কলেজে তো ভর্তি হলাম। বটানি অনার্স, পাশ-এ জুলজি, ফিজিওলজি। ফিজিক্সে প্রচুর নম্বর পেয়েছিলাম। কলেজে অ্যাডমিশনের সময় আমার মার্কস দেখে বলা হল, ফিজিক্স অনার্স। পাশ-এ কেমিস্ট্রি, ম্যাথস নেবার জন্য। আমি রাজি হলাম না। কারণ আছে। মা আমার গৃহশিক্ষকের ওই ধরনের ঘটনার পর কিছুতেই কলেজে ভর্তি করাতে রাজি ছিল না। তাঁর মতামত ছিল, গৌরীর আর পড়ার দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক। যদি পড়তে হয়, বিয়ের পর পড়বে।
আমার তো কান্নাকাটি চলছেই। বাবা, দাদু সবাই খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। মা’র কথা ফেলতেও পারছে না। আবার আমার কান্নাকাটি সেটাও বরদাস্ত করতে পারছে না। ডাক্তারি পড়ব না আগেই আমি ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পড়াশোনা ছেড়ে বিয়ে করব—এটাও আমি জেদের সঙ্গে নাকচ করলাম। আমার কত স্বপ্ন। পড়ব, নিজের পায়ে দাঁড়াব। বিয়ে? অসম্ভব!!! কিছুতেই না। আমি জীবনপণ করে বসলাম। খাওয়া-দাওয়া মাথায় উঠল। অনবরত অশ্রুবর্ষণ। মায়ের প্রচুর বকুনি। কিছুতেই কিছু কাজ হল না, তখন মা রাজি হল। কিন্তু কোনওমতেই কলকাতায় থাকা চলবে না। অনেক ভেবেচিন্তে আমিও রাজি হলাম। কলকাতা না হোক কোথাও না কোথাও, কোনও না কোনও কলেজে তো পড়াশোনা করতে পারব।

ফিজিক্স নিয়ে পড়ব। মা বলল, যাই পড়ো, নিজে পড়তে হবে। কোনও প্রাইভেট টিউটর রাখা চলবে না। এ আর এক সমস্যা। ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পুরোপুরি নিজের ভরসায় কী করে এগোই। তার ওপর ওই কলেজের লাইব্রেরি কেমন, যাঁরা পড়ান, তাঁরা কতটা শুধু ক্লাসেই সাহায্য করতে পারবেন। কিরকম স্ট্যান্ডার্ড—কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। এখন বুঝি মা, মায়ের দিক থেকে ঠিকই ছিল। একজন প্রাইভেট টিউটর নিয়ে যা কাণ্ড চলছে। তাতে খুব দোষ দেওয়া যায় না মা’কে। যদিও তার মধ্যে তাদের বাড়ির লোকজন এসে যথেষ্ট দুঃখপ্রকাশ করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোক ভবিষ্যতে আবার যে কিছু করবেন না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই।
এর মধ্যে কো-এড্ কলেজে মা’র আপত্তি ছিল। গোপ্ কলেজ—শুধু মেয়েদের কলেজে—ওইখানে ভর্তি হবার জন্য মা জেদ ধরে বসল। কিন্তু ওখানে অনার্স নেই কোনও সাবজেক্টের। আমিও বেঁকে বসলাম অনার্স না পড়লে হায়ার স্টাডিজে যেতে পারব না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, রিসার্চ কিছুই করতে পারব না। অসম্ভব! আমি অনার্স ছাড়া পড়ব না।
