২৯শে ফেব্রুয়ারি আমার স্ত্রী বৈশালী কলকাতা থেকে ম্যানচেস্টার ফিরল| আমি এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যাই ওকে| অন্য বছর হলে এই সময় এই বসন্তের বাগানের এক গোছা তাজা ড্যাফোডিল নিয়ে যেতাম| এবার একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার জেল নিয়ে গেছিলাম| কিছু ধরার আগে ভালো করে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত পরিষ্কার করালাম| একটু অবাক হলো বৈশালী| বললো — ‘ বাবা , এই অবস্থা এখানে?’ কলকাতায় তখনও করোনা নিয়ে নানা রকম হাসি-ঠাট্টা চলছে| সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যাচ্ছে করোনার meme দিয়ে | আমি বলি — ‘ একটু সাবধানে থাকা ভালো| ‘
২৮শে ফেব্রুয়ারী ব্রিটেনের ভেতরে প্রথম নথিবদ্ধ সংক্রমণ| তার প্রায় এক মাস আগেই ব্রিটেনের চিফ মেডিকেল অফিসাররা এই রোগের রিস্ক ‘লো’ থেকে ‘মডারেট’ করে দেন| স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যাঙ্কক কিছু নিয়মাবলী চালু করেন| ব্রিটিশ সরকারের চিফ মেডিকেল এডভাইসারের কথা অনুযায়ী সরকার চারটি ধাপে এই রোগের মোকাবিলার কৌশলের কথা ঘোষণা করেন — contain , delay , research আর mitigation |
আমি এক বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা কোম্পানির ক্লিনিকাল ডিরেক্টর| ইংল্যান্ড আর ওয়েলস জুড়ে আমাদের প্রায় ৭০টা হাসপাতাল| ব্রিটেনে সবার স্বাস্থ্য আর চিকিৎসা ন্এযাসনাল হেল্থ সার্ভিস-এর (এনএইচএস) দায়িত্ব| বিনামূল্যে সরকার এই পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন ৫ই জুলাই ১৯৪৮ থেকে| আমরা বেসরকারি সংস্থা হলেও এনএইচএস-এর সঙ্গে একযোগে কাজ করি| আমরা মানসিক রোগীদের চিকিৎসা আর পুনর্বাসন করি| এনএইচএস তাঁদের রোগীদের আমাদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করান | তাই COVID – 19 এর মোকাবিলায় আমরাও নেমে পড়ি এনএইচএস এর সঙ্গেই | কর্পোরেট স্ট্র্যাটেজি ঠিক হতে দেরি হয় না| মাসখানেক আগে এই মিটিঙে যাওয়ার পথে একজনকে বলতে শুনি — ‘ এরকম ফ্লু তো ব্রিটেনে প্রত্যেক বছর হয়েই থাকে| ইরান আর উত্তর ইতালিতে হচ্ছে| আমাদের বেশি কিছু হবে না | ‘
আমাদের বেশি কিছু হবে না — বিশ্বের তাবড় তাবড় শক্তিশালী রাষ্ট্র আর তাদের রাষ্ট্রনায়করা এটাই ভেবেছিলেন| এতেই গোড়ায় একটা গলদ হয়ে যায়| প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ঠিক সময়ে নিতে হয়তো একটু দেরি হয়ে যায় | প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট আলাদা — তার নিরিখে সরকারদের ব্যবস্থা নিতে হয় | কিন্তু এই মারণ ভাইরাসের মানবজাতির এই ভিন্নতা তোয়াক্কা করার কোনও দায় নেই | আন্তর্জাতিক নানা যানবাহন বেয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে| হালকা তরঙ্গ থেকে পৃথিবী-ব্যাপী সুনামি হয়ে ওঠে বিশেষ কিছু বোঝার আগেই| আলোক তরঙ্গে ভাইরাস দেখা যায় না| ইলেক্ট্রন তরঙ্গ লেগেছিল ভাইরাসের অস্তিত্ব বুঝতে | এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আধা জীব মানবজাতিকে এক ভুতুড়ে চৌরাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছে | ধূসর দুঃস্বপ্নে দেখা যায় এরকম — কোন দিকে যাব ঠাহর করা যায় না | ঘেমেচুমে ঘুম ভেঙে গেলে স্বস্তি পাওয়া যায়| মানবজাতি আজ এই সামগ্রিক দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুণছে |
৬ই মার্চ সন্ধ্যাবেলা সুপারমার্কেটে গিয়ে একটু হোঁচট খেলাম| হ্যান্ড সানিটাইজার কিনতে গিয়েছিলাম| ততদিনে হাত ধোয়ার ওপর খুব জোর দেওয়া হচ্ছে| কোনও দোকানেই হ্যান্ড সানিটাইজার নেই| তবে বলা হচ্ছিল সাবান জল দিয়ে হাত ধুলেই ভালো| হ্যান্ড-ওয়াশ বাজারে অঢেল| বেশ কয়েকটা কিনে বাড়ি ফিরলাম| সঙ্গে উইকএন্ডের বাজার| সুপারমার্কেটে উপচে পড়া সম্ভার — যেমন দেখি সবসময়, ঠিক তেমনই|
তারপর থেকে সবকিছু কেমন লাগামছাড়া| ১১ই মার্চ WHO এই রোগকে প্যান্ডেমিক ঘোষণা করে| একের পর এক বিমান কোম্পানি উড়ান বন্ধ করে দিতে থাকে| উত্তর ইতালি থেকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায় মৃত্যুর মিছিল সারা ইতালি| ফ্রান্স , স্পেন , জার্মানি সীমানা বন্ধ করে দিতে থাকে| ১২ই মার্চ ব্রিটেনে রিস্ক লেভেলকে মডারেট থেকে ঠেলে তুলে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে| বিলেতের বেশির ভাগ দায়িত্বশীল সংগঠন তাদের হোলি বা অন্যান্য অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে থাকে| সরকার ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙের ‘ কথা জোর গলায় ঘোষণা করে| নেহাত দরকার ছাড়া কোথাও যাতায়াত বারণ করা হয় — নিষিদ্ধ করা হয় না | প্রধান মন্ত্রী বরিস জনসন প্রতিদিন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে জোর গলায় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলতে থাকেন| containment থেকে delay পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইকে| বলা হয়, করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে বাড়িতে ৭দিন অন্তরীণ থাকতে | আর বাড়ির লোকেদের ১৪ দিন| বাড়াবাড়ি না হলে হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই বলা হয়| টেস্ট করা হয় শুধু এই বাড়াবাড়ি হওয়া রোগীদের| এদিকে বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা| মৃতের দলে বয়স্ক মানুষই বেশি| যদিও মাঝে মাঝে অল্প বয়েসীদের কথাও শোনা যেতে থাকে|
১৮ই মার্চ স্কুল , কলেজ ,য়ুনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়| বাতিল করে দেওয়া হয় জিসিএসই আর এ লেভেল পরীক্ষা — বিলেতের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক | ২০শে মার্চের পর থেকে সমস্ত পানশালা, রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়| সেই রাতে পাবগুলিতে নামে মানুষের ঢল| ব্রিটেনে ভরা বসন্তের আরাম পেতে ২১শে মার্চ দলে দলে মানুষ ভিড় জমায় সমুদ্রতটে| বসন্তের মাতাল হাওয়ায় দোল খাওয়া ড্যাফোডিল, টিউলিপ, চেরি ব্লসমের মেলা দেখে হয়তো মানুষ ভাবছিল এসব নির্দেশ নেহাতই বাড়াবাড়ি| ২৩শে মার্চ বরিস জনসন ঘোষণা করেন আরও কঠোর নিয়মাবলীর কথা| নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোনো যাবে না| যতটা সম্ভব ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে হবে| পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয় রাস্তায় কোনও মানুষ দেখলে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার| প্রয়োজনে ফাইন বা গ্রেফতার করার|

বিলেতের সুপারমার্কেটের শেল্ফ কোন রঙের আমাদের জানা ছিল না | উপচে পড়া পণ্যসামগ্রীতে ভরা দেখেছি সবসময় | হ্যান্ড সানিটাইজারের পর টয়লেট পেপার, রুটি, পাস্তা, চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কিনতে থাকেন| বলা হয় প্রচুর জিনিস আছে সাপ্লাই চেনে| অযথা ঘরে জমিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই| মানুষের ভয় তাতে কাটে না | সুপারমার্কেটের ফাঁকা শেল্ফের রং দেখতে পাই এই প্রথম — ধবধবে সাদা | রুটি না থাকলেও কেক আছে থরে থরে | কমতি নেই বিলাসবহুল খাবারের| কিন্তু মানুষের সেদিকে তাকানোর উৎসাহ নেই| এ দোকান ও দোকান ঘুরে মানুষ কিনে চলেছেন জীবনধারণের ন্যূনতম সামগ্রী| সুপারমার্কেটের পানীয়ের বিভাগে মহার্ঘ শ্যাম্পেন, ওয়াইন, সিঙ্গল মল্ট স্কচ হুইস্কি পরিহাসের মতো সার বেঁধে অপেক্ষা করে চলে| খদ্দেরের আশায়| সেই ফরাসি রানীর কথা কানে বাজতে থাকে — রুটি নেই তো কেক খাও| বুঝতে পারি রুটির জায়গা, ভাতের জায়গা কেক বা ক্যাভিয়ারের নেওয়া সম্ভব নয় কোনওদিনই |
আমি নিয়মিত হাসপাতালে যাচ্ছি| বেশ কয়েকটি হাসপাতালের দায়িত্ব আমার ওপর| এইসব হাসপাতালে মানসিক রোগীদের পুনর্বাসন হয়| আসে পাশের শহর থেকে বাজার করেন এঁরা| বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি ও কমিউনিটিতে| সমস্ত কিছুই প্রায় বন্ধ| এঁদের বোঝা মুশকিল হচ্ছে কেন এরকম হচ্ছে| বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা| নানাভাবে আমাদের টিম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এঁদের ব্যস্ত রাখার| অবসাদগ্রস্ত যাতে হয়ে না পড়েন তার জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে| টিমের দুজন তাঁদের পোষা কুকুর নিয়ে আসছেন| রোগীরা এই কুকুরদুটির সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন| খেলাধুলো করছেন | খানিকটা সময় তাঁদের ভালো কাটছে| সবাই চিন্তা ভাবনা করছেন আরও কী কী ভাবে এঁদের মনের দিক থেকে তাজা রাখা যায়|
জিনিসপত্রের এই কমতির বাজারে একটি দোকানও কিন্তু কোনও জিনিসের দাম বাড়ায় নি | নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দুটোর বেশি কেউ কিনতে পারছেন না| বয়স্ক মানুষ আর স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বেশির ভাগ সুপারস্টোরে আলাদা সময় বরাদ্দ করা হয়েছে| খানিকটা স্বাভাবিক হচ্ছে বাজার| কিন্তু এর ভেতর ঝোপ বুঝে কোপ মারতে বাজারে নেমে পড়েছে আমাজন | ৪-৫ গুণ দামেও বিক্রি করছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস| শোনা যাচ্ছে আমাজনের দামের ওপর ব্রিটিশ সরকারের কোনও হাত নেই| সেই সুযোগেরই কি পুরোমাত্রায় ব্যবহার করছেন আমাজনের বিক্রেতারা ?
স্বাস্থ্যব্যবস্থা, হাসপাতাল যতই উন্নত হোক না কেন — এই করোনাভাইরাসের উত্তাল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে | সঠিক পিপিই (পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট)-এর অভাব, সীমিত টেস্ট কিট নিয়ে মানুষের ক্ষোভ থাকলেও প্রাণপণ কাজ করে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা| দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাচ্ছেন এই অদৃশ্য শত্রূর বিরুদ্ধে| যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তৈরি হচ্ছে অস্থায়ী হাসপাতাল – লন্ডন, বার্মিংহাম , ম্যানচেস্টারে | ভেন্টিলেটর উৎপাদনে নেমে পড়েছে বেশ কিছু কোম্পানি| বার্মিংহাম এয়ারপোর্ট তৈরি হয়েছে অস্থায়ী মর্গ|
২৬শে মার্চ রাত ৮টায় সমস্ত মানুষ নিজেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেন স্বাস্থ্যকর্মীদের — এই যুদ্ধের সেনানীকে| ওই সময় গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম| সামনে ফাঁকা রাস্তা – তার দুধারে দাঁড়িয়ে মানুষ হাততালি দিচ্ছেন| আমি গাড়ির কাচ নামিয়ে হাত নাড়তে থাকায় হাততালি দ্বিগুণ হলো| ভালো লাগছিল খুব এই সম্ভাষণ মানুষ জানিয়ে থাকেন তারকা ফুটবলারদের, রকস্টারদের| একজন চিকিৎসক হয়ে মানুষের এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে খুব ভালো লাগছিল|
এটা একটা যুদ্ধ| এক আধা-জীবের বিরুদ্ধে মানব জাতির যুদ্ধ| যুদ্ধজয় হয় সৈন্যদল আর সাধারণ মানুষের জীবনের বিনিময়ে| দেশের উচ্চ-নেতৃত্ব দুর্গ- প্রাসাদ- বাঙ্কারের নিরাপদ আশ্রয় থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন| বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা অটুট থাকেন| এই যুদ্ধ অন্যরকম| এই লেখা প্রকাশ হবার সময় পর্যন্ত এই যুদ্ধে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও যুবরাজ ভাইরাসে আক্রান্ত| হাজার হাজার সাধারণ মানুষের সঙ্গে| যুদ্ধে মানবজাতির জয় হবে – এখনও এই আশা করতে পারছি| তবে বিরাট দাম দিতে হচ্ছে মানুষকে| আরও কতটা দিতে হবে — সেই হিসেব এখনই করা মুশকিল……
দু দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনে প্রবাসী পাঞ্চজন্য পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট। অবসর সময়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন।
2 Responses
আমার কাছে খুব প্রয়োজনীয় লেখা।ওখানের পরিস্থিতি জানতে পারলাম।ব্যাস্ততার ভিতর এই লেখার জন্য ধন্যবাদ। আরও তথ্যের আশায় থাকলাম।
পাঞ্চজন্যদা, তোমার কাছ থেকে এইরকম একটা লেখা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। ছবির মতো পুরোটা যেন সামনে ভেসে উঠলো। আরেকটা কথা ও বলতেই হয় যে এই মানসিক চাপ এবং চূড়ান্ত ব্যস্ততার মাঝেও তুমি যে এত সুন্দর করে লিখে আমাদের সামনে পরিবেশন করলে, এই প্রয়াস অমূল্য । ইতিহাসের দলিলপত্র হয়ে থাকবে এই লেখা! পরবর্তী অংশের জন্য শুরু হলো অপেক্ষা…