আমার ছেলে জুজুর জন্ম আর অফিসে নতুন কাজের দায়িত্ব একই সঙ্গে এল আমার জীবনে। দুটোই ভালোবাসি তাই একটাকে ছেড়ে অন্যটাকে ধরতে পারিনি। বরং জুজুকে কোলে নিয়ে মিটিং করতাম— মিটিং-এর ফাঁকে ঝট করে বাড়ি এসে ছেলেকে ফলের রস খাইয়ে যেতাম। ঘরে বাইরে সমান তালে— কথাটা শুনতে খুব ভাল লাগে কিন্তু করতে দম ছুটে যায়। দশ হাতের কাজ দু’হাতের মানুষ করলে সে হাঁপিয়ে উঠবেই। আমিও ব্যাতিক্রম নই। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। (Column)
বরং হাতড়াচ্ছিলাম, আরও ভাল মা আর আরও ভাল অফিস-কর্মী কীভাবে হয়ে উঠতে পারি। বাড়ি ফিরে জুজুর জড়িয়ে ধরা আর আদর করায় মন ভরে যেত কিন্তু অফিসে মনে হত এই বুঝি কোনও ভুল করে ফেললাম। অনেকের সামনে কথা বলায় একটা জড়তা হতে থাকল, যেটা বাইরে থেকে বোঝা যেত না, মনের মধ্যে কাজ করত। কাজের সূত্রে মিটিং-এ অনেক presentation দিতে হত, স্টেজে উঠতে হত, দু’চার কথা বলতেও হত। আর এই প্রত্যেকটা সময় নিজেকে খাপছাড়া বেমানান মনে হত। এক মনস্তাত্ত্বিক বন্ধু বললেন—এই public speaking anxiety আর stage freight নাকি নাটক করলে অথবা নাটকের ওয়ার্কশপ করলে ঠিক হয়ে যায়। (Column)

কাজের চাপে, জুজুকে বড় করার দায়িত্বে মনে হয় দিনটা ২৪ ঘণ্টা না হয়ে যদি ৪৮ ঘণ্টা হত, হয়তো একটু স্বস্তি পেতাম। তার মধ্যে কোথায় সময় আমার নাটকের কর্মশালায় যোগ দেওয়ার। কিন্তু, ওই বলে না- জীবনে সত্যি যদি কোনও জিনিসের খুব প্রয়োজন হয়– সেটা একবার না একবার আসবে তোমার সামনে- তাকে চিনে আঁকড়ে ধরতে হয়। আমার জীবনেও সেই মুশকিল আসান হয়ে এল অবন্তী। (Column)
কথালয়া – কথার জন্ম হয় যেখানে : মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
অবন্তী চক্রবর্তী নাট্যকার, নাটকের পরিচালক। সাল ২০১৭, অবন্তী সে সময় বিনোদিনী অপেরার মতো সফল প্রযোজনা না করলেও ইচ্ছের অলিগলি, ট্রয়, নাগমণ্ডলা করে তার যথেষ্ট সুনাম। জুজুর বাবা তখন এক নতুন সিনেমার কথা ভাবছেন। সেই সূত্রেই অবন্তী এল আমাদের বাড়িতে। চা দেওয়া, আর কেমন আছেন, আপনি কী করেন— এইরকম আলাপ। ফোন নম্বর বিনিময়। ব্যস ওইটুকুই। এর কিছুদিন পর অবন্তীর হোয়াটঅ্যাপ এল হাম্পিতে— তুঙ্গভদ্রার তীরে এক ওয়ার্কশপ করবে নাম ‘Body Act Rasa’— নাট্যশাস্ত্রের নবরসকে ভিত্তি করে নিজেকে express করা, আবিষ্কার করার কর্মশালা। (Column)

আমি এর আগে এরকম কোনও কর্মশালা যা ঠিক অভিনয় শেখার নয় বরং নিজেকে আবিষ্কার করার— বিষয়টা সম্বন্ধেই জানতাম না। খুব ইচ্ছে হল যেতে কিন্তু অফিস ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে কী করে পাঁচ-ছয়দিন থাকব— শুধু নিজেকে জানার জন্য—বিষয়টা নিজেই মেনে নিতে পারলাম না। কিন্তু মনের মধ্যে থেকে গেল বিষয়টি। ভাবছিলাম অফিসেই যদি এরকম কোনও কর্মশালা আয়োজন করা যায়— আমরা নাটক, সিনেমা নিয়ে কত বিদেশি থিওরি আলোচনা করি, কিন্তু নাট্যশাস্ত্র মন দিয়ে ক’জন পড়েছি! অবন্তীর সঙ্গে ততদিনে আমার আলাপ আপনি থেকে তুমিতে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎই একদিন বলল— ‘শোনো! ইতালি যাবে?’ হাম্পি তো আর গেলে না— এই ওয়ার্কশপ Italy-তে করার সঙ্গে Italy ঘোরাও হবে! স্পষ্ট মনে হয় সময়টা ২০১৮— শরৎকাল— গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বিজন সেতু পার হতে হতেই ঠিক করে ফেললাম— ইতালি যাব। যাওয়ার কথা ছিল হাম্পি, চলে গেলাম ইতালি! (Column)
আপনাকে এই জানা : শেকড়ের ডানা আর ডানার শেকড় : মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
বহু বছর আগে এক অসাধারণ প্রেমের সিনেমা দেখেছিলাম—Under the Tuscan Sun। সেই Tuscan Sun আমি দেখব ভেবে নিজেই অবাক হয়ে দু’বার চিমটি কেটে নিলাম গায়ে। এতে ঠিক ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে বেড়ানো নয়— হয়তো ইতালি গিয়ে Tourist এর মতো অনেক জায়গা দেখা হবে না, কিন্তু ইতালির অন্যতম সুন্দর প্রদেশ টাস্কানিতে পাঁচদিন ইতালিয়ানদের পাড়ায় থাকব, তাদের বাড়ির মতো রান্না খাব, আরও নানান দেশের লোকের সঙ্গে মিশব আর নতুন অনেক কিছু জানব— এর থেকে ভাল বেড়ানো আর কী হতে পারে? দেশটাকে আরও ভালভাবে জানার জন্য আরও বেশ কিছু সিনেমা আর ডকুমেন্টারি দেখে নিলাম। কিন্তু জানতাম না তার বাইরেও আরও অনেক অনেক বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। (Column)
অবন্তী সে সময় বিনোদিনী অপেরার মতো সফল প্রযোজনা না করলেও ইচ্ছের অলিগলি, ট্রয়, নাগমণ্ডলা করে তার যথেষ্ট সুনাম। জুজুর বাবা তখন এক নতুন সিনেমার কথা ভাবছেন।
একদিকে যেমন নতুন দেশে যাওয়ার উত্তেজনা অন্যদিকে তেমনই মন খারাপ। জুজু তখন পাঁচ কী সাড়ে পাঁচ। মধ্যরাতের ফ্লাইট। জুজুকে তার বাবা, দিদা আর ঠাকুমার ভরসায় রেখে একটু রাতের দিকে যখন বেরোচ্ছি ছেলে আমার ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘যেখানেই থেকো ভাল থেকো’! এত গভীর কথা একরত্তি ছেলে কোথায় শিখল কে জানে? বড় হয়ে ঠিক এমনভাবেই জুজুও একদিন যাবে দেশ ঘুরতে। আমি কী ওকে জড়িয়ে ধরে এত মায়াময় ভালোবাসায় মুড়ে সে কথা বলতে পারব? (Column)

প্রায় দশ বছর আগে একা একা ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার সময় আমার যেমন পেট গুড় গুড় করছিল দুশ্চিন্তায়, এবারেও তাই। তার সঙ্গে জুড়ে বসেছে মাতৃসুলভ অপরাধবোধ। তবে Airport-এ ঝলমলে অবন্তীকে দেখে মনে খুব আনন্দ হল। ছুটির আনন্দ। আমাদের দলে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন চলেছেন— কেউ অভিনয় করেন, কেউ নাট্য পরিচালক, কেউ গান করেন আর আমি। টেলিভিশনে কর্পোরেট চাকরি করি আর খুঁজে চলি সেই হারিয়ে যাওয়া আমিটাকে যে একটা সময় গান গাইত, নাচত, ছবি আঁকত, নাটক করত, বক্তৃতা দিত! এখন ঘড়ির কাঁটার তালে চলা, নিজেকে মা, বৌ, কর্মী-বিভিন্ন খোপে বসাতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছি নিজেকেই! (Column)
আমাদের দলে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন চলেছেন— কেউ অভিনয় করেন, কেউ নাট্য পরিচালক, কেউ গান করেন আর আমি।
কলকাতা থেকে কাতার, সেখান থেকে রোম। রোমে নেমেই ট্যাক্সি করে ছুট্টে স্টেশন। ট্রেনে চড়ে টাসকানির এক ছোট্ট শহরতলী অ্যারেজো আমাদের গন্তব্য। রোমের স্টেশনে এক ছোট্ট খাবার গাড়ি থেকে মুসাকা কিনলাম। বেগুন, মাংস আর চিজের এই অপূর্ব পদ ভূমধ্যসাগরের চারপাশে নানা দেশে নানাভাবে পাওয়া যায়। পরে টার্কিতেও মুসাকা খেয়েছি, মুম্বইয়ে লেবানিজ রেস্তোরাঁতেও, কিন্তু খিদে পেটে ক্লান্ত শরীরে ও মুসাকাকেই মনে হয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার। আমাদের ট্রেন বেশ সন্ধ্যের দিকে অ্যারেজোয় পৌঁছল। সেখান থেকে আমাদের গন্তব্য Spazio Seme। অবন্তীর বন্ধু, একসময়ের সহকর্মী জিয়ানি ব্রুচি নিজে নাটকের পরিচালক, শিক্ষক আর অপেরাতে গানও করেন। জিয়ামির হাতে তৈরি এই সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পীরা আসেন। ঢুকে ছোট্ট বসার জায়গা, টাটকা ক্যাপুচিনোর গন্ধ—আমাদের স্বাগত জানালেন জিয়ানি। দেখালেন ভেতরে এক ছোট্ট লাইব্রেরি আর তার পাশে বিশাল এক হল—যেখানে কর্মশালা হবে। (Column)

জিয়ানি আমাদের থাকার জন্য এক চার্চের hermitage মানে যেখানে পাদ্রী ও অন্যান্য সন্ন্যাসীরা থাকেন দূর দেশ থেকে এসে সেরকম এক বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, Spazio Seme অপেক্ষাকৃত নতুন বসতিতে গড়ে ওঠা। বাড়ির ধরন আধুনিক, কিন্তু গাড়ি যত এগিয়ে চলল দেখলাম এক পুরনো থেকে অতি পুরনো পাড়ায় ঢুকছি। বড় বড় থাম, আর্চওয়ালা পুরনো দিনের বাড়ির সারি। অন্ধকারে টিমটিমে আলো জ্বলছে—আমাদের গাড়ি থামল এক পেল্লায় বাড়ির সামনে যার দরজাই হয়তো হবে চোদ্দ-পনের ফুট বা তার থেকেও উঁচু। আগেকার দিনে বিশাল বিশাল ঘোড়ায় চেপে বল্লম হাতে সৈনিক বা পাহারাদাররা বাড়িতে ঢুকত— তারপর ঘোড়ার গাড়ি, সবশেষে পায়ে হাঁটা মানুষজন— তাই অত উঁচু দরজা। দরজার উপরে লেখা আছে বাড়িটি কবে তৈরি। (Column)
বাড়িটিতে যে লিফট আছে, শুধু মানুষ ওঠা-নামা করার জন্য—তাতে লাগেজ তোলা যাবে না। কী বিপদ। আমার একটাই সুটকেশ কিন্তু পেল্লায় বড়।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল— পলাশীর যুদ্ধেরও আগে তৈরি এক বাড়িতে আমি থাকব ভেবে। সন্ধ্যে তখন আটটা— আমাদের বলা হল সন্ন্যাসীদের এখন ঘুমোনোর সময়, মালপত্র তুলতে যেন বেশি শব্দ না করি। কিন্তু বিপদ হল—বাড়িটিতে যে লিফট আছে, শুধু মানুষ ওঠা-নামা করার জন্য—তাতে লাগেজ তোলা যাবে না। কী বিপদ। আমার একটাই সুটকেশ কিন্তু পেল্লায় বড়। ভাগ্যিস চাকা ছিল—বড়বড় সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় উঠতে দম ছুটে গেল আমাদের। বুঝলাম কৃচ্ছ্বসাধনের শুরু এখান থেকেই। এই না হলে কর্মশালা! (Column)
কর্মই ধর্ম বলে হেঁইও হেঁইও করে পাঁচতলা উঠলাম আমরা। প্রত্যেককে নিজের ঘরের চাবি দেওয়া হল— সে চাবিও কারুকাজ করা পুরনো দিনের মতো! দরজা খুলে নিজের ঘর দেখে ভারি পছন্দ হল। কাজের সূত্রে ভারতের নানা পাঁচতারায় থেকেছি, শুয়েছি নরম বিছানায়, স্নান করেছি বাহারি বাথটবে— এই শতাব্দী প্রাচীন ঘরে সেসব কিছু নেই– আছে একটা ছোট্ট কাঠের খাট, রুম হিটার, বাথরুমে গিজার আর জানলার ধারে এক টেবিল চেয়ার। খুব সাধারণ— কিন্তু জানলা দিয়ে দেখা যায় টেরাকোটা রাঙা সারি সারি বাড়ির মাথা— কোনওটা চার্চের চূড়োর মতো, কোনওটা বা গম্বুজের মতো! অন্ধকারে দেখলাম কলকাতার পুরনো ট্রামলাইনের মতো পুরো রাস্তায় cobble stone করা। আমাদের সকলেরই তখন বেশ খিদে আর Swiggy-Zomato-র চল তখন ছিল না। (Column)

আমি আর কল্যাণী নাট্যচর্চাকেন্দ্রের প্রাণপুরুষ কিশোর সেনগুপ্ত— যাত্রাপথেই যাঁর সঙ্গে অল্প আলাপ— দুজনে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গেলাম খাবার খুঁজতে। একটু ডানদিক বাঁ-দিক করেই চলে এল মার্কেট স্কোয়ার। ইউরোপের সব দেশের Urban planning-এ এই Market Square খুব কমন- কিন্তু রাতে সব দোকানই প্রায় বন্ধ। একটা কফি শপ খোলা দেখে গেলাম। প্রায় চার-পাঁচজনের খাবার তৈরি করতে একটু সময় লাগবে— অর্ডার দিলাম এক কাপ অ্যামেরিকানো-র। দোকান মালিক খুবই অপমানিত হলেন ব্যাপারটায়। বললেন, ইতালিতে এসে অ্যামেরিকানো খাবে? কাপুচিনো নয়! বেশি কথা না বাড়িয়ে বললাম আচ্ছা তাই দিন। (Column)
ক্যাফের চারিদিকে দেখি বিখ্যাত ইতালিয়ান অভিনেতা রবার্তো বেনিনির নানা ছবি। ছবি দেখে মনে হল ‘অস্কার’ পাওয়া ‘Life is Beautiful’ ছবিরই ফটোগ্রাফ হবে।
বরফ গলল। তারপর চলল গল্পের ফোয়ারা। ক্যাফের চারিদিকে দেখি বিখ্যাত ইতালিয়ান অভিনেতা রবার্তো বেনিনির নানা ছবি। ছবি দেখে মনে হল ‘অস্কার’ পাওয়া ‘Life is Beautiful’ ছবিরই ফটোগ্রাফ হবে। জেনে অবাক হলাম ওই ছবির বেশিরভাগ শুটিং হয়েছে অ্যারেজোতে। যে কফি শপে বসে আছি, বাইরে যে Market Square, সেখানেও শ্যুটিং হয়েছে বেশ কিছু দৃশ্য। ভেবেই গায়ে কাঁটা দিল, অন্যদিকে ঘড়ির কাঁটায় ন’টা। চারপাশ নিঃঝুম। দু’হাতে প্যাকেটভরা খাবার নিয়ে আমি আর কিশোরদা হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলাম আমরা রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছি। সবকটা বাড়িকেই এক মনে হচ্ছে। বাড়ির নাম, ঠিকানা কিছু না জেনে প্রবল আত্মবিশ্বাসে অচেনা পাড়ায় বেড়াতে বেরোলে যা হয় আর কী। সঙ্গে মোবাইলও নেই যে ফোন করে বাড়ির নম্বর দেখব। খালি জানি বাড়ির সামনের ছোট্ট গোল চক্করে এক সাধুর মূর্তি—কোন Saint তাও জানি না। নভেম্বরের প্রবল ঠান্ডায়ও ঘামতে শুরু করলাম ভয়ে। নিজেকে খুঁজতে এসে আক্ষরিকভাবেই হারিয়ে গেলাম অজানা দেশে। (Column)
অলংকরণ – মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
ছাত্রী ইতিহাসের আর চাকরি গণমাধ্যমে। তাতে কী! নেশা কিন্তু আঁকা এবং লেখা। বিশেষত নকশা। নোটবুক ভর্তি তার প্রতিটি ছবিই গল্প বলে চলে। গুছিয়ে বসে বা দফতরের মিটিংয়ের ফাঁকে - রং কাগজ এবং কলম সবসময় মজুত।
One Response
যেমন আঁকা তেমন লেখা। সব ছাপিয়ে এক ভ্রামক মন।