সে এক সময় গেছে। ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। সত্যি বলছি, দুঃস্বপ্ন! এইরকম বাধাবিপত্তি আমার জীবনে বহু বহুবার এসেছে। নানান ভাবে, নানান দিক থেকে। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। কিন্তু আমার একটাই বাসনা ছিল, প্রার্থনা ছিল ঠাকুরের কাছে, পড়াশোনা করব, গান শিখব, গাইব। কী যে ভালবাসতাম পড়তে। যা পাই তাই পড়ি। কলেজে যখন পড়ছি তখনও নিয়ম করে সকাল, বিকেল, সন্ধ্যে, সময়ে-অসময়ে বাবু হয়ে বিছানায় বসে দুলে দুলে পড়া সারতাম। প্রত্যেকদিন ক্লাসে যা পড়া হত, সমস্ত সাবজেক্ট, একদম ঝরঝরে মুখস্থ। ছবি আঁকা, প্র্যাকটিক্যাল—সব, সব আপডেটেড। ভাইবোনরা হাসত। ছবি আঁকার কথায় আসি।
একবার বায়োলজি পরীক্ষায়, স্কুলে, ফাইনালে আরও অন্যান্য আঁকা লেখার সঙ্গে ব্যাঙের লাইফ হিস্ট্রি ছিল। সঙ্গে ওই হিস্ট্রির সব পর্যায়ের আঁকা। পরীক্ষার খাতা বেরলো। দেখি ছবি আঁকাতে আমি শূন্য পেয়েছি। আমার মনে আছে রেখা-ম্যাম পড়াতেন। আমি হন্তদন্ত হয়ে খাতা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। শূন্য কেন? ম্যাম বললেন, তোমার পরীক্ষা যে ক্যানসেল করিনি, তোমাকে যে ক্লাস প্রোমোশন দেওয়া হয়েছে সেটাই যথেষ্ট। তুমি আবার প্রশ্ন করছ? এত সাহস তোমার!!! তুমি তো ভাল মেয়ে বলেই জানতাম ইন্দ্রাণী। তুমি এটা কী করলে?
এর মধ্যে কো-এড্ কলেজে মা’র আপত্তি ছিল। গোপ্ কলেজ—শুধু মেয়েদের কলেজে—ওইখানে ভর্তি হবার জন্য মা জেদ ধরে বসল। কিন্তু ওখানে অনার্স নেই কোনও সাবজেক্টের। আমিও বেঁকে বসলাম অনার্স না পড়লে হায়ার স্টাডিজে যেতে পারব না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, রিসার্চ কিছুই করতে পারব না। অসম্ভব! আমি অনার্স ছাড়া পড়ব না।
আমি তো হতবাক।
—কী করেছি আমি ম্যাম? ছবি তো এঁকেছি। তাহলে?
—ছবি এঁকেছ! প্রচণ্ড রেগে তিনি চিৎকার করে বললেন, তুমি ট্রেস করেছ। আমি পেরেন্টস কল করব।
—না ম্যাম। আমি কেন ট্রেস করব!!! আমি তো পেন্সিল দিয়ে এঁকেছি।
কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না। কোনও কথাও শুনছেন না। আমি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললাম, আমি আপনার সামনে বসে এঁকে দিই?
ওনার দেওয়া কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে সামনে বসে আমি সমস্ত ছবি আবার আঁকলাম। ছবি দেখে কপালে হাত দিয়ে ম্যাম অনেকক্ষণ বসে থাকলেন মাথা নিচু করে। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে ইন্দ্রাণী। তুমি ভাল আঁকো জানতাম। কিন্তু এত পারফেক্ট!
এইবার তিরিশে তিরিশ পেলাম। এবং ওই তিরিশ নম্বর বাড়ার জন্য আমি একলাফে নাম্বার টু-তে চলে গেলাম।

কিন্তু একটা বিপদ হল। তারপর থেকে বন্ধুরা কেউ আর তাদের ক্লাসের খাতায় নিজেরা ছবি আঁকত না। সব আমার আঁকা। টিফিনের একঘণ্টা কোথা দিয়ে চলে যেত বুঝতেও পারতাম না। একটার পর একটা, দুটো, তিনটে… ছবি এঁকে চলেছি। টিফিন খাওয়া হত না। কিন্তু বাক্সটা খালি হয়ে যেত। খাবার লোকের তো অভাব নেই। ইন্দ্রাণীর যা কিছু, সব তো জনগণের।
* ছবি সৌজন্য: লেখক
* আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে ১ মে ২০২৪
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব