প্রথম ডাল মাখানি জিভে ঠেকিয়েছিলাম দিল্লির এক পথ-রেস্তোরাঁয়। চিরাচরিত একঘেয়ে ডাল থেকে বেরিয়ে এসে এই ডাল চরিত মানস লিখতে বসা। উত্তর থেকে দক্ষিণভারত, কলকাতার কেটারার, নামী অনামী মোগলাই রেস্তোরাঁ অথবা পঞ্জাবি ধাবা, সবজায়গাতেই ডাল মাখানি মেলে। বিশ্বায়নের দৌলতে সারা বিশ্বে এখন অভারতীয়েরাও পরিচিত এই সুস্বাদু ভারতীয় ডালটির সঙ্গে।
বিদেশে দেখেছি স্বাস্থ্যসচেতন সাহেব-মেমরা মাংস সবসময় খেতে নারাজ। তবে তাঁরাও রুটি বা নান ছিঁড়ে দিব্য এই ডাল মাখানিতে চুবিয়ে খেয়ে উমম, ইয়াম, ডেলিশিয়াস বলে সুখ-ঢেঁকুর তোলেন। বস্তুত, সাগরপারের চাল-ডাল মিশিয়ে বিদেশি ‘কেডগ্রি’-ও আদপে আমাদেরই খিচুড়ি। ভিক্টোরীয় যুগে দেশে ফেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ অফিসাররা খিচুড়ি বানাতে শিখে ইংল্যান্ডের ডাইনিং টেবিলে হাজির করেছিল তাকে।
ভারতীয় খাদ্যতালিকায় বিশেষ জায়গা জুড়ে রয়েছে নানারকমের ডাল। খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করতে এমন বৈচিত্রে ভরা শস্য বুঝি আর কোনও দেশে হয় না। ইবন বতুতা ভ্রমণকথায় চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারতে মুগ ডাল আর চাল দিয়ে ‘খিশ্রি’ তৈরির কথা আছে। তাঁর ঠিক পরই এ দেশে আসা রুশ পর্যটক নিকিতিন-এর লেখাতেও চালেডালে খিচুড়ির প্রসঙ্গ আছে। আর মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর থেকে আকবরের খিচুড়ি প্রীতি আমাদের সবার জানা। হুমায়ুন যখন শের শাহ-এর তাড়া খেয়ে পারস্যে পৌঁছলেন, শাহকে তিনি নেমন্তন্ন করে এমন সুস্বাদু ভারতীয় খিচুড়ি খাইয়েছিলেন, যে শাহ মোহিত হয়ে হুমায়ুনকে পারস্যে আশ্রয় দেবেন ঠিক করেন।
আকবর-বীরবলের গপ্পে আছে, বীরবল খিচুড়ি রান্না করে আকবরকে নীতিকথা শেখাচ্ছেন। ফলে এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, মুঘল বাদশাদের খিচুড়ি-প্রীতি বংশানুক্রমিক। আবুল ফজলও তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’-তে সাত রকম খিচুড়ির রেসিপি লিখেছেন। তবে ভারতে ডালের ব্যবহার কিন্তু মুঘল যুগের আগে থেকেই।

বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের “পাক প্রণালী”-তে ডাল অর্থাৎ “দাইল প্রকরণ” নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা রয়েছে। এই দাইল বা ডাল নিরামিষাশিদের প্রধান ভোজ্য এবং প্রোটিনের অন্যতম উৎস। এ বইখানিতে “সাজাহানী ধরণে দাইল পাক” নামে একটি কেতাদুরস্ত ডালের কথা জানা গেল, যেটি অধুনা ডাল মাখানির অনুরূপ। কালে কালে হয়তো এই মুঘলাই ডালের মেটামরফোসিস হয়েছে ভারতীয় খানাখজানায়। সাজাহান বাদশাহের এই বিশেষ ডালে লংকার অনুমোদন ছিল না, কিন্তু বাদশাহী দাইল পাক ঝোল ঝোল হত না আর অধিক পরিমাণে ঘি দেওয়া, থকথকে এই ডাল রুটি, পরোটার সঙ্গে মুঘলরা খেতেন।
ভারতীয় খাদ্যাভাসের সঙ্গে পারসিক, আরবীয় ও তুর্কি খাদ্যাভাসের মেলবন্ধন ঘটেছিল মুঘল আমলে। শেরশাহ, শাহজাহান এবং অওরঙ্গজেবের হাতে তা পরিপূর্ণতা পায় মোগলাই খাদ্যশৈলী হিসেবে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় এই মোগলাই রন্ধনশৈলী বিবর্তিত হয়েছে ৷ ঢাকা ও দিল্লির হালিম বা হিন্দিতে ডাল-গোস্ত বলা হয় যাকে, সেখানেও মাংসের সঙ্গে ডালের মাখোমাখো সখ্য ঘটেছিল। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের তথ্য বলছে, অতীতকালে এই ডাল পরিবেশন করা হত খুব অভিজাত একটি পদ হিসাবে। ৩০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিয়ের সময় পরিবেশন করা হয়েছিল ঘুগনি ডাল যা এক সর্বভারতীয়, সুস্বাদু এবং চটজলদি ‘স্ট্রিট ফুড’।
আর বাঙালির ঘরে ‘ডাল-ভাত’-এর কদর কে না জানে! প্রবাদে প্রবচনে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে হেঁশেলের সৌরভ সুবাসে বাঙালির ঘরে ডাল, ভাতের পাতে একটি অত্যাবশ্যকীয় পদ। আসমুদ্রহিমাচল বাঙালি হেঁশেলের গিন্নিরা ভোরে উঠেই প্রেসারে সিটি দিয়ে আগেভাগে প্রস্তুতি নেন একটা বিশেষ পরিপাটি ডালের। তার সুঘ্রাণে আপিসবাবুর ভাতে বসার টাইমে বাড়ির বাকিদেরও খিদে পেয়ে যায়। আজ পেঁয়াজ, ধনেপাতা দিয়ে মুশুরের ডাল তো কাল নারকেল দিয়ে ভাজা মুগ। পরশু লাউ দিয়ে কাঁচা মুগ তো তরশু হিং দিয়ে অড়হর। একদিন পোস্তর সঙ্গতে আদা মৌরিবাটা দিয়ে বিউলি তো পরের দিন পেঁপে দিয়ে মটর ডাল।
তবে শুধু বাঙালি নয়, ভারতবাসীদের খাদ্য তালিকাতেও ডালের একটা নিজস্ব জায়গা রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের খুঁজে পাওয়া প্রত্নরাজি থেকেই প্রমাণ মেলে যে সেই সিন্ধুসভ্যতার যুগেও ডাল জাতীয় শস্যের প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই এভাবে বিবর্তন হতে হতে আজ অতি সাধারণ পুষ্টিকর ধাবা স্টাইল ‘তড়কা ডাল’ থেকে শুরু করে ‘ডাল মাখানি’ পর্যন্ত পৌঁছেছে। বিভিন্ন জায়গায় এই ডাল তৈরি করার পদ্ধতি বিভিন্ন রকম। মশলার উপর নির্ভর করে তার স্বাদ।
মেওয়ারের রাজ পরিবার থেকে এসেছে পাঁচমেল কিংবা পঞ্চরত্ন ডাল রান্নার ধারণা। শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবও নাকি এই শাহী পঞ্চরত্ন ডালের অনুরাগী ছিলেন। এ ডালের উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতেও। যেখানে পাচক এবং খাদ্যরসিক ভীমসেন নিজের হাতে ঢিমে আঁচে মাটির পাত্রে এই পঞ্চরত্ন ডাল বানাচ্ছেন এবং নামানোর আগে যত্ন করে এক চামচ ঘি ছড়াচ্ছেন। মহাভারতের আদিপর্বে বশিষ্ঠ কর্তৃক নন্দিনী নামক কামধেনুর কাছে ঋষি বিশ্বামিত্রের আহারের জন্য যে অন্ন-সূপ-মিষ্টান্ন-মদ্যের প্রার্থনা রয়েছে, সেখানে এই সূপ বা দাইল যে আমাদের ডালের অনুরূপ তা বুঝতে বাকি থাকে না।

আন্তর্জালে প্রাপ্ত তথ্য জানাচ্ছে, ডাল মাখানির অর্থ হল মাখনের মতো ডাল। অর্থাৎ গলে, ঘেঁটে ক্ষীর হয়ে যাওয়া ডাল। স্থান কাল পাত্র ভেদে তা কখনও কালি দাল তো কখনও পঞ্চরত্ন। কখনও শাহী ডাল তো কখনও আবার বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের সাজাহানি দাইল। ডাল মাখানির বহুমুখী জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে তার পুষ্টি সমৃদ্ধ নিরামিষ আঙ্গিক এবং ভাতের অনুষঙ্গে প্রধান পদ হিসেবে তার কাটতি সুঘ্রাণ এবং স্বাদের নিরিখে। তবে এই মাখানি নিয়ে অবাঙালি মহলে যথেষ্ট দ্বন্দ্ব রয়েছে। কেউ বলেন, মাখন বা ক্রিম বা দুধ ব্যবহারের জন্য এমন নাম। কেউ বলেন পদ্মফুলের বীজ বা শোলার মতো দেখতে স্বাস্থ্যকর মাখানা ঘিয়ে স্টারফ্রাই করে এই মিক্সড ডালে দেওয়ার রেওয়াজের জন্য অমন নাম। দেশভাগের পরে যখন পঞ্জাবের অনেক লোক ভারতের উত্তরাঞ্চলগুলিতে চলে আসে, তারপর থেকেই ক্রমে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পঞ্জাবিরা ভারত এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমানোর ফলে বহির্বিশ্বেও তা জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ডাল প্রসঙ্গে পঞ্জাবি অভিবাসী উদ্যোগপতি কুন্দনলাল গুজরালের নাম করতেই হয়। ১৯৫০ সালে সদ্যোজাত পাকিস্তান থেকে দিল্লির দরিয়াগঞ্জে এসে উঠেছিলেন কুন্দনলালের পরিবার এবং সেখানেই খাবারের ব্যবসা শুরু করেন। এঁরা দরিয়াগঞ্জের সুপ্রসিদ্ধ মোতি মহল রেস্তোঁরার প্রতিষ্ঠাতা। কুন্দনলালেরই মানসসন্তান এই ‘মোতি মহল’। তিনি সেখানে শুরু করেন তন্দুরি খাবারের ব্যবসা। উন্মুক্ত স্থানে রেখে দেওয়া বেঁচে যাওয়া তন্দুরি চিকেনের টুকরো খুব তাড়াতাড়ি শুকনো হয়ে যায়৷ অগত্যা মাথা খাটিয়ে তন্দুরি চিকেনের সঙ্গে গ্রেভি মিশিয়ে তৈরি করলেন নতুন পদ, বাটার চিকেন৷
শুরু হল পঞ্জাবী তন্দুরি হেঁসেলের ইতিহাসের নতুন অধ্যায়৷ ডাল মাখানি অবশ্য কুন্দনলালের সৃষ্টি নয়। তার মূলে সর্দার সিং নামে আর এক পঞ্জাবনন্দন ৷ বাটার চিকেনের পাশাপাশি নিরামিশাষিদের জন্যও মনমোহিনী স্বাদের এক আইটেম হয়ে গেল ডাল মাখানি। আর শুধু আমআদমির পাতেই নয়, বাটার চিকেন ও ডাল মাখানির কাটতি হল বিশ্বের দরবারে। নেহেরু পরিবার থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, কেনেডির পাতেও দিব্য জনপ্রিয় হল ৷ আজও বাটার চিকেন, ডাল মাখানি কম্বিনেশনের স্বাদ এবং ঐতিহ্যের পরম্পরা বজায় রেখেছে মোতি মহল।

যে কোনও পুজোর উপচারে পঞ্চশস্য দেবার চল সেই গুপ্ত ও মৌর্য যুগ থেকেই। পঞ্চশস্যের মধ্যে মাসকলাই হল ডাল। এখন যে ডাল মাখানি আমরা খাই তার মধ্যে ছোলা, মটর, কাবুলি চানা, খোসা শুদ্ধ গোটা মুশুর, মাসকলাই, মুগ কলাই আর রাজমা থাকে। তা এই সপ্তরথীকে একত্রে আগের দিন রাতে ভিজিয়ে রেখে সেদ্ধ করে গলে ক্ষীর হবার রসায়নেই মাখোমাখো হবে ডাল। আর বাদশাহী রীতি অনুসারে সেদ্ধ করবার সময় এই ডালের মধ্যে গোটা বড় এলাচ, ছোট এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, তেজপাতা, গোটা রসুন আর গোটা আদার ডুমো দেবার রেওয়াজ সে যুগ থেকেই। ভারী হাতা দিয়ে কুকারের মধ্যেই ঘেঁটে ঘ করে দিতে হবে যাতে সবের ঘ্রাণ মিলেমিশে, ন্যায়দম খেয়ে শাহী গন্ধে ভরপুর হয় এই ডালশস্য। তখন ছিল দমে সেদ্ধ করা। এখন প্রেসারকুকারে।
আঁচ থেকে নামিয়ে পরিবেশনের আগে গারনিশ না করলে কোনও রান্না কৌলীন্য পায় না। সে যুগে ধনেপাতা কুচি, পেঁয়াজের রিং আর ঘিয়ে ভাজা মাখানা দিত কিনা জানা নেই। তবে উদার হস্তে পোয়াখানেক ঘি ছড়ানোর কথা জানিয়েছেন বিপ্রদাসবাবু। তার বদলে এখন গরম ডালের মধ্যিখানে একটুকরো মাখনের কিউব আর বেশি উদার হলে ক্রিমের স্থান। মাখন আর মাখানা দুজনেই রইল, ব্যাস! এই ঘি বা মাখন দেওয়া আধুনিক ডালমাখানি যে বিপ্রদাস বর্ণিত বাদশাহী দাইলের থেকে কোনও অংশে কম নয়, তা বলাই বাহুল্য। তবে মোগলাই দাইলে হিংয়ের ছোঁয়া থাকত বলে খবর। সাহেবসুবো যখন আমাদের এই দেশে রাজত্ব করে গেছেন তখন তাঁদের ভোজনের শুরুয়াত হত বাঙালির ডালের স্যুপ দিয়ে। অতএব সেই অর্থে বাঙালির নিজস্ব স্যুপ কিন্তু যে কোনও প্রকার ডাল। ওদেশে যারে কয় লেনটিল স্যুপ!
*ছবি সৌজন্য: Whiskaffair, Facebook, Myfoodstory
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।