্কা দোক্কা খেলছে’
১৮ ও ১৯ তারিখ, এই উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব ছিল কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন ‘দ্য বেঙ্গল ক্লাব’-এ। ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে এই উৎসব হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন। সেখানে যেমন মাতৃভাষায় কবিতা পাঠ করেছেন একাধিক ভারতীয় কবি, তেমনই ইংরাজি মৌলিক কবিতার পাঠ, অনুবাদ— দর্শকদের জন্য হাজির ছিল সবকিছুই। ভৌগোলিক সীমারেখা অনুষ্ঠানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি মোটেও। বিদেশ থেকে বহু কবিই অংশগ্রহণ করেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে। দর্শকদের সঙ্গে আদানপ্রদানও সহজ হয়ে উঠেছিল।

কলকাতায় উৎসবের দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানের সূচনা করেন কমনওয়েলথ পুরস্কার-জয়ী কবি এবং বিশিষ্ট মার্গসঙ্গীত শিল্পী অমিত চৌধুরী। আলোচনায় সঙ্গী হয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন কবি এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রীকান্ত রেড্ডি। অমিত চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রথমে বাংলা, পরে দেশের বাইরে হলেও ভারতীয় বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আজও অক্ষুণ্ণ। কলকাতার গন্ধ, সাইনবোর্ড, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মুম্বাই শহরের কোলাহল, বান্দ্রার রাস্তা দিয়ে গিটার বাজিয়ে হেঁটে চলা যুবকের সুর, রবীন্দ্রসঙ্গীত— সবকিছুই ঢুকে পড়ে তাঁর কবিতায়, পাঠে, কথনে। দূরে থেকেও যেন জুড়ে যান কবি।
অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ লগ্নে উপস্থিত ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ও কবি অভীক মজুমদার, আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স সম্মানিত বিখ্যাত মার্কিন কবি রোজানা ওয়ারেন এবং কবি ও ইংরাজির অধ্যাপক দেবাশিস লাহিড়ী। ‘ইন্টারনাল অ্যান্ড এক্সটার্নাল ক্রাইসিস ইন পোয়েট্রি’ শীর্ষক এই আলোচনায় রোজানা ধরার চেষ্টা করছিলেন কবিতার ভেতরে নানাবিধ সংকটের ছবিকে। তা কখনও বিকৃত, কখনও ব্যক্তিগত— কবিতা তার নিজের শরীর দিয়েই যা ধরে রাখে। অভীক তাঁর কবিতাপাঠের পরে বলেন, কবিতা লেখাই তাঁর কাছে একটি সংকট। পল ভ্যালেরির স্বর্গ থেকে কবিতাকে খুঁজে পাওয়ার কথা উঠে আসে আলোচনায়। কবিতা কতটা এগোতে চায়? কবিতা কি আদৌ একজন কবি লেখেন? নাকি কবিতা নিজেই ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে? রোজানা অভীকের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। বলেন, কবিতা নিজেই কবিতাকে লেখে। অভীক প্রশ্ন করেন— কবিতার সম্পাদনা তো তাহলে কবিতার এই কবিতা হয়ে ওঠাকেই বেঁধে ফেলার চেষ্টা? তা কি আদৌ উচিত? কবিতা তো সবসময় তার পাঠ বা শ্রুতির জমিতে দাঁড়িয়ে থাকে না, তার ভেতরে জমে থাকা দগদগে সংকট ক্রমশ প্রকাশ পায়। ফলে কবিতাকে না দেখলে, তার ভেতরের সংকটের হদিশ পাওয়া যায় না। দেবাশিস লাহিড়ী প্রশ্ন তোলেন, কোনও কবির ভেতরে যদি ব্যক্তিগত সংকটের জমি থাকে, তাহলে তা কি আসলে সময় নির্ধারিত নয়? তা কি আসলে কোনও না কোনও বিশ্বাসভঙ্গ, স্বপ্নভঙ্গ, সম্মিলিত যন্ত্রণাবোধ বা ডিস্টোপিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছে না?
‘ইন্টারনাল অ্যান্ড এক্সটার্নাল ক্রাইসিস ইন পোয়েট্রি’ শীর্ষক এই আলোচনায় রোজানা ধরার চেষ্টা করছিলেন কবিতার ভেতরে নানাবিধ সংকটের ছবিকে। তা কখনও বিকৃত, কখনও ব্যক্তিগত— কবিতা তার নিজের শরীর দিয়েই যা ধরে রাখে। অভীক তাঁর কবিতাপাঠের পরে বলেন, কবিতা লেখাই তাঁর কাছে একটি সংকট।
বিখ্যাত ভারতবিদ ওয়েন্ডি ডনিগারের হাত ধরে দর্শকেরা পৌঁছে যান মহাভারতের শেষ পর্বে। কৃষ্ণের প্রয়াণ, মৌষলপর্ব, স্বর্গারোহণ—মহাভারতের বিভিন্ন আখ্যানে ফুটে উঠেছে অসংখ্য কাব্যিক আঙ্গিক, রূপকের খেলা। সেসবই ফুটে ওঠে ওয়েন্ডির নিবিড় পাঠে

চার দিনের এই উৎসবে হাজির ছিলেন দলজিৎ নাগরা, কে সচ্চিদানন্দন, বিবেক নারায়ণন, জয় গোস্বামী, অরুন্ধতী সুব্রমণ্যম, অনিতা নায়ার, বিবেক দেবরায়, কাজিম আলি, টিশানি দোশির মতো ব্যক্তিত্বরাও। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিরান্ডা হাউজ কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিশেষ কর্মশালারও আয়োজন করা হয়েছিল, যার দায়িত্বে ছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন উইলকিন্সন, আ্যলিসন জেমস এবং শ্রীকান্ত রেড্ডি। তাঁদের খালি হাতে ফেরায়নি কলকাতা। ছাত্রছাত্রীদের উদ্দীপনায় মুগ্ধ শিকাগোর অধ্যাপকমণ্ডলী।
চারদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠান যে-কোনও কবিতাপ্রেমী ভারতবাসীর কাছেই এক বিরাট প্রাপ্তি। অনুষ্ঠানের নেপথ্যে ছিল ‘শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘হারপার কলিনস’ প্রকাশনা, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান। প্রচারের দায়িত্বে ছিল ওয়েব পোর্টাল প্রহর ডট ইন। জানা গেল, এই উৎসবের প্রতিটি আলোচনা ও কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানই আগামীদিনে পৃথকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কবিতাপ্রেমীদের কাছে পৌঁছে দেবেন ক্যান্টোর উদ্যোক্তারা।
‘কবিতার একজন সবচেয়ে ভালো অনুবাদক হয়তো একজন কবিই হতে পারেন। জয় গোস্বামীর কবিতা আমাকে ছুঁয়েছিল… একাত্মবোধ করেছিলাম শব্দের সঙ্গে। তিনি তো শুধুমাত্র বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন নন, তাঁর কবিতা যথার্থই আন্তর্জাতিক।’—বলছিলেন সম্পূর্ণা চট্টোপাধ্যায়। জয় গোস্বামীর একাধিক কবিতার অনুবাদক তিনি। বেঙ্গল ক্লাবের বাইরে তখন অবিরাম বারিধারা। ভেতরে মন্ত্রোচ্চারণ। ‘সূর্য-পোড়া ছাই’,‘সপাং-সপাং’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একের পর এক পাঠ করে চলেছেন জয় গোস্বামী। ঝড়জল, অসুস্থতার বাধা পেরিয়ে অনলাইন মাধ্যমেই হাজির হয়েছিলেন তিনি। শব্দস্নাত সেই বিকেলের ঘোর হয়তো মুছবে না সহজে।
মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial