(Chaitra Season) রমজান মাস ফুরিয়ে আসছে। এই তো, আর কদিনেই আকাশ আলো করে এক ফালি চাঁদ উঠবে। আসলে আকাশের আলো তো ঠিক নয়! সে আলো মানুষের মুখে চোখে। যে চাঁদের কথা ভেবে ভেবে মানুষ ধবধবে সাদা চেলে (চালের) রুটি বানায়, সে কি আর আকাশের! মানুষের মুখে মানুষ জোছনা খোঁজে জীবনভর। চৈত্রের দিন এমন করেই জীবনকে দেখেছে। খরার ধান কি আর সকলে ফলাতে পারে! সে রেস্তো কই! এই পড়ে থাকা মাঠ আর শুকিয়ে আসা কাঁদড় জানে চৈতের খরা কী কঠিন! সেই কঠিন মাঠ রুখুশুখু জমিন পেরিয়েও কেউ কেউ তিল ফুলের খোঁজ পায়। (Chaitra Season)

যে মানুষ বৈষ্ণব পদাবলী পড়েনি কোনোদিন তারও শ্রীরাধিকার কথা মনে পড়ে বুঝি। ‘তিল ফুল জিনি নাসা’র খোঁজ কি আর খেটে খাওয়া মানুষের একলার! এই জগত তার রূপের ডোরে পথ ভুলেছে। নেহাত কাজের শেষ নেই। এই গ্রাম জীবনে আর কবেই বা রবিবার তার ছুটির ডানাখানি মেলে বসেছে! তাই না এই চৈত্রের গ্রাম একেকদিন তিলখেতের পাশটিতে গিয়ে গা এলিয়ে বসে। নিম জিউলির ছায়ায় বসলে মিঠে মিঠে হাওয়া দেয়। সে হাওয়া এই দুপুরখানিকে ভালোবাসতে শেখায়। (Chaitra Season)
জীবন কি আর অগাধ! তবু কী অগাধ এই চৈত্রের দুপুর! বেলা ফুরিয়ে আসার আগে, ও চৈত্রের শালবন! ঝরবে নাকি খানিক? ঝরিয়ে দেবে মঞ্জরী?
বিষণ্ণতার পাঠ কি কেবল নাগরিক কবিয়ালকে ছুঁয়ে যায়! এই গাঁ-গেরামের মাঠ-ঘাট আর ঘণ্টিহারা সাইকেল তাকে পেয়েছে নিবিড় করে। শালের জঙ্গলে গুঁড়ো গুঁড়ো শালফুলেরা যখন ঝরে পড়ছে অবিরত! তার মন মাতাল করা গন্ধে জানু ডুবিয়ে বসবার ব্যাকুলতা বাড়ছে ক্রমশ! তখন এই মাঠ আর কাঁদড় পেরিয়ে ওই দূরে দূরে ছেলে ছোকরার দল কাদা ছেনে ছেনে ল্যাটা আর গোচিমাছ ধরছে। শালফুলেদের ঝরে পড়া ওদের জীবনে কী বিষম বাহুল্য! অথচ জীবনকে ওরা নিঙরে নিচ্ছে শেষ বসন্তের উদ্দীপনায়। এই জীবন তো কখনও জীবনানন্দ পড়েনি, কখনও কবিতার পাশটিতে গিয়ে বসেনি। অথচ সেসব কবিতাকে ওরা চাইলেই ছুঁয়ে দেখতে পারতো অনায়াসে। (Chaitra Season)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০]
আমার কেবলই মনে হয়, কবিতাকে যাঁরা শহরের মন দিয়ে গড়েপিটে নিতে চান তাঁরা কখনও এমন চৈত্রের দুপুরে ছায়া খুঁজে খুঁজে নিম জিউলির তলাটিতে গিয়ে বসেননি হয়তো। বেলা ফুরিয়ে আসার আগে আগে মাগরিবের আজান তখন ছড়িয়ে পড়ে একেকটি শান্ত জনপদে। সন্ধ্যে নামবে আর কিছুক্ষণে হয়তো। আকাশের তিমিরে ডুবে যাবে যে জমি মাঠ তারা তো কত কত বছর ধরে এই চৈত্রকে চিনেছে। ফুরিয়ে আসা বসন্তের কী লাবণ্য! সে যেন আর নায়িকার মতো চপলা নয়! তার শরীর শুকিয়ে আসা কাঁদড়ের মতো কত না জলকে ধারণ করতে শিখেছে কত কত বছর ধরে। (Chaitra Season)

সেসব পেরিয়ে গেলে নদী আছে কি? মানুষের মানচিত্রের নদী? আছে হয়তো। মজে আসা ওর শরীরে ইতস্তত মাছেদের ঘূর্ণি। খ্যাপলা জাল ফেলে ফেলে যাঁরা খুব ভোর ভোর মাছ ধরেন, তাদের শরীরে ঊষার আলো এসে পড়ে। চেলা, বাচা আর নদীর বোয়ালের কী আশ্চর্য রঙ! সেই আলো দিয়ে কি চৈত্রের দুপুরকে চেনা যায়? যায় না। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, – পেলব স্নিগ্ধ যুক্তিফুলের গোছা কেমন বিছিয়ে আছে বেড়া জড়িয়ে! সে বেড়ার গায়ে গায়ে মানুষের স্পর্শ। সে কেবলই বলতে চাইছে, – চৈত্রদিন, ওর রোদ্দুর জ্বলা দিনে যুক্তিফুলের সাজি ভরে রেখেছে যতনে। মানুষের পাতে সে ফিরিয়ে দিতে চাইছে কবিতার পঙক্তিমালা। সেসব কবিতার পাঠক যাঁরা, তাঁরা জানেন – চৈত্রের দিন কবিতা হয়ে ওঠে কোনো কোনো দিন। (Chaitra Season)

ফুটে ওঠা মান্দার আর ঝরে পড়া শালফুলের মধ্যে কি কোনও বিরোধ আছে? নেই তো! থাকতে পারে না। নিম জিউলির গাছ তাই ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অবিচল। তেতে ওঠা তিলখেতের থেকে গরম হাওয়া পাক খেতে খেতে যদি এক গেলাস জল চায়? ছায়ারা তাই জলসত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই শীতলতাটুকু মানুষের ব্যক্তিগত সঞ্চয়। গাছ ফুরোলে সে সঞ্চয় ফুরোবে বই কী! জীবন কি আর অগাধ! তবু কী অগাধ এই চৈত্রের দুপুর! বেলা ফুরিয়ে আসার আগে, ও চৈত্রের শালবন! ঝরবে নাকি খানিক? ঝরিয়ে দেবে মঞ্জরী? (Chaitra Season)
কাঁচা আম আর করলা দিয়ে সজনে ডাঁটার ঝোল

উপকরণ : সজনে ডাঁটা কয়েকটি, কাঁচা আম একটি, আলু, করলা, বিউলির ডালের বড়ি এক মুঠো, সর্ষের তেল, নুন, হলুদ, শুকনো লঙ্কা, এক চিমটে মেথি, কাঁচালঙ্কা, সাদা সর্ষে বাটা অল্প খানিকটা আর খুব সামান্য মিষ্টি।
পদ্ধতি: গাছে গাছে সজনে ডাঁটা পুরুষ্টু হয়ে উঠেছে এখন। চৈত্রের দিনে এই ঝোল বড়ই আরামের। প্রথমে লম্বা লম্বা করে আলু আর সজনে ডাঁটা কেটে জলে ভালো করে ধুয়ে নিন। করলা আর আম কেটে নিন। সর্ষে বেটে জলে গুলে ছেঁকে নিন। ছাঁকা জলটিই আমরা ব্যবহার করবো। (Chaitra Season)

উনোন ধরিয়ে কড়াই বসান। কড়াই গরম হলে তেল দিন। বড়ি ভেজে তুলে নিন। করলাও নরম করে ভেজে তুলে নিন। অবশিষ্ট তেলে শুকনো লঙ্কা আর মেথি ফোড়ন দিন। ফোড়নের গন্ধ বেরোলে আলুগুলি দিয়ে দিন। আলু একটু ভাজা হলে ডাঁটাগুলিও দিয়ে দিন। অল্প কষিয়ে নুন, হলুদ আর জল দিন। আলু প্রায় সেদ্ধ হয়ে এলে কাঁচা আম আর কাঁচালঙ্কা দিন। আবার সব ভালো মতো সেদ্ধ হলে ভাজা বড়ি দিন। রান্না প্রায় শেষ হয়ে এলে সর্ষেবাটার ছাঁকা জল দিন এবং করলা দিন। ঢাকা খুলে সামান্য ফুটিয়ে সব বেশ নরম হয়ে এলে সামান্য মিষ্টি দিয়ে রান্না শেষ করুন। (Chaitra Season)
বাচা মাছের জিরে গোলমরিচ বাটা ঝোল

উপকরণ : বাচা মাছ, নুন, সর্ষের তেল, কাঁচালঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, জিরে, গোলমরিচ, হলুদ।
পদ্ধতি : নদীর বাচা মাছ পেলে খুব ভালো। না পেলেও ক্ষতি নেই। মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রেখে দিন কিছুক্ষণের জন্য। জিরে আদা গোলমরিচ একটা শুকনো লঙ্কা দিয়ে বেটে নিন। চাইলে এক্ষেত্রে শুকনো লঙ্কা বাদও দিতে পারেন। কড়াইতে তেল গরম করে খুব হালকা করে বাচা মাছগুলো ভেজে নিন। অতিরিক্ত ভাজলে স্বাদ ভালো থাকে না। (Chaitra Season)

ওই তেলেই শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন। জলে গুলে বাটা মশলা আর নুন হলুদ দিন। ভালো করে কষে নিন। কষানো হলে জল দিন। ফুটে উঠলে মাছগুলি বিছিয়ে দিন। খুব সাবধানে উলটে দেবেন কিছুক্ষণ পর। ঝোল বেশ গা মাখা হয়ে এলে চেরা কাঁচালঙ্কা আর সামান্য কাঁচা তেল ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন।
ছবি সৌজন্য: লেখক
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।