মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাবসানের পাঁচদিন পরে মাঘোৎসবে যোগ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাবামশায়’ সম্পর্কে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটা যদি একবার পড়ে দেখা যায়, তাহলে মহর্ষির ঈশ্বরচিন্তা সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হয়। কবি সেই সভায় বলেছিলেন:
‘যে মহাপুরুষ পাঁচদিন পূর্বে লোকান্তরে যাত্রা করিলেন, তিনি জীবিতকালে এই ব্রহ্মোৎসবে বর্ষে বর্ষে আমাদিগকে উর্ধ্বস্বরে আহ্বান করিয়াছেন, বলিয়াছেন- ‘ত্বমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি নান্যপন্থা বিদ্যতে অয়নায়- তাঁহাকে জানিয়াই মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়, মুক্তির আর কোনো উপায় নাই। তখন আমরা সকলে তাঁহার আহ্বানে সমান কর্ণপাত করি নাই- আমরা এখন লঘুচিত্তে আসিয়াছি, চক্ষুকর্ণের কৌতুহল চরিতার্থ করিয়াছি, আনন্দের ঔদার্যকে ঐশ্বর্যের আড়ম্বরে পরিণত হইতে দেখিয়াছি। আজ সেই মহাত্মা মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া অন্ধকারের পরপার হইতে আমাদিগকে অদ্যকার এই উৎসবে আহ্বান করিতেছেন- আজ এই ক্ষুদ্র গৃহের মধ্য হইতে তিনি আমাদিগকে ডাকিতেছেন না- সমস্ত আকাশের মধ্য হইতে আজ তাঁহার উচ্চারিত এই বাণী আমরা শুনিতেছি- যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম। ‘অমৃত যাঁহার ছায়া- যাঁহার ছায়া মৃত্যু- তিনি ছাড়া আর কোন দেবতাকে আমরা পূজা করিব?’
পিতামহী অলকাদেবীর অন্তর্জলীযাত্রার সময় নদীর ধারে বসে দেবেন্দ্রনাথের মনে এক রূপান্তর ঘটে। পার্থিব জগতের সমস্ত বস্তুর উপর থেকে তাঁর আগ্রহ চলে যায়। শুরু হয় আত্মানুসন্ধান। ঈশ্বরানুসন্ধান। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন গ্রন্থে তিনি খুঁজতে থাকেন নিজের মনের উত্তর। লক, হিউম, বেনসনের লেখায় তিনি খুঁজে ফেরেন আত্মোপলব্ধির উপায়। কিন্তু মনের মতো কথা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, মনের অশান্তিও ঘোচে না।
একদিন নিজেরই ঘরে তাঁর হাতে এসে পড়ে রাজা রামমোহন রায় সম্পাদিত ঈশোপনিষদের একটি ছেঁড়া পাতা। তাতে লেখা এক সংস্কৃত শ্লোক:
‘ঈশাবাস্যমিদং সবর্বং যত্ কিঞ্চ জগত্যাং জগত্, তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনং।’

এই শ্লোকের অর্থ দেবেন্দ্রনাথ কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। ব্রাহ্মসমাজের আচার্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের শরণাপন্ন হলেন। বিদ্যাবাগীশমশাই তাঁকে বোঝালেন যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যা কিছু রয়েছে তা সবই পরমেশ্বর দ্বারা ব্যাপ্ত রয়েছে। পাপ-চিন্তা ও বিষয়ের প্রতি লোভ ত্যাগ করে ব্রহ্মের আনন্দ উপভোগ করতে হবে। অন্য কারও ধনে লোভ করা অনুচিত। দেবেন্দ্রনাথ এতদিন যা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তা এই শ্লোকটিতে তিনি লাভ করলেন। সেই সময় থেকে তিনি উপনিষদ চর্চায় ডুবে গেলেন। বর্জন করলেন তাঁর বিলাস আর ভোগের আনন্দ।
১৮৩৯ সালের ৬ অক্টোবর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দশজন আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে স্থাপিত হল ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’। পরে এই সভার নাম বদল করে ‘তত্ত্ববোধিনী’ রাখা হয়। সেখানে নিয়মিত ভারতীয় শাস্ত্রের আলোচনা চলতে লাগল এবং ব্রহ্মবিদ্যার প্রচারও শুরু হল। কিশোর বয়স থেকেই মহর্ষি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের অনুরাগী। দেবেন্দ্রনাথের পড়াশোনা প্রথমে রামমোহন প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো হিন্দু স্কুলে এবং পরে হিন্দু কলেজে। তার কিছুদিন পর থেকেই দেবেন্দ্রনাথ, রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই সময় রামমোহন রায় ছিলেন বিলেতে।
এক সময় তত্ত্ববোধিনী সভা-ই ব্রাহ্মসমাজ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। পরের বছর ভাই গিরীন্দ্রনাথ ও আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মানুযায়ী প্রতিজ্ঞা পাঠ করে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেন। এরপর থেকে মহোৎসাহে তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। দু’বছরের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হল ৫০০। সেই সময় প্রথম মাঘোৎসব পালন করা হয়। তখন কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ তাঁর বাবার বিরাট ব্যবসা ও সম্পত্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। কিছুদিন পরেই বিলেত থেকে ১ অগস্ট তাঁর পিতার মৃত্যুসংবাদ আসে। সালটা ছিল ১৮৪৬।

এমনিতেই ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার জন্য নিজের পরিবারে এবং সমাজে তাঁর বিরুদ্ধাচারণের শেষ ছিল না। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর সেটা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নিয়ে গোল বাধল। দেবেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলেও ঠাকুরবাড়িতে কিন্তু হিন্দুমতে কোনও আচার-অনুষ্ঠানই বন্ধ হয়নি। শেষ পর্যন্ত গিরীন্দ্রনাথ হিন্দুমতে শ্রাদ্ধের ক্রিয়া-কর্ম করলেও দেবেন্দ্রনাথ রাজি হননি শালগ্রাম শিলা নিয়ে পিতার শ্রাদ্ধ করতে। সেই কারণে আত্মীয়স্বজন এবং সমাজের মাথারা তাঁকে পরিত্যাগ করেন।

দ্বারকানাথ ঠাকুরের উইল অনুযায়ী মহর্ষি পেয়েছিলেন টেগোর কার কোম্পানির একটা অংশ। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ একলা ভোগ না করে তিন ভাইয়ের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেন দেবেন্দ্রনাথ। মূলত ভাই গিরীন্দ্রনাথের ওপর ব্যবসার দায়িত্ব দিয়ে মহর্ষি চলে যান কাশীতে এবং সেখানে তিনি বেদ-উপনিষদ পাঠে মনকে নিযুক্ত করেন। অনুপযুক্ত সময় ব্যবসা চলায় টেগোর কার কোম্পানি ও ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সমাপ্তি ঘটল। ঋণের বোঝা নিয়ে চিন্তিত দেবেন্দ্রনাথ কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে সমস্ত ঋণের দায় স্বীকার করে নিয়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় আরও কমিয়ে দিলেন।
১৮৫৪ সালে গিরীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। সেই সময় অল্প কিছু ঋণ বাকি থেকে যাওয়ায় নতুন করে গোলমাল শুরু হয়। পাওনাদারদের অভিযোগের ভিত্তিতে দেবেন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তারও করা হয়। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। শেষ পর্যন্ত ঋণ শোধ হয়। বেদ চর্চা করতে গিয়ে মহর্ষির ধারণা হয় যে বেদ পরস্পরবিরোধী। বেদ এবং উপনিষদের সব শ্লোক এবং মন্ত্রকে তিনি সমর্থন করতে পারেননি। তাই এই দুটি থেকে নিজের কিছু অংশকে একত্রে নিয়ে এসে তিনি একটি সংকলন তৈরি করেন। ‘ব্রাহ্মধর্ম’ শীর্ষক এই সংকলনকে দেবেন্দ্রনাথ ‘ব্রাহ্মী উপনিষদ’ আখ্যাও দেন।

১৮৩৮ সালে হিমালয় ভ্রমণ সেরে কলকাতায় আসার পরে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের পরিচয় হয় এবং তাঁরা যৌথভাবে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে মেতে ওঠেন। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের মতান্তর শুরু হয়। ফলে ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হয়। নতুন সমাজটির নাম হয় ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ আর দেবেন্দ্রনাথের সমাজকে বলা হত ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ বা ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’। কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে ছিল আদি ব্রাহ্মমন্দির আর মেছুয়াবাজার স্ট্রিটে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মমন্দির। তখন ওই এলাকাকে অনেকে বলত সমাজপাড়া। বিচ্ছেদ হওয়ার পরেও নতুন সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে চেষ্টা করতেন দেবেন্দ্রনাথ। মজার বিষয় হল ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ থেকেই তাঁকে মহর্ষি উপাধি দেওয়া হয়।
এরইমধ্যে বোলপুরে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ভুবনডাঙার কাছে দু’টি ছাতিম গাছ চোখে পড়ে মহর্ষির, জায়গাটিকে বড় ভাল লেগে যায় তাঁর। তিনি সে জমি কিনে নেন এবং পরবর্তীকালে সেখানে ব্রহ্মচর্য আশ্রম স্থাপন করেন। ধর্মই ছিল তাঁর জীবনের মূল আশ্রয়। তবে জীবন থেকে ধনসম্পদকে বর্জন করলেও পারিবারিক ও সাংসারিক বিষয়ে থাকত তাঁর সজাগ দৃষ্টি। যদিও শেষজীবনে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ধর্ম পরিবর্তন ও নানা পারিবারিক কারণে জীবনে পেয়েছিলেন অসংখ্য আঘাত। তাও ঈশ্বরকে জানা এবং আত্মোপলব্ধির পথ ত্যাগ করেননি। তাই অনায়াসে লিখতে পেরেছিলেন
‘দেহ জ্ঞান, দিব্য জ্ঞান, দেহপ্রীতি, শুদ্ধপ্রীতি, তুমি মঙ্গল আলয়, ওহে তুমি মঙ্গল আলয়।
ধৈর্য দেহ, বীর্য দেহ, তিতিক্ষা সন্তোষ দেহ, বিবেক বৈরাগ্য দেহ, দেহ পদ আশ্রয়।’
*ছবি সৌজন্য – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